বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৭

কপি পেস্ট লেখিকা

তসলিমা নাসরিনের একটি কলামে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন। জান্নাতুন নাঈম প্রীতি তাঁর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে এ কথা বলেছেন, হুমায়ুন আহমেদ আসলে পুরুষতান্ত্রিক নন।

যখন ক্লাস ৬-৭ এ পড়ি, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসগুলো পাগলের মত পড়তাম। হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র ‘হিমু’। টানা হিমু পড়তে পড়তে ঠিক করে ফেললাম আমিও হিমু হবো। নিজেকে তখন হিমু ভাবতে শুরু করলাম। তখন সবেমাত্র ফেসবুক একাউন্ট খুলেছি। সার্চ করে পেয়ে গেলাম হিমুদের কয়েকটি গ্রুপ। একটি গ্রুপে মেম্বার ও হয়ে গেলাম। আমার মত আরও অনেক হিমুরা আছে গ্রুপে। আমরা সবাই হিমু, সে কী উচ্ছ্বাস! গ্রুপে হিমুদের পোস্ট পড়তে পড়তে আমিও একদিন সাহস করে পোস্ট করলাম, মেয়ে হিমু কে কে আছে জানতে চেয়ে। তখন গ্রুপের কয়েকজন আমাকে জানালেন, মেয়েদের আসলে হিমু হওয়া সম্ভব না। মেয়েরা তবে কী হয়? মেয়েরা রূপা হয়। রূপার মত রূপবতী হবে, রূপার মত হিমুদেরকে ভালোবাসবে, নীল শাড়ি পরে নীল পদ্ম হাতে হিমুদের জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু আমি তো রূপা হতে চাই না, আমি হিমু হতে চাই। হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে মাঝরাতে হেঁটে বেড়াতে চাই। শুরু করলাম তর্ক। তখন গ্রুপের কয়েকজন আমাকে হিমু উপন্যাস থেকে লাইন কোট করে দেখালেন, মেয়েদের সম্পর্কে হিমুর কী ধারণা। আর হিমুর পিতা অর্থাৎ হিমুর লেখক মেয়েদের চরিত্র নিয়ে যেসব বাণী দিয়েছেন, যেগুলো অনলাইনে সার্চ করলেই পাওয়া যায়, আমাকে সেসব দেখালেন অনেকে। যেমন- মেয়েদের দুটি জিনিস খুব খারাপ, একটি হচ্ছে সাহস অন্যটি গুয়ার্তুমি/ মেয়েদের বেশি বুদ্ধি ভাল না।বেশি বুদ্ধির মেয়ে কখনো সুখী হয় না। সংসারে যে মেয়ের বুদ্ধি যত কম সে তত সুখী ইত্যাদি ইত্যাদি। সব হিমুরা মিলে প্রমাণ করে দিলেন আমার হিমু হওয়া আসলে সম্ভব নয়। আমি রাগে দুঃখে অপমানে গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর একসময় হিমুর নেশা কেটে গেল, ভুলেও গেলাম সব।

হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ গল্পের মূল চরিত্রের মেয়েটি থাকে অত্যন্ত রূপবতী। তাদের রূপই তাদের গুণ। তাঁর গল্পগুলোর মত তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁর পুরুষতান্ত্রিকতার পরিচয় মিলেছে। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এইচএসসিতে হলিক্রসে পড়তাম। পরীক্ষার ৩ মাস আগে আমার বাচ্চাদের বাবা (হুমায়ূন আহমেদ) আমাকে জোর করে ইউএসএ নিয়ে গেল। পরীক্ষা দেওয়া হল না। আমি যেতে চাইনি। শেষে আমার দাদাকে চিঠি লিখে আমাকে যেতে বাধ্য করল। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। মেডিকেলে পড়তে পারলাম না।'
এইচএসসির মত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষায় হুমায়ূন আহমেদ চাইছিলেন না তাঁর স্ত্রী অংশগ্রহণ করুক।

যাইহোক তিনি পরবর্তীতে এইচএসসি পাশ করলেন। গুলতেকিন লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে হুমায়ূন আহমেদ জানালেন, ‘তোমাকে ইডেনে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছি। মেডিকেলতো পারছোই না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও না।’

গুলতেকিন আহমেদ পরে জানতে পারলেন লং গ্যাপ হলেও তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ আছে। হুমায়ুন আহমেদের কাছে এ ব্যাপারে বললে, তিনি সোজা জানিয়ে দিলেন, তিনি এ বিষয়ে কোনও হেল্প করতে পারবেন না। গুলতেকিন হুমায়ূন আহমেদকে অবাক করে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেন এবং বেশ ভালো নম্বর পেয়েই চান্স পেয়েছেন। গুলতেকিন আহমেদকে হুমায়ুন আহমেদ পরামর্শ দিলেন সোশ্যালজি নিয়ে পড়তে। এ বিষয়ে গুলতেকিন আহম্মেদ তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভাইভার দিন স্যার আমাকে বললেন, তুমি ইংলিশে পড়। আমি বললাম- না। আমি সোশ্যালজি লিখে দিয়ে আসলাম। বিকেলে আমার এক্স হাজবেন্ড আসলেন। বললাম, তোমার কথায় সাবজেক্ট সোশ্যালজি দিয়েছি।সে বলল, খুব ভাল। তুমি ইংলিশ পারবে না। তোমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। ..আমার খুব ইগোতে লাগল। কেন বলল, আমি ইংলিশ পারবো না! আমি ডায়েরি থেকে ফোন নম্বর নিয়ে যে স্যার ভাইভা নিয়েছিলেন তাকে ফোন করলাম। বললাম, স্যার আমি কি সোশ্যালজির পরিবর্তে ইংলিশ নিতে পারি? তিনি বললেন- হ্যাঁ। আর একটা কথা খুব ইগোতে লেগেছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হুমায়ূন বলেছিল, আমাকে সে পোষ্য কোটায় ভর্তি করাতে চেয়েছিল। আমি কেন পোষ্য কোটায় ভর্তি হব!’

হুমায়ূন আহমেদ চান নি তাঁর স্ত্রী লেখাপড়া করুক, স্বাবলম্বী হোক। চেয়েছিলেন, স্ত্রী যেন অল্প শিক্ষিত হয়, যেন স্বামীর উপর নির্ভরশীল থাকে, আর নির্ভরশীল থাকা মানেই স্বামীর সকল অন্যায় মুখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হওয়া। সেটি শেষপর্যন্ত হল না। গুলতেকিন শিক্ষিত হলেন, স্বাবলম্বী হলেন। কাজেই অন্যায় আর মুখে বুজে মেনে নেয়ার কারণ নেই।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মেয়ের বয়সী একজনের প্রেমে পড়লেন। গুলতেকিনের সাথে তাঁর ডিভোর্স হল। তাদের সন্তানদের নামে হুমায়ূন আহমেদের নামের চিহ্ন থাকলেও সন্তানদের দায়িত্ব গেল গুলতেকিনের কাছে, যার নামের কোনও চিহ্ন নেই সন্তানদের নামের পাশে।

এত কিছুর পরও লেখিকা প্রীতি মনে করেন হুমায়ূন আহমেদ পুরুষতান্ত্রিক নন। তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে হুমায়ূন আহমেদকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তিনি একটি ছবি দেখেছেন যেখানে তসলিমা নাসরিন হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন, কাজেই এটি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ না হয়ে যায় না। অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তি। আর ওই ছবিটির প্রেক্ষাপট তসলিমা নাসরিন আগেও বলেছেন। ওইদিন প্রীতির স্ট্যাটাসে তসলিমা নাসরিনের ছোট বোন রোকসানা ইয়াসমিন আবার সেইদিনের কথা প্রীতিকে জানালেন। কারণ ওই সময় ইয়াসমিনও তসলিমা নাসরিনের সাথে ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের আমন্ত্রণে তসলিমা ও ইয়াসমিন বইমেলা থেকে একটি চায়ের স্টলে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কিছু ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন এবং তসলিমা নাসরিন ও তাঁর বোন অপেক্ষা করছিলেন। এই তথ্যটি জেনেও প্রীতি স্ট্যাটাসটি এডিট করবেন না, কারণ তিনি মনে করেন না তিনি কোনও ভুল তথ্য লিখেছেন, তিনি বরং মনে করেন তসলিমা নাসরিন এবং তাঁর বোন মিথ্যে বলছেন। আমি সেখানে কমেন্ট করলে প্রীতি বললেন, আমি নাকি নাক গলাচ্ছি। পাবলিক কমেন্টে যার যা ইচ্ছে কমেন্ট করে, সেখানে আমি ওই স্ট্যাটাসের সাথেই প্রাসঙ্গিক একটি কমেন্ট করলে প্রীতি বড়ই বিরক্ত হলেন। যুক্তি তর্ক আলোচনা এসবে তিনি বড়ই বিরক্ত হোন তা অবশ্য কয়েকদিন আগে বুঝেছি। আমি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছি, যাতে তিনি মনে করলেন আমি তাঁর বাণী নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, সাথে সাথে তিনি আমাকে আনফ্রেন্ড করলেন এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্লক করতে ভোলেন নি।

আবার ফিরে যেতে হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে। কারণ লেখিকা প্রীতি এটি নিয়ে এরমধ্যে আরও একটি স্ট্যাটাস লিখেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মেয়ের বয়সীর সাথে বিয়ে করে সংসার করতে লাগলেন। এতে তাঁর জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়ে নি। পুরুষ বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। কোনও নারীর পক্ষে কি সম্ভব ছিল ছেলের বয়সী কাউকে নিয়ে সংসার পাতানো, কোনও রকম সামাজিক সম্মানহানি ছাড়া? এ কথাটিই তসলিমা নাসরিন তাঁর লেখায় বলেছেন। কিন্তু লেখিকা প্রীতি মনে করেন, অবশ্যই সম্ভব। উদাহরণ দেখালেন সুবর্ণা মোস্তফার। সুবর্ণা মোস্তফা তাঁর চেয়ে কম বয়সী পুরুষকে বিয়ে করেছেন। ৪৮ বছর বয়সী পুরুষ ২০-২৫ বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করছে এতো সমাজে অহরহ ঘটছে। সেখানে সুবর্ণার বয়স যখন ৪৮ তখন তিনি বিয়ে করলেন ৩২ বছর বয়সী পুরুষকে। তারপরও সুবর্ণার কি কম সমস্যা পোহাতে হয়েছে বা হচ্ছে? এখনও সুবর্ণাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রশ্ন আসে সুবর্ণার চরিত্র নিয়ে, কারণ তিনি তাঁর চেয়ে কম বয়সী একজন পুরুষের সাথে প্রেম করেছেন। যেন তসলিমা নাসরিন এটি জানতেন না। সুবর্ণা সেলেব্রেটি হয়েও এত বিতর্কিত হলেন সেখানে একজন সাধারণ নারীর পক্ষে আমাদের সমাজে এটি সম্ভব? তসলিমাকে তিনি ভুল প্রমাণ করে বললেন, প্রেম ভালোবাসা গোপন রাখতে নেই, অন্যায় নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথা আমরা তসলিমা নাসরিনের বই পড়ে আগেই জেনেছি। তসলিমাকে ভুল প্রমাণ করে যেসব জ্ঞানের কথা তিনি বললেন সেসব আসলে তসলিমার কাছ থেকে ধার করা। অবশ্য এগুলো যে তসলিমা বলেছেন তা তিনি উল্লেখ করেন নি। বিশ্বাস করুন, যদি ফেসবুকের বাইরে দু একটা বই আমার পড়া না থাকতো তাহলে আমিও প্রীতির ভক্ত হয়ে যেতাম। যেহেতু কিছু বই পড়েছি তাই শাহরুখ খান, আমির খান, অমিতাভ বচ্চন, হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর ভাই পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী(তাঁর ভাষ্যমতে) মাসুম আব্দুল্লাহকে নিয়ে প্রীতির লেখা অনুপ্রেরণামূলক গল্পগুলো ছাড়া বাকি অধিকাংশ লেখা পড়লেই স্মৃতি নড়েচড়ে উঠে। মনে হয় কোথায় যেন পড়েছি। হয়তো একটু এদিক সেদিক হতে পারে, তবে ঘটনাটা এটাই।
আমরা ফেসবুকে যা লিখি এসব আসলে নতুন কিছু নয়। কেউ নিজেদের নামের জন্যে, পুরষ্কারের জন্য লিখি না। তাই একই কথা যদি লিখেও থাকে নিজের মত করে সেটাও অনেক সময় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু যখন আপনি যার কাছ থেকে শিখেছেন, যার লেখা কপি করছেন নিজের ভাষায়, তাঁকেই ভুল প্রমাণ করতে মাঠে নামেন? 

আপনি যা লেখেন তা যে আপনি কপি করছেন না, এটা প্রমাণের জন্য যার কাছ থেকে কপি করছেন তাঁর বিরুদ্ধে মাঝেমাঝে বলা খুব জরুরী হতে পারে। তবে এটা খুব অন্যায়। পাঠকের সাথে এবং আদর্শের সাথে ভণ্ডামী।

শুরুতে তসলিমার নাম নিয়ে আলোচনায় আসা, যথেষ্ট আলোচনা হল, এখন তসলিমার নিন্দা করে সম্মান পেতে হবে। অন্যদের মত সুর ধরলেন ‘তসলিমা নাসরিনের সব বিষয়ের সাথে একমত নই’ তসলিমা নারীবাদ, মানবতাবাদ, সমতায় বিশ্বাসী। প্রীতি এরমধ্যে কোনটির সাথে একমত নন সেটা প্রীতিই ভালো বলতে পারবেন। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন- এই কথা যখন বলেছেন একসময় হয়তো বলবেন পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে তসলিমা যা বলেছেন তা আসলে পুরুষবিদ্বেষ থেকে বলেছেন। এসব বলে হয়তো সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যাবে কিন্তু আদর্শের লড়াই থেকে অনেক দূরে সরে যাবেন।

মানবতা যখন ধর্ষকের শিশ্নের ডগায়!

মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার কিছুদিন আগে তার ডাক্তারী জীবনের একটি ভীষণ অমানবিক অভিজ্ঞতার কথা তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে শেয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর ডাক্তারী জীবনে একটি কেইস পেয়েছিলেন যেখানে একজন ধর্ষক ধর্ষণ করতে গিয়ে তাঁর যৌনাঙ্গটি ক্ষতবিক্ষত করে নিয়ে এসেছিলেন। ভিক্টিম নারীটি ধর্ষকের পুরুষ যৌনাঙ্গটি সম্পূর্ণ কর্তন করতে পারেননি। কিন্তু হাসপাতালে দেরী করে আসার কারণে অধ্যাপক তাঁর অর্ধকর্তিত যৌনাঙ্গটি মেরামত করতে পারেননি। কেটে ফেলতে হয়েছিলো তাঁর পুরুষাঙ্গটির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। যারা ডাক্তার নন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার চাইতে একজন মানুষের মৃত্যু হওয়াও ভালো। কেননা, এটা শুধুমাত্র পুরুষের যৌনতা হারানো নয়, এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কাজ মুত্র ত্যাগের এর সাথে জড়িত। স্বাভাবিক মুত্র ত্যাগের ব্যাঘাত ঘটলে একজন মানুষ মারাও যেতে পারেন। তাঁর চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে এই ধরনের রিপেয়ার বা মেরামতের পরে রোগীকে প্রায় প্রতিমাসেই হাসপাতালে হাজিরা দিতে হয় তাঁর মুত্রনালীকে সচল রাখার জন্য এবং এই কাজটি তাকে প্রায় সারাজীবন করতে হয়।” তিনি আরও বলেছেন,“এর পেছনে টাকা খরচ আছে, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট আছে। এটা অমানবিক। এটা ভীষণ অমানবিক।”

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? ভিক্টিম নারীটি যদি কোনও রকম আত্মরক্ষার চেষ্টা না করে ধর্ষণের শিকার হয়ে যেতো তাহলে তাকে আমরা ‘ধর্ষিতা’ হিসেবে সহানুভূতির চোখে দেখতাম। তিনি যদি ধর্ষণের বিচার চেয়ে বছরের পর বছর আদালতে হাজিরা দিতেন, অর্থ, শারিরীক ও মানসিক কষ্টে দিন যাপন করতেন তাহলে তাঁর দুঃখে চুক চুক করে দুঃখ প্রকাশ করতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু নারীটি ধর্ষককে প্রতিরোধ করতে ধর্ষকের যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছেন সেক্ষেত্রে আমাদের মানবতার নেক নজরে উনি আসবেন না, আসবে ধর্ষক। কারন তাঁর মহামূল্যবান যন্ত্রটি, যার গর্বে তিনি ‘তরে চুদি, তর মায়েরে চুদি, বোইনরে চুদি’ নিত্ত নৈমিত্তিক কথা বলতেন সেই কনফিডেন্সটি তাঁর থাকছে না। তাই এক্ষেত্রে সারওয়ার সাহেব নারীটিকে কাঠ গড়ায় দাঁড় করালেন। নারীটি যে কত বড় অমানবিক তা জানালেন। ধর্ষণ করতে গিয়ে লিঙ্গ হারানো মানুষের বেদনা সম্পর্কে জানালেন। তাঁর ডাক্তারী জীবনে হয়তো কোনও গণধর্ষণের শিকার হওয়া নারীকে তিনি দেখেন নি, দেখন নি পূজার মত শিশু, যাদেরকে ধর্ষণ করতে যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কাটা হয়, দেখেন নি ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রাণ হারানো কারও শরীর, ধর্ষণের পর যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়ার কাহিনীগুলোও হয়তো ওনার কানে আসে নি কখনো।

একজন মানুষ আক্রন্ত হলে সে নিজেকে বাঁচাতে ওই মুহূর্তে কী করতে পারে তা আমি আপনি বলে দিতে পারি না। আমাকে কেউ ধর্ষণ করতে আসলে আমি অবশ্যই সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তাকে প্রতিরোধ করার, এতে তার বিচি গেল না দণ্ড গেল সেটা নিয়ে ভাবতে যাব না। ধর্ষকের লিঙ্গ যেমন গুরুত্বপূর্ণ আমারটাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সারওয়ার সাহেবেরা মনে করেন, আর যাই করো ধর্ষকের লিঙ্গ মেরামোত অযোগ্য করো না, এ বড় অমনাবিক।


এ বিষয়ে ওমর ফারুক লুক্স একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আইনকানুন-শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে যা বলেছেন সেসবের সাথে একমত না হওয়ার কারন নেই। তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে কি ধর্ষণের হার কমানো যায়?’ অবশ্যই না। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে বছর খানেক হল। তাহলে তিনি কেন মনে করলেন, ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে লিঙ্গ কেটে ফেলার মত কোনও বর্বর আইন হতে যাচ্ছে? এরকম আইনের জন্য কোনও মিছিল সমাবেশ ও বাংলাদেশে হয় নি কখনো। ‘ধর্ষণ করা উচিত হয় নি। কিন্তু কোনও ভদ্র ঘরের মেয়ে সন্ধ্যায় ছেলেদের পার্টির দাওয়াতে যায়?’ সন্ধ্যায় ছেলেদের পার্টির দাওয়াতে যাওয়া মানেই ধরে নেয়া হয় তারা ধর্ষণের অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। ‘এসব মেয়েরা আসলে ধর্ষিত হতেই যায়।’ ‘ধর্ষণ করা ঠিক হয় নি, কিন্তু আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ধর্ষকের বিচি ছ্যাচে দেয়াও ঠিক না। এ ভীষণ অমানবিক।’ - এই মানসিকতা যতদিন সমাজে থাকবে ততদিন ধর্ষণ নানা ভাবে বৈধতা পাবে।

তিনি আরও বলেছেন, “ধর্ষণের আগেই ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। আসলেই ধর্ষণ হয়েছে কিনা, পুরুষটির ধর্ষণের উদ্দেশ্য ছিলো কিনা- আদালত সেটা কিভাবে প্রমাণ করবে?”

তাহালে আমরা জানলাম, ধর্ষক যে আসলেই ধর্ষণ করতে এসেছিল এটি মহামান্য আদলতে প্রমাণের স্বার্থে ধর্ষিত হয়ে আদালতে যেতে হবে। আগে ভাবতাম মাথায় মগজের জায়গায় বিচি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর পক্ষেই এধরণের কথা বলা সম্ভব। এখন জানলাম,মাথায় মানবতা থাকলেও এধরণের কথা বলা যায়। কত কিছু যে জানার বাকি!

‘মওলানা দূরের পাখি’ নামের একটি আইডি চোর, ছিনতাইকারী, ছেলেধরা সন্দেহে গনপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা অপরাধগুলোর সাথে ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষায় যৌনাঙ্গে আঘাত করার তুলনা দিলেন। চোর ছিনতাইকারীদের সন্দেহ করে গণপিটুনি দেয়া হয়, ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষক যদি আপনাকে লিঙ্গের জোর প্রদর্শন করতে না আসে কেবল ইশারা ইঙ্গিতে ধর্ষণের সন্দেহ করে লিঙ্গ কেটে ফেলা কি সম্ভব? আর যেই স্ট্যাটাসটি থেকে এই ইস্যুর সুত্রপাত সেখানে সারওয়ার সাহেব স্পষ্টই বলেছেন, ওই ব্যক্তি ধর্ষণ করতে গিয়ে লিঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে এনেছেন।

১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের মধ্যে ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে।

২০১০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৪২৭টি। এর মধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে ২ হাজার ৭৩৪টি। গত ছয় বছরে ধর্ষণের পর ৫০৮ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। তবে হত্যা করার পরও সব পরিবার মামলা বা আইনি আশ্রয় নেয়নি। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ২৮০টি ঘটনায়। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৬৮ নারী এবং মামলা হয়েছে মাত্র ১১৩টি।

http://www.prothom-alo.com/we-are/article/813160/

মানবাধিকার ও আইন সহায়তাকারী বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিভিন্ন গণমাধ্যম পর্যলোচনা করে নারী ও শিশু নির্যাতনের নানা ঘটনা সংরক্ষণ করে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৭২৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সী শিশু ৬২ জন, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ১৭৮ জন এবং ১৩ থেকে আঠারো বছর বয়সীর সংখ্যা ২৫১ জন। অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার হওয়া প্রায় সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত মোট ২৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যাদের ২০ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ রকম বিভিন্ন সংস্থার হিসাবেও একথা স্পষ্ট যে ধর্ষণের মতো নির্মম ঘটনার শিকার হওয়াদের অধিকাংশই শিশু।

https://www.jugantor.com/online/national/2017/03/21/42653/

২০১৭ সালটা শেষ হলেই ১৭ সালের তালিকাটাও পেয়ে যাবেন। আমি জানি লেখাটা পড়ার সময় অনেকেই এই সংখ্যার তথ্যগুলো এড়িয়ে যাবেন। এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। কারন এগুলো পত্রপত্রিকায়-প্রশাসনের খাতায় লিপিবদ্ধ হওয়া ধর্ষণগুলোর একটি পরিসংখ্যান মাত্র। ধর্ষণ যখন দেশে নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে, এরকম অবস্থায় কোনও মেয়ে যদি আত্মরক্ষার্থে ধর্ষককে আঘাত করে, সেটা মাথায় হোক কিংবা ধর্ষকের বিচির মাথায় আমি মেয়েটিকে বাহাবাই দিব। কারন সমাজে মেয়েরা নিজেদের সম্পর্কে ‘দূর্বল, কোমল, শক্তি নেই’ ইত্যাদি শুনতে শুনতে অনেক সময় নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তাই ধর্ষনের হাত থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু না করে নিজের শরীরের উপর সকল অত্যাচার নির্যাতন সয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কোনও মেয়ে যদি আত্মরক্ষার্থে ধর্ষককে আঘাত, ক্ষতবিক্ষত করে নিজেকে মুক্ত করতে পারে তাহলে অন্য মেয়েরাও জানবে পাল্টা আঘাতের ক্ষমতা মেয়েদের আছে। পুরুষাঙ্গের গর্বে যারা মেয়েদেরকে দূর্বল, যৌনবস্তু ভাবে তারাও জানবে ওটি হাত, পা, চোখ, মাথার মত নিরীহ একটি অঙ্গ মাত্র। আর বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১০১ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের সময় আত্মরক্ষার্থে ভিকটিম যদি ধর্ষককে মেরে ফেলে বা শরীরের খুব “গুরুত্বপূর্ণ কোনও অংশ” পারমানেন্টলি ড্যামেজ করে দেয়, আত্মরক্ষার অধিকারবলে (Right to Private Defence) সে আইনের পূর্ণ সুরক্ষা পাবে।

নারীবাদীরা কি পুরুষাতঙ্ক ছড়াচ্ছে?

অভিযোগ উঠেছে, অনলাইনের নারীবাদীরা নাকি নারীবাদের নামে পুরুষাতঙ্ক ছড়িয়ে কিশোরীদের পুরুষবিদ্বেষী করে ফেলছে।


যে পোশাকই পরুক, বুকের ওপর ওড়না নামক অতিরিক্ত কাপড়টি মেয়েরা কাদের আতঙ্কে জড়ায়? মেয়ে সময় মত বাড়ি না ফিরলে অভিভাবকের দুঃশ্চিন্তা বাড়ে কাদের আতঙ্কে? কলেজের ছেলে বন্ধুরা কত জায়গায় ঘুরতে যেত। অথচ শহরের ভিতরেই একটা জায়গায় বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায় না, কীসের আশংকায় অভিভাবকেরা অনুমতি দেন না? কাদের আতঙ্কে? ওড়না, হিজাব, বোরকা এতসব পোশাকের বস্তা পরতে হয় কাদের হাত থেকে বাঁচতে? পুরুষাতঙ্ক ছড়ানোর জন্য পুরুষেরাই কি যথেষ্ট নয়? এখন নিশ্চয়ই জিকির ধরবেন, সব পুরুষ এক না। সেটা আমরা খুব জানি। সব পুরুষ ধর্ষণ করেন না। কেউ কেউ করেন। কেউ কনডম পরে করেন, কেউ না পরে করেন। কেউ হোটেলে নিয়ে করেন, কেউ বন্ধুর বাসায় করেন। কেউ সৎ মেয়েকে করেন, কেউ নিজের মেয়েকে করেন। কোনও পুরুষ চিমটি দেন, কেউ খামচি, কেউ আবার ‘পাছা হাতান’। কেউ বাসে হাতান, কেউ রাস্তায় হাতান। কেউ হিজাবে আকর্ষিত হন, কেউ ওড়নায় আকর্ষণ পান। কোনও কোনও পুরুষ আবার খুব ভাল। এসব কিছুই করেন না। এরা বউ নিয়ে থাকেন। ইচ্ছে হলে বউকে চাকরী করার অনুমতি দেন, ইচ্ছা না হলে দেন না। ইচ্ছে হলে বউকে শাড়ি পরান, ইচ্ছা হলে বউএর শাড়ি খুলেন। কাজেই সব পুরুষ কোনও ভাবেই এক হতে পারেন না। কিন্তু সমস্যাটা হল, সব পুরুষই আমাদের সমাজে বসবাস করেন, বিয়ে করেন, সংসার করেন, বউ আছে, বাচ্চা আছে, চাকরী করেন, ফেসবুক করেন, ভালো ভালো স্ট্যাটাস শেয়ার দেন, কমেন্টে ভালো উপদেশ দেন, লাইক দিয়ে পাশে থাকেন। এখন ভালো পুরুষ- খারাপ পুরুষ আলাদা করার উপায় কী? আর ভাল খারাপের সংজ্ঞাটাই বা কী? যিনি ধর্ষণ করেন তিনি খারাপ পুরুষ, আর যারা ধর্ষণের কারণ হিসেবে ভিক্টিমের দোষ খুঁজে বের করেন তারা কী? যিনি এসবের মধ্যে নেই কিন্তু ঘরে বউ নামক একটা সেবাদাসী রাখেন, নিজেরা ইচ্ছেতে বউকে চলতে বাধ্য করেন তিনি কেমন পুরুষ? ছোটবেলায় সমাজ বইয়ে পরিবারের শ্রেণিবিভাগ পড়েছি। ‘আমাদের সমাজের পরিবারগুলো পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। পরিবারের কর্তা থাকেন একজন পুরুষ। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে পুরুষের হাতে।’ পিতৃতন্ত্র ব্যাপারটা বইয়ে পড়তে পড়তে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পিতৃ্তন্ত্রের জায়গায় পুরুষতন্ত্র পড়ে দেখুন। নারীর কর্তা সাজা, নারীকে দাসী বানানো যে সমাজে সামাজিক নিয়ম সে সমাজে ভালো পুরুষটি কে? আর এরকম ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বষী সমাজে পুরুষাতঙ্ক ছড়ানোর দায় নাকি নারীবাদীদের! যেন নারীদের আতংকিত করার মত যথেষ্ট পরিমাণ ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা, অত্যাচার, নির্যাতন এখনও তারা করে উঠতে পারেন নি। আরও কিছু বাকি আছে।

নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে। এরকম খারাপ পরিস্থিতিতেও আশা রাখছিলাম, ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেক মেয়েই এখন তাদের জীবনের কথা লিখছে। নিজের মত করে নারীবাদের চর্চা করছে। সবার মতের সাথে যে আমি একমত তা না। কেউ হিজাব পরে নারীবাদের কথা বলে, কেউ ওড়না পরে। কেউ ধার্মিক, কেউ নাস্তিক। কেউ তসলিমার মতাদর্শকে সঠিক মনে করেন, কেউ করেন না। যার যাই মত থাকুক, তসলিমা নাসরিন একা সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে ‘নারীর কথা, নারী বলবে’ এটার চর্চা শুরু করেছিলেন। এর ফল আমরা সবাই ভোগ করছি।

মেয়েরা কথা বলছে এটা আমার কাছে যখন স্বস্তির বিষয় অন্যদিকে অনেকের কাছে এটিই এখন ভয়ংকর অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো পুরুষ, খারাপ পুরুষ সব একজোট হয়ে এখন মেয়েদের কথা বলা বন্ধের চেষ্টা চালাচ্ছেন। খারাপ পুরুষেরা জোরে করে আর ভালো পুরুষেরা নানান অভিযোগ তুলে। এখানেও আরেকবার প্রমাণিত হয়ে যায় সব পুরুষ এক না।

ভালো পুরুষ, খারাপ পুরুষ নির্বিশেষে উপসংহার টানেন এই বলে যে, নারীরাই নারীর শত্রু। নারী মুক্তিতে যেহেতু তাদের কোনও স্বার্থ নেই, তাই নারীমুক্তির জন্য নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। তারা কি আসলে বলতে চান, পুরুষতন্ত্র যেহেতু পুরুষের স্বার্থ রক্ষা করে তাই তারা পুরুষতান্ত্রিক হবেনই। ধর্ষণ যেহেতু পুরুষকে মজা দেয় তাই পুরুষ ধর্ষণ করবেই। নারীকেই বরং রেখে ঢেকে চলতে হবে? সংসারে নারী পুরুষের অবাধ্য হলে যেহেতু পুরুষ অসন্তুষ্ট হয়ে নারী নির্যাতন করবে, তাই নারী নির্যাতন রুখতে নারীকেই পুরুষের বাধ্য হতে হবে?

পুরুষ চায় পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে। পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে নারীদের দমিয়ে রাখতে হবে। নারীর শরীরকে অশুচি, যৌনবস্তু, মাংসপিণ্ড বলে প্রচার করতে হবে। একইভাবে পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে নারীর কথা বলা বন্ধ করতে হবে। নারীর কথা বলা বন্ধ রাখতে মাঝেমাঝে নারীর দুঃখে চুকচুক করতে হবে, ধর্ষণের কারণে নারীর ইজ্জত-সম্ভ্রম চলে গেল বলে গভীর দুঃখ প্রকাশ করতে হবে, ধর্ষকের ফাঁসির মাধ্যমেই সমস্ত সমস্যার সমাধান করে ফেলার ভান করতে হবে। আমাদের সমাজের তথাকথিত ভালো পুরুষেরা সেটিই করে থাকেন। এরপরেও নারীরা কথা বলতে চাইলে, প্রতিবাদ করতে চাইলে তাদেরকে পুরুষবিদ্বেষী উপাধি দিতে হবে। ভয়ংকর নারীবিদ্বেষী সমাজে বসবাস করে যখন কেউ নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষবিদ্বেষের অভিযোগ তোলে, তখন হেসে বাঁচি না। ধর্মের বিরুদ্ধে বললে যেমন ধার্মিকেরা ধর্মবিদ্বেষী শব্দটি এড়িয়ে মুসলমান বিদ্বেষী কিংবা হিন্দু বিদ্বেষী, খ্রিষ্টান বিদ্বেষী ইত্যাদি অভিযোগ তোলে, তেমনি পুরুষের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বললে পুরুষেরা পুরুষতন্ত্র বিদ্বেষী শব্দটি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলে পুরুষ বিদ্বেষী। একবার ভেবে দেখে না, নারীরা পুরুষ বিদ্বেষী হলে ভ্রূণ অবস্থা থেকে জন্ম নিয়ে, মাতৃদুগ্ধ খেয়ে পুরুষ হয়ে, নারীর দিকে এই অভিযোগ তোলার সুযোগ হতো না।

শফি হুজুররা আসলে কতটা ক্ষমতাবান?

বাংলাদেশের রাস্তায় বের হলে খেয়াল করে দেখবেন রাস্তায় চলাফেরা করছে মানুষদের মধ্যে ৯০ ভাগ পুরুষ, আর ১০ ভাগ নারী। যেন বাইরের জগতটা কেবল পুরুষের। পুরুষের জগতে নারী অনিরাপত্তায় ভুগে।

খুব সকালে যখন কলেজ বাসের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করতাম, তখন যেন একটি অন্য জগৎ দেখতাম। রাস্তার অধিকাংশ মানুষ নারী, বাসের অধিকাংশ যাত্রী নারী। নারী শ্রমিক তারা। বিভিন্ন গার্মেন্টসে কাজ করেন। বাসের হেল্পার তাদেরকে বলতে পারে না, ‘মহিলা তুলি না, মহিলা সিট নাই’।

উচ্চবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ নারীরাই চাকরী করেন না, যেহেতু পরিবারে অতিরিক্ত অর্থের দরকার হয় না। মধ্যবিত্ত পরিবারেরও খুব কম সংখ্যক নারীই চাকরীর সাথে যুক্ত। তবে নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ নারীরাই স্বচ্ছল জীবনের আশায় চাকরী করেন। তাদের শ্রম ও মেধা দেশের কাজে লাগান। সকালে গার্মেন্টসে কাজের জন্য এবং সন্ধ্যায় কাজের ছুটির পর দলে দলে মেয়েরা যখন রাস্তায় হাঁটে, সেই দৃশ্যটি আমাকে মুগ্ধ করে। শুরুর দিকে পথে পথে হাজারো নারীবিদ্বেষী লোকের হেনস্থা ও টিজিং সহ্য করে গার্মেন্টস এর মেয়েরা আজকে এই পর্যায় এসেছে।


মনে আছে, আমরা প্রথম যখন আল্লামা শফি’কে চিনতে শুরু করি, তখন তার একটি ওয়াজের বক্তব্য অনলাইনে ছড়িয়ে গিয়েছিল? শফি তাঁর সেই বক্তব্যে গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকদের সম্পর্কে কী বলেছিলেন মনে আছে? বলেছিলেন, “আপনার মেয়েকে কেন দিচ্ছেন গার্মেন্টসে কাজ করার জন্য? চাকরি তো অনেক করতেসেন। আপনি নিজে করতেসেন, আপনার বউ করতেসে, মেয়েরা করতেসে। কিন্তু কুলাইতে তো পারতেসেন না। খালি অভাব আর অভাব। আগের যুগে রোজগার করত একজন, স্বামী। সবাই মিইলা খাইত। এখন বরকত নাই। সবাই মিইলা এতো টাকা কামাইয়াও তো কুলাইতে পারতেসেন না। গার্মেন্টসে কেন দিচ্ছেন আপনার মেয়েকে? সকাল ৭/৮ টায় যায়, রাত ১০/১২ টায়ও আসেনা। কোন পুরুষের সাথে ঘোরাফেরা করে তুমি তো জান না। কতজনের সাথে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে তা তো জানেন না। জেনা কইরা টাকা কামাই করতেসে, বরকত থাকবে কেমনে?”

মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে গেলে তো আবার শফি হুজুরদের সমস্যা, দরিদ্র অল্প বয়সী মেয়েরা গার্মেন্টসে চাকরী করলে শফি হুজুরেরা বিয়া করার জন্য কচি মেয়ে পাবেন কীভাবে!

যাদের পরিশ্রমের ঘামে ঘুরছে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা, যাদের তৈরী কাপড় পরে হুজুর ওয়াজে যান, যাদের শ্রমের বিনিময়ে রাষ্ট্র বিদেশী মুদ্রা পায়, বিদেশী নানান পণ্য কিনে, সেসব দিয়ে তৈরী হেলিকপ্টারে চড়ে হুজুর সমাবেশে গিয়ে বলে আসেন, মেয়েদেরকে যেন ঘরে বন্দী করে। গার্মেন্টসে তারা ‘জেনা কইরা টাকা কামাই করতেসে’। একটি দেশের অর্থনীতি যাদের জন্য টিকে আছে তাদের’কে অপমান করে এধরণের ঘৃণ্য কথা বলেও সে কীভাবে পার পেয়ে যায়? শুধু যে পার পেয়েছে তা না। পেয়েছে- রেলের জমি, দখল করা পুকুরের মালিকানা, কওমি মাদ্রাসায় তিনি যেসব মূর্খ ও ধর্মান্ধ তৈরী করেন তাদেরকে পাইয়ে দিয়েছেন মাস্টার্সের সমমান সনদ।

প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রী, সরকারি আমলা, বড় বড় ব্যবসায়ী, পুঁজিপতি, এনজিও কর্তা সবার ঠাটবাট এইসব নারী শ্রমিকদের ১২ ঘন্টা শ্রমের ঘামে গড়া। দেশ চালানোর অর্থ আসে শ্রমিকদের কাছ থেকে, আর দেশ চালানোর পদ্ধতি আসে শফি হুজুরের কাছ থেকে। আর শফি হুজুরের আদর্শ বাস্তবায়নে হুজুরের ব্যক্তিগত পুতুল হিসেবে চেয়ারে বসেছেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!

হাসিনা ভোট পাবার আশায় নয়, বিএনপির ভোট কাটার আশায় শফি হুজুরের সাথে আপোষ করছেন। শুনেছি, আগামী নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের কিছু নেতা ৩০টি আসনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবেন। তবে হেফাজত’কে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন প্রমাণ করতে তারা দলের নাম ব্যবহার করবেন না। হাসিনা যদি ধারণা করে থাকেন যে ওই ৩০টি আসনে বিএনপির ভোটগুলো ভাগ হয়ে কিছু হেফাজতের কাছে কিছু বিএনপির কাছে যাবে এবং বিএনপি এতে হেরে গেলেই হাসিনার জয় নিশ্চিত হয়ে যাবে, তবে হাসিনা খুব ভুল ভাবছেন। ৩০টি আসনে যেসব হেফাজতের নেতারা দাঁড়াবেন, তারা কেউ নিজেরা নিজেদেরকে ভোট দিবে কিনা আমার সন্দেহ হয়। হাসিনার মত একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ কি এটা বুঝেন না? ভোট নিয়ে হাসিনার এত চিন্তা! যার জন্য তিনি শফি হুজুরের মত একজন নোংরা লোকের সাথেও আপোষ করতে প্রস্তুত। কিন্তু ভোট নিয়ে তিনি এত ভাবছেন কেন? যারা হৈ-চৈ, দাঙ্গা- হাঙ্গামা করে নিজেদের সংখ্যা জানান দেয় তাদের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। সংখ্যায় কম বলেই সবসময় কোনও না কোনও ঝামেলা সৃষ্টি করে রাস্তায় জড়ো হয়ে নিজেদের সংখ্যা ও ক্ষমতা দেখাতে চায় তারা। সংখ্যায় এই নগণ্য গোষ্ঠীর সন্ত্রাস আর লুটপাট করা ছাড়া তেমন কোনও ক্ষমতা নেই। যদিও তাদের সন্ত্রাসী ও লুটপাটের ক্ষমতার গুণেই আড়ালে চলে যায় আসল ক্ষমতাবান মানুষেরা, যারা বাঁচিয়ে রাখছেন দেশটাকে।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত করেছেন বলে গর্ব করে জানান। কাদের ক্ষমতায় বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ? বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান দুইটি খাতের প্রথম হল গার্মেন্টস শিল্প এবং দ্বিতীয় প্রবাসী শ্রমিক। যাদের ক্ষমতায় হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশ বানানোর স্বপ্ন দেখেন তাদের ক্ষমতা হাসিনার নজরে আসবে কবে? কবে থেকে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের ভোটের মায়া ভুলে আসল ক্ষমতাবানদের ভোটের জন্য হাসিনা রাজনীতি করবেন?

বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৭

দুর্বল বানিয়ে দুর্বলতা খোঁজা আর কতদিন চলবে?

১. বাচ্চাদেরকে পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা করানো নিয়ে মাঝেমাঝে পত্রিকায় নিউজ দেখি। মানুষ এতটা নির্মম হতে পারে বিশ্বাস হতো না। সেদিন ‘স্ল্যামডগ মিলিয়নিয়ার্স’ মুভিটা দেখছিলাম। মুভিতে সেলিম আর জামাল দুই ভাই সেরকমই একটি চক্রের ফাঁদে পড়ে যায়। তাদেরকে ভালো খাবারের লোভ দেখিয়ে এক জায়গায় আনা হয়। সেখানে তারা দেখে তাদের মত আরও অনেক শিশু। যারা ভাল গান গাইতে পারে তাদেরকে বড় শিল্পী বানানোর স্বপ্ন দেখানো হল। বাছাই পর্ব শুরু হল। খুব ভালো গাইতে পারে এমন একজন বাচ্চাকে একটি গান গেয়ে শোনাতে বলা হল। বাচ্চাটি খুব ভালো গাইল। তারপর তাকে চোখ বেধে অজ্ঞান করে পরে তার চোখ দুটি নষ্ট করে তাকে অন্ধ বানিয়ে দিলো। গান গাইতে পারে এমন অন্ধ ভিক্ষুক তাও আবার বাচ্চা, কামাই খুব ভালো হবে। সেলিম পুরো ব্যাপারটা দেখে ফেলে। এদিকে তার ভাই জামাল বড় শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। অপেক্ষা করছে কবে তার পালা আসবে। জামালের পালা এলে সেলিমকে পাঠানো হয় জামালকে ডেকে আনতে। পথে সেলিম জামালকে ইশারায় বুঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলে, সেলিম ইশারা করলেই যেন দৌঁড়ে পালায়। দু’ভাই পালিয়ে বাঁচে ওই ভয়ংকর চক্রের হাত থেকে। শিশুদের পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা ব্যবসা চালানোর বিরুদ্ধে আমরা সবাই।

পঙ্গু বানিয়ে শুধু কি ভিক্ষা ব্যবসা চলে? না। পঙ্গু বানিয়ে আরও অনেক কিছুই করা হয় যেগুলোকে আমরা অপরাধ মানি না, খারাপ কিছু বলেও মনে হয় না।

পাবলিক বাসে ড্রাইভারের পাশের কিছু সিট নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত। সংরক্ষিত সিট নিয়ে পুরুষের বাঁকা কথার শেষ নেই। কোনও পুরুষ যদি নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন দখল করে তবে তাকে শাস্তি বা জরিমানা গুণতে হবে। কিছুদিন আগে পরিবহণ সংক্রান্ত কিছু বিধি নিষেধে এমন আইন করা হয়। যার কারণে পুরানো তর্ক আবার ঘুরে ফিরে এলো। সমানাধিকারের কথা বলা হয়, অথচ সংরক্ষিত সিট বরাদ্ধ করে নারীরা অতিরিক্ত অধিকার ভোগ করছে! এ নিয়ে প্রায় বাসে পুরুষেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। এ আলোচনা যে কেবল বাসে হয় তা নয়। দৈনন্দিন জীবনে, পথে ঘাটে, ফেসবুকেও হয়। নারীদের জন্য সংরক্ষিত সিটের দরকার হয়। কারণ নারীরা দুর্বল এজন্য তারা দাঁড়িয়ে বাসে চড়তে পারে না, এছাড়াও আছে মহিলা সংক্রান্ত আরও নানান ঝামেলা। মহিলা সংক্রান্ত ঝামেলা গুলো কীরকম? এই যেমন ভিড়ের মধ্যে নারীর শরীর পুরুষের কাম জাগায়। পুরুষ বাধ্য হয়ে নারীদের গায়ে হাত দেয়। অধিকাংশ নারী নীরবে নিজেকে সরিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কোনও কোনও নারী আবার এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের প্রতিবাদ করে যা বাসের সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিনষ্টের কারণ হয়।

কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য নিয়মিত বাসে চলাচল করেন এমন একজন নারীর সাথে কথা হয়েছে। যিনি জানিয়েছেন তাদের দুর্ভোগের কথা। বাসে সিট খালি নেই, তবে দাঁড়ানোর জায়গা আছে, এরকম অবস্থায় নারীরা বাসে উঠতে গেলে গাড়ির হেল্পার জানায়, ‘মহিলা সিট নাই’। বাসের ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, ‘মহিলা তুলিস না’ কারণ মহিলা যাত্রী নিলে আবার যদি তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। ‘সিট লাগবে না, দাঁড়িয়ে যাব’ বলতে বলতে কর্মজীবী নারীরা ভিড় ঠেলে বাসে চড়েন। জানান, ভিড় বাসে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শগুলোর কথা। লজ্জায় প্রতিবাদ করতে পারেন না। যদি বলেন ‘লোকটা অসভ্যতা করছে’ তাহলে জানতে চাওয়া হয় ‘কী ধরণের অসভ্যতা তিনি করছেন?’ অসভ্যটিকে লাথি দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দিতে অসভ্যতার ধরণ জানতে হবে। কারণ পুরো বাসটিই যে ছোটবড় নানান জাতের অসভ্যতে ভরপুর।

কর্মস্থলেও নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অফিস শেষে ভিড় বাসের দুর্ভোগ পোহানোর পর বাড়ি ফিরে রান্না করে স্বামী বাচ্চাদের খাইয়ে, চাকরি ও সংসার সামলে দিন শেষে প্রমাণিত হয় নারী দুর্বল। এটা মেনে নিয়েই তারা ঘুমাতে যায়। আবার ভোর হলেই স্বামী বাচ্চাকে খাইয়ে, অফিস-স্কুলের জন্য প্রস্তুত করে নিজেকে দুর্বল প্রমাণের লড়ায়ে নেমে যায় তারা।

২. মেয়ে মানুষ একা বাইরে যাওয়া ঠিক না।

কেন ঠিক না?

মেয়ে মানুষ বলে।

আমার কাছে সবচেয়ে অপমানজনক মনে হতো যখন, সন্ধ্যার পর বের হতে হলে ছোট ভাই বা কোনও পুরুষকে সাথে নিয়ে বের হতে বলা হতো। যেন আমি একটা যৌনবস্তু, মাংসের দলা ছাড়া আর কিছু না।

হয়তো কোনও ওষুধ আনতে যেতে হবে। বলা হল দারোয়ান চাচাকে সাথে নিয়ে যাবে। সোজা বলে দিতাম, ‘তাহলে দারোয়ান চাচাকেই বলো, আমাকে বলছ কেন?’ জানি আমার নিরাপত্তার জন্যই বাবা-মা এসব বলতেন। মেয়েদের কাছে এটা স্বাভাবিক কারণ ‘তুমি দূর্বল’ ‘তুমি দুর্বল’ শুনতে শুনতে ওরা মেনেই নিয়েছে ওরা দুর্বল, অসহায়। কিন্তু অন্য মেয়েদের মত আমি এটিকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারি নি। তাই কাউকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনলেই প্রচণ্ড রেগে যেতাম।

নারীদের সংরক্ষিত আসনের দরকার হয়, চলাফেরার জন্য পুরুষ সঙ্গীর দরকার হয়, অপরাধের ভুক্তভোগী হওয়ার কারণে লজ্জিত হতে হয়। সুযোগ দেয়া হবে না কিন্তু বলা হবে, পারে না। পুরুষের উপর নির্ভরশীল বানিয়ে রেখে বলা হবে, পুরুষ ছাড়া চলতে পারে না। এটা অনেকটা শিশুদেরকে পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা ব্যবসা চালানোর মত নারীদেরকে পঙ্গু বানিয়ে ‘পুরুষতন্ত্র’ চালানো নয় কি?

যদিও একটি আমাদের কাছে নির্মম অন্যটি স্বাভাবিক। মুভিতে সেলিম ও জামাল পালিয়ে নিজেদেরকে পঙ্গু হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। নারীদের মধ্যে যারা পঙ্গুত্ব বরণ করে নি, সচেতন হয়েছে, তারা অন্যদেরকে সচেতন করার চেষ্টা করে। এজন্য আমার মতো কেউ কেউ অনলাইনে লেখালেখির পথ বেছে নিয়েছে। নারীবাদ নিয়ে লিখি বলে Abidur Rahman Maya নামে একজন বললেন, ‘লিঙ্গ নিয়ে এত নাড়াচাড়া করা কি ঠিক?’ উত্তরে বললাম, ‘আমার লিঙ্গ তো নড়াচড়া করে না, ফিক্সড। আপনাদের লিঙ্গের এত নড়াচড়া দেখে বলি। এত নড়াচড়া করলে কেউ যদি লিঙ্গে বাইড়াইয়া আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর অবস্থা না রাখে, তাইলে তো আপনাদেরই বিপদ। আপনাদের ভালোর জন্যই বলি’। আমার উত্তরটি অনেকের কাছে খুব অশ্লীল মনে হতে পারে। কারণ অন্যায়টা সমাজে স্বাভাবিক হয়ে গেছে প্রতিবাদটা বরং অস্বাভাবিক, যা অনেকের কাছে বাড়াবাড়িও মনে হয়।

সেদিন Taibur Rahaman নামে একজন আমার একটি লেখায় মন্তব্য করল, ‘এ কেমন দুনিয়া এসে গেল। দাদী নানীর পোশাক ছেড়ে সব শর্ট পোশাক পরলে ইভটিজিং ধর্ষণ হবে না কেন? এ যেন বাঘের সামনে মাংস রেখে মানবতার কথা বলা হা হা হা আজব দুনিয়া’। ধর্ষণ করাটাকে উনি সম্ভবত ওনার মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছেন। উত্তর দিলাম, ‘নিজেকে বাঘ আর মেয়েদেরকে মাংসের দলা মনে করা প্রজাতির স্থান জঙ্গলে। যদিও জঙ্গলের পশুরা তাকে মেনে নিলে আরকি! মেনে না নিলে তাদের জন্য রয়েছে চিড়িয়াখানা, রয়েছে খাঁচা।’

‘সেক্স চ্যাট করতে পারেন?’ এর উত্তরে, ‘না ভাই, আমি খালি বিচি ছ্যাঁচতে পারি। লাগবে ছ্যাঁচা?’ গুণীজনেরা বলেন, এ ধরণের মন্তব্যকারীদের সাথে তর্কে যেও না। কুকুর তোমাকে কামড় দিলে তুমিও কি কুকুরকে কামড়াতে যাবে?’ আমার কাছে আসলে এধরণের মন্তব্যগুলোর উত্তর দেয়া জরুরী মনে হয়। আমি প্রতিবাদী হতে প্রেরণা জাগানো বিশাল লেখা লিখে ফেললাম। আমার লেখা অনুযায়ী কেউ চলতে গেলে তাকে ঠিক এ ধরণেরই মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হবে যা আমার লেখার মন্তব্যে আমি পেয়ে থাকি। আরেকজনকে প্রতিবাদী হতে বলে একই ধরণের মন্তব্যের মুখোমুখি করলাম, অথচ আমি নিজে সেসব এড়িয়ে গেলাম। এটা অনেকটা নিজেকে বাঁচিয়ে অন্যকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার মত। আমি এই থিউরিতে বিশ্বাসী নই। আমার মতে, প্রতিবাদ করতে সাহস জোগাতে বড় বড় লেখার চেয়ে একজনকে প্রতিবাদ করতে দেখলেই বরং অনেকটা সাহস সৃষ্টি হয়ে যায় যা ওই লেখায় হয় না। ইদানীং আমার উত্তর পেয়ে কেউ কেউ নিজেদের কমেন্টটাই ডিলিট করে দেয়, কেউ আবার ক্ষমা চায় বাজে মন্তব্যের জন্য। আমি এড়িয়ে গেলে অনেক মেয়েরা নিজেরা সেসবের উত্তর দেয়। পাল্টা আঘাত না এলে ওদের হুশ ফিরবে না, দুর্বল বানিয়ে দুর্বল প্রমাণের এসব প্রথা চলতেই থাকবে। আর পাল্টা আঘাতের শুরুটা বোধ হয় এভাবেই হয়।

মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০১৭

বিয়ের বাজার

মাসখানেক আগে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। আমারও এবছর এইচএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে এখন আমি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাঁটছি। সেসব কথা থাক।

আমার বন্ধুরা সবাই এইচএসসি দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ এর ওপরই নির্ভর করে ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার। ক্যারিয়ার গড়ার প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু বৈষম্য ভবিষ্যতে কীভাবে বিরাট পার্থক্য গড়ে দেয় সেই চিত্রটা আজকের লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশে মোট ৩৭টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটি গুলোর ডিমান্ড চাকরির বাজারে বেশি বলে সবার লক্ষ্য থাকে ঐ ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়। মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় এসব ইউনিভার্সিটিতে সিটের সংখ্যা নগণ্য। তাই প্রত্যেককেই অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। নিজের শহরের বাইরে গিয়ে এসব পরীক্ষা দেয়া ছেলেদের পক্ষে সম্ভব হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশাল সমস্যা।

ছেলেরা সাধারণত বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে যায়, অভিভাবক যাওয়ার দরকার হয় না। আর মেয়েরা? বন্ধুদের সাথে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় এক ইউনিভার্সিটি থেকে আরেক ইউনিভার্সিটিতে দল বেঁধে যাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেনা। অভিভাবকদের সাহায্য নিতে হয়, অনুমতি নিতে হয়, অভিভাবকদের কাজের ফাঁকে সময় বের করতে পারবে কিনা সেই চিন্তাও করতে হয়। অভিভাবকরা যদি বলে, তোমার সাথে যাওয়ার মতো আমার সময় নেই, কাজের চাপ, ছুটি নিতে পারছি না, ব্যবসার ক্ষতি হয়ে যাবে অতএব পরীক্ষা দিতে হবে না। পরীক্ষা দেয়া বন্ধ। কাছের কোনো ইউনিভার্সিটিতে চেষ্টা করো। না হলে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হও। শেষ পর্যন্ত পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।

স্বপ্ন বাস্তবতার মুখ না দেখার একটি অন্যতম কারণ, নিরাপত্তা সমস্যা। আর অনার্সের মাঝামাঝি সময় একটা ভালো পাত্র পেয়ে গেলেই মেয়ের আসল ঠিকানা অর্থাৎ ‘স্বামীর সংসার’এ পাঠিয়ে দেয়ার মানসিকতা তো আছেই। ভালো পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, বিয়ের পিঁড়িতে বসও। ব্যস, সংসার পেতে বসতে হয়। তখন স্বাবলম্বী হওয়ার সুখ স্বপ্ন ভুলে, হাঁড়ি পাতিল, বাচ্চাকাচ্চা স্বামী সেবায় সুখ খোঁজে।

আমার এক মেয়ে বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। তার মা-বাবার কোনও আপত্তি নেই মেয়েকে অন্য শহরে রেখে পড়াতে। তবে তার জ্ঞানীগুণী আত্মীয় স্বজনেরা নাকি প্রায় তার মা-বাবাকে বাস্তবতা বোঝাতে আসতেন। মেয়েকে চোখের আড়াল করে লেখাপড়া করতে পাঠানো কতটা ভুল সিদ্ধান্ত সেটা জানাতেন।

নিরাপত্তা সমস্যা এবং মানসিকতা সমস্যা, এই দুটো সমস্যার কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সারাদেশে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ফলাফল ভাল হওয়া স্বত্বেও ভবিষ্যতে ভালো ক্যারিয়ারের রাস্তাটাতে ছেলেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়।

আপাত দৃষ্টিতে এটাকে তুচ্ছ কিছু মনে হলেও এটা কিন্তু ভয়াবহ একটি সমস্যা। দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। শিক্ষিতের অর্ধেক অংশ নিজের বিদ্যা বুদ্ধিকে কাপড় ধোয়ার সেরা সাবান, আর সেরা মেলামাইন বাছাইয়ের ক্ষেত্রেই শুধু ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে।

আমার এক ডাক্তারি পড়ুয়া দাদার সাথে কথা বলছিলাম। সে বিয়ের ক্ষেত্রে কী ধরনের মেয়ে পছন্দ করবে সেসব নিয়েই মূলত আলোচনা। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, সহপাঠীদের মধ্যে কাউকে পছন্দ হয় কিনা। বলল, তা হয়। তবে সে সহপাঠীদের কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারবে না। তার মায়ের বয়স হচ্ছে, বাড়িতে মায়ের একজন সাহায্যকারী লাগবে, সেই উদ্দেশ্যেই সে বিয়ে করবে। আর ডাক্তারি পড়া একজন মেয়েকে সে বাড়িতে বসিয়ে রাখবে? তার একটা বিবেক আছে না? তাই সে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ কাউকে বিয়ে করবে। যাকে বাড়িতে মায়ের সাহায্যকারী বানানো যাবে।

বাংলাদেশে কয়জন ছেলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়? বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ কোনও বিষয় নিয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করে ভালো চাকরিও করে। কিন্তু ডাক্তার স্বামীর বিশ্ববিদ্যালয় পাশ স্ত্রীকে সাধারণত ঘরের কাজেই দেখা যায়। অর্থের দরকার না থাকলে মেয়েদের চাকরির প্রয়োজনীয়তা তেমন থাকে না বলে অনুমতিও পাওয়া যায় না।

ফেসবুকে প্রায় স্ট্যাটাস দেখি, ছেলে বিয়ে করতে চায়। কারণ তার রান্না করার কেউ নেই,কাপড় ধোয়ার কেউ নেই, ঘর গোছানোর কেউ নেই। তাই তার একজন বউ লাগবে। আমি বুঝি না, এধরনের ছেলেরা বিয়ে করতে গিয়ে শিক্ষিত মেয়ে খুঁজে কেন! ঘরের কাজ করে এরকম কাজের খালাদের কাউকে বিয়ে করে নিলেই পারে। কারণ ঘরের কাজের দক্ষতা তো শিক্ষিত বউদের চেয়ে তাদেরই বেশি থাকার কথা। আমার মনে হয়, কে কত শিক্ষিত একটি মেয়েকে নিজের দখলে নিতে পেরেছে সেরকম একটা প্রতিযোগিতা বাজারে চালু আছে। তাই বিয়ের সময় তাদের শিক্ষিত মেয়ে দরকার হয়।

এতো গেল শিক্ষিত ছেলেদের শিক্ষিত মেয়ে খোঁজার কথা। দেশের প্রায় সব ছেলেই বিয়ের সময় শিক্ষিত মেয়ের চেয়ে সুন্দরী মেয়ে খোঁজে বেশি। যাতে করে আড্ডায় বন্ধুদের সাথে বড় মুখ করে বলতে পারে, আমার বউ সবচেয়ে সুন্দরী! মেয়ে দেখতে গিয়ে- মেয়ে হাঁটতে পারে কিনা, কথা বলতে পারে কিনা, গলার স্বর কেমন, শরীরে কোথাও কোনও খুঁত আছে কিনা ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। যেন মাছের বাজারে মাছ টিপে টিপে দেখছে। পছন্দ না হলে নতুন কোনো মেয়ে দেখে, পছন্দ হলে শুরু হয় দরদাম। বিয়েতে মেয়ের বাবা কী দিবে। কয় ভরি সোনা, কোন ব্র্যান্ডের বাইক নাকি কার, ঘর সাজানোর খাট, ফ্রিজ, টেলিভিশন। তর্কবিতর্ক করে কত টাকায় বা কত সস্তায় দেনমোহরের নামে মেয়ে কেনা যায়! এ যে মেয়েদের জন্যে কত লজ্জার, কত অপমানের তা কি সে সব ‘শিক্ষিত’ (?), টাকাওয়ালা, একের পর এক পাত্রী দেখে যাওয়া ছেলেরা ভেবে দেখেছে কখনো?

মেয়েদের ন্যূনতম সম্মান আছে, অধিকার আছে এমন সমাজেও এ ধরনের বর্বর নিয়ম নেই যা আমাদের সমাজে গর্ব ও ঐতিহ্য নিয়ে যুগযুগ ধরে চলে আসছে।

বাহির বলে দূরে থাকো



অনেক ছেলেদের দেখি মেয়েদের সিরিয়াল দেখা নিয়ে ব্যঙ্গ করে। ছেলেরাও যে সিরিয়াল দেখে না, তা নয়। তবে সিরিয়ালের অধিকাংশ দর্শক নারী। মেয়েদের সিরিয়াল দেখা নিয়ে ব্যঙ্গ করা ছেলেরা কি কখনো এর কারণ ভেবে দেখেছেন?

ছেলেরা বিকেল হলে পাড়ার মাঠে খেলতে যায়, সারা মাঠ দৌড়ায়, ফুটবল-ক্রিকেট খেলে, সাইকেল নিয়ে রেইস করে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়, একা কোনও মেয়েকে পেলে সুযোগ বুঝে দলেবলে হয় তো কেউ কেউ ইভটিজিং করে পুরুষত্বও দেখিয়ে দেয়। বাইরের জগতে ছেলেদের বিনোদনের কোন অভাব নেই।

আর বাইরের জগতে মেয়েদের জন্য ‘বিনোদন` নামক কোন শব্দ এখনো প্রচলিত হয় নি। বাইরের জগৎ বলতে মেয়েদের কাছে অনিরাপদ কিছু। মেয়ে যতক্ষণ বাড়ি না ফিরছে ততক্ষণ বাবা মায়ের চিন্তার শেষ নেই। ‘সন্ধ্যা হয়ে গেল, দেরি করছে কেন? কোন বিপদ হয়নি তো?’

শিশু অবস্থায় ছেলে মেয়ে একসাথে মাঠে খেলতে দেখা যায়, একটু বড় হলেই ছেলেটি পাড়ার মাঠের বাইরে আরও একটু বড় মাঠে খেলতে যায়। স্বাভাবিক। ছেলে বড় হচ্ছে। মাঠ বড় হবে, জগৎ বড় হবে। আর মেয়েটির? মেয়েটির শরীর বড় হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ছোট হতে থাকে তার জগৎ। মেয়েটিকে ঘিরে চারদিক থেকে ছুটে আসতে থাকে কথার তীর। মেয়ে বড় হচ্ছে, তার কি খেলা মানায়? দৌড়লে যদি ওড়না ঠিক ওই জায়গা থেকে নড়ে যায়, যদি ওড়নার ফাঁকে কিছু দেখা যায়, যদি মেয়ের দৌড়নোতে নিতম্বের নড়াচড়া কারও কাছে আকর্ষণীয় ঠেকে, যদি কারও ধর্ষণের ইচ্ছে জাগে, আরও কত কী সমস্যা।

মনে পড়ে, আমি যখন ফাইভ-সিক্সে পড়তাম, তখন আমাদের বাসার সামনের সামান্য একটু খোলা জায়গায় আমার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে খেলতাম। পাড়ার অন্য মেয়েরা আসতো না। তাই ছেলেরাই ছিল আমার বন্ধু। কিন্তু যখন ক্লাস সেভেন-এইটে উঠি, আমার সবচেয়ে ক্লোজ ছেলে বন্ধুটির লম্বায় বাড়তে থাকে আমার চেয়ে বেশি, নাকের নিচে একটু একটু গোঁফের আভাস দেখা দেয়, আমারও শারীরিক পরিবর্তন হতে থাকে। তখন আমার খেলার ক্ষেত্রে বাধা আসে। আর ওই বন্ধুটি তখন ছোট জায়গা থেকে বড় মাঠে খেলতে যায়। ছেলেমেয়ের বন্ধুত্বকে সমাজে স্বাভাবিক ভাবে নেয় না বলে ওর সাথে আমার বন্ধুত্বও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন তো কথাবার্তাও বন্ধ। ও আমাকে দেখলে কেমন যেন লজ্জা পেতো। আমার এক বান্ধবীকে একটা ছেলে বিরক্ত করতো। একদিন দেখলাম আমার ছোটবেলার বন্ধু সেই ইভটিজারসহ তার আরও কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একসাথে রাস্তায় হাঁটছে।

মেয়েরা যত বড় হতে থাকে মেয়েদের জগৎ তত ছোট হতে থাকে। আর ছেলেদের বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের জগৎও বড় হতে থাকে। আমাদের পাড়ায় একটি মেয়ে সাইকেল চালাতো। মেয়েটির নাম জানতাম না। সবাই বলতো ‘ফাহিমের বোন’। পাড়ার একটা কোচিংএ পড়তাম তখন। একদিন শুনি, কোচিং এর স্যারেরা কিছু সিনিয়র ছেলেদের নিয়ে ‘ফাহিমের বোন’এর সাইকেল চালানো নিয়ে সমালোচনা করছেন। এতবড় মেয়ের সাইকেল চালানোর কী দরকার সেটা তারা বুঝে উঠতে পারছেন না। মেয়েটির বাবা-মাও এসব ব্যাপারে সচেতন না বলে তাদেরকে নিয়ে সমালোচনা চলে আরও কিছুক্ষণ।

এসব সমালোচক, নিন্দুক, ধর্ষক, ইভটিজারদের ভয়ে প্রয়োজন ছাড়া মেয়েরা সাধারণত বাইরে যায় না। কারণ বাইরে গেলে সুস্থ ভাবে ফিরে আসতে পারবে এর নিশ্চয়তা কে দিবে? বাইরের জগতে মেয়েদের কোন বিনোদন নেই, বিনোদন তবে কোথায়? কেউ কেউ বিনোদন খুঁজে নেয় টিভি সিরিয়ালে। সিরিয়ালে বৌ-শাশুড়ির ঝগড়া দেখে সবাই নিশ্চিত হয়, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু আর জগতের সব সমস্যার স্রষ্টা মেয়েরাই। যদিও বৌ-শাশুড়ির ঝগড়ার স্ক্রিপ্ট লেখক, পরিচালক যে অধিকাংশ সময় পুরুষেরাই হয় সেটা কারও খেয়াল থাকে না।

আপনারা মেয়েদের বাইরে খেলাধুলা মেনে নিতে পারেন না, ইভ টিজিং করে মজা লুটেন, গলির মুখে মেয়েরা আড্ডা দিলে মেয়ের চরিত্র নিয়ে পাড়ায় গবেষণা করাকে সামাজিক দায়িত্ব মনে করেন। আপনারাই মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী, এই আপনারাই নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে মেয়েকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। আবার ঘরে বসে সিরিয়াল দেখলেও আপনাদের আপত্তি। আপনারা আসলে চানটা কী?

পুরুষত্বে সিগারেটের ছেঁকা

সুন্দরবন রক্ষার হরতালে একটি মেয়েকে ক্যামেরা হাতে সিগারেট ফুঁকতে দেখা গেল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি ছড়িয়ে পড়লে মেয়েটি তীব্র সমালোচনাও নিন্দার মুখোমুখি হয়। যেন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রও এতটা পরিবেশ দূষণ করতে পারবে না, যতটা একটি মেয়ে সিগারেট ধরিয়ে করে ফেলেছে।

সিগারেট খাওয়া তো বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। ছেলে মানেই সিগারেট মদ একটু আধটু হলেও খাবে। সিগারেট খায় নি এমন ছেলের সংখ্যা হাতে গোণা কয়েকজন হবে হয়তো। অনেককেই দেখি সিগারেট ফুঁকছে, ধোয়া উড়ছে এমন ছবি ডিএসএলআর ক্যামেরায় তুলে সেসব প্রোফাইল পিকচার দেয়। কাউকে তো সমালোচনা করতে দেখি নি। তবে এই মেয়েটির ছবি নিয়ে এত নিন্দের কারণ কী? মেয়েটি কি এমন কিছু করেছে যা সমাজে নিষিদ্ধ? এর উত্তর একইসাথে হ্যাঁ এবং না। কারণ সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ না হলেও মেয়েটির জন্য নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর বেশ কয়েকটি বিখ্যাত ছবির মধ্যে অন্যতম হল, পাইপ হাতে মুজিব। মুজিব কন্যা’র যদি এমন কোনও ছবি পাওয়া যায়? প্রধানমন্ত্রীত্ব যাবে, বঙ্গবন্ধু তার মেয়েকে সুশিক্ষা দিতে পারেননি বলে তিনিও সমালোচিত হবেন। নিজের পাইপ হাতে ছবি’তে কিন্তু তার কোনও সম্মানহানি হয় নি, মেয়েরটিতে হবে। এ কেমন নিয়ম?

সুশীল সমাজ মেয়েটিকে বোঝাচ্ছেন, সিগারেট খাওয়া কতটা ক্ষতিকর। যেন এই প্রথম সবাই মিলে বুঝতে পারলেন, সিগারেট খাওয়া ক্ষতিকর কিছু! রাস্তাঘাটে এত পুরুষ সিগারেট খায়। কই, কেউ তো কখনো তাদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে আসেন না, মেয়ে হলেই উপদেশ দিতে ছুটে আসতে হবে? মজার ব্যাপার হল- সিগারেট বলে নয়, মেয়েদের যেকোনো কাজেই পুরুষেরা ছুটে আসে উপদেশ দিতে। দুপায়ের ফাঁকের অঙ্গটির কারণে নিজেকে সকল বিষয়ে বোদ্ধা ভেবে ফেলেন বোধহয়। যখন বিদেশী সিগারেট আমদানী করা হয়, তখন আপনাদের কেন মনে হয় না দেশের, সমাজের জন্য ক্ষতিকর এই জিনিসটির আমদানী বন্ধ করা উচিত? তামাক চাষ বন্ধের আন্দোলনে আপনাদের পাওয়া যায় না কেন?

কেউ কেউ বলছেন, ‘সিগারেট খেলেই কি পুরুষ হওয়া যায় ? কাজেকর্মে পুরুষ হও।’ হেসে বাঁচি না। তাদের ধারণা মেয়েটি পুরুষ হতে প্যান্ট শার্ট পরেছে, পুরুষ হতেই সিগারেট খাচ্ছে। যেন পুরুষ হওয়া গর্বের কিছু! শিশ্ন আর অণ্ডকোষ নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। প্যান্টশার্ট পরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তাই পরেছে। সিগারেট খেতে ইচ্ছে হয়েছে তাই খেয়েছে- এ ব্যাপারটা তাদের চিন্তায় আসে না কেন? প্যান্ট,শার্ট, সিগারেট এসবে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার এমন ধারণার কারণ কী?

সিগারেট হাতে মেয়ের জন্য ‘সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ এই উপদেশ নিয়ে হাজির হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ শুভাকাঙ্ক্ষী । ইভটিজিং, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার নারীদের পাশে কেন শুভাকাঙ্ক্ষীরা সংখ্যায় নগণ্য হয়?

সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে পুরুষতন্ত্র ধ্বংস করা যায় না, বিপ্লব হয় না- এসব আমি জানি। আমি সিগারেট খাওয়া’কে ভালো বলছি না। কিন্তু একটি মেয়ের ক্ষেত্রে, মেয়েটি কী খাবে, কী পরবে এসব নিয়ে সমাজের মাথা ঘামানো, চোখ রাঙানোর স্বভাবটির প্রতিবাদ করছি। সিগারেট যেহেতু বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কিছু নয়, তাই ছেলেমেয়ে যেকেউ চাইলে সিগারেট খেতে পারে। কিন্তু একজন ছেলে ধূমপায়ীকে কেউ খারাপ চরিত্রের অধিকারী ভাববে না। কিন্তু একজন মেয়ে ধূমপায়ীর শুধুমাত্র ধূমপান করে বলে চরিত্রের দোষ ধরা হবে কেন? ধূমপানের সাথে ছেলের চরিত্রের সম্পর্ক না থাকলে মেয়ের চরিত্রের সম্পর্ক থাকে কী করে? একই কাজ ছেলে করলে এক নিয়ম, মেয়ে করলে ভিন্ন নিয়ম হবে কেন?

আম্মু তোমার কোলে তোমার বলে

আজকাল অনেকেই স্মার্ট সাজতে কথা বলার সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি। এরই প্রতিবাদে বায়ান্ন নিয়ে একটি গান শুনছিলাম। শিল্পীর নাম নাজির মাহামুদ। না, শিল্পীর নামে বাংলার চিহ্ন নেই। এতে অবশ্য শিল্পীর কোনো দোষ নেই। বাঙালি মুসলমানের নাম মানেই যেন অদ্ভুত অর্থের আরবি শব্দ। বেশিরভাগ আবার আরবি শব্দগুলোর অর্থ না বুঝেই আরবির প্রতি গভীর প্রেম থেকে নামগুলো রাখে। আরবি শব্দ এত্তেলা থেকে ইত্তিলা শব্দটি এসেছে যার অর্থ সংবাদ। স্কুল কলেজে অনেকেই আমার নামের অর্থ জানতে চেয়েছে। কারণ এ শব্দ তারা আগে শোনে নি। বাংলা ডিকশনারিতে আছে নাকি? -প্রশ্ন অনেকের। নামটা অপরিচিত বলেই বাংলা ডিকশেনারিতে আছে কিনা জানার ইচ্ছে। যদিও বিভিন্ন অদ্ভুত অর্থের আরবি নাম অহরহ শুনে এতটাই পরিচিত হয়ে গেছে, সেগুলোর সাথে যে বাংলা ডিকশনারির কোনো সম্পর্ক নেই সেদিকে নজর নেই। নজর নেই বলাটা বোধহয় ভুল হবে। আরবি নাম মানে ইসলামিক নাম, এ ধারণা থেকেই তো সবাই আরবিতে নাম রাখে। এখন আরবিতে সেই শব্দের অর্থ ছাগল হোক বা ভেড়া, তাতে কী যায় আসে? আরবি তো আরবিই। আর তাছাড়া বাংলা নামগুলো অনেকটা ‘হিন্দু হিন্দু’ শোনায়। মুসলমানের নামে ‘হিন্দু হিন্দু’ গন্ধ, একজন মুসলমানের জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু হয় না।

নাজির মাহামুদ গানের একটি লাইন অনেকটা এরকম, ওরা মাকে ডাকে মাম্মি আর বাবাকে ডাকে ড্যাড/….. আমি হাসবো না কাঁদবো ওরে ও ও বায়ান্ন, তোর জন্য; যদিও মাম্মি আর ড্যাড ডাকার সংখ্যা খুব বেশি নয়। বরং অধিকাংশই মাকে আম্মু/আম্মা/আম্মি, বাবাকে আব্বু/আব্বা ডাকে। অথচ আগে কিন্তু সবাই মাকে মা, বাবাকে বাবা-ই ডাকতো। কে কার বাবা-মা’কে কী ডাকবে সেটা যার যার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু সবাই মিলে একসাথে বাবা-মা নামক দু’টি অতিপ্রিয় শব্দকে অন্য ভাষায় আপন করে নেয়া মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। আরো দুঃখের বিষয়, শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা মাম্মি আর আম্মি ডাকের সংখ্যা সম্পর্কে জেনেও শুধুমাত্র মাম্মি ডাকেরই প্রতিবাদ করেন।

কথায় কথায় ইনশাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, মাশাল্লাহ, সোবাহানাল্লাহ, খোদাহাফেজের ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে। না, এ নিয়ে আমরা কথা বলবো না। এ যে সুন্নত! রাজনৈতিক নেতারা কথায় কথায় ‘ইনশাল্লাহ’ শব্দটি ব্যবহার করে। আমরা ক্ষমতায় গেলে- ‘ইনশাল্লাহ, ব্রিজ হবে’,‘ইনশাল্লাহ, হাসপাতাল হবে, ‘ইনশাল্লাহ, উন্নয়নের জোয়ার বইবে’। ইনশাল্লাহ মানে হল, আল্লাহ চাইলে। ব্যাস আল্লাহও চায় না, উন্নয়নের গল্পও ধীরে ধীরে রূপকথার পাতায় চলে যায়। আল্লাহ চায় না বলাতে রাগ করতে পারেন অনেকেই। তবে অর্থটা তো এমনই দাঁড়ায়।

‘মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ, চেহারা হ্যায় মাশাল্লাহ...’ এরকম একটা হিন্দি গান ক্লাসে বসে কলেজের এক বান্ধবী গাইছিল। স্যার তার সামনে হাঁটছে সে খেয়াল নেই। স্যার প্রথম দু’টা শব্দ শুনেই বললেন, ‘দেখছো দেখছো, মেয়েটা কতো ভালো গজল গাচ্ছে’। হাসতে হাসতে স্যারকে বললাম, স্যার পুরো গজলটা শুনে যান। দেখলাম স্যার একরকম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করলেন। যার অর্থ, নিজে তো এসব ভালো কাজের মধ্যে নেই, অন্য কেউ ভালো কিছু করলে তাকে নিয়ে ফাজলামো, বেয়াদব মেয়ে!

‘এখানে প্রস্রাব করবেন না’ এ দেয়াল লিখনের তোয়াক্কা ছেলেরা করে না। অনলাইনে একটি ছবি দেখলাম, প্রস্রাব না করার অনুরোধটি আরবিতে লেখা হয়েছে। ব্যাস, আর কেউ ভুলেও ওদিকে মূত্রত্যাগ করতে যায় না। এতেই বোঝা যায়, মানুষের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। আসল প্রেম অন্য ভাষায়।

কথায় অপ্রয়োজনীয় আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে বলছি, ইংরেজির বিরুদ্ধে কিছুই বলিনি। কারণ আজকের দিনটিই তো সুশীল সমাজের ইংরেজির বিরুদ্ধে বলার দিন। এ নিয়ে বলার লোকের অভাব হবে না। তবুও বলি, নিজেদের স্মার্টনেস জাহির করতে আমার বয়সী অনেকেই কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি, বাংলা শব্দকে ইংরেজির মতো উচ্চারণ করি, যা খুব বাজে শোনায়। আমরা হয়তো বুঝতে পারি না সেটা। কারণ ইংরেজি জানা মানেই বিশাল জ্ঞানী কিছু, এ ধারণা তো আমরা বড়দের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমি ইংরেজি বর্জন করতে বলছি না। বাংলা ভাষায় অনেক ইংরেজি শব্দ আছে সেসবও ত্যাগ করতে বলছি না। আমি বলতে চাইছি, বাংলা বলতে গিয়ে ন্যাকামো করে অপ্রয়োজনীয় ভাবে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে নিজেকে জাহির করার ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। একইভাবে বাংলার সাথে অপ্রয়োজনীয় ভাবে আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহার করে নিজেকে ধার্মিক বা অতিভদ্র জাতীয় কিছু দেখানোটার অভ্যাসটাও বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালীর জন্য শুভ কিছু বয়ে আনবে না।

নারীবাদ যখন শিশ্নের আগায়

নাস্তিক মানেই মানবিক হবে, নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করবে এরকম ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নাস্তিকতা যেহেতু একটি লড়াইয়ের অংশ, প্রগতির অংশ সেখানে অনেকেই ভাবতে পারেন প্রগতিশীল নাস্তিকরা নিশ্চয়ই নারীবাদী। আমিও একসময় এমনটি ভাবতাম। ইদানীং আমার ভুল ধারণা ভাঙ্গতে বসেছে। ধর্মের বিরুদ্ধে লিখে বাস্তব জগতের অনেক বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হলেও ভার্চুয়াল জগতে পেয়েছি অনেক বন্ধু, যাদেরকে আমি এতদিন সমমনা বন্ধু ভেবে এসেছি। ভেবেছিলাম আমরা বুঝি একই লড়াই লড়ছি। কিন্তু না, আমাদের লড়াইটা ভিন্ন- এটা বুঝতে শুরু করেছি যখন থেকে ধর্মের ভণ্ডামি তুলে ধরার পাশাপাশি পুরুষতন্ত্রের বর্বরতা নিয়ে লিখতে শুরু করেছি।

আমার নাস্তিক বন্ধুরা আমাকে নারীবাদের একটি সীমারেখা এঁকে দিয়েছেন, এর বাইরে কিছু বললে তাঁরা আমাকে 'উগ্রনারী' আমার নারীবাদ'কে 'উগ্রনারীবাদ' বলেন। পুরুষতন্ত্রের স্রষ্টা যেহেতু পুরুষ সেহেতু পুরুষতন্ত্রের কথা লিখতে পুরুষের কথাও এসেছে। আমার একসময়ের সমমনা বন্ধুরা আমাকে অবাক করে বললেন, আমি নাকি সরলীকরণ করছি। যারা পুরুষতান্ত্রিক চেতনার মানুষ নন তাঁদের কেন আমার কথা গায়ে লাগাতে হয় আমি বুঝে উঠতে পারি না। বাঙ্গালি লেখকদের লেখায় কত পড়েছি বাঙ্গালি নারী নিয়ে নানান কথা। বাঙ্গালি মেয়ে শাড়ি পরতে পছন্দ করে, শাড়ির সাথে মিলিয়ে একটা টিপ পরে, সাথে চুড়ি... আমি শাড়ি পরি না, টিপ চুড়িও না। কিন্তু আমার কখনো নিজেকে বাঙ্গালি মেয়ে নয় বলে মনে হয় নি। অথচ আমার নাস্তিক পুরুষ বন্ধুরা যুক্তি দেখান, আমি যখন পুরুষ লিখে পুরুষের সমালোচনা করি তখন নাকি তাঁরাও অপমানিত বোধ করেন। অন্য পুরুষদের দোষ তাঁদের গায়ে এসেও লাগে। এমন সরলীকরণ নাকি উগ্রতার লক্ষণ। আমাকে বলতে হবে 'কিছু পুরুষ' 'কিছু ছেলে'। আচ্ছা, স্কুলে যখন স্যারেরা বলতেন, ক্লাস সেভেনের ছেলেগুলো হল বদমাশের হাড্ডি, একেকজন বিচ্ছুর সেরা। এর মানে কি এই যে ক্লাস সেভেনের প্রতিটা ছেলেই বিচ্ছু, ওই ক্লাসে একজন ভালো ছেলেও নেই? তখন কি আপনাদের মনে হয়েছিল, স্যার সরলীকরণ করে খুব অন্যায় করে ফেলেছেন? উনি একজন উগ্র শিক্ষক? ক্লাসের ভালো ছাত্রটি ঠিক জানে কথাগুলো স্যার তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন নি। আবার ক্লাসের বিচ্ছুরাও জানে কথাগুলো স্যার তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন। কিন্তু আমার মুক্তমনা, প্রগতিশীল, নাস্তিক পুরুষ বন্ধুরা এই সহজ বিষয়টি বুঝতে পারেন না কেন? হয়তো বুঝতে পারেন বলেই প্রতিবাদ করেন। নাকি নিজেদের ভিতরের পুরুষতন্ত্রকে আড়াল করে, নারীবাদীর মুখোশে পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার এটি একটি নতুন কৌশল? উগ্র নারীবাদীদের কারণে শুনেছি অনেক নারীবাদী পুরুষ পুরুষতান্ত্রিক আচরণ করছে, এই উগ্র নারীবাদীরা নারীবাদের জন্য ক্ষতিকর! যারা উগ্র নারীবাদীদের জন্য পুরুষতান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছেন বলে দাবী করছেন তাঁরা কি নারীদের দয়া বা করুণা করতেন বলে নারীবাদী হয়েছিলেন যে, উগ্র নারীবাদীদের কারো দয়া দরকার হয় না বলে জানিয়ে দেয়াতে আপনারা আবার আপনাদের আসল রূপে ফিরে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন? উগ্র নারীবাদীরা আপনাদের দয়া দেখিয়ে ভালো পুরুষটি সাজার সুযোগ দিচ্ছে না, আপনাদের দয়া করুণা প্রার্থনা করছে না। আর এটিই বোধহয় আপনাদের চোখে উগ্র নারীবাদীদের মূল উগ্রতা।

বুক ঢেকে রাখতে হবে, নিজের শরীর নিয়ে লজ্জিত বা বিব্রত থাকতে হবে-- বাংলাদেশের সমাজের নিয়মটি যখন এই, সেখানে আমি যখন মেয়েদের শরীর ঢেকে রাখার এই বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে লিখি আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি নাস্তিক পুরুষদের বদলে যাওয়া রূপ। না, তাঁরা হিজাব-বোরখার বিরুদ্ধে, যেহেতু এটি ইসলামি পোশাক। কেউ কেউ আবার ওড়নারও বিরুদ্ধে। কিন্তু তাঁদের প্রগতি আটকে যায় যখন একটি ১৮ বছর বয়সী মেয়ে প্রশ্ন তুলে তারই সমবয়সী একটি ছেলে খালি গাঁয়ে দৌঁড়ঝাঁপ করে ঘুরে বেড়াতে পারলে সে পারবে না কেন? বাংলাদেশের মতো ইসলামিক দেশে একটি মেয়ে যখন তার ব্রা পরা ছবি পাবলিকলি দিয়ে বুঝান যে তিনি তাঁর শরীর নিয়ে লজ্জিত নন, বিব্রত নন, তখন আমার নাস্তিক বন্ধুরা ব্যঙ্গ সুরে জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা যদি এখন তাঁদের শিশ্নের ছবি পোস্ট করেন তাতে কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগবে কিনা। শিশ্ন কি গোপন কিছু? রাস্তা ঘাটে লুঙ্গি তুলে প্রস্রাব করতে বসে যাওয়া কত শিশ্নই তো দেখেছি। দেখেও না দেখার ভান করেছি, চোখ সরিয়ে নিয়েছি। বাংলাদেশে কোথাও দেখেছেন কোনও মা'কে সবার সামনে স্তন না ঢেকে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে? বাংলাদেশের মত একটি সমাজে যেখানে মেয়েদের ওড়না ঠিক বুকে না থাকলে একশ পুরুষ ছুটে আসে মেয়েটির স্তন খুবলে খেতে, যেখানে মা বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে ঢেকে খাওয়াতে হয় যেন কোনও ফাঁকে আবার স্তন দেখা না যায়- সেখানে মেয়েদের বুকের সাথে নিজেদের শিশ্নের তুলনা দিয়ে আমার নারীবাদ গবেষক নাস্তিক পুরুষ বন্ধুরা কোন ধরণের নারীবাদের চর্চা করেন?

'আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে, 

এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।' এরকম উক্তির ব্যাখায় শিক্ষক ও লেখক হুমায়ুন আজাদ যখন বলেন, 'কানন বালা ছিলেন এক সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী; প্রখ্যাত নায়িকা। আমাদের বাঙলায় অভিনয়ের যে ইতিহাস, তাতে দেখা যায় পতিতা পল্লী থেকেই প্রথম নায়িকাদের মঞ্চে নেয়া হয়েছে। ..বিশ্ববিদ্যালয় অভিনেত্রী তৈরির স্থান নয়, জ্ঞানী তৈরির স্থান। অভিনেত্রী হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের ভোগ্যপণ্য, আমি চাই না আমার ছাত্রী ভোগ্যপণ্য হোক।' তখন শফি হুজুর আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মধ্যে আমি পার্থক্য করতে পারি না। অভিনয়ে তাঁরা উভয়েই কোনও শিল্প খুঁজে পান না, খুঁজে পান শুধু নারীর দেহ, যাকে তাঁরা ভোগ্যপণ্য বলেন। প্রগতিশীল শিক্ষক চান না তাঁর ছাত্রীরা কেউ অভিনেত্রী হোক। আচ্ছা, উনি কি তাঁর ছাত্রদের অভিনয়ে কোনও শিল্প খুঁজে পেয়েছিলেন? নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন। কারণ তিনি কাননবালাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাওয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন কেবল। নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিন'কে যখন মোল্লারা এবং প্রথাবিরোধী লেখক নামে পরিচিত কেউ একই সুরে পতিতা বলে গালি দেয় তখন আমি প্রথাবিরোধী লেখক আর মোল্লাদের মধ্যে পার্থক্য কীভাবে করি? শুধু বুঝে নিই, প্রথাবিরোধীরাও নারীবিরোধী প্রথাগুলোকে যত্নে লালন করেন। এদিক থেকে শফি হুজুররা আমার চোখে অনেকটাই সৎ। ধর্ম মতে তাঁদের নাটক, গান, সিনেমা হারাম, মেয়েরা তাঁদের কাছে শস্য ক্ষেত্রে- এটি তাঁরা স্বীকার করেন। অথচ প্রগতির মুখোশে আমাদের প্রগতিশীলেরা নারীদেরকে শস্য ক্ষেত্র বানিয়ে রাখেন বটে কিন্তু অভিনয় করেন যেন তাঁরা নারীর কর্তা নয় বন্ধু হতে চান।

আমার লেখাটি পড়ে যাদের মনে হচ্ছে, আমি লেখাটি তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে লিখেছি, তাহলে নিঃসন্দেহে লেখাটি তাঁদের মতো প্রগতির মুখোশে পুরুষতান্ত্রিক পুরুষের জন্যই লেখা।

একসময় আমি যা জানতাম না বা নতুন কিছু শুনলে হেসে উঠতাম, 'এও আবার হয় নাকি?' 'এটা তো পাগলের কাজ' এরকম ভাব নিতাম। এখন ভাবলে বুঝি, তখন আমি কতটা বোকা ও বদ্ধ মানসিকতার ছিলাম। নতুন কি দেখলে সেটা নিয়ে ব্যঙ্গ করা, হেসে উড়িয়ে দেয়া মূলত আমার চিন্তার সীমাবদ্ধতাকেই প্রকাশ করে। এখন দেখছি, এধরণের চিন্তার সীমাবদ্ধতা সম্পন্ন মানুষগুলোই নাকি প্রথাবিরোধী, একেকজন বড় মুক্তমনা। লড়াইটা কেবল বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীদের মধ্যে নয়। লড়াইটা নিজের সাথে নিজেরও। আমাদের সকলের মনেই বিভিন্ন সংস্কার রয়ে গেছে যা আমরা ছোট থেকে দেখে বড় হয়েছি, সেসব সংস্কার থেকে প্রতিনিয়ত মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে যাওয়া, ভুল শুধরে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা, নিজেকে ভেঙ্গে গড়ে প্রতিনিয়ত শুদ্ধ হওয়ার লড়াইটা কিন্তু আমরা অনেকেই লড়তে চাই না। এজন্যই বোধহয় আমরা অনেক প্রথার বিরুদ্ধে গিয়েও শেষ পর্যন্ত কোনও না কোনও প্রথার জালে আটকে যাই।

পুরুষ হওয়া কি খুব গর্বের কিছু?

‘নারীরা কি চাইলে খাড়াইয়া মুততে পারবে? পারবে না, কাজেই পুরুষ যে অধিকার ভোগ করবে সেটা নারীরা ভোগ করার অধিকার রাখে না।’ এরকম মন্তব্য প্রতিনিয়ত শুনছি। যেন দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা ভয়ংকর গর্বের একটি কাজ। এরকম মন্তব্যকারীরা মনে করেন, নারীরা সমানাধিকার চায় মানে হল তারা পুরুষ হতে চায়, পুরুষের মত দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে চায়। ‘নারীবাদ মানে পুরুষ হবার চেষ্টা নয়’। এধরণের মন্তব্য তাদের মুখেই শোভা পায়। প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত কেউ এধরণের মন্তব্য করলে বুঝতে হবে, তিনিও দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার গর্বে গর্ভবতী হওয়া গ্রুপের একজন গর্বিত সদস্য। তাদের ধারণা, পুরুষ হওয়া গর্বের কিছু। তাই নারীরা শুধু পুরুষ হতে চায়। আহা! ভেবে কী সুখটাই না পায় তারা!

বাঙালি নারীর পোশাক শাড়ি। এখন অনেকে শাড়ির সাথে হিজাব পরছে। অথচ কিছু নারী হিজাব তো দূরে থাক, শাড়ি পর্যন্ত পরে না! পরে জিন্স, টি শার্ট! আজ্ঞে, বাঙালি পুরুষের পোশাকটি যেন কী? কে পরে ওই ধুতি,ফতুয়া,পাঞ্জাবী? কোনও মেয়ের ছোট চুল রাখা, প্যান্ট,শার্ট পরার মানে দাঁড় করানো হয়েছে, মেয়েটি পুরুষ হতে চায়। প্যান্ট শার্টকে বাঙালি পুরুষদের নিজেদের বাপদাদার সম্পত্তি ভেবে ফেলার কারণটা কী? আপনি চুল ছোট রেখে, প্যান্ট শার্টের মত ঝামেলা মুক্ত পোশাকটিকে আপনি নিজের পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কেউ যদি, চুল ছোট রাখে, প্যান্টশার্ট পরে তবে সে আপনার মত পুরুষ হতে চায় না, বরং আপনার মত ঝামেলা মুক্ত হতে চায়। নিজের ভালোটা শুধু আপনিই বোঝেন এবং বোঝার অধিকার রাখেন- আপনার যদি এমন ধারণা হয়ে থাকে তবে জেনে রাখুন ধারণাটি একশ ভাগ ভুল। মেয়েরা কীভাবে চলবে, কীভাবে বলবে, প্রস্রাব দাঁড়িয়ে করবে নাকি বসে করবে, চুল ছোট রাখবে নাকি বড় রাখবে, পর্দা করবে কি করবে না-- এসব কিছু মেয়েদের উপরই ছেড়ে দিন। মেয়েরা কী করবে মেয়েদেরকেই বুঝতে দিন। ঠিক যেভাবে আপনি কী পরবেন, কীভাবে চলবেন সেটা নিজে ঠিক করে থাকেন।

নারীবাদ মানে, "এটা নয়, ওটা নয়, সেটা নয়” এসব হল নারীবাদ’কে পুরুষের নিজস্ব সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করে ফেলার চেষ্টা। বাংলাদেশের মত একটি ঘোর নারী বিদ্বেষী সমাজে নারীবাদ নিয়ে লিখতে গেলেই বলে, ‘পুরুষ বিদ্বেষী’। নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা পেলে এতদিন ধরে নারীর অধিকার খর্ব করে যে রাজত্ব করেছেন সেটি আর চলবে না। ধর্ষণ করে দোষ দিয়েছেন-মেয়ের চরিত্রের, চলাফেরার, পোশাকের। পতিতাদের সাথে সমাজের বাবুরা শুয়ে পতিতাদের নষ্ট করে, বেশ্যা মাগী বানান। অথচ বাবুর চরিত্র, সামাজিক মর্যাদার কোনও হেরফের হয় না। পতিতালয় বন্ধের দাবী তুললে নির্লজ্জ ভাবে তারা জানান- ‘এতে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে’। নিজেদের নষ্টামির দোষ ভুক্তভোগীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার এ সুযোগ যারা আপনাদের দিতে চায় না, আপনাদের দৃষ্টিতে তারা নিশ্চয়ই ঘোর পুরুষ বিদ্বেষী।

মেয়েরা বড় হলে মায়েরা সাধারণত তাদের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলে থাকেন, ‘শত হলেও পুরুষ, পুরুষ মানুষের বিশ্বাস নাই’। মামা, চাচা, খালু,ফুপা, এমনকি বাবা, ভাই দ্বারা যৌন হেনস্থার স্বীকার হচ্ছে নারীরা। এমন কোনও মেয়ে হয়তো পাওয়া যাবে না, যে তার সমগ্র জীবনে কোনও রকমের যৌন হেনস্থার স্বীকার হয় নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এটি নিকট আত্মীয়ের দ্বারা ঘটে থাকে। আমি গরমকালে বাসায় পাতলা হাতকাটা গেঞ্জি পরতাম। যা আমার মায়ের খুব অপছন্দ ছিল। ‘বাসায় বাবার সামনে এধরণের কাপড় পরতে নেই’ এই কথার উত্তরে আমি যখন বলেছি, ‘কেন? বাবা কি মাঝেমধ্যে ভুলে যান যে, আমি তার সম্পর্কে মেয়ে হই’। নিশ্চিত ভাবে আমার উত্তরটি শুনতে খুব বাজে লাগছে। যদিও বাবার সামনে, ভাইয়ের সামনে ঢেকে চলার কথাটিকে খারাপ বা বাজে কথা বলে আপনাদের মনে হয়নি। বাবা বা ভাইয়ের চোখ যদি মেয়ে বা বোনের শরীরের দিকে যায় তবে তাদের দ্বারাও ভুল কিছু হয়ে যেতে পারে-- এই ভয়েই তো মেয়েরা, বোনেরা তাদের বাবা-ভাই-নিকট পুরুষ আত্মীয়দের সামনে শরীর ঢেকে চলে।

আমাকে দেখে কেউ ভয় পাচ্ছে, আমি আছি বলে অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে পোশাক পরছে, আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না-- এরকম কিছু আমার জন্য নিঃসন্দেহে লজ্জার। আচ্ছা, ছেলেদেরও কি লজ্জা হয়, যখন একটি মেয়ে তাকে ধর্ষক ভেবে ভয় পায়, তাকে দেখে সতর্ক হয়, ওড়না টানে? সমগ্র নারী জাতি যখন পুরুষ জাতিটিকে ভয় পেয়ে চলে, বিশ্বাস করতে পারে না, ধর্ষক কামুক ভাবে তখন পুরুষ হিসেবে লজ্জিত না হয়ে তারা কীসের গুণে গর্বিত হয়?

মনে মনে নিশ্চয়ই আপনাদের রণ সংগীতটি বাজছে, ‘সব পুরুষ এক নয়’। জেনে রাখুন, সব পুরুষ এক না হলেও, সব নারীরাই সব পুরুষকে অবিশ্বাস করে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেই ৭৬টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৩৬৫জন নারী ও কন্যাশিশুকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। দেশে প্রকাশিত ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

তাদের প্রকাশিত তথ্যানুসারে ৭৬টি ধর্ষণের মধ্যে ১৪ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪ জনকে, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৪ জন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫ জন। এছাড়া এসিডদগ্ধ হয়েছেন ৩ জন। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ৫ জন, তন্মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১ জনের। ৮ জন নারী অপহরণের শিকার হয়েছেন। পাচারের শিকার হয়েছে ৯ জন নারী ও কন্যাশিশু। এদের মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে ২ জনকে। বিভিন্ন কারণে ৬৩ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে।এছাড়া যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩১ জন, এদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ১২ জনকে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১ জন। উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ২৩ জনকে। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ৩৩ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন এবং ৯ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। জানুয়ারি মাসে বাল্য বিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ২২টি, এদের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১২ জন এবং ৩১ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ২১ জনকে। পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছে ০৪ জন। বে-আইনি ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ২টি। 

ফেব্রুয়ারি মাসে মোট নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৭৬টি। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৭৯ টি। বিভিন্ন কারণে ৫৯ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন নির্যাতনের কারনে ২৫ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এবং ০৮ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।

এছাড়াও প্রতিনিয়ত, রাস্তায় ঘাটে, যানবাহনে, কর্মস্থলে, নিজের ঘরে যেসকল যৌন হেনস্থা হয় সেগুলা অধিকাংশই অজানা থাকে। যৌন নিপীড়ককে রক্ষা করতে সবাই উঠে পরে লাগে, ঘটনা জানাজানি হলে মেয়ের জন্য ভালো হবে না- এই অজুহাতে চেপে যেতে বলা হয়। যেন, মেয়ের ভালোর কথা কতই না ভাবেন তারা। মেয়েদের এমন শুভাকাঙ্ক্ষী থাকলে আর শত্রুর দরকার কী?

মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৭

একই আদর্শে নন্দিত রোকেয়া, নিন্দিত তসলিমা



৯ ডিসেম্বর। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস। বেগম রোকেয়া ও তসলিমা নাসরিন উভয়েই নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। বেগম রোকেয়া তাঁর সময়কালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিন্দা কুড়িয়েছিলেন, বর্তমানে তসলিমা নাসরিন কুড়াচ্ছেন। তসলিমা নাসরিন ও বেগম রোকেয়ার লেখার মূল অর্থ এক হলেও তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ নাম আর বেগম রোকেয়া মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে সম্মানিত। পাঠ্যবইয়ে বেগম রোকেয়ার বাছাই করা কিছু লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রোকেয়া হল, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নারী অধিকারের পক্ষে তসলিমা নাসরিনের কোনও লেখা উল্লেখ করলে লোকে বলে তসলিমা নয় বেগম রোকেয়া পড়ো। বেগম রোকেয়াকে অনুসরণ করো। বেগম রোকেয়াকে আমাদের সমাজে একজন মুসলিম নারীর ইমেজ দেয়া হয়েছে। ঘোমটা পরা, স্বামী-পিতা-ভাইদের সকল আদেশ মাথা পেতে নিয়ে কেবল স্কুলে যাওয়ার অধিকার চায় এমন। যদিও বেগম রোকেয়ার বই গুলো ঘাঁটলে তাঁর লেখা ভয়ংকর সব সত্য বেরিয়ে আসে- ধর্ম সম্পর্কে, পুরুষ সম্পর্কে। এতে বোঝা যায় রোকেয়া ও তসলিমার আদর্শ ভিন্ন নয় বরং এক।

বেগম রোকেয়া মৃত। তসলিমা জীবিত। জীবিত তসলিমাকে কবর দিতে মৃত বেগম রোকেয়াকে টেনে আনা হয় নিজেদের মত করে। ভবিষ্যতে হয়তো নতুন কোনও প্রতিবাদী নারী আসবে যাকে নিষিদ্ধ করতে তসলিমাকে হিজাব পরিয়ে মুসলিম নারী সাজানো হবে। একথা তসলিমা নাসরিন তাঁর ‘সেই সব অন্ধকার’ বইটিতেও উল্লেখ করেছিলেন।

তসলিমা নাস্তিক, বেগম রোকেয়া আস্তিক। কাজেই বেগম রোকেয়াকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। এরকম একটি ধারণা প্রচলিত আছে। চলুন দেখি বেগম রোকেয়া ধর্ম সম্পর্কে কী লিখে গেছেন- "আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।... তবেই দেখিতেছেন, এই ধর্মগ্রন্থগুলো পুরুষ রচিত বিধি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। ...কোন স্ত্রী মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন।..যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ় সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।..." ( গ্রন্থঃ মতিচুর) 




এখানে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় রোকেয়া ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। বেগম রোকেয়ার মত তসলিমা নাসরিনও মনে করেন, ধর্ম হল নারীকে দমনের উদ্দেশ্যে পুরুষের সৃষ্ট কিছু বিধান। যেখানে ধর্মের প্রভাব বেশি সেখানে নারীর প্রতি অত্যাচার ও বেশি। এ কথা রোকেয়া বলেছিলেন, তসলিমা তাঁর বিভিন্ন লেখায় নানান তথ্য হাজির করে প্রমাণও করেছেন। 

‘অলঙ্কার না Badge of Slavery’ প্রবন্ধে রোকেয়া লিখেছেন “ ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে। যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণী শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিত না । ... যে কথা পুরাকালে অসভ্য বর্বরগণ বিশ্বাস করিয়াছিল, তাহা বর্তমান কালের সুসভ্যগণ যদি বিশ্বাস করেন, তবে সভ্যতা ও অসভ্যতায় প্রভেদ কি ? যাহা হউক আমরা আর ধর্মের নামে নতমস্তকে নরের প্রভুত্ব সহিব না ।”

ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা পুরুষতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী তাঁরা মনে করেন তসলিমা নাসরিন পুরুষ বিদ্বেষী, আর রোকেয়া তেমনটা নন। কাজেই রোকেয়া অনুসরনীয়, তসলিমা বর্জনীয়। আসুন দেখি পুরুষ সম্পর্কে রোকেয়া কী বলেছেন-




১. নারী যাহা দশ বৎসরে করিতে পারে, পুরুষ তাহা শতবর্ষেও করিতে অক্ষম।

২. নারীস্থানে স্বয়ং শয়তানকেই (পুরুষ জাতি) শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছেন, দেশে আর শয়তানী থাকিবে কি রূপে? (সুলতানার স্বপ্ন, ১৩৪) 

৩. তাহারা কিছুই করিবে না- তাহারা কোন ভালো কাজের উপযুক্ত নহে। তাহাদিগকে ধরিয়া অন্তঃপুরে বন্দি করিয়া রাখুন। (সুলতানার স্বপ্ন, ১৩৫)

৪. কুকুরজাতি পুরুষাপেক্ষা অধিক বিশ্বাসযোগ্য। (ডেলিশিয়া-হত্যা)

যারা পুরুষতন্ত্রকে মনেপ্রাণে ধারণ করে, তাঁরা সাধারণত পুরুষ আর পুরুষতন্ত্র’কে আলাদা করতে পারেন না। তাই তাঁরা নারীবাদ বলতে বুঝেন পুরুষ বিদ্বেষ। ইদানীং অনলাইনে নারীবাদ নিয়ে কিছু লিখলেই সেসব পুরুষেরা স্লোগান তুলেন, ‘সব পুরুষ এক নয়’। নিজেকে এক মনে না করলে, ভিন্ন মনে করলে সেসব কথা নিজের গায়ে না লাগালেই পারেন। হাতেগোনা কয়েকজন ভালো পুরুষ আছেন অবশ্যই। যারা সমানাধিকারে বিশ্বাস করেন, নারী অধিকারে বিশ্বাস করেন। কিন্তু ভুষির বস্তায় দু এক দানা চাল পাওয়া গেলেই তো আর সেটা চালের বস্তা হয়ে যায় না বা সে চালগুলোর কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করতে হয় না। তসলিমা’কে বর্জনের ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের একটি হাস্যকর যুক্তি হলঃ বেগম রোকেয়া মেয়েদের জন্য স্কুল করেছে, ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অভিভাবকদের বুঝিয়েছেন।তসলিমা কি ঘরে ঘরে গিয়ে সবাইকে নারী অধিকার বুঝিয়েছে? মেয়েদের জন্য স্কুল করেছে? না। কাজেই তসলিমা বর্জনীয়। ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষার আলো পৌঁছানোর যুগ পার করে এসেছি আমরা। আর মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্য দেশে এনজিওর অভাব নেই। বেগম রোকেয়ার সময়ে রোকেয়া যা করছেন এবং তসলিমার সময়ে তসলিমা যা করছেন দুজনেই সঠিক। সময়ের পার্থক্যে কাজের পদ্ধতি ভিন্ন হয়েছে শুধু।

বেগম রোকেয়া সমাজের অবস্থা বিবেচনায় তাঁর স্কুলটিকে টিকিয়ে রাখতে অনেক সময় আপোষ করেছেন বটে। তবে বর্তমানে বেগম রোকেয়ার মূল আদর্শকে আড়াল করে ওই আপোষের অংশটুকুকেই রোকেয়ার আদর্শ হিসেবে দেখানো হয়।

১. আমার স্কুলটা আমার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়। একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়ম কানুনগুলিও পালন করছি। (সওগত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনকে দেয়া সাক্ষাৎকার)

২. তবু পর্দা করছি কেন জানেন? বুড়ো হয়ে গেছি, মরে যাব। ইস্কুলটা এতদিন চালিয়ে এলাম, আমার মরার সঙ্গে সঙ্গে এও যদি মরে সেই ভয়ে। (ইব্রাহিম খাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার) 

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এবং তসলিমা নাসরিন উভয়েই স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন, ধর্মের ছায়াতলে কখনও নারীমুক্তি সম্ভব নয়। বর্তমানে অনেকেই আছেন যারা বেগম রোকেয়াকে আদর্শ মনে করেন, লেখাপড়া শিখে স্বামীর আদেশ মেনে হিজাব মাথায় চাপেন। মনে করেন হিজাব পালন তাদের ধর্মীয় নীতি এবং হিজাবে নারীর সম্মান বাড়ে। তারা কেন প্রশ্ন তোলে না, ধর্ম রক্ষা করতে ক’জন পুরুষ দাড়ি রাখে, টুপি পরে, জিন্স টি-শার্ট ফেলে টাকনুর উপর পাজামা পরে? ধর্ম রক্ষার দায় কি শুধু নারীর? তাঁরা প্রশ্ন করেন না, কারণ ধর্ম তাদেরকে প্রশ্ন করতে শেখায় না, মেনে চলতে শেখায়।

ইসলামিক পিস টিভির হুজুর যিনি তাঁর ওয়াজের জন্য বিখ্যাত, নাম আব্দুর রাজ্জাক। এই আব্দুর রাজ্জাকের এক ওয়াজে দেখলাম, তিনি বেগম রোকেয়াকে নারী জাতির কলঙ্ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং হাজারো ধর্মপ্রাণ মুসল্লি সেসব শুনছেন। না, তিনি রোকেয়ার ধর্মবিরোধী লেখা পড়ে তাঁকে ত্যাগের ৯ ডিসেম্বর। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস। বেগম রোকেয়া ও তসলিমা নাসরিন উভয়েই নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। বেগম রোকেয়া তাঁর সময়কালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিন্দা কুড়িয়েছিলেন, বর্তমানে তসলিমা নাসরিন কুড়াচ্ছেন। তসলিমা নাসরিন ও বেগম রোকেয়ার লেখার মূল অর্থ বা উদ্দেশ্য এক হলেও তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ নাম আর বেগম রোকেয়া মুসলিম নারী জাগরণের অঘোষণা দিয়েছেন তা নয়। রোকেয়া নারীকে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হওয়ার কথা বলেছেন বলেই হুজুরের কাছে তিনি নারী জাতির কলঙ্ক উপাধি পেয়েছেন। শফি হুজুর, যিনি মনে করেন মেয়েদের বাইরে কাজ করার অধিকার নেই, আল্লাহ্‌ নারীদের সৃষ্টি করেছেন শুধু ঘরের কাজ ও স্বামী সেবার জন্য। সেই হুজুর লক্ষ জনতা নিয়ে ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে সংবিধান বিরোধী ১৩ দফা দাবী তোলার সাহস পায়। ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার ফল তো এমনই হয়।

বেগম রোকেয়ার সময়কাল থেকে নারীরা একটু করে এগিয়ে প্রথমে পর্দার ভিতরে থেকে স্কুলে গেছে, ধীরে ধীরে শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পর্দা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে, পরবর্তীতে রাজনৈতিক-সামাজিক বিভিন্ন বিপ্লবে ও প্রতিবাদে নিজেরা অংশগ্রহণ করেছে, মতামত দিয়েছে।রোকেয়ার আদর্শ’কে পুরোপুরি মেনে না নিলেও বাছাই করা অংশটুকুকে অন্তত মেনে নেয়া হয়েছিল, রোকেয়া নামটিকে শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণের নীতি চালু হয়েছিল।এই অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বর্তমানে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ আমরা এক পা এক পা করে পিছিয়ে আবার ‘পর্দার ভিতরে থেকে লেখাপড়ার অধিকার’এর যুগে চলে এসেছি। ঠিক যেভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় একটি দেশ সৃষ্টি হয়ে বর্তমানে দেশটি রাষ্ট্রধর্মের অভিশাপ নিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হওয়ার পথে হাঁটছে। এখানেই ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদীদের সার্থকতা।

শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল মেয়েটির?



কিছুদিন আগে অনলাইনে একজন ছাত্রীর সাথে স্কুল শিক্ষকের কথোপকথন শুনছিলাম। ওই শিক্ষক ক্লাস এইটে কিংবা নাইনে পড়ে এমন একজন বাচ্চা মেয়েকে বিছানায় নেয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছিলেন। কথোপকথনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরছি-

স্যারঃ তুমি কি আমার কথা রাখবা না? আমাকে একটু সময় দাও, আসো কথা বলি। 

ছাত্রীঃ কী কথা স্যার? শিক্ষা বিষয়ক কথা? 

স্যারঃ তোমাকে কেনাকাটা করে দিব। 

ছাত্রীঃ আমার বাপ কি আমারে টাকা দেয় না? আপনের টাকা কেন নিব? 

স্যারঃ তোমাকে আমার ভালো লাগে। মনটা উথাল পাতাল করে তোমাকে দেখলে। 

ছাত্রীঃ ছিঃ ছিঃ স্যার। আপনি এসব কী বলেন? স্যার আপনার বউ নাই? 

স্যারঃ বউ আছে, কিন্তু বউ কী সবসময় ভালো লাগে? 

ছাত্রীঃ বউকে সবসময় ভালো না লাগলে আরেকটা বিয়া করেন। 

স্যারঃ তুমি কী পারবা না? তুমি পারবে কিনা বলো। 

ছাত্রীঃ আমি পারব মানে? কয়লা ধুইলে কখনো ময়লা যায় না। আমি যদি এখন এই কথা গুলো সবাইকে শোনাই? স্যারঃ না, প্লিজ। আমি আর বলব না। 

ছাত্রীঃ বলবেন না কেন স্যার? আজকে আপনি আমাকে বলছেন, কালকে আরেকজন স্টুডেন্টকে বলবেন। 

স্যারঃ আমি যা বলছি ভুল করছি। আর কখনো বলব না। 

ছাত্রীঃ স্যারদের একটা আলাদা নলেজ থাকে, আর একজন স্টুডেন্টের কথায় যদি স্যারের নলেজ হয় তাহলে সেই স্যারের কোনও যোগ্যতাই নাই স্কুলে শিক্ষকতা করার। আমি সব হেডমাস্টার স্যারকে শুনাইয়া দিব।

একজন শিক্ষক কী নোংরাভাবে বাচ্চা মেয়েটিকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দিলো! ভাবতে অবাক লাগে শিক্ষকদের মধ্যে এই মানসিকতার মানুষও আছেন। হেড স্যারের কাছে জানিয়ে কোনও ফল পেয়েছে কিনা জানি না। তবে মেয়েটির বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রেই মেয়েরা সমাজে সম্মানী ব্যক্তিদের নষ্ট চরিত্রের কথা প্রকাশ করে কোনও ফল পায় না। উল্টো মেয়েটির চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠে, দোষ দেওয়া হয় মেয়েটিকে। এই ভয়ে অনেকে অভিযোগ করতেও ভয় পায়।

আমি ফেসবুকে এরকম একজন ব্যক্তিকে চিনি, যিনি নিজেকে নাস্তিক দাবি করেন, টুকটাক কপিপেস্ট নারীবাদী লেখা লিখেন, আবার মাঝেমাঝে নারী নিয়ে মস্করাও করেন। তিনি সাধারণত নারীকে দুর্বল দাবি করে তার একটি লেখা বিভিন্ন মেয়েদের ইনবক্সে পাঠান। যেসব মেয়েরা ওই লেখার কোনও প্রতিবাদ করে না তাদেরকে তিনি নিয়মিত ইনবক্সে নক দিয়ে রূপের প্রশংসা, শরীরের প্রশংসা ইত্যাদি করে সম্পর্ক বিছানা পর্যন্ত নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আর নিজের সম্পর্কে সবাইকে বলেন, তিনি ইয়াং হ্যান্ডসাম, বিয়ে একবার করেছিলেন তবে বৌয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি, একা থাকেন। যদিও আমি তার বাসায় গিয়ে তার স্ত্রীর হাতের রান্না খেয়ে এসেছি। নিজেকে ইয়াং দাবি করলেও তার মেয়ের বয়স এখন ত্রিশের কাছাকাছি।

সরকারি চাকরি করেন, টাকা পয়সা ভালোই আছে, সমাজে সম্মান আছে, শুধু চরিত্রের ঠিক নেই। অনলাইনে নাস্তিকতা নিয়ে টুকটাক লিখেন বলে ঝুঁকির কথা চিন্তা করে আমি তার নাম ঠিকানা প্রকাশ না করে তার সম্পর্কে একবার লিখেছিলাম, অন্যদের সচেতন করতে। বদলা নিতে তিনি আমার নাম ঠিকানা সব প্রকাশ করতে বেশ কিছু ফেক আইডি, ফেক চ্যাট বানিয়েছিলে। যদিও শেষ পর্যন্ত খুব বেশিদূর আগাতে পারেননি। আমি যদি তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে তার নাম প্রকাশ করে তার সম্পর্কে লিখতাম, তবে অধিকাংশ মানুষই আমার কথা বিশ্বাস করতেন না। পুরুষ হওয়ার এই এক সুবিধা। সব ধরনের নোংরা কাজ করেও সমাজের চোখে সম্মানী পুরুষ হিসেবে সমর্থন পাওয়া যায়।

খাদিজাকে কোপানোর ভিডিওটা পাওয়া না গেলে হয়তো খুনি বদরুলের ফেসবুকে মায়াভরা ‘পবিত্র’ চেহারা আর স্ট্যাটাস হিসেবে দেয়া জ্ঞানের কথাগুলো দেখে খাদিজার পোশাকের দোষ ত্রুটি খোঁজার চেষ্টা করতাম। ভাগ্যিস কেউ একজন সেদিন ভিডিও করেছিলেন! প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার কারণে এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ এসব প্রতিদিন খবরের পাতার কোণায় অবহেলিত ভাবে থাকে, আমাদের নজর এড়িয়ে যায় । প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ায় কুপিয়ে হত্যা- ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এসব খবর আবার পত্রিকার মাঝখান থেকে ছোট্ট কোনও কোণায় স্থান পাবে।

মের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ার ব্যাপারটা সমাজের পুরুষেরা অনেকেই মেনে নিতে পারে না। পুরুষের আধিপত্য সমাজের প্রতিটি স্তরে। পরিবার, স্কুল কলেজ, কর্মস্থল সব জায়গাতে সিদ্ধান্ত বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো থাকে পুরুষের দখলে। তাই নারী, পুরুষের হ্যাঁ তে হ্যাঁ, না তে না মেলাচ্ছে এমনটাতেই অভ্যস্ত পুরুষ। এর ব্যতিক্রম তারা সহ্য করতে পারে না। তাদের কোনও প্রস্তাবে নারী ‘না’ বলছে, এটা মেনে নিতে পারে না। নারী স্বাধীনতার মূল কথাই হল, নারীর স্বেচ্ছায় ‘না’ বা ‘হ্যাঁ’ বলার অধিকার। বদরুলের বিচার চাওয়ার মিছিলে পুরুষের সংখ্যা দেখে অনেকে মনে করতে পারেন সমাজে বদরুলদের সংখ্যা কম। যদিও বাস্তবে ওই মিছিলে অংশ নেয়া পুরুষদের অনেকেই নারীর এই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলার স্বাধীনতাতে বিশ্বাস করে না। সমাজে পুরুষের আধিপত্য যতদিন জারি থাকবে ততদিন সমাজে নতুন নতুন বদরুলের সৃষ্টি হবে এতে কোনও সন্দেহ নেই।

বিয়ের বাজার

মাসখানেক আগে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। আমারও এবছর এইচএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে এখন আমি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাঁটছি। সেসব কথা থাক।
আমার বন্ধুরা সবাই এইচএসসি দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ এর ওপরই নির্ভর করে ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার। ক্যারিয়ার গড়ার প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু বৈষম্য ভবিষ্যতে কীভাবে বিরাট পার্থক্য গড়ে দেয় সেই চিত্রটা আজকের লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশে মোট ৩৭টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটি গুলোর ডিমান্ড চাকরির বাজারে বেশি বলে সবার লক্ষ্য থাকে ঐ ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়। মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় এসব ইউনিভার্সিটিতে সিটের সংখ্যা নগণ্য। তাই প্রত্যেককেই অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। নিজের শহরের বাইরে গিয়ে এসব পরীক্ষা দেয়া ছেলেদের পক্ষে সম্ভব হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশাল সমস্যা।
ছেলেরা সাধারণত বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে যায়, অভিভাবক যাওয়ার দরকার হয় না। আর মেয়েরা? বন্ধুদের সাথে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় এক ইউনিভার্সিটি থেকে আরেক ইউনিভার্সিটিতে দল বেঁধে যাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেনা। অভিভাবকদের সাহায্য নিতে হয়, অনুমতি নিতে হয়, অভিভাবকদের কাজের ফাঁকে সময় বের করতে পারবে কিনা সেই চিন্তাও করতে হয়। অভিভাবকরা যদি বলে, তোমার সাথে যাওয়ার মতো আমার সময় নেই, কাজের চাপ, ছুটি নিতে পারছি না, ব্যবসার ক্ষতি হয়ে যাবে অতএব পরীক্ষা দিতে হবে না। পরীক্ষা দেয়া বন্ধ। কাছের কোনো ইউনিভার্সিটিতে চেষ্টা করো। না হলে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হও। শেষ পর্যন্ত পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।
স্বপ্ন বাস্তবতার মুখ না দেখার একটি অন্যতম কারণ, নিরাপত্তা সমস্যা। আর অনার্সের মাঝামাঝি সময় একটা ভালো পাত্র পেয়ে গেলেই মেয়ের আসল ঠিকানা অর্থাৎ ‘স্বামীর সংসার’এ পাঠিয়ে দেয়ার মানসিকতা তো আছেই। ভালো পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, বিয়ের পিঁড়িতে বসও। ব্যস, সংসার পেতে বসতে হয়। তখন স্বাবলম্বী হওয়ার সুখ স্বপ্ন ভুলে, হাঁড়ি পাতিল, বাচ্চাকাচ্চা স্বামী সেবায় সুখ খোঁজে।
আমার এক মেয়ে বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। তার মা-বাবার কোনও আপত্তি নেই মেয়েকে অন্য শহরে রেখে পড়াতে। তবে তার জ্ঞানীগুণী আত্মীয় স্বজনেরা নাকি প্রায় তার মা-বাবাকে বাস্তবতা বোঝাতে আসতেন। মেয়েকে চোখের আড়াল করে লেখাপড়া করতে পাঠানো কতটা ভুল সিদ্ধান্ত সেটা জানাতেন।
নিরাপত্তা সমস্যা এবং মানসিকতা সমস্যা, এই দুটো সমস্যার কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সারাদেশে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ফলাফল ভাল হওয়া স্বত্বেও ভবিষ্যতে ভালো ক্যারিয়ারের রাস্তাটাতে ছেলেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়।
আপাত দৃষ্টিতে এটাকে তুচ্ছ কিছু মনে হলেও এটা কিন্তু ভয়াবহ একটি সমস্যা। দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। শিক্ষিতের অর্ধেক অংশ নিজের বিদ্যা বুদ্ধিকে কাপড় ধোয়ার সেরা সাবান, আর সেরা মেলামাইন বাছাইয়ের ক্ষেত্রেই শুধু ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে।
আমার এক ডাক্তারি পড়ুয়া দাদার সাথে কথা বলছিলাম। সে বিয়ের ক্ষেত্রে কী ধরনের মেয়ে পছন্দ করবে সেসব নিয়েই মূলত আলোচনা। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, সহপাঠীদের মধ্যে কাউকে পছন্দ হয় কিনা। বলল, তা হয়। তবে সে সহপাঠীদের কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারবে না। তার মায়ের বয়স হচ্ছে, বাড়িতে মায়ের একজন সাহায্যকারী লাগবে, সেই উদ্দেশ্যেই সে বিয়ে করবে। আর ডাক্তারি পড়া একজন মেয়েকে সে বাড়িতে বসিয়ে রাখবে? তার একটা বিবেক আছে না? তাই সে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ কাউকে বিয়ে করবে। যাকে বাড়িতে মায়ের সাহায্যকারী বানানো যাবে।
বাংলাদেশে কয়জন ছেলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়? বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ কোনও বিষয় নিয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করে ভালো চাকরিও করে। কিন্তু ডাক্তার স্বামীর বিশ্ববিদ্যালয় পাশ স্ত্রীকে সাধারণত ঘরের কাজেই দেখা যায়। অর্থের দরকার না থাকলে মেয়েদের চাকরির প্রয়োজনীয়তা তেমন থাকে না বলে অনুমতিও পাওয়া যায় না।
ফেসবুকে প্রায় স্ট্যাটাস দেখি, ছেলে বিয়ে করতে চায়। কারণ তার রান্না করার কেউ নেই,কাপড় ধোয়ার কেউ নেই, ঘর গোছানোর কেউ নেই। তাই তার একজন বউ লাগবে। আমি বুঝি না, এধরনের ছেলেরা বিয়ে করতে গিয়ে শিক্ষিত মেয়ে খুঁজে কেন! ঘরের কাজ করে এরকম কাজের খালাদের কাউকে বিয়ে করে নিলেই পারে। কারণ ঘরের কাজের দক্ষতা তো শিক্ষিত বউদের চেয়ে তাদেরই বেশি থাকার কথা। আমার মনে হয়, কে কত শিক্ষিত একটি মেয়েকে নিজের দখলে নিতে পেরেছে সেরকম একটা প্রতিযোগিতা বাজারে চালু আছে। তাই বিয়ের সময় তাদের শিক্ষিত মেয়ে দরকার হয়।
এতো গেল শিক্ষিত ছেলেদের শিক্ষিত মেয়ে খোঁজার কথা। দেশের প্রায় সব ছেলেই বিয়ের সময় শিক্ষিত মেয়ের চেয়ে সুন্দরী মেয়ে খোঁজে বেশি। যাতে করে আড্ডায় বন্ধুদের সাথে বড় মুখ করে বলতে পারে, আমার বউ সবচেয়ে সুন্দরী! মেয়ে দেখতে গিয়ে- মেয়ে হাঁটতে পারে কিনা, কথা বলতে পারে কিনা, গলার স্বর কেমন, শরীরে কোথাও কোনও খুঁত আছে কিনা ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। যেন মাছের বাজারে মাছ টিপে টিপে দেখছে। পছন্দ না হলে নতুন কোনো মেয়ে দেখে, পছন্দ হলে শুরু হয় দরদাম। বিয়েতে মেয়ের বাবা কী দিবে। কয় ভরি সোনা, কোন ব্র্যান্ডের বাইক নাকি কার, ঘর সাজানোর খাট, ফ্রিজ, টেলিভিশন। তর্কবিতর্ক করে কত টাকায় বা কত সস্তায় দেনমোহরের নামে মেয়ে কেনা যায়! এ যে মেয়েদের জন্যে কত লজ্জার, কত অপমানের তা কি সে সব ‘শিক্ষিত’ (?), টাকাওয়ালা, একের পর এক পাত্রী দেখে যাওয়া ছেলেরা ভেবে দেখেছে কখনো?
মেয়েদের ন্যূনতম সম্মান আছে, অধিকার আছে এমন সমাজেও এ ধরনের বর্বর নিয়ম নেই যা আমাদের সমাজে গর্ব ও ঐতিহ্য নিয়ে যুগযুগ ধরে চলে আসছে।