আমি স্লোভাকিয়ায় একজন বাঙালি মহিলার সাথে থাকি। এই ৪মাসের মধ্যে তার সাথে আমার যথেষ্ট ভাব হয়েছে। তিনি এখন আমার সবকিছুর সঙ্গী। কথায় কথায় তিনি জানতে পারলেন যে আমি কখনও ব্রা পরিনি। শুনে খুব অবাক হলেন।তিনি আমার বুকের সাইজ নিয়ে খুব চিন্তিত। তার মতে, আঠারো বছরের মেয়ের বুকের গঠন যেমন হওয়া উচিত, আমার বুকের গঠন ঠিক সেরকম নয়। আমাকে গায়োনকলিজিস্ট দেখানোর চিন্তাও করছিলেন তিনি।
সেদিন হটাত আমাকে ডেকে, একটা লাল রঙের ব্রা দেখিয়ে বললেন, এটি তার অনেক আগের ব্রা, সবচেয়ে ছোট সাইজের ব্রা বলতে যা বুঝায়, এটি তাই। একবার মাত্র পরেছেন, তিনি ওই ব্রা আমাকে উপহার দিতে চান। তিনি আমার ব্রার ‘হাতেখড়ি’ করাতে চান। বললাম, এটা ‘হাতেখড়ি’ হবে না, ‘বুকে-খড়ি’ হবে। আমি তার উপহার গ্রহণ করলাম বটে, তবে আমি জিজ্ঞেস করলাম ব্রা কেন পরা জরুরি? উনি বললেন, গুগল করে যেন জেনে নিই।
ব্রা যেহেতু আমি পরি নি, কাজেই এই বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই বললেই চলে। তাই আমার আজকের লেখার বিষয় ব্রা নয়, বুক। বাংলাদেশে, মায়েরা সবসময় খেয়াল রাখে মেয়ের ওড়না ঠিক জায়গায় আছে কিনা। রাস্তায় চলাফেরার সময় লোকেরাও মেয়েদের বুকের ওড়নাটা ঠিক ওই জায়গাটাতে আছে কিনা দেখে নেয়, তারপর কোন একটা বাজে মন্তব্য করে নিজের পুরুষত্বের প্রমাণ দেয়। ঠিক এই কারণেই মেয়েরা সবসময় নিজের বুক নিয়ে চিন্তিত থাকে। কেউ দেখে ফেলল কিনা, কেউ যেন আবার বাজে মন্তব্য না করে। বুকের সাইজ বড় হতে থাকলে সেটা নিয়ে তারা খুব বিরক্ত হয়। কারণ এজন্য হয়তো তাকে ওড়নার উপর আরও কিছু পরতে হতে পারে, বুক ঢাকার জন্য।
আমাদের কলেজে আমরা ছেলেমেয়ে একসাথে লেখাপড়া করতাম। কলেজের মাঠটাতে ছেলেরা সবসময়ই কিছু না কিছু খেলতও।কখনও কলেজের কোন মেয়েকে ওই মাঠে খেলতে দেখি নি। একবার আমার মেয়ে বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে মজা করতে করতে দৌড়চ্ছিল, দৌড়ানোর সময় ক্রস বেল্ট বাতাসে উল্টেপাল্টে গিয়েছিল, সেসব দেখে ছেলেদের হাসির শেষ নেই। এরপর থেকে ওই মেয়ে বন্ধুদের দৌড়ানোটুকুও বন্ধ হয়ে গেলও। কেউ দৌড়লে খুব সাবধানে, যেন ওড়নার কিছু না হয়, জামা যেন বাতাসে না উড়ে। অথচ ছেলেরা কলেজের ফুল প্যান্ট খুলে থ্রি কোয়াটার, আর শার্ট খুলে সেন্ডও গেঞ্জি পরে দিব্যি খেলছে। খেলার সময় কারও কারও প্যান্ট নিচে নামতে নামতে শেষ পর্যায়ে এসে গেলেও সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। না থাকাটাই স্বাভাবিক। খেলার সময় এসব নিয়ে ভাবলে চলে নাকি! কিন্তু মেয়েদের এসব নিয়ে ভাবতে হবে।
একদিন কলেজে গিয়ে জানতে পারলাম, আমাদের কলেজে নাকি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হবে। আমার মেয়ে বন্ধুরা বলল, ‘ইতু তোর তো ক্রিকেট পছন্দ, তুই টুর্নামেন্টে নাম দিস’। জিজ্ঞেস করলাম, ‘শুধু আমি কেন? তোরা দিবি না?’ বলল, ‘তুই দিলে আমরাও দিব।’ আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন টুর্নামেন্টের জন্য নাম নিতে আসবে।
পরদিন আমাদের ক্লাসে কয়েকজন ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল, ক্রিকেট টুর্নামেন্টে কারা কারা খেলতে ইচ্ছুক? আমি সহ আমার মেয়ে বন্ধুরা হাত তুললাম, ছেলেরা হেসে আমাদেরকে হাত নামাতে বলল। ছেলেদের কেউ ইচ্ছুক কিনা তারা সেটা জানতে এসেছে। মেয়েরা কিভাবে ক্রিকেট খেলবে সেটা তাদের বোধগম্য হল না। আমার ক্রিকেট এত পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও, আমি সেদিন খেলতে পারলাম না, আমি মেয়ে বলে।
আমাদের বুকের সাইজ ঠিক ছেলেদের মত নয় বলে, ছেলেরা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করবে, এই ভয়ে আমরা খেলতে পারব না। আমাদের সেই স্তনের দুধ পান করেই হয়তো কোন শিশু মোটা তাজা পুরুষ হয়ে অন্যকোন মেয়ের খেলা বন্ধের কারণ হবে।
আমি গার্লস স্কুলে পড়েছি। সেই স্কুলে তো আমি দিব্যি ক্রিকেট খেলেছি, স্কুলে একটা ক্রিকেট টীমও ছিল।
টেনিস বল নয়, কাঠের বল দিয়ে আমরা স্কুলের বাইরে অন্য স্কুলের সাথেও খেলেছি। সেসময় তো মেয়ে বলে আমার খেলায় কোন সমস্যা হয় নি। আমাদের স্কুলের মেয়েরা সারাদিন দৌড়তও, কেউ তাদের নিয়ে হাসে নি। দৌড়ানোর সময় তাদের ওড়না, জামা এসব নিয়ে কখনও ভাবতে হয় নি।
টেনিস বল নয়, কাঠের বল দিয়ে আমরা স্কুলের বাইরে অন্য স্কুলের সাথেও খেলেছি। সেসময় তো মেয়ে বলে আমার খেলায় কোন সমস্যা হয় নি। আমাদের স্কুলের মেয়েরা সারাদিন দৌড়তও, কেউ তাদের নিয়ে হাসে নি। দৌড়ানোর সময় তাদের ওড়না, জামা এসব নিয়ে কখনও ভাবতে হয় নি।
ফেইসবুকে একদিন কেউ একজন ম্যাসেজ করল, ‘তোমার দুধ খেতে চাই’। আমি উত্তর দিলাম, ‘লাত্থি মাইরা বিচি
ফাটাইয়া বিচির রস বাইর কইরা দিমু, তারপর নিজের বিচির রস নিজে খাইশ’।
ফাটাইয়া বিচির রস বাইর কইরা দিমু, তারপর নিজের বিচির রস নিজে খাইশ’।
আমি জানি, এই ধরনের মন্তব্য বাস্তব জীবনে কিংবা ভার্চুয়াল জীবনে অধিকাংশ মেয়েরই শুনতে হয়েছে। ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের বিব্রত করতে এধরনের মন্তব্য গুলো করে থাকে। তারা যখন দেখে, মেয়ে বিব্রত না হয়ে পাল্টা আঘাত করছে তখন তাদের পুরুষানুভূতি আহত হয়।
ছেলেরা মেয়েদের বুককে লজ্জা-স্থান বানিয়ে, সেই লজ্জা-স্থান নিয়ে হাসাহাসি করতে পছন্দ করে। যদি কোন মেয়ে নিজের হাত,পা, মুখের মত বুককে শরীরের স্বাভাবিক একটি অঙ্গের মত উন্মুক্ত করে, তবে ছেলেরা খুব রাগ করে। এমনিতে তসলিমা নাসরিনের শরীর ফটোশপ করে, উলঙ্গ ছবিতে তাঁর মুখ বসিয়ে দিয়ে অনেক পুরুষলিঙ্গধারীরা মজা নেয়। কিন্তু যেই না তসলিমা নাসরিন একদিন প্রেশার কুকার এক্সিডেন্টে তাঁর পুড়ে যাওয়ার কথা লিখে, পুড়ে যাওয়া হাতের সাথে, বুকের পোড়াটুকুর ছবিও দিলেন, সাথে সাথেই নিন্দার তুফান শুরু হল। কেন তসলিমা নিজের বুক এভাবে কোন রাখঢাক ছাড়াই দেখাবে? তসলিমার লজ্জা নেই। তসলিমাদের লজ্জা পেতে হবে। লজ্জা পেলেই তো সেই লজ্জার নিয়ে তসলিমাদের ভয় দেখানো যাবে, বিব্রত করা যাবে, হাসিঠাট্টা করা যাবে, দমিয়ে রাখা যাবে।
আমার মনে হয়, মেয়েদের এখন নিজের বুক নিয়ে চিন্তা ঝেড়ে ফেলা উচিত। কারণ বুক শরীরের অন্য অঙ্গগুলোর
মতোই একটি অঙ্গ। এটা যতদিন মেয়েরা ঢেকে রাখবে, ততদিন ছেলেরা বুকে ছোবল মারতে চাইবে, বিব্রত করতে চাইবে। যখন থেকে মেয়েরা নিজেদের বুক নিজেরাই উন্মুক্ত করবে, তখন ছেলেদের অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, তারা মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। কিন্তু এসব রাস্তার ধুলোর মত ঝেড়ে ফেলে দিয়ে স্বাধীন ভাবে চলতে পারলেই মেয়েরা নিজেদের জীবনটাকে উপভোগ করতে পারবে।
মতোই একটি অঙ্গ। এটা যতদিন মেয়েরা ঢেকে রাখবে, ততদিন ছেলেরা বুকে ছোবল মারতে চাইবে, বিব্রত করতে চাইবে। যখন থেকে মেয়েরা নিজেদের বুক নিজেরাই উন্মুক্ত করবে, তখন ছেলেদের অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, তারা মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। কিন্তু এসব রাস্তার ধুলোর মত ঝেড়ে ফেলে দিয়ে স্বাধীন ভাবে চলতে পারলেই মেয়েরা নিজেদের জীবনটাকে উপভোগ করতে পারবে।