মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০১৭

বিয়ের বাজার

মাসখানেক আগে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। আমারও এবছর এইচএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে এখন আমি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাঁটছি। সেসব কথা থাক।

আমার বন্ধুরা সবাই এইচএসসি দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ এর ওপরই নির্ভর করে ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার। ক্যারিয়ার গড়ার প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু বৈষম্য ভবিষ্যতে কীভাবে বিরাট পার্থক্য গড়ে দেয় সেই চিত্রটা আজকের লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশে মোট ৩৭টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটি গুলোর ডিমান্ড চাকরির বাজারে বেশি বলে সবার লক্ষ্য থাকে ঐ ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়। মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় এসব ইউনিভার্সিটিতে সিটের সংখ্যা নগণ্য। তাই প্রত্যেককেই অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। নিজের শহরের বাইরে গিয়ে এসব পরীক্ষা দেয়া ছেলেদের পক্ষে সম্ভব হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশাল সমস্যা।

ছেলেরা সাধারণত বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে যায়, অভিভাবক যাওয়ার দরকার হয় না। আর মেয়েরা? বন্ধুদের সাথে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় এক ইউনিভার্সিটি থেকে আরেক ইউনিভার্সিটিতে দল বেঁধে যাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেনা। অভিভাবকদের সাহায্য নিতে হয়, অনুমতি নিতে হয়, অভিভাবকদের কাজের ফাঁকে সময় বের করতে পারবে কিনা সেই চিন্তাও করতে হয়। অভিভাবকরা যদি বলে, তোমার সাথে যাওয়ার মতো আমার সময় নেই, কাজের চাপ, ছুটি নিতে পারছি না, ব্যবসার ক্ষতি হয়ে যাবে অতএব পরীক্ষা দিতে হবে না। পরীক্ষা দেয়া বন্ধ। কাছের কোনো ইউনিভার্সিটিতে চেষ্টা করো। না হলে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হও। শেষ পর্যন্ত পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।

স্বপ্ন বাস্তবতার মুখ না দেখার একটি অন্যতম কারণ, নিরাপত্তা সমস্যা। আর অনার্সের মাঝামাঝি সময় একটা ভালো পাত্র পেয়ে গেলেই মেয়ের আসল ঠিকানা অর্থাৎ ‘স্বামীর সংসার’এ পাঠিয়ে দেয়ার মানসিকতা তো আছেই। ভালো পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, বিয়ের পিঁড়িতে বসও। ব্যস, সংসার পেতে বসতে হয়। তখন স্বাবলম্বী হওয়ার সুখ স্বপ্ন ভুলে, হাঁড়ি পাতিল, বাচ্চাকাচ্চা স্বামী সেবায় সুখ খোঁজে।

আমার এক মেয়ে বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। তার মা-বাবার কোনও আপত্তি নেই মেয়েকে অন্য শহরে রেখে পড়াতে। তবে তার জ্ঞানীগুণী আত্মীয় স্বজনেরা নাকি প্রায় তার মা-বাবাকে বাস্তবতা বোঝাতে আসতেন। মেয়েকে চোখের আড়াল করে লেখাপড়া করতে পাঠানো কতটা ভুল সিদ্ধান্ত সেটা জানাতেন।

নিরাপত্তা সমস্যা এবং মানসিকতা সমস্যা, এই দুটো সমস্যার কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সারাদেশে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ফলাফল ভাল হওয়া স্বত্বেও ভবিষ্যতে ভালো ক্যারিয়ারের রাস্তাটাতে ছেলেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়।

আপাত দৃষ্টিতে এটাকে তুচ্ছ কিছু মনে হলেও এটা কিন্তু ভয়াবহ একটি সমস্যা। দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। শিক্ষিতের অর্ধেক অংশ নিজের বিদ্যা বুদ্ধিকে কাপড় ধোয়ার সেরা সাবান, আর সেরা মেলামাইন বাছাইয়ের ক্ষেত্রেই শুধু ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে।

আমার এক ডাক্তারি পড়ুয়া দাদার সাথে কথা বলছিলাম। সে বিয়ের ক্ষেত্রে কী ধরনের মেয়ে পছন্দ করবে সেসব নিয়েই মূলত আলোচনা। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, সহপাঠীদের মধ্যে কাউকে পছন্দ হয় কিনা। বলল, তা হয়। তবে সে সহপাঠীদের কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারবে না। তার মায়ের বয়স হচ্ছে, বাড়িতে মায়ের একজন সাহায্যকারী লাগবে, সেই উদ্দেশ্যেই সে বিয়ে করবে। আর ডাক্তারি পড়া একজন মেয়েকে সে বাড়িতে বসিয়ে রাখবে? তার একটা বিবেক আছে না? তাই সে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ কাউকে বিয়ে করবে। যাকে বাড়িতে মায়ের সাহায্যকারী বানানো যাবে।

