বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫

পরাধীন বিজয় দিবস‬

বিজয় দিবসে ফেইসবুকে ঢুকেই দেখলাম অনেকে পোস্ট দিচ্ছে, তারা শাহাবাগে যাচ্ছে, সবাই একসাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে, কনসার্ট করবে, বিজয় দিবস উদযাপন করবে। আর আমি দূর দেশে একা বসে ভাবছিলাম, গত বছরে আমি বিজয় দিবসে কি করেছিলাম। ২০১৪ সালের বিজয় দিবসে বন্ধুদের সাথে একটা র‍্যালিতে গিয়েছিলাম, তারপর একটা শপিং সেন্টারের পাশে সবাই মিলে আড্ডা। ২০১৩ সালে কি করেছিলাম? ২০১৩ সালে বন্ধুদের সাথে জামালখান চেরাগী পাহাড়, যেখানে চিটাগাং গণজাগরণ মঞ্চ বসে, সেখানে বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলাম সবাই মিলে একসাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে। স্কুলে যদিও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে, কিভাবে স্কুলে নতুন কোন হাঙ্গামা করা যায়, সেসব প্ল্যান করতাম। কলেজে কড়া নিয়ম থাকার কারণে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় বন্ধুরা যারা চুলে বেনি করে আসে নি, তারা ইন্সট্যান্ট বেনি করে নিতো, কারণ জাতীয় সঙ্গীত শেষ হলেই চেকিং চলতো। আমার যেহেতু চুলের ঝামেলা নেই, তাই আমি জুতা মোজা, আইডি কার্ড, নেইম প্লেট সব ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে নিতাম। আর কোন কারণে আইডি কার্ড বা নেইম প্লেট না আনলে কিভাবে কড়া চেকিং এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সেসব নিয়ে প্ল্যান করতাম।

মাঝেমাঝে খুব কলেজে যেতে ইচ্ছে করে। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চগুলো ছিল আমার এবং আমার মত কিছু হাই লেভেলের ব্রিলিয়েন্টদের জন্য বরাদ্ধ। সকাল সাড়ে ছয়টায় কলেজের জন্য বের হতাম, বাসায় ফিরতাম দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে। দিনের প্রায় নয় ঘন্টা সময় আমি বন্ধুবান্ধব নিয়ে কাটাতাম। কলেজে কখনও একটার বেশি বই নিয়ে যাই নি, কারণ আমি কলেজে পড়তে যেতাম না, বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈহুল্লোড় করতাম, স্কুলেও তাই করতাম। স্কুলে ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত প্রতিবছর আমি নিয়মিত উপস্থিতির জন্য পুরষ্কার পেয়েছিলাম। আমি স্কুলে যাব না, এটা ভাবতেই পারি না। সেই আমি এখন বন্ধুবান্ধব ছাড়া, আমার মজার স্কুল-কলেজ ফেলে একা একটি অনিশ্চিত জীবনযাপন করছি, কেবলমাত্র বাংলাদেশের মত একটি স্বাধীন দেশে বসে নিজের মত প্রকাশ করেছিলাম বলে।

পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে বলে থাকেন, ‘পাকিস্তানিরা বর্বর জাতি। কারণ ৭১ এ তারা আমাদের মা-বোনদের অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, ধর্ষণ করেছে’। পাকিস্তানিরা তাদের মা-বোনদের অত্যাচার-নির্যাতন-ধর্ষণ করেছে বলে পাকিস্তানিদের উপর ঘৃণা। আর প্রতিদিন স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে নারী নির্যাতন, ধর্ষণের পরিসংখ্যান গুলো নিয়ে কারও মাথা ব্যথা আছে? বাংলা ভাষার অধিকাংশ গালি মা বোন দিয়ে শুরু হয়। এইসব গালি আবার তাদের খুব পছন্দের।

‘নারী স্বাধীনতা’ শব্দটি এখনও স্বাধীন দেশটির অধিকাংশ পুরুষকে হাসায়। ‘নারী স্বাধীনতা আবার কি? নারীরা আমাদের মা-বোন-বউ হয়ে থাকবে, আমাদের ইচ্ছায় চলবে, এইতো!’ ইদানিং রাস্তাঘাটে হিজাব বোরখার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা বেড়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, পুরুষের স্বাধীনতা। নারীর উপর যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। ইচ্ছে হলেই রাস্তায় চলতে বিরক্ত করা, ইচ্ছে হলেই ধর্ষণ করা, যৌন হয়রানি করা, ইচ্ছে হলে বিয়ে, ইচ্ছে হলেই তালাক। নারী স্বাধীনতার কথাগুলো স্পষ্ট কন্ঠে জানিয়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। সেই তসলিমা নাসরিন আজ প্রায় একুশ বছর ধরে নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত।

স্বাধীন দেশটিতে কেউ যদি ব্লগ, ফেইসবুকে নিজের মতামত প্রকাশ করে তবে তাকে হত্যা করা হয় এবং যার কোন বিচার তো দূরে থাক, রাষ্ট্র এই হত্যাকে কোন অপরাধের আওতায় ফেলে না।

সরকার বদলের সাথে সাথে স্বাধীনতার ঘোষকের নাম পাল্টে যায়, যুদ্ধাপরাধী একটি দল দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়, সেই যুদ্ধাপরাধীদের পাশে দাঁড়ায় দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল, যেটি মুক্তিযোদ্ধার দল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। তাদেরই ডাকা হরতালে ককটেল বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ হারায়, পঙ্গু হয় সাধারণ মানুষ। মুক্তিযোদ্ধারা এদেশে চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারায়, আর কুখ্যাত রাজাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে শান্তিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। বিভিন্ন ইস্যুতে সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা এখানে নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপার। মায়ের পেটেও এদেশে শিশুরা নিরাপদ নয়। স্বাধীন দেশটিতে এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনার খেতাব পায়।

সত্যি বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। এই দেশে স্বাধীনভাবে সব ধরণের অপরাধ করা যায়। অপরাধীদের জন্য এটি একটি স্বাধীন দেশই বটে।

দু'জন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি দেয়ার পর নাশকতার ভয়ে সারাদেশে সব ধরণের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে রাখতে হয়, বিজিবি মোতায়ন করতে হয় বিভিন্ন শহরে- কাদের ভয়ে? এই শত্রুদেরই তো আমরা ৭১এ আমরা পরাজিত করেছিলাম, তবে এত ভয় কেন? ৭১এ নয় মাস যুদ্ধের পর যাদের পরাজিত করেছিলাম বলে ১৬ ডিসেম্বর দিনটিকে আমরা বিজয় দিবস পালন করি, সেই শত্রুদের থেকে কি বাংলাদেশ আজও মুক্ত হতে পেরেছে? আমরা কি ১৬ ডিসেম্বরের মর্যাদা রাখতে পেরেছি? বিজয় দিবস পালনের যোগ্যতা অর্জন করেছি?

‎নাস্তিক হত্যার বিচারেও অনুভূতিতে আঘাত লাগে‬!


অনেকদিন হয়ে গেলও কিছু লিখতে পারছি না। কি লিখব, কাদের জন্য লিখব, লিখে কি হবে--এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। এতগুলো প্রাণ নেই হয়ে গেলও শুধুমাত্র তারা দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, ভাবতো বলে। নাস্তিক মরলে দেশে কার কি যায় আসে? 
লিখতে গেলে কিছু স্বপ্ন লাগে, আশা লাগে। কিন্তু দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে এখন ভয় হয়। অনলাইনে দেশের পত্রিকা পড়ে হতাশ হই। জানি হতাশ হবো, তবুও দেশের পত্রিকাই পড়ি। অথচ আমি এখন যেই দেশে আছি, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামটাও জানি না।

মাঝে মাঝে মনে হয়, ঘুম থেকে উঠে যদি শুনি বাংলাদেশ বলতে কোন দেশ কখনও ছিল না, তবে খুব খুশি হবো। আমার সমস্ত ভাবনা জুড়েই বাংলাদেশ। দেশটা আমাকে হতাশা ছাড়া আর কিছুই দেয় না। দেশটা যদি নেই হয়ে যেতো, তাহলে হয়তো একটা চিন্তা মাথা থেকে দূর হতো।
আগে রাতে টিভিতে টক শো দেখতাম, আর রাজনীতি নিয়ে বাবার সাথে কঠিন আলাপ করতাম। এখন রাজনীতি নিয়ে নিজেই ভাবি, যদিও ভেবে কোন কূল কিনারা পাই না। জিয়া পরিবার দেশে খাল কেটে কুমির আনলো। কাজেই বিএনপির কাছে কারও কোন কিছু চাওয়ার নেই। তখন সব আশা ভরসা হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামীলীগ। কিন্তু ভোটের রাজনীতিটা এখন আওয়ামীলীগও শিখে ফেলেছে। এদেশের অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে ভোট দেয়। কাজেই যেই দলের ব্যানারে আল্লাহ খোদার নাম পাওয়া যায়, তাদের মার্কায় ভোট দিয়ে ভাবে যে, ‘যাক আল্লাহ্‌র পথেই আছি’। বিএনপি-জামায়েত ভোট পায় শুধুমাত্র এই কারণে। আওয়ামীলীগও বুঝে গেছে ভোট পেতে হলে তাদেরও ধর্মকে ব্যবহার করতে হবে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান এদেরকে আওয়ামীলীগ যতই লাথি-জুতা মারুক না কেনও, ভোট তারা আওয়ামীলীগকেই দিবে। কাজেই এদের নিয়ে আওয়ামীলীগের কোন চিন্তা নেই। চিন্তা এখন বাকি ৯০ পার্সেন্টের ভোট নিয়ে। তাই বিএনপি-জামায়েতের সাথে তাল মিলাতে আওয়ামীলীগ এখন মাঠে নামিয়েছে ওলামীলীগকে। নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যু নিয়ে তারা আর ঘাটাচ্ছে না। সজীব ওয়াজেদ জয় তো বলেই দিলেন যে, এটা নাকি একটা ‘সেন্সিটিভ’ ইস্যু। নাস্তিক হত্যার বিচার করলেও তো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। আর অনুভূতিতে আঘাত লাগা মানেই ভোট কমে যাওয়া। তাতো হতে দেয়া যায় না। কাজেই মরুক কিছু নাস্তিক।
প্রতিবার কোন নাস্তিক হত্যার পর মন্ত্রী-মিনিস্টাররা স্ক্রিপটে লেখা কিছু বক্তব্য গেয়ে চলে যান, প্রতিবারই বিচারের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে, তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে, আবার বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তদন্তের কোন অগ্রগতি নেই। ব্লগার রাজীবের খুনীরা এখন জামিনে মুক্ত হয়ে নতুন কোন ব্লগার হত্যায় মনযোগী হয়েছে। অভিজিৎ হত্যা মামলায় ও একই রকম কিছু নাটক দেখলাম। বাবু হত্যাকারীদের দুইজন পথচারী পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিলেও পরবর্তিতে সেসবের কোন খবর পেলাম না। হয়তো তারাও এখন মুক্ত হয়ে নতুন লিস্ট নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এরপর অনন্ত হত্যা, নীলয় হত্যা- এসব মামলারও কোন খবর জানা নেই। এসব দেখে প্রকাশক দীপনের বাবা ক্ষোভে বলেছেন যে, তিনি পুত্র হত্যার বিচার চান না। হানিফ সাহবে নাকি দীপনের বাবাকে খুনীদের আদর্শের একজন বলে মন্তব্য করেছেন। আর এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, দেশে কোন জঙ্গি নেই, দেশের আইন শৃঙ্খলার অবস্থা খুব ভালো। যা ঘটছে, সবই বিচ্ছিন্ন। এরপর আর বিচার চাওয়ার কোন মানে হয়? এদিকে দেশের মানুষও সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। প্রতিটি ব্লগারের মৃত্যুর পর তারা জানতে যায়, ‘কেন মারল? কি লিখছিল? ইসলাম নিয়ে না লিখলেই তো হয়’। দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে কারও কোন ভাবনা নেই।

শুনেছি, মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে বিচার প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি দিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাকামীদের বিচার চাইলো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এসব ছাতারমাথা সংগঠনগুলো কথা বলছে, নিজেদের দাবী জানাচ্ছে। এত স্পর্ধা তাদের!
স্পর্ধা হবে নাই বা কেনও? আমাদের এখানে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে বিচার চাইতে যায় উন্নতদেশগুলোর কাছে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নালিশ করতে যায় উন্নতদেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের কাছে। আমরাই বুঝিয়ে দিয়েছি যে, আমরা একটা মেরুদন্ডহীন জাতি, দেশের আভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে কথা বলার সাহস তো আমরাই তাদেরকে দিয়েছি।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে এত সময় ব্যয় সহ্য হয় না। ৪২ বছর পর বিচার হচ্ছে, তাও আবার ট্রাইবুনালের রায়, এরপর সুপ্রীম কোর্টে আপিল, তারপর আবার রিভিউ। রিভিউয়ের পর আবার ক্ষমা- আরও কতকিছু। এরমধ্যে আবার রায়ের কপি নাকি লেখা শেষ হয় না। এইসব কাহিনী করতে গিয়ে জেলের ভিতরেই যুদ্ধাপরাধীদের অধিকাংশ মারা যাবে। তাও ভালো যে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মারা যাবে, মন্ত্রী হিসেবে নয়। আওয়ামীলীগের কাছে পাওয়া বলতে এতটুকুই। আর বাকি সবকিছুই এখন দুইদলেরই এক। দেশ নিয়ে এখন আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে হয় না। কাকে ভরসা করে দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখব? দেশের স্বার্থেই আওয়ামীলীগ-বিএনপির বিকল্প কিছু ভাবার সময় এসেছে কি?

‪ফেইসবুকহীন নিরাপদ দেশটির গল্প‬


কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী, মুজাহিদ এই পর্যন্ত চারজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। আমার জন্য, যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর মানেই ছিল বইখাতা বন্ধ করে টিভির সামনে বসে থাকা। কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের দিন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে কুখ্যাত ঘাতকের বিচার হচ্ছে!বিভিন্ন চ্যানেলে তার কুকর্মের কথাগুলো বর্নণা করা হচ্ছিল, সেসব দেখছিলাম, আর রাগে ফেটে পড়ছিলাম। কামারুজ্জামানের রায় কার্যকরের দিন বিনা নোটিশে স্যার পড়াতে চলে এলেন। স্যারকে সাথে নিয়েই সেদিন কামারুজ্জামানের কুকর্মের কাহিনী শুনলাম, স্যারের সাথে রাজনৈতিক আলাপ করলাম, সাথে বাবাও এসে যোগ দিলেন। গত ২২শে নভেম্বর, কুখ্যাত দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহাসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হল। আমি দেশের বাইরে। জাগো বিডি ওয়েব সাইট থেকেই সাধারণ আমি বাংলাদেশের চ্যানেল গুলো দেখি, কিন্তু সেদিন জাগো বিডি সাইটটা স্লো হয়ে গেলও। প্রবাসীরা সবাই নিশ্চয়ই এই একটি ওয়েব সাইটের মাধ্যমে দেশের খবর শুনছিল। সাইট স্লো, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর শোনার সময় বারবার আটকে যাচ্ছিল, রেগে গিয়ে হয়তো ল্যাপটপ ভেঙ্গে ফেলতে পারি, এই ভয়ে ল্যাপটপটা হাতের নাগালের বাইরে রেখে, নাওয়া খাওয়া বন্ধ রেখে নিউজ শুনছিলাম। ভেবেছিলাম রাত ১০টার মধ্যেই হয়তো ঝুলিয়ে দেয়া হবে। ১১টায়ও যখন ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে না, তখন মনে মনে খুব চাইছিলাম আরেকটু দেরী হোক, ১২টা ক্রস করুক। ফাঁসির তারিখটা ২১শে নভেম্বর না হয়ে যেন ২২শে নভেম্বর হয়। অবশেষে বাংলাদেশ সময়ে ১২টা ৫৫ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হল। কাজেই দিনটাকে ২২শে নভেম্বর ধরাই যায়। ২২শে নভেম্বর আমার জন্মদিন। জন্মদিনটা ফেইসবুক প্রোফাইলে হাইড করে দিয়েছিলাম যাতে কেউ দেখতে না পায়। কিন্তু কয়েকজন বন্ধু মনে রেখেছিল, তারা ওয়ালে পোস্ট করার পর, অনেকেই শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাতে শুরু করল। জানা যখন হয়েই গেলও, ভাবছিলাম সুকান্ত ভট্টাচার্যের আঠারো বছর বয়স কবিতাটা পোস্ট করব, শেষ পর্যন্ত আর করা হল না। এই বয়স নিয়ে কম ভোগান্তি হয় নি। তবে ছোট থাকার অনেক উপকারিতাও আছে। সব ভুলত্রুটিগুলো ছোট বলে মাফ পাওয়া যায়। কিন্তু বড় হয়ে গেলে এই সুবিধাটুকু আর পাওয়া যায় না। জগতের জটিল সব বিষয়গুলো নিয়ে ছোটদের ভাবতে হয় না। কিন্তু আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলেই মানুষ নিজেকে জটিল সবকিছুতে জড়িয়ে ফেলে। আমি ছোট থাকতে চাই, ভুল করার পর বয়সের অজুহাতে ক্ষমা পাওয়ার সুবিধাটুকু পেতে চাই সবসময়। জটিল কোনকিছুতে নিজেকে জড়াতে চাই না।

শুনেছি কিশোরী ঐশীর নাকি ফাঁসির রায় হয়েছে? ঐশী তার পুলিশ বাবা ও মাকে খুন করেছে। ঐশী মাদকাশক্ত ছিল। খুনের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছরের কম। বয়স বিবেচনায়, ঘাতক গোলাম আজম যাবজ্জীবন সাজা পেলও, অথচ ঐশীর বেলায় বয়স বিবেচনায় আনা হল না!

ঐশীর এই পরিণতিতে ঐশী একা দায়ী নয়, একজন ঐশীকে ফাঁসি দিলেই সমাজে আরেকজন ঐশী সৃষ্টি হবে না, এমন নিশ্চয়তা কি দেয়া সম্ভব হবে? ঐশীর বয়স অল্প ছিল, সে যে ভুল করেছে সেটাই তাকে বুঝতে দেয়া হল না, তাকে তার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হল না। হ্যাঁ, আমি ঐশীর ফাঁসির বিপক্ষে। কেবল ঐশী না, আমি চাই সব মানুষকেই নিজের ভুল বোঝার, অনুতপ্ত হওয়ার, ভুল সংশোধের সুযোগ দেয়া হোক। তবে যুদ্ধাপরাধীর কথা আলাদা।

মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কাদের মোল্লা নিজের কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত তো দূরের কথা, ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে গেলও। কামারুজ্জামানের মৃত্যুর পর তার পরিবার মিডিয়ায় ‘ভি’ চিহ্ন প্রদর্শন করেছে। সাকা-মুজাহিদ ক্ষমা চাওয়ার নাটকটা করে, চেয়েছিল হয়তো একদিন বেশি বাঁচতে পারবে, কিন্তু যখন দেখল এতে কাজ হচ্ছে না, তখন তার পরিবারের সদস্যরা বাইরে এসে জানিয়ে দিলো তাদের বাবা ক্ষমা চায় নি। এইসব যুদ্ধাপরাধীরা কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময়ই অপরাধ করে নি, যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে দেশে এসে তারা বিএনপি সরকারের আমলে পুনর্বাসিত হয়ে নিজেদের কুকর্ম অব্যাহত রেখেছে। আর এই অপরাধীদের যদি কোন ভাবে ক্ষমা করা হয়, তবে ভবিষ্যতে সরকার বদলের পরই তারা জেল থেকে মুক্ত হয়ে, ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যের সাথে জড়িত প্রত্যেক সদস্যকে হত্যা করবে। বিচার চলাকালীনই কিছু সাক্ষীকে হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে। কাজেই এইসব পশুর প্রতি মানবতা দেখানোর ভুলটা আমি করছি না। তবে কথা হল, এই কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিলেই কি দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে যাবে? তা কিন্তু না। দেশে জঙ্গিবাদের চাষ ঠিকই হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদের চাষের দিকে নজর না দিয়ে আমাদেরকে ঢেড়স চাষের পরামর্শ দিয়েছেন। বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের এই জাতীয় মন্তব্য শুনেই বুঝতে পারি, ৭১ এ ঘাতকরা জাতিকে অনেকটুকুই মেধাশুণ্য করতে পেরেছে।

একের পর এক মুক্তমনা মানুষ হত্যা চলছে, কেবল নাস্তিক মুক্তমনা নয়, বিদেশী নাগরিক হত্যা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া—এসবই নির্বিঘ্নে ঘটে চলেছে। সরকার যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দিচ্ছে, এর জন্য ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এইসব ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনাগুলোর দিকেও কি তারা একটু নজর দিবেন? নাকি এখনও ৪৪ বছর হয়নি বলে বিচার কার্য শুরু করা যাচ্ছে না?

আবার দেশের মানুষের নিরাপত্তার দোহায় দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এই অবস্থাতেও হত্যা উৎসব চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে কি কোন ফল পেয়েছে? দেশের মসজিদ মাদ্রাসায় মগজ ধোলায় চলছে, নাস্তিক হত্যাকে ‘সেন্সিটিভ’ ইস্যু আখ্যা দিয়ে অপরাধীদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে—এইগুলো যদি পারেন বন্ধ করেন, সুফল পাবেনই, নিশ্চিত।

বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৫

প্রবাস জীবনের গল্প..

ব্লগ সম্পর্কে দেশের অধিকাংশ মানুষের কোন ধারণা না থাকলেও ব্লগারদের প্রতি তাদের ঘৃণার কোন কমতি নেই। আমি দেশ থেকে বের হওয়ার পরপরই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব অনেকের জানা হয়ে গেছে যে, ইতুও একটা নাস্তিক ব্লগার ছিলও। আমার আত্মীয়-স্বজনেরা এখন আমাদের বাসায় আসতে ভয় পায়, তারা এখন আমার সম্পর্কে আড়ালে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পছন্দ করে।

আমি মিশুক স্বভাবের ছিলাম না, আমি কখনও বিকালে ছাদে উঠে প্রতিবেশীদের সাথে আড্ডা দিতে যাই নি, কোন প্রতিবেশীর বাসায় যাই নি। আমার সাথে কেউ কথা বললে তবেই আমি কথা বলতাম, নিজে থেকে কখনও কথা বলি নি। একদিন সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ইতু কেমন আছো?’ আমি বললাম, ‘আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না’। তারপর উনি আমার ছোট বোনের নাম বলে বললেন যে, তুমি ওর বোন না? আমি বললাম, হ্যা। তারপর বললেন, আমি তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি’। ‘ও আচ্ছা, আমি ভালো আছি’ এইটুকু বলেই আমি চলে গেলাম। আমি অসামাজিক ছিলাম। অথচ আমার মা-বাবা-বোন আমার সম্পূর্ণ বিপরীত। পাশের বাসার বাচ্চাটাকে দেখলেই বাবা আদর করতেন, তার সাথে শিশুতোষ কথা বলতেন। মা সবসময় আশেপাশের সবার খোঁজখবর রাখতেন। আমি দেশ ছাড়ার পর আমার প্রতিবেশীরাও জানতে পারলেন যে, আমি নাস্তিক ব্লগার ছিলাম। তারা এখন আমার বাবা-মা’কে আড়চোখে দেখে। 

আমার স্কুলের টিচার্স টেবিলে আমাকে নিয়ে আলোচনা উঠেছে। আমার একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকার মতে, ‘আরে ওকে আমি চিনি, ফাজিল একটা। বড় বড় ব্লগারদেরকে মারার জন্য লিস্ট করছে, ওর মতো চুনোপুঁটি আবার কিসের ব্লগার? সব নাটক’। টিচারের এই কথাও আমার কানে চলে এলো। আমি তো পুরাই ‘বেয়াক্কেল’ হয়ে গেলাম। আমার এক বন্ধু বলল, ‘এই টিচাররে তো স্যালুট দেয়া দরকার। সাধারণ স্যালুটে কাজ হবে না। এক্কেরে পতাকার বাঁশের লগে বাইন্ধ্যা বাঁশটা ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া উনারা স্যালুট দেয়া দরকার’। আমি ব্যাপার গুলোকে হাস্যকর ভাবে নিলেও, আমার মা-বাবা এসবে কষ্ট পান। আমার মা-বাবা যারা কিনা রাতদিন আমার জন্য চোখের পানি ফেলেন, তাদের কানে যখন এসব কথা যায় তখন তারা নিজেদেরকে আরও অসহায় ভাবতে শুরু করেন।

কলেজের স্যারেরা শুনেছি আমার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে, অনুভূতিতে আঘাত দেয়া ঠিক না, এই জাতীয় কথাবার্তা বলেছেন। একের পর এক ব্লগার হত্যায় নিশ্চয়ই তাদের কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগে নি। 

আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীরা আমার পরিবারের সাথে দূরত্ব রেখে চললেও আমার বাবার এক বন্ধু যার বাসায় আমি বেশ কয়েকদিন লুকিয়ে ছিলাম, সেই বন্ধু ও বন্ধুর পরিবারের সদস্যরা আমার খোঁজ নেন সবসময়। আমার বাবা-মা’কে সাহস দেন।
আমার বন্ধুরাও আমাকে ভুলে নি, আমাকে সবসময় ফেইসবুকে তাদের জীবনের খবর জানায়, আমি থাকলে আরও কি কি হতে পারতো, সেসব বলে। 

এখানেই আত্মীয় আর বন্ধুদের মধ্যে পার্থক্য। আত্মীয় হল তারা যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক আছে বলে জোর করে আত্মীয়তা রাখতে হয়। আর বন্ধু তো বন্ধুই। বন্ধুত্বের কোন সংজ্ঞা হয় না।

মাঝেমাঝে মনে হয় কোন দুঃখে যে লেখালেখি করতে গিয়েছিলাম! স্বাধীনতার কোন কমতি ছিলও না আমার জীবনে। লিখতে গিয়ে বরং আমি আমার স্বাধীন জীবনটাকে হারিয়েছি। মেয়েদের সাধারণত কোথাও বের হতে গেলে, বাসায় ম্যানেজ করার একটা ব্যাপার থাকলেও আমার সেটা কখনোই ছিলও না। যখন তখন বের হতাম, আড্ডা দিতাম, ঘুরে বেড়াতাম, বাবা-মায়ের বকুনি’কে পাত্তা দিই নি কখনও।

জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ফলো করা শুরু হল, তখন থেকে কলেজ আর বাসা ছাড়া আর সব জায়গায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলও। ঠিকমত কলেজে পৌঁছালাম কিনা- এই নিয়ে বাবা-মা’র চিন্তার শেষ ছিল না। বন্ধুরা কোথাও বের হওয়ার কথা বললে এড়িয়ে যেতাম। বন্ধুরা সবাই বলতো, ‘ইতু বদলে গেছে, আগে তো এমন ছিলি না’। স্কুলের বন্ধুরা ভাবতো আমি কলেজে গিয়ে স্কুলের বন্ধুদের অবহেলা করছি। আর কলেজের বন্ধুরা ভাবতো, আমার কাছে স্কুলের বন্ধুরাই সব, কলেজের বন্ধুরা কিছুই না। কিন্তু আমার করার কিছুই ছিলও না। কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। এসব কথা বাবা-মা আর ফেইসবুকের কিছু প্রিয় বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানতো না। বাবা-মা’কে এইরকম চিন্তায় ফেলেছি বলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো, এরমধ্যে বাবা যেদিন বললেন, ‘আমাদের অপরাধ, আমরা তোমার বাবা-মা’। সেদিন থেকে কারও সাথে এ নিয়ে একটি কথাও বলি নি। 

ভেবেছিলাম, শীঘ্রই দেশের পরিস্থিতি ভালো হবে। হাসিনা সরকার নিশ্চয়ই ব্লগার হত্যাকারীদের শনাক্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করবে, আর কাউকে ব্লগে লিখার জন্য চাপাতির কোপে মৃত্যুবরণ করতে হবে না। প্রতিমুহুর্তে ভাবতাম, খুব তাড়াতাড়ি আমি আগের সেই স্বাধীন জীবণে ফিরে যাবো। কিন্তু আমার ভাবনা দিয়ে কি আর রাজনীতি চলে? রাজনীতি চলে ভোট দিয়ে। কাজেই নাস্তিক হত্যার বিচার করে কে-ই-বা ভোট হারাতে চায়? সরকারের কাছে দেশে ঘটে যাওয়া সবধরনের অপরাধগুলো কেবলই বিছিন্ন ঘটনা মাত্র। নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, প্রশ্ন ফাঁস, একের পর এক ব্লগার হত্যা, বিদেশী নাগরিক হত্যা এসব ঘটনা সরকারকে মোটেই বিব্রত করে না। বিব্রত করে শুধু ব্লগাররা, যারা এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। জঙ্গিরা ব্লগারদের মেরে ফেলার হিট লিস্ট বানায়, আর সরকার বিব্রতকারী ব্লগারদের লিস্ট বানায়, ৫৭ধারায় গ্রেফতারের জন্য! 

অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। আত্মীয়স্বজন বাবা-মা’কে ফোন করে বলতে শুরু করেন, আপনার মেয়েকে থামান, এই মেয়েকে তো বেশিদিন ঘরে রাখা যাবে না, কিসব লিখে সে? বাবা-মা ঠিক করলেন, ইন্টারটা শেষ করে দেশের বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিবেন। যদিও দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি সিরিয়াসলি নিতাম না। এর আগে ২০১০ সালে, তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়তাম। ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটা প্রজেক্টে অংশ নিয়েছিলাম, সেখানে নাটকে
প্রথম হয়ে আমি সহ বাংলাদেশ থেকে আমরা পাঁচজন ইংল্যান্ড গিয়েছিলাম দশ দিনের জন্য। যদিও বন্ধুদের সাথে মজা করেই দিন কাটছিলও তবুও ইংল্যান্ডে পা রেখেই আমরা প্রত্যেকেই দেশকে প্রচন্ডভাবে মিস করতে লাগলাম। দেশে বসে দেশের যতই সমালোচনা করি না কেন, দেশ যে কি, সেটা তখনই বুঝেছিলাম। কাজেই দেশের বাইরে যাওয়াটা আমার কাছে তখন থেকেই প্রচন্ড আতংকের মত ছিলও।

কিন্তু এরমধ্যেই ফলোর মাত্র বেড়ে গেলও, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে গিয়ে আমার ফলোয়ারেরা আমার সম্পর্কে তথ্য চাইতে লাগলো, আর বন্ধুরা ফোন করে জানাতে লাগলো যে আমাকে খুঁজতে নাকি কারা যেন কোচিং এ যায়। না, আমি এসব আর কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করি নি, কারণ আমি জানি এসব বলে কেবলই চিন্তা বাড়বে, আমাদের কারোর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু কোন এক কোচিং এ গিয়ে আমার ফলোয়ারেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিল, ‘এই মাসের মধ্যেই ইনশাল্লাহ …….’ তাদের এই কথা আমার এক বন্ধু শুনে সাথে সাথে বাসায় ফোন করে, তখন আমি বাসায় স্যারের কাছে পড়ছিলাম বলে ফোনটা বাবা ধরে। বাবা সব জানতে পেরে ওইদিন আমাকে রাতের আঁধারে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়। দুইটা প্যান্ট, আর দুইটা টি’শার্ট নিয়ে ৯ আগস্ট রাত ১২টার দিকে বাসা থেকে বেড়িয়ে যাই, তখনও ভাবি নি যে আর কখনও আমি ঘরে ফিরতে পারব না। আমার কাছে এসব এখনও স্বপ্ন বলে মনে হয়। এখনও সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলে আমাকে কয়েক মিনিট ভাবতে হয়, ‘আমি কোথায় আছি’।

বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার এক নিউজে দেখলাম ব্লগাররা নাকি পলিটিক্যাল এসাইলাম নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে মিথ্যা নাটক করছে। শুনে হাসি পেলো, নিজের বাবা-মা-ভাই-বোন-প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে কেউ বুঝে স্বেচ্ছায় একা-সম্পূর্ন অচেনা পরিবেশে, নিষ্ঠুর একটি জীবন বেছে নেয়? এমন পাগলও আছে নাকি? প্রবাসী ব্লগারদের কেউ কেউ দেশে গিয়ে পুকুরে মাছ ধরার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে, পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের আড্ডার সময়গুলোর কথা ভেবে চোখের জল মুছে।

দেশের অনেকের ধারণা প্রবাসী ব্লগার
রা ডলার-পাউন্ডের উপর শুয়ে শুয়ে ব্লগ লিখছে। ‘বিদেশ’ কি জিনিস সে সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তারাই এধরণের কিছু ভাবতে পারে। প্রবাসী ব্লগারেরা এখানে দিনের ১২ ঘন্টা ব্যয় করে জীবিকা নির্বাহের অর্থ জোগাতে, দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে রুমে ফিরে কারও কারও ভাগ্যে ঘুমের জন্য বিছানাটুকু জোটে না। অনেকেই লেখালেখি ভুলে গিয়ে জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 

দেশে ব্লগারদের মৃত্যু ভয় নিয়ে বাঁচতে হয় আর প্রবাসী ব্লগারেরা প্রতিমুহুর্তে মৃতের মত বাঁচে। ভয়াবহ একাকীত্বে প্রতিমুহুর্তে তাদের মৃত্যু হয়। বন্ধুদের সাথে রাস্তার মোড়ে নালার পাশে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে দিতেই কখন বিকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে যেতো টের পেতাম না। আর এখন উন্নতদেশের বড় বড় বিল্ডিং আর পার্ক গুলো দেখলেও আমার কোন ধরণের ভালো লাগা তো দূরে থাক, একবার ঘুরে দেখতেও ইচ্ছা হয় না। ভালো লাগা, খারাপ লাগা কোন ধরণের অনুভুতিই কাজ করে না। অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের কাছে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বললে, তাঁরা আঁতকে উঠে। জিজ্ঞেস করে, মাথায় সমস্যা আছে কিনা! আগে আমার অনেক চাহিদা ছিলও, বাবা-মায়ের কাছে এটাওটা কিনে দেয়ার বায়না ধরতাম, এখন আমার একটাই চাহিদা, যদি একবারের জন্য দেশে ফিরতে পারতাম।


শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৫

মূর্তি ভাঙলে ভগবানের অক্ষমতা প্রমাণ পায়, আর মসজিদ ভাঙলে?

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এ জাতীয় একটা কথা ঈদ-পূজার আগে প্রায় শুনি। সত্যি কি তাই? চলুন দেখা যাক।
মন্দিরের সামনে গরু কোরবানী

ইদুল আযহা, মুসলমানদের একটি ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবটি মূলত পশু কোরাবনীর মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। কোরবানীর পশু হিসেবে থাকে গরু, ছাগল ইত্যাদি। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গরুকে তাদের দেবতা রূপে পূজা করে। আর মুসলমানরা কোরবানী ঈদে আনন্দের সাথে গরু কোরবানী করে। এতে সনাতান ধর্মের অনুসারীদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। যদিও দেশে ধর্মানুভূতির আদর-যত্নের জন্য ৫৭ ধারা রয়েছে। কিন্তু সেটি এক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়।

হিন্দুরা মাটির মূর্তি বানিয়ে তাদের কল্পিত দেবদেবীদের পূজা করে। আবার মূর্তি পূজা ইসলামে নিষিদ্ধ। শুধুই নিষিদ্ধ নয়, এ বিষয়ে সহীহ্‌ বুখারী, হাদিয়াত ২২৩৬ এ উল্লেখ আছে, ‘হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় মক্কায় থাকা অবস্থায় এই ঘোষণা দিয়েছেন যে, আল্লাহ ও তার রাসূল মদ ও মূর্তি এবং ও শুকর বিক্রি করা হারাম করেছেন’।

সহীহ্‌ মুসলিম, হাদিয়াত ৯৬৯ এ আছে, আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন, আলী ইবনে আবী তালেব (রা.) আমাকে বললেন, “আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সকল মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সকল সমাধি-সৌধ ভূমিসাৎ করে দিবে এবং সকল চিত্র মুছে ফেলবে”।

এছাড়াও মুসনাদে আহমাদ এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘আলী ইবনে আবী তালেব রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদীনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো প্রাণীর মূর্তি পাবে তা ভেঙে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধি-সৌধ পাবে তা ভূমিসাৎ করে দিবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দিবে?” আলী রা. এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে কেউ পুনরায় উপরোক্ত কোনো কিছু তৈরী করতে প্রবৃত্ত হবে সে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি নাযিলকৃত দ্বীনকে অস্বীকারকারী।”
স্থানঃ সাতক্ষীরা, মুর্তি ভাঙ্গা উৎসব, ২০১৫।
  কাজেই, ইসলাম ধর্ম মতে, মূর্তি ভাঙা  প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব।  প্রতিবছর বিশেষ করে শারদীয় দুর্গা  পূজায়, বাংলাদেশে অনেক আদর্শ  মুসলমান নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্ব  পালন করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে  মূর্তি ভাঙা পাপ হলেও ইসলাম ধর্ম মতে এটিকে সোয়াবের কাজ বলাই যায়।

 অথচ মূর্তি ভাঙার খবরগুলোতে যারা মূর্তি ভেঙেছে তাদেরকে দুর্বৃত্ত হিসেবে  চিহ্নিত করা হয়। এ নিয়ে যখন টকশো’তে আলোচনা হয় তখন মডারেট  মুসলমানেরা বলে থাকেন, এসকল দুর্বৃত্তদের কোন ধর্ম নেই, ইসলাম শান্তির  কথা বলে, ইসলামে মূর্তি ভাঙার কথা বলা হয় নি। অথচ ইসলাম ধর্মের সূচনা হয়েছিল কোরাইশদের ৩৬০ টি মূর্তি ভাঙার মধ্য দিয়ে। হযরত মোহাম্মদ নিজ হাতে এসব মূর্তি ভেঙেছেন। তার মানে কি তারা তাদের নবীকেও দুর্বৃত্ত মনে করেন? তারা নিজেরা মূর্তি না ভেঙে, মূর্তি পূজার পক্ষে কথা বলে ধর্মবিরোধী কাজ তো করছেনই, সাথে আবার ‘ইসলামে মূর্তি ভাঙার কথা নেই’ এই জাতীয় কথা বলে মানুষকে ইসলাম ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যা ও ভূল ধারণা দিচ্ছেন। 

তবে সরকার এই বিষয়ে খুব সচেতন। আইন অনুযায়ী, কেউ মূর্তি ভেঙে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে তাদেরকে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করার কথা। কিন্তু মূর্তি ভাঙার জন্য গ্রেফতার করা মানে তো মোহাম্মদের যুগে ৫৭ ধারা থাকলে তিনিও একই অপরাধে গ্রেফতার হতেন। কাজেই নবীকে অনুসরণ করে যারা মূর্তি ভাঙছে, তাদেরকে কোনরকম গ্রেফতার না করে বরং অবিশ্বাসীদের কেউ যদি মডারেটদের দেওয়া ভুল তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে, তবে তাদের জন্য ৫৭ ধারা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে এভাবেই ৫৭ ধারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। 

একদিকে মডারেট মুসলমানরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল-মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছেন, অন্যদিকে বাংলার হুজুর সমাজ নিরলস ভাবে মূর্তি পূজা সম্পর্কে ইসলামের বাণীগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। পিস টিভি বাংলার একজন জনপ্রিয় হুজুর হলেন, আব্দুর রাজ্জাক। হুজুর আব্দুর রাজ্জাক তার বিভিন্ন ওয়াজ গুলোতে মূর্তি পূজা সম্পর্কে ইসলামে কি বলা আছে এবং মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। তিনি তার এক ওয়াজে বলেছেন, “আমি মুসলিম চির  রণবীর, মরণকে করিনা ভয়। আমি ছবিকে কবর দিতে এসেছি। আমি মূর্তিকে লাত্থি দিয়ে ভাঙতে এসেছি! তুমি জানো না আমি মুসলিম? তুমি যখন বিজাতিতে চলে গেছ, সেটা তোমার ব্যাপার। তুমি তো পহেলা বৈশাখ মানো, আমি কি হিন্দুর বাচ্চা? আমি কি হিন্দুর ঘরে জন্ম নিয়েছি নাকি আমি পহেলা বৈশাখ মানবো? তুমি বলো কী! তুমি জানো না আমি মুসলিম? আমার রক্তের সাথে মিশে আছে মূর্তি-ভাঙা নীতি, আমার গোস্তের সাথে মিশে আছে মূর্তি-ভাঙা নীতি, আমি পহেলা বৈশাখকে কবর দিতে এসেছি…আমি হিন্দুর ঘরে জন্ম নেই নি, আমি মুসলিম চির রণবীর, মরণকে করিনা ভয়। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী—আমার উভয়ই সমান”। 


হিন্দুদের মূর্তি ভাঙার পর, মুসলমানরা সাধারণত দাবী করেন, যেহেতু দেবদেবীরা নিজেদের মূর্তি নিজেরা রক্ষা করতে পারে নি, কাজেই সনাতন ধর্ম একটি মিথ্যা ধর্ম আর এতেই প্রমাণিত হয়, ইসলাম একমাত্র সত্য ধর্ম।

মক্কায় ক্রেন দুর্ঘটনায় শ'খানেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, মিনায় পদদলিত হয়ে মারা গেছেন প্রায় হাজার খানেক মানুষ। যদিও সৌদি আরব তাদের ব্যবসায়িক কারণে মিনায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যাটি গোপন রেখেছে। মুসলমানরা আল্লাহ্‌র ঘরকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বলে মনে করেন। আর হাজীরা হলেন ‘আল্লাহ্‌র মেহমান’। অথচ আল্লাহ তার অতিথিদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে যথারীতি ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করা হয়।


তবে আর যাই হোক, আল্লাহর ঘর কাবা কখনও বন্যা-ভুমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হয় না – এই জাতীয় কথা মুসলমানদের কাছ থেকে শুনে আসলেও গুগল করে ১৯৪১ সালের বন্যায় কাবাঘর ডুবে যাওয়ার বেশ কিছু ছবি ভিডিও পেয়ে গেলাম।



মূর্তি-মন্দির ভাঙার মাধ্যমে হিন্দুদের দেবদেবীদের অক্ষমতা প্রমাণিত হয়, একই ভাবে আল্লাহ্‌র ঘর- মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়েও কি আল্লাহর অক্ষমতা প্রমাণিত হয়?

ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে ভারতসহ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময়ে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের অত্যাচারের চিত্র গুলো ফুটে উঠেছিল তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইটিতে। দেশের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এই অযুহাত দেখিয়ে ‘লজ্জা’ বইটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। 

মসজিদ ভাঙার তথ্য বের করতে গিয়ে বেশ কিছু মসজিদ ও মাজার পেলাম যেগুলা ভাঙা হয়েছে মুসলমান জঙ্গিদের দ্বারা।

বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৫

সার্কাসের দেশ!

৫৭ ধারার খেলা বেশ জমেছে দেখছি। কিছুদিন আগে একইসঙ্গে মূর্তিপূজা ও কোরআন পড়ার অপরাধে সোলেমান ও তার স্ত্রী নূরজাহান বেগম’কে আটক করেছে পুলিশ। নূরজাহান বলেন, “ধনসম্পদ প্রাপ্তিসহ সন্তানের মঙ্গলের আশায় দীর্ঘদিন থেকেই আমরা সাধনা করছি। কিছুদিন আগে স্বপ্নে বাড়িতে
কালীপূজা ও কোরআন তেলাওয়াতসহ জিকির-আসকার করার নির্দেশনা পাই।” সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান বলেন, “একটি মানুষ কখনোই দুটি ধর্মের অনুসারী হতে পারে না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে তাদের আটক করা হয়েছে।” খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কোন ব্যক্তি একই সঙ্গে দুটি ধর্মের অনুসারী হলে ঠিক কোন ধর্মের মানুষের অনুভুতিতে আঘাত লাগে? সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কথা বলা হয়। সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করা যাবে কিন্তু একাধিক ধর্ম পালন করা বা বিশ্বাস করা যাবে না! তাতে নাকি অনুভূতিতে আঘাত লাগে! 


সৌদি আরবের হজ্ব ব্যবসা যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ব্যবসা এই কথা স্পষ্ট করে বলেছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। এরপর তার বিরুদ্ধে মিছিল, গ্রফতার হওয়া, মন্ত্রীত্ব বাতিল সহ নানাভাবে তাকে হেনস্থা করা হল। 


এবারের হজ্বে সৌদি আরবের যুবরাজের যাতায়াতের সুবিধা করতে গিয়ে প্রায় হাজার খানেক লোকের প্রাণ গেলো। যদিও সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রী নাকি বলেছেন, তেরোশ মানুষ আল্লার ইচ্ছাতেই পদদলিত হয়ে মারা গেছে। এই নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়া্র কারণে মোহন কুমার মন্ডল নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাবেক জামাতী নেতা যিনি বর্তমা্নে আওয়ামীলীগের নেতা হয়েছেন, সেই নেতার নাকি ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লেগেছে। তিনি আঘাতের চিকিৎসা নিতে পুলিশের কাছে গিয়ে ৫৭ ধারার মামলা করে এসেছেন। পুলিশের জানা নেই মোহন কি লিখেছেন। তবে আওয়ামীলীগ নেতার দ্রুত চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে মোহন কুমারকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এদিকে শুনছি, সৌদি আরবের মক্কা প্রশাসন ছয়টি কবরস্থানে ৭৪ হাজার ৭০০
কবর প্রস্তুত করছে। এসব কবরে মিনায় পদপিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া কিছুসংখ্যক হাজিসহ অন্যদের দাফন করা হতে পারে। যদিও সৌদি প্রশাসনের মতে মিনায় পদপিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া লোকের সংখ্যা সাতশ। তবে এত কবর কেন? এখানে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, হজ্ব ব্যবসায় ধ্বস নামার ভয়ে মৃতের সংখ্যা গোপন করা হচ্ছে। এরপরও হজ্বকে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ব্যবসা বলা যাবে না, বললেই ৫৭ ধারা। এই হজ্বে আবার যৌন হয়রানিরও অভিযোগ পাওয়া যায়। বড়ই সৌন্দর্য! 
বাংলাদেশের আইনগুলোর মধ্যে সম্ভবত ৫৭ ধারাটাই সবচেয়ে কার্যকর। ৫৭ ধারাটা না থাকলে বুঝতামই না যে বাংলাদেশে আইনকানুন বলে কিছু আছে!

আইএস বলেছিল পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতসহ সারা বিশ্ব দখল করার টার্গেট নিয়েছে। আগেই বলেছিলাম, বিশ্ব দখল করতে পারবে কিনা সেসব জানি না, তবে বাংলাদেশ দখল করতে বেশি দেরী নেই। দেরী নেই জানতাম, তবে এত তাড়াতাড়ি ঘোষণা দিয়ে হত্যা কার্যক্রম শুরু করবে, জানা ছিল না। দেশের বাইরে থাকার কারণে দেশের খবর পেতে হলে ইন্টারনেটই ভরসা। খবর পেলাম, ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক খুনে জঙ্গী সংগঠন আইএসের 'দায় স্বীকার'।
অনেকের ধারনা বাংলাদেশে আইএস, আলকায়দা এইসব জঙ্গি সংগঠন বলতে বিদেশী কিছু জঙ্গি টঙ্গি। দেশে এত জঙ্গি কারখানা মাদ্রাসা থাকতে বিদেশ থেকে জঙ্গি আনার কি দরকার পড়েছে? বাংলাদেশে সব জঙ্গিদের পিতা জামায়েত শিবির, এটা নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়! আর জঙ্গি-জঙ্গি ভাই-ভাই, কাজেই আইএস এর লক্ষ্য পূরণে জামায়েত শিবির এগিয়ে আসবে, স্বাভাবিক।

যাইহোক, দেশ জঙ্গিতে ভরে যাক, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু দেশ নাস্তিক মুক্ত রাখা জরুরী। এর জন্য তো ৫৭ ধারা আর সাথে চাপাতি আছেই। তবে আর চিন্তা কিসের?

দেশে বিনোদনমূলক সার্কাস চলছে, আপনারা উপভোগ করছেন তো?




বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

সিগারেটে পুরুষত্ব!

শুনলাম, বাংলাদেশের সমাজকল্যান মন্ত্রী মহসিন আলী মারা গেছেন। তাঁর সিগারেট খাওয়া নিয়ে একবার বেশ সমালোচনা হয়েছিল। তিনি নাকি কোনো এক স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের সামনেই সিগারেট ধরিয়েছিলেন, এই নিয়ে মিডিয়ায় তুমুল নিন্দার মুখে পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন। 
এটা খুব ভালো যে তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন, কারণ বাংলাদেশে মন্ত্রী-এমপিরা ক্ষমা চেয়েছেন এইধরনের দৃষ্টান্ত তো আগে দেখা যায় নি। মহসীন আলীর মৃত্যুর কথা শুনে তাঁর ওই সিগারেট খাওয়ার কথাটাই মনে পড়ে গেলো। এই সিগারেট নিয়েই ভাবছি আজ কিছু লিখি। 

আমার ক্লাসমেইট ছেলেরা অধিকাংশই সিগারেটের স্বাদ গ্রহণ করেছে। নিয়মিত না হলেও বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় একবারের জন্য হলেও সিগারেট খেয়েছে, অনেকে তো আবার নিয়মিতই সিগারেট খায়। কৈশোরে সিগারেট খাওয়া ব্যাপারটাকে অনেকটা গর্বের ব্যাপার বলে মনে করা হয়। আর এমনিতেও ওই বয়সে যা যা নিষেধ, তার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকেই। তাছাড়া সিগারেট না খেলে বন্ধুবান্ধবের কাছে শুনতে হয়, ‘তুই শালা একটা লেডিস’ আর লেডিসের সাথে তুলনা করা পুরুষ মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি অপমানজনক। লেডিসের পেট থেকে বের হয়, লেডিসের দুধ খেয়ে বড় হয়, তারপর লেডিস শব্দটাই তাদের জন্য অপমানের হয়ে যায়। নিমকহারাম আর কাকে বলে!

 ছেলেদের একটু দাড়িগোঁফ গজালেই শার্টের বোতাম কয়েকটা খোলা রেখে চলা, প্যান্টটা আরও একটু নিচে নামিয়ে আনা, আঙ্গুলের ফাঁকে একটা সিগারেট রাখা, রাস্তায় মেয়ে দেখলে টিজ করা - এইসব না হলে কি আর পুরুষ হওয়া যায়? ছেলেরা যতই বড় হতে থাকে ততই তাদের স্বাধীনতা বাড়তে থাকে। আর মেয়েরা যতই বড় থাকে মেয়েদের জগতটা আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকে। স্বাধীনতার কথা আর না-ই বা বললাম, সে তো জন্মের পর বাবার হাতে, এরপর ভাইয়ের হাতে, ভাইয়ের পর স্বামীর হাতে, মরার আগ পর্যন্ত ছেলের হাতে বন্ধক থাকে। 

তো সিগারেট খাওয়া নিয়ে বলছিলাম। সিগারেট খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু এটা না খেলে যেহেতু ‘লেডিস’ হয়ে যায় কাজেই শরীরের ক্ষতি করে হলেও এটা খেতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই, নিষিদ্ধ কিছুর প্রতি আমার আগ্রহও প্রবল। কাজেই সিগারেট,হুইস্কি, ভদকা--কোন কিছুর স্বাদ থেকেই আমি নিজেকে বঞ্চিত করিনি। কিন্তু আমার মেয়ে-বন্ধুদের অধিকাংশেরই নিষিদ্ধ কিছুর প্রতি তেমন কোন আকর্ষণ নেই কিংবা আকর্ষণ তারা দমন করে রাখে। এমনিতেই যে-কোনো কিছুতেই সবাই মেয়েদের দোষটাই আগে দেখে, কাজেই এইসব সিগারেট বিড়ি ছুঁয়ে না জানি কোন কলংকের ভাগীদার হতে হয়, কাজেই তারা এসব থেকে একশ’ হাত দূরে থাকে। 

নিয়মিত সিগারেটের অভ্যাস না থাকলেও বন্ধুবান্ধবের সাথে থাকলে মাঝেমাঝেই সিগারেট খেতাম। নিষিদ্ধ থাকলেও পাবলিক প্লেসে ছেলেদের সিগারেট খাওয়াটা কোন সমস্যা না হলেও মেয়েদের বেলায় বিরাট সমস্যা। যদিও আমি রাস্তা ঘাটে ছেলে-বন্ধুদের সাথে দিব্যি সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হেঁটেছি, এতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি, কারণ কেউ বুঝতেই পারে নি যে আমি মেয়ে। 

বাংলাদেশে আমার বয়সী একটা ছেলে রাস্তায় সিগারেট খেলে কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাবে না, কিন্তু ওই একই বয়সী একটা মেয়ে যদি সিগারেট হাতে নিয়ে রাস্তায় বের হয় তবে রাস্তার প্রত্যেকটা লোক তার দিকে তাকিয়ে থাকবে, কেউ কেউ হয়তো তাকে সিগারেট ফেলে মাথায় ওড়না দেয়ার উপদেশ দিতেও এগিয়ে আসতে পারে। যেহেতু সিগারেট খাওয়া পুরুষের জন্য অনেকটা বিনোদনের মত, আর বিনোদনের অধিকার তো কেবলই পুরুষের, তাই কোনো নারী পুরুষের অধিকারে ভাগ বসাবে এটা তারা মেনে নেবে কেন?

 সিগারেট শরীরের জন্য ক্ষতিকর, কারো সিগারেটের নেশা করা উচিত নয়। কিন্তু কারো কারো জন্য সিগারেট খাওয়া পুরুষত্বের লক্ষণ, আবার কারো কারো জন্য সিগারেট খাওয়া নিন্দার কারণ, এ কেমন নিয়ম?

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ধর্মের খেলা!



আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতাম না, ওসব আমি ঠিক বুঝতাম না। আরও একটু বড় হওয়ার পর বুঝলাম ধর্ম,ঈশ্বর, -- সবই কাল্পনিক। তখন ভাবতাম ধর্মটর্ম বুঝি আমার মায়ের মত ইমোশোনাল কিংবা দুর্বল হৃদয়ের মানুষরাই পালন করে। ভাবতাম, ইয়াং জেনারেশন নিশ্চয়ই এই জাতীয় কাল্পনিক বিষয়গুলো বিশ্বাস করে না। 

আমার স্কুল জীবনের অধিকাংশ বন্ধু-বান্ধব ফাজিল টাইপ ছিলো। কাজেই আমাদের ফাজলামি থেকে ধর্মও রেহাই পেতো না। ধর্ম বিষয়টাকে কখনো পাত্তা দিই নি।

ধর্ম-ক্লাসে সাধারণত আমাদের ধর্ম-টিচার ধর্ম-বইয়ের গল্প ‘রিডিং’ পড়তেন, সেসব নিয়ে আলোচনা করতেন। একদিন একটা গল্প পড়া শুরু করেলন, গল্পটা হল--একবার ব্রহ্মা বিশ্রাম নিতে কোনো এক আশ্রমে গেলেন। তো দেবতা-মানব-দানব অনেকেই ব্রহ্মার কাছে উপদেশ নিতে এসেছে। ব্রহ্মা সবাইকে এক কথায় উপদেশ দিলেন, ‘দ’। দেবতারা যেহেতু অনেক ধন সম্পদের মালিক তারা ধরে নিয়েছে যে, ব্রহ্মা তাদেরকে ‘দ’ মানে দান করতে বলেছেন। মানবেরা যেহেতু লোভী প্রকৃতির হয়, কাজেই তারা ধরে নিয়েছে, ‘দ’ বলতে ব্রহ্মা তাদেরকে দমন করতে মানে, নিজেদের লোভকে দমন করতে বলেছেন। আবার দানব অর্থাৎ দৈত্যরা ভাবল যে, তারা যেহেতু নির্দয়, ব্রহ্মা তাদেরকে দয়াশীল হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন।

ধর্ম-শিক্ষকের গল্প পড়া শেষ হলে, আমরা বন্ধুরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। একজন বলল, ব্রহ্মা আসলে ‘দ’ বলতে কী বুঝিয়েছিলেন বলতো, আরেকজন বলল, ব্রহ্মা বিশ্রাম নিতে জঙ্গলে এলেন, এরমধ্যে তাকে উপদেশের জন্য বিরক্ত করছিল, তাই বললেন ‘দ’ মানে ‘দূর হও’। আর এইসব মাথা নষ্টগুলো এর কত অর্থ বানিয়ে ফেললো। তারপর এটা নিয়ে কতক্ষন হাসাহাসি হল। তো, এই ছিল আমার ধর্ম। 

মাঝেমাঝে ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, ধর্ম একটি সিরিয়াস বিষয়। অধিকাংশ মানুষই এই বিষয়টাকে ভয় পায়, কাল্পনিক ঈশ্বরের ভয়ে কত কিছুই যে করে! এসব দেখে আমার হাসি পেতো। মনে হতো, আমার মত একটা ছোট মানুষ বুঝতে পারছে যে, ঈশ্বর আল্লাহ সব কাল্পনিক, ধর্ম মানুষেরই সৃষ্ট কিছু নিয়ম, সেখানে বড় মানুষগুলো বোকার মত এসব হাবিজাবি কাহিনী বিশ্বাস করে কেন? 

ধীরে ধীরে আরও একটু বড় হয়ে, বইপত্র পড়ে টের পেলাম যে, ধর্ম কেবলই একটি সিরিয়াস বিষয় নয়, বরং ভয়ংকর সিরিয়াস জাতীয় কিছু। এটি এতই ভয়ংকর যে, এটি রক্ষা করতে মানুষকে খুন করা হয়, নির্বাসিত করা হয়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান সিঁড়ি। 

রাজনীতিবিদরা এই সিঁড়ির প্রতি খুবই যত্নবান। এটা অপরাধ ঢাকার ঢাল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। জঘন্য জঘন্য সব অপরাধ করেও যদি ইমেজ ঠিক রাখতে চান, তবে ধর্মিক ইমেজটা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী। 

আমি এমনিতেই সিরিয়াস টাইপ কিছু ভাবতে পারি না, কাজেই এই ভয়ংকর সিরিয়াস বিষয়টা থেকে সবসময় নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখতাম। কিন্তু দূরে গিয়েও রক্ষা নেই। কেন আমি ধর্ম পালন করি না, এইসব নিয়ে প্রশ্ন, ধর্ম পালনে বাধ্য করা.. এইসবে খুব বিরক্ত হতাম। এভাবে ধর্মের প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কোনো ধর্মের মানুষে প্রতি কোনো রকম ঘৃণা আমার ছিল না। কিন্তু লক্ষ্য করতাম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, এক ধর্মের মানুষের অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণা ভাব থাকেই।





২৪ জুলাই, ২০১৪ সালে অভিজিৎ রায় তার ফেইসবুকের একটি স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশে পাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা’। 

অভিজিৎ রায়ের জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে কিছু লিখব ভাবতেই তাঁর এই স্ট্যাটাসের কথা মনে পড়ে গেলো। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর কলেজের এক বন্ধু মন্তব্য করেছিল, ‘আমাদের দেশে প্রতিদিন কত অভিজিৎ মারা যাচ্ছে, এক অভিজিৎকে নিয়ে এত কান্নাকাটির কী আছে?’ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে কুপিয়ে ফেলে গেলেও কি সে এই জাতীয় কোনো মন্তব্য করবে কিনা। সে চুপ হয়ে গেলো।

অভিজিৎ রায় একজন নাস্তিক ছিলেন, তিনি ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। নিজেকে হিন্দু মুসলিম না ভেবে মানুষ ভাবতেন। মানুষের প্রতি তাঁর কখনো বিদ্বেষ ছিল না, ভালোবাসা ছিল। অভিজিৎ রায়ের মত মানুষ প্রতিদিন জন্মায় না। সমাজটাকে সুন্দর-সভ্য করতে, তাঁর মত মানুষেরা তাঁদের চিন্তা-চেতনা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান। আর যারা চায়, মানুষ নিজেকে মানুষ না ভেবে ধার্মিক ভাবুক, চোখ বন্ধ করে সত্য কে অস্বীকার করুক, তারা অভিজিৎ রায়দের হত্যা করে। কিন্তু হত্যা করলে, ভয় দেখালেই কি সত্য বদলে যায়?



বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বেঁচে ফিরার গল্প

আমি প্রায় বিশ দিনের বেশি সময় ধরে অনলাইনে নেই। অনেকে হয়তো ভেবেছেন আমার আইডি রিপোর্টের কারনে বন্ধ, আসলে তা নয়। আমি আমার অপরাধের সাজা স্বরূপ এতদিন অজ্ঞাত জীবনে গিয়েছিলাম। নিশ্চয়ই জানতে চাইছেন কি আমার অপরাধ? আমার অপরাধ, ৯৯ পারসেন্ট মূর্খের দেশে জন্মে মুক্তচিন্তার চর্চা করা, নিজের মতামত স্বাধীন ভাবে প্রকাশ করা, ধর্মে নয় বরং মানবতার মধ্যেই সকল সমস্যার সমধান খোঁজা। আমি আসলে স্বেচ্ছায় চোখ বন্ধ করে থাকতে ভালোবাসে যারা সেইসব অন্ধের দেশে চশমা বিলি করছিলাম, অথচ আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে যাদের চোখ খুলে দেখার ক্ষমতা নেই, তাদের চশমার কি প্রয়োজন? আমার এই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের শাস্তি প্রদানের ‘মহান’ দায়িত্ব যারা পেয়েছেন তারা গত দুই মাস ধরে আমাকে নিয়মিত ফলো করে যাচ্ছিলেন। না ফেইসবুক-টুইটার-ব্লগে ফলো করছেন না, আমার আদর্শকেও ফলো করছেন না। তারা ফলো করছিলেন আমাকে, আমি কোথায় থাকি, কোথায় পড়ি, কখন কোথায় যাই, সরাসরি আসমান থেকে আসা সেই ‘মহান’ দায়িত্ব কিভাবে সফল করবেন তারই ছক আঁকা হচ্ছিল নানাভাবে।

প্রায় দুই মাস আগে আমি প্রথম বুঝতে পারি আমাকে ফলো করা হচ্ছে। খুব ভোরে, সকাল সাড়ে ছয়টায় আমি কলেজের জন্য বাসা থেকে বের হতাম, নির্দিষ্ট স্থানে আমার কলেজ বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম। প্রায় দুই মাস আগে, একদিন আমি লক্ষ্য করলাম একজন লোক বেশ কয়েকদিন ধরে আমি যেখানে বাসের জন্য অপেক্ষা করি তার পাশে মুখে হাত দিয়ে গৌতম বুদ্ধের ন্যায় মৌন ভাব ধারন করে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আমার দিকে লক্ষ্য রাখে। আমার বাস চলে এলে সেই ব্যক্তি মৌন ভাব ভঙ্গ করে হাঁটা শুরু করে। সে যেমন আমাকে লক্ষ্য রাখছিল আমিও তার কর্মকান্ড পর্যবেক্ষন করে যাচ্ছিলাম। একদিন দেখি ওই ব্যক্তি একা নয়, তার সাথে আরো দুইজন যারা আমার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে এবং আমাকে কোণা চোখে লক্ষ্য রাখে। আর প্রথম ব্যক্তি হাঁটা ধরলে অন্য দুইজন ও তার পিছনে পিছনে চলে যায়। এরপর আমার কলেজ রোজার কারনে সময় বদল করলে তাদেরকে আর দেখি নি। রোজার ছুটি শেষ হলে আমি আবার কলেজে যাতায়ত শুরু করি। পরে কলেজে যাতায়তের জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করি। এরপর আমার বাসার আশেপাশে কিছু অচেনা লোকের আনাগোনা দেখতে পাই। যেহেতু এসব নিয়ে ভেবে আমি কিছুই করতে পারব না, রাষ্ট্র যেহেতু খুনীদের পক্ষে কাজেই আমি এসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমার কাজে মনযোগী হই। নীল হত্যার ঘটনায় যখন আমরা সবাই স্তব্ধ তখন আমার এক বন্ধু ফোন করে জানায়, তাদের কোচিং ছুটির পর দুজন মোটর সাইকেল আরোহী আমার খোঁজ করছিল, তারা কোচিং এর কয়েকজন স্টুডেন্টকে জিজ্ঞেস করছিল আমার সম্পর্কে। আমি কোন এলাকায় থাকি, কোন সিম ইউজ করি, আমার ফোন নাম্বার সবই তাদের জানা, শুধু জানা নেই- কোন বিল্ডিং, কত নম্বর ফ্ল্যাট। ওই দুই মোটরবাইক আরোহী নাকি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, ‘ইনশাল্লাহ, এই সপ্তাহ না পারলে এই মাসের মধ্যেই সব দেখাই দিব’।

এসব জানতে পেরে আমার মা-বাবা ভীত হয়ে সেদিন রাতের অন্ধকারে আমাকে এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আমার ফোন বন্ধ, নেট অফ, সবকিছু অফ, আমি কোথায় আছি সেসব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও জানতো না। এভাবেই কাটছিল আমার দিন। এরপর আমার বাবা মা লক্ষ্য করল, আমার বাবা মা অফিসে যাওয়ার পথে তাদেরকেও ফলো করা হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছিল, আমি লুকিয়ে আছি, কিন্তু কোথায় আছি তা বুঝতে পারছিল না। বাসায় আছি কিনা তা নিশ্চিত করতে দুইজন ছদ্মবেশে আমার বাসায় কলিংবেল দেয়, আমার পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পেরে দারোয়ানকে ফোন করে তাদেরকে নামিয়ে নিয়ে যায়। আমার খোঁজ বের করতে তারা আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত ফলো করে যাচ্ছিল। তাদের দুই মাসের প্ররিশ্রম এভাবে পন্ড হয়ে যাবে তা তারা কিছুতেই মানতে পারছিল না। তাই তারা আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজছিল।

আর এদিকে আমি নিরাপত্তার জন্য একের পর এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছি। ওড়নার আড়ালে মুখ লুকিয়ে চলাফেরা করছিলাম। এরমধ্যে দেশের বাইরের ভিসার কাজ চলছিল। ভিসা পেতেই আর দেরী না করে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জীবন রক্ষার জন্যে দেশ ত্যাগ করি।

‘কি দরকার ছিল এসব লেখালেখির?’ এইপ্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে হতে হয়েছিল এই কয়দিন। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেয়ার কারনেই হত্যা করা হয়েছে অভিজিত-বাবু-অনন্ত-নীলয়দের। কোন ব্লগার হত্যার পর সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করে, ‘কেন? কি লিখতো সে?’ যেন এমন কিছু কথা আছে যা লিখলে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়। আর ব্লগার হত্যার নমুনা দেখে মনে হচ্ছে যেন, বাংলাদেশে সব নাস্তিক কেবল হিন্দু পরিবার থেকে আসা। আসলে হিন্দু পরিবার থেকে নাস্তিক হওয়া ব্লগারদের হত্যা করলে সেটা সাধারন মানুষের মধ্যে গ্রহনযোগ্যতা পায় বেশি। ‘হেন্দু হইয়া আমাগো ধর্মের বিরুদ্ধে কয়, এত বড় সাহস, যা করছে ঠিক করছে’- হিন্দু পরিবার থেকে নাস্তিক হওয়া ব্লগারদের হত্যা করলে এই এক্সট্রা সুবিধাটুকু পাওয়া যায়। আসলে ব্লগাররা কি লিখে না লিখে, আস্তিক নাকি নাস্তিক এইসব ব্যাপারে খুব বেশি চিন্তিত নয় খুনীরা।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কোন বাঁধা না পেয়েই নিজেদেরকে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী করেছে। এতদিন কোন বাঁধা পায় নি, কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করে নি, তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ একটি শব্দ ও উচ্চারণ করে নি। একজন তসলিমা নাসরিন প্রতিবাদ শুরু করেছিল বলে আমরা সবাই মিলে তাঁকে দেশ ছাড়া করলাম। কিন্তু এখন অনেকেই প্রতিবাদ করতে শিখে গেছে। কাজেই যখন থেকে বাঁধা পেতে শুরু হল, যখনই আন্দোলন প্রতিবাদ শুরু হল তখনই তারা বুঝতে পেরেছে, এত বছর তারা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারলেও এখন তা আর সম্ভব হবে না। কাজেই যারা ভবিষ্যতে তাদের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছে তাদেরকেই তারা সরিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রথমে তারা ‘নাস্তিক ব্লগার’ ট্যাগ লাগিয়ে মুক্তচিন্তক ও স্বাধীনতার পক্ষের ব্লগারদের হত্যা শুরু করছে। এই হত্যাকে জায়েজ করতে ‘নাস্তিক ব্লগার’ ট্যাগটা খুব কাজে দিয়েছে, নাস্তিক হত্যার বিচার করতে গিয়ে সরকার ভোট কমাতে চায় না, সাধারণ জনগন ‘নাস্তিক মরছে, তাতে আমার কি?’ এই ভাব নিয়ে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করছে। আর এছাড়া ধার্মিক খুনিরা নাস্তিক হত্যা করে ধর্মমতে কিছু পুণ্য ও অর্জন করে নিচ্ছে। কোন ব্লগারকে হত্যা করা হবে, কারা করবে এইসবই প্রশাসনের জানা। প্রশাসন জানে না, এ আমি বিশ্বাস করি না। শেখ হাসিনাকে নিয়ে অনলাইনেকে কটূক্তি করল তাকে দেশের আরেক প্রান্ত থেকে খুঁজে নিয়ে আসতে পারে আর একেরপর এক খুন হচ্ছে, এসব খুনীদের ধরতে পারে না? হয়তো বলবেন, অভিজিৎ হত্যার সাথে জড়িত তিনজনকে তো গ্রেফতার করা হল। হ্যা। অভিজিৎ যুক্তরাস্ট্রের নাগরিক, এই কেইস নিয়ে এফবিআই ও গবেষনা করছে। সঙ্গত কারনেই এই কেইস নিয়ে সরকার চাপে আছে। তাই অভিজিৎ হত্যার তিনজন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাও প্রকৃত কাউকে ধরছে কিনা তা ও তো বলা যায় না। এফবিআই নীলয় হত্যার ব্যাপারে সাহায্য করতে চাইলে সরকার সাহায্য নিবে না বলে জানায়। নিজেরা অপরাধী ধরতে পারছে না, আবার কেউ সাহায্য করতে চাইলে সাহায্য ও নিচ্ছে না। এতে স্পষ্ট বুঝা যায়, কোন হত্যার রহস্যই প্রশাসনের অজানা নয়।

আইএস ঘোষণা দিয়েছে, পাঁচ বছরের মধ্যেই তারা ভারতসহ সারা বিশ্ব দখলের লক্ষ্যে কাজ করছে। সারা বিশ্ব দখল করতে পারুক কিংবা না পারুক বাংলাদেশ দখল করতে তাদের খুব বেশি সময় লাগবে না। প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, নাস্তিক হত্যা চলছে। আস্তে আস্তে নাস্তিতদের লিস্ট শেষ হলে অন্য লিস্ট আসবে। দেশ নিয়ে আমরা যারা স্বপ্ন দেখি, সভ্য একটি সমাজ ব্যবস্থার জন্য লড়াই করছি তাদের সবাইকেই একে একে হত্যা করা হবে। দেশবাসী নাকে খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে ঘুমান।

‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ আসলেই এমন দেশ আর কোথায় পাবেন? যেখানে খুনীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় আর সতের বছর বয়সী একটা মেয়েকে মুক্তচিন্তা করার অপরাধের শাস্তি দিতে সকলে মিলে চাপাতিতে শান দেয়!

‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’ আমার দেশ নিশ্চয়ই জঙ্গিবাদের রানী। অপরাধীদের জন্য নিরাপদ ভূমি।

যেখানে সরকার-প্রশাসন-অধিকাংশ জনগণ নীরব হয়ে দেশ ধ্বংসের কাজে উৎসাহ যোগাচ্ছে, সেখানে আমরা ক’জন দেশটাকে ভালোবেসে, একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে দেখতে চাপাতির আঘাতে প্রান দিতে পারব, এর বেশি কিছু নয়। তবুও তো আমরা দেশের সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের ন্যায় মুখ বুজে থাকি নি, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কোন অপশক্তির সাথে আপোষ করি নি, এতটুকুই আমাদের সান্ত্বনা।

দেশে আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ালেখা করছিলাম। আগামী বছর ইন্টার পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব কিছু কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। সম্পুর্ন অজানা অচেনা পথে আমি হেঁটে চলছি। এরপর কি হবে আমার জানা নেই।

দেশের কথা ভাবতে গেলেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে। দেশ বলতে দেশের মানুষরা যা বুঝে, পরদেশে বসে দেশ মানে অন্যরকম কিছু মনে হয়, যেন খুব আপন কিছু, অনেকদিনের চেনা, অনেক স্বপ্ন আর ভালোবাসার স্পর্শ।

বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ধর্ম রক্ষার দায় কি কেবল নারীর?

বাংলাদেশ এই কয়েকবছরে হিজাবী নারীর সংখ্যা প্রচুর পরিমানে বেড়ে গেছে। মনে হয় যেন, হিজাব এইদেশের জাতীয় পোশাক। আমি মিশনারি স্কুলে পড়েছি। তাই ওই স্কুলে হিজাব বোরখা এইসব নিষিদ্ধ ছিল। অনেকে স্কুল থেকে বের হলে হিজাব ওড়না জড়িয়ে নিতো, স্কুলে ঢুকলে সেসব খুলে ফেলতো। কলেজে এসে দেখি হিজাবে চারদিক ছেয়ে গেছে। কলেজের বেশির ভাগ ম্যাডাম হিজাব পরে। আমাদের কলেজে ছেলেদের দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ, তবে মেয়েদের হিজাবের ব্যাপারে কোন নিষেধ নেই।

গত বছর শীতকালে ঠান্ডা থেকে বাঁচতে, কলেজে যাওয়ার সময় একটা মাফলার গলায় জড়িয়ে নিতাম। তবে এর অন্য একটি ব্যবহারও ছিল। আমি যখন ক্লাস পালাতাম তখন দূর থেকে আমার ছোট চুল দেখে আমাকে চিনে ফেলতেন অনেক স্যারেরা। তাই শীতাকাল গলায় মাফলার ঝুলিয়ে রাখতাম যাতে শীতও কম লাগে, আবার প্রয়োজনের সময় মাথা মাফলার দিয়ে ঢেকে ক্লাস পালাতেও সুবিধা হয়। যখন আস্তে আস্তে শীত কমতে শুরু করল, তখন এই মাফলার আমার অস্বস্তির কারন হয়ে দাঁড়ালো। ধরা পড়লে পরব, তবে এই মাফলার পেঁচিয়ে থাকা সম্ভব নয়, এই ভেবে মাফলার ত্যাগ করলাম। তখন আমার মাথায় প্রশ্ন এলো, গরম তখনো শুরু হয় নি, অথচ এতেই মাফলার নিয়ে আমার এত বিরক্তি! আর প্রচন্ড গরমে আমার সমবয়সীরা কিনা মাথায় কাপড়ের বস্তা জড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়, তারা কিভাবে থাকে? ভাবতে গেলে খুব খারাপ লাগে। তাদের কষ্ট হয় কিনা জিজ্ঞেস করলে বলে, অভ্যাস হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দেখি গরমে অতিষ্ঠ হয়ে হিজাবীরা ওয়াশরুমে গিয়ে হিজাব খুলে বসে থাকে।

কেন তারা হিজাব পরে, জানতে চাইলে অধিকাংশই বলেছে, তাদের ধর্মে আছে তাই। আবার কেউ বলেছে, আব্বু বলেছে হিজাব পরতে। কেউ বলে ‘খারাপ দৃষ্টি’ থেকে নিজেকে বাঁচাতে হিজাব পরে। 

ধর্মে আছে হিজাব পড়তে তাই পড়েছে, ধর্মে তো আগেও ছিল। আর ধর্মে তো শুধু হিজাব-বোরখা নয়, দাড়ি-টুপি-পায়ের গোড়ালির উপরে প্যান্ট পরার কথা ও আছে। কিন্তু সেসব নিয়ে কয়জন চিন্তিত? তবে হঠাৎ কেবল মেয়েরাই কেন এমন ধর্মকর্মে বিশেষ মনযোগী হয়ে উঠল, এর কারণ আমাকে খুব ভাবিয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা অনেকটা সংক্রামক। কয়েকজন হিজাব পরল, চারপাশের মানুষজন যখন তাদেরকে দেখে যখন ভালো মেয়ে, ধার্মিক মেয়ে ইত্যাদি মন্তব্য করতে লাগলো তখন অন্যেরাও সমাজের চোখে ভালো হতে, ধার্মিক হতে হিজাবের আশ্রয় নিলো। এই যেমন চিত্রনায়িকা হ্যাপি জিন্সের প্যান্ট পড়ে রুবেলের সাথে প্রেম করেছে। যখনই রুবেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মিডিয়ায় এলো তখনই সবাই হ্যাপিকে ‘পতিতা’ উপাধি দিয়ে রুবেলকে জমজমের পানিতে ধোয়া তুলসী পাতা বানিয়ে দিলো। তাই হ্যাপি সমাজের চোখে ভালো হতে জিন্স ছেড়ে হিজাবের আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের সমাজে মেয়েরা সবসময় ভালো মেয়ে, ভদ্র মেয়ে, ধার্মিক মেয়ে হওয়ার চেষ্টা করে। কারণ যা কিছুই হোক না কেন, দোষ তো মেয়েরই হবে। কাজেই মেয়েরা এই বিষয়ে খুব সচেতন।

ছবিটি গতবছর চিটাগাং এর বিনোদন পার্ক ফয়েজলেইক থেকে তোলা
আমার এক হিজাবী বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম, হিজাব নিয়ে তার বিরক্তির শেষ নেই। সে বলে সব কিছুর মূলে হল তার আম্মু। তার আম্মু তার আব্বুর নির্দেশে বোরখা পড়ে এবং আমার ওই বন্ধুকেও বাধ্য করে হিজাব পরতে। সে সব কিছুর মূলে তার আম্মুর দোষ খুঁজে পায়। কিন্তু আমি খুঁজে পাই, ধর্মের দোষ।

বোরখাওয়ালীরাও আনন্দ করতে চায়, তখন তারা অনুভব করে যে বোরখা খুব বিরক্তিকর। তারা তাদেরকে যে বোরখা পরতে বাধ্য করছে, যেমনঃ বাবা, ভাই, স্বামী, তাদের উপর রাগ দেখায়। তারা ভুলে যায় যে, তাদেরকে বস্তাবন্দী থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ধর্মে। আমরা নাস্তিকরা যদি সেটা দেখিয়ে দিই যে, মূল সমস্যা তোমার পিতা বা স্বামী না, মূল সমস্যা হল ধর্ম, এইসব ধর্মের সৃষ্টিকর্তা হল পুরুষ, তখন এইসব বোরখাওয়ালীরা এর প্রতিবাদ করে, তখন তাদের ধর্ম অনুভুতিতে আঘাত লাগে। তারা মুক্তি চায়, আবার মুক্ত করার রাস্তায় হাঁটতে চায় না। তাদেরই বা দোষ কিভাবে দেই? তারা তো নিজের চিন্তা বুদ্ধি বিবেক বলে যে কিছু আছে, নিজের মতামত বলে যে কিছু একটা আছে, সেটাই জানে না। কারণ জন্মের পর থেকেই তাদের শুধু প্রভুর নির্দেশ অনুযায়ী চলার ট্রেনিংই দেয়া হয়েছে। তারা তাদের নিজস্ব বুদ্ধিবিবেক বিবেচনা বন্ধক রেখেছে ধর্ম আর পুরুষতান্ত্রিকতার হাতে ।

চট্টগ্রামে নার্সিং কলেজের অঞ্জলি নামের এক শিক্ষক তার ছাত্রীদের হিজাব না পরার কথা বললে কয়েকদিন পরই তাকে প্রাণ হারাতে হয় মৌলবাদীদের হাতে। এটা খুব স্পষ্ট যে, এক শ্রেনির মানুষ খুব সচেতন ভাবে মেয়েদের হিজাবী বানানোর ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। কেউ বাধা দিলেই তাকে মেরে ফেলছে।

কেন মেয়েরা সব একসাথে তসলিমা নাসরিনের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলছে না যে, ‘যৌন উত্তেজনা বেড়েছে তোমার, সে তোমার সমস্যা, আমার নয়। তোমার সেটি বাড়ে বলে আমার নাক চোখ মুখ সব বন্ধ করে দেবে, এ হতে পারে না। আমি তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নই’? নিজেকে অন্যের সম্পত্তি ভাবে বলেই মেয়েরা হিজাব পরে, বোরখা পরে, স্বামীর মঙ্গলের জন্য সিঁদুর পরে। নিজের ভালো লাগা ভুলে গিয়ে অন্যের ইচ্ছায় জীবন চালায়। আমাদের দেশের মেয়েদের নিজের বলে কিছু নেই, তারা নিজেরাই অন্যের সম্পত্তি। কি অসহায় তারা, তাই না? ভাবতে খুব কষ্ট হয়।

শনিবার, ১ আগস্ট, ২০১৫

নারীবাদ কি মানবতাবাদের বাইরে কিছু?


 আমি যখন নারীবাদ নিয়ে লিখি, অনেকেই বলে,
নারীবাদ পুরুষবাদ এসব বাদ দিয়ে বরং মানবতাবাদ নিয়ে লিখুন। আবার তারাই বলে, নারীদের অধিকার আদায়ে নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তারা যদি মানবতাবাদেই বিশ্বাসী হয়ে থাকে, তবে তারা কেন বলে না যে, মানুষের অধিকার আদায়ে মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে! আর তখনই আমার কাছে তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি যখন নারীবাদ নিয়ে লিখি তখন তারা আমাকে থামিয়ে দেয়ার জন্য মানবতাবাদ নিয়ে লেখার পরামর্শ দেয়। তবে কি তারা মনে করে, নারীবাদ মানবতাবাদের বাইরে কিছু? নারী কি মানব শ্রেনির বাইরের কোন প্রানী? 

অনেকে আবার নারীবাদ আর পুরুষতন্ত্র এই দুই বিষয়কে এক করে ফেলে। নারীবাদ নারীর অধিকারের কথা বলে। আর পুরুষতন্ত্র নারীর অধিকার খর্ব করে পুরুষ লিঙ্গ ধারনের কারনে বিশেষ সুবিধা ভোগের কথা বলে। নারীবাদ মানে তো পুরুষের অধিকার খর্ব করা নয়। তবে এই দুটো বিষয় এক হল কি করে?

কিছু সুবিধাবাদীদের মতে, পুরুষতন্ত্রের পক্ষে কথা বলা যেমন ঠিক না, ঠিক একই ভাবে নারীবাদের পক্ষে কথা বলা ও ঠিক না।

আচ্ছা ধরুন, দুইজন মানুষ একজনের বিলাসী জীবন অন্য জনের বিলাস তো দূরের কথা নিজের বলে কোন কিছু নেই। নেই, কারণ তাকে দেয়া হচ্ছে না। আমি যদি সেই মানুষটির পক্ষে কথা বলি তবে সেটা কি মানবতাবাদ নয়? এখন যদি আপনি বলেন যে, যেই ব্যাক্তি বিলাসী জীবনযাপন করে তার পক্ষে কথা বলা যেমন খারাপ, তেমনি যেই মানুষটি অন্যের দাস হিসেবে জীবনযাপন করে, তার দাসত্ব অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য কথা বলা ও খারাপ, তবে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়? 


বিয়ের আগে বাবার বাড়ি, বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি। বাবার বাড়ি চলে বাবার নিয়মে, স্বামীর বাড়ি চলে স্বামীর নিয়মে। একবার ভেবে দেখুন তো আমাদের সমাজে মেয়েদের নিজের বলে কিছু আছে কিনা, নারী নিজেই নিজের না, অন্যের ইচ্ছায় বাঁচে, অন্যের মত করে চলে। আর নারীবাদ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে।

আর যেসব সাহসী নারীরা নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়, সমাজের প্রগতিশীল পুরুষেরা তাদের থামিয়ে দিতে নারীবাদের সীমা সৃষ্টি করে দেয়। তাদের সৃষ্ট সীমা মেনে চললে সেটা নারীবাদ। আর তাদের সৃষ্ট সীমার বাইরে গেলেই, সেই নারী পতিতা বেশ্যা 

নারীর কন্ঠরোধ করে যারা নারীবাদী হয়, নারীর কথা গুলো নারীকে বলতে না দিয়ে যারা পুরুষের কথাগুলোই নারীবাদ নামে প্রচার করে নারীবাদের সীমা সৃষ্টির করার চেষ্টা করে। এসব প্রগতিশীলেরা প্রগতিশীল বটে, তবে তারা কেবলই প্রগতিশীল পুরুষ, প্রগতিশীল মানুষ নয়। তাদের সব প্রগতি পুরুষের স্বার্থে। তারা অফিসে কর্তার চেয়ারে বসে, কর্তার এখন একটা সুন্দরী এসিস্ট্যান্ট লাগবে বলে কর্তাবাবু মধ্যযুগীয় প্রথা থেকে নারীকে বের করে আনতে চায়। তবে সেটা নারীর জন্য নয়, একজন সুন্দরী এসিস্ট্যান্ট এর সঙ্গ পাওয়ার জন্য। 

নারীর অধিকার নিয় আদৌ তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। নারীর দুঃখকষ্ট গুলো তাদেরকে মোটেই স্পর্শ করে না। দুঃখের বিষয় হল, আমাদের সমাজে প্রগতিশীল মানুষের চেয়ে প্রগতিশীল পুরুষের সংখ্যায়ই বেশি। তাই নারী নিয়ে প্রেম ভালোবাসার গদ্য-পদ্য-গান লেখার অনেক মানুষ পাওয়া গেলেও নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলার মানুষের দেখা পাওয়া যায় না।