বাংলাদেশে কয়জন ছেলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়? বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ কোনও বিষয় নিয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করে ভালো চাকরিও করে। কিন্তু ডাক্তার স্বামীর বিশ্ববিদ্যালয় পাশ স্ত্রীকে সাধারণত ঘরের কাজেই দেখা যায়। অর্থের দরকার না থাকলে মেয়েদের চাকরির প্রয়োজনীয়তা তেমন থাকে না বলে অনুমতিও পাওয়া যায় না।

ফেসবুকে প্রায় স্ট্যাটাস দেখি, ছেলে বিয়ে করতে চায়। কারণ তার রান্না করার কেউ নেই,কাপড় ধোয়ার কেউ নেই, ঘর গোছানোর কেউ নেই। তাই তার একজন বউ লাগবে। আমি বুঝি না, এধরনের ছেলেরা বিয়ে করতে গিয়ে শিক্ষিত মেয়ে খুঁজে কেন! ঘরের কাজ করে এরকম কাজের খালাদের কাউকে বিয়ে করে নিলেই পারে। কারণ ঘরের কাজের দক্ষতা তো শিক্ষিত বউদের চেয়ে তাদেরই বেশি থাকার কথা। আমার মনে হয়, কে কত শিক্ষিত একটি মেয়েকে নিজের দখলে নিতে পেরেছে সেরকম একটা প্রতিযোগিতা বাজারে চালু আছে। তাই বিয়ের সময় তাদের শিক্ষিত মেয়ে দরকার হয়।

এতো গেল শিক্ষিত ছেলেদের শিক্ষিত মেয়ে খোঁজার কথা। দেশের প্রায় সব ছেলেই বিয়ের সময় শিক্ষিত মেয়ের চেয়ে সুন্দরী মেয়ে খোঁজে বেশি। যাতে করে আড্ডায় বন্ধুদের সাথে বড় মুখ করে বলতে পারে, আমার বউ সবচেয়ে সুন্দরী! মেয়ে দেখতে গিয়ে- মেয়ে হাঁটতে পারে কিনা, কথা বলতে পারে কিনা, গলার স্বর কেমন, শরীরে কোথাও কোনও খুঁত আছে কিনা ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। যেন মাছের বাজারে মাছ টিপে টিপে দেখছে। পছন্দ না হলে নতুন কোনো মেয়ে দেখে, পছন্দ হলে শুরু হয় দরদাম। বিয়েতে মেয়ের বাবা কী দিবে। কয় ভরি সোনা, কোন ব্র্যান্ডের বাইক নাকি কার, ঘর সাজানোর খাট, ফ্রিজ, টেলিভিশন। তর্কবিতর্ক করে কত টাকায় বা কত সস্তায় দেনমোহরের নামে মেয়ে কেনা যায়! এ যে মেয়েদের জন্যে কত লজ্জার, কত অপমানের তা কি সে সব ‘শিক্ষিত’ (?), টাকাওয়ালা, একের পর এক পাত্রী দেখে যাওয়া ছেলেরা ভেবে দেখেছে কখনো?

মেয়েদের ন্যূনতম সম্মান আছে, অধিকার আছে এমন সমাজেও এ ধরনের বর্বর নিয়ম নেই যা আমাদের সমাজে গর্ব ও ঐতিহ্য নিয়ে যুগযুগ ধরে চলে আসছে।

বাহির বলে দূরে থাকো



অনেক ছেলেদের দেখি মেয়েদের সিরিয়াল দেখা নিয়ে ব্যঙ্গ করে। ছেলেরাও যে সিরিয়াল দেখে না, তা নয়। তবে সিরিয়ালের অধিকাংশ দর্শক নারী। মেয়েদের সিরিয়াল দেখা নিয়ে ব্যঙ্গ করা ছেলেরা কি কখনো এর কারণ ভেবে দেখেছেন?

ছেলেরা বিকেল হলে পাড়ার মাঠে খেলতে যায়, সারা মাঠ দৌড়ায়, ফুটবল-ক্রিকেট খেলে, সাইকেল নিয়ে রেইস করে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়, একা কোনও মেয়েকে পেলে সুযোগ বুঝে দলেবলে হয় তো কেউ কেউ ইভটিজিং করে পুরুষত্বও দেখিয়ে দেয়। বাইরের জগতে ছেলেদের বিনোদনের কোন অভাব নেই।

আর বাইরের জগতে মেয়েদের জন্য ‘বিনোদন` নামক কোন শব্দ এখনো প্রচলিত হয় নি। বাইরের জগৎ বলতে মেয়েদের কাছে অনিরাপদ কিছু। মেয়ে যতক্ষণ বাড়ি না ফিরছে ততক্ষণ বাবা মায়ের চিন্তার শেষ নেই। ‘সন্ধ্যা হয়ে গেল, দেরি করছে কেন? কোন বিপদ হয়নি তো?’

শিশু অবস্থায় ছেলে মেয়ে একসাথে মাঠে খেলতে দেখা যায়, একটু বড় হলেই ছেলেটি পাড়ার মাঠের বাইরে আরও একটু বড় মাঠে খেলতে যায়। স্বাভাবিক। ছেলে বড় হচ্ছে। মাঠ বড় হবে, জগৎ বড় হবে। আর মেয়েটির? মেয়েটির শরীর বড় হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ছোট হতে থাকে তার জগৎ। মেয়েটিকে ঘিরে চারদিক থেকে ছুটে আসতে থাকে কথার তীর। মেয়ে বড় হচ্ছে, তার কি খেলা মানায়? দৌড়লে যদি ওড়না ঠিক ওই জায়গা থেকে নড়ে যায়, যদি ওড়নার ফাঁকে কিছু দেখা যায়, যদি মেয়ের দৌড়নোতে নিতম্বের নড়াচড়া কারও কাছে আকর্ষণীয় ঠেকে, যদি কারও ধর্ষণের ইচ্ছে জাগে, আরও কত কী সমস্যা।

মনে পড়ে, আমি যখন ফাইভ-সিক্সে পড়তাম, তখন আমাদের বাসার সামনের সামান্য একটু খোলা জায়গায় আমার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে খেলতাম। পাড়ার অন্য মেয়েরা আসতো না। তাই ছেলেরাই ছিল আমার বন্ধু। কিন্তু যখন ক্লাস সেভেন-এইটে উঠি, আমার সবচেয়ে ক্লোজ ছেলে বন্ধুটির লম্বায় বাড়তে থাকে আমার চেয়ে বেশি, নাকের নিচে একটু একটু গোঁফের আভাস দেখা দেয়, আমারও শারীরিক পরিবর্তন হতে থাকে। তখন আমার খেলার ক্ষেত্রে বাধা আসে। আর ওই বন্ধুটি তখন ছোট জায়গা থেকে বড় মাঠে খেলতে যায়। ছেলেমেয়ের বন্ধুত্বকে সমাজে স্বাভাবিক ভাবে নেয় না বলে ওর সাথে আমার বন্ধুত্বও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন তো কথাবার্তাও বন্ধ। ও আমাকে দেখলে কেমন যেন লজ্জা পেতো। আমার এক বান্ধবীকে একটা ছেলে বিরক্ত করতো। একদিন দেখলাম আমার ছোটবেলার বন্ধু সেই ইভটিজারসহ তার আরও কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একসাথে রাস্তায় হাঁটছে।

মেয়েরা যত বড় হতে থাকে মেয়েদের জগৎ তত ছোট হতে থাকে। আর ছেলেদের বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের জগৎও বড় হতে থাকে। আমাদের পাড়ায় একটি মেয়ে সাইকেল চালাতো। মেয়েটির নাম জানতাম না। সবাই বলতো ‘ফাহিমের বোন’। পাড়ার একটা কোচিংএ পড়তাম তখন। একদিন শুনি, কোচিং এর স্যারেরা কিছু সিনিয়র ছেলেদের নিয়ে ‘ফাহিমের বোন’এর সাইকেল চালানো নিয়ে সমালোচনা করছেন। এতবড় মেয়ের সাইকেল চালানোর কী দরকার সেটা তারা বুঝে উঠতে পারছেন না। মেয়েটির বাবা-মাও এসব ব্যাপারে সচেতন না বলে তাদেরকে নিয়ে সমালোচনা চলে আরও কিছুক্ষণ।

এসব সমালোচক, নিন্দুক, ধর্ষক, ইভটিজারদের ভয়ে প্রয়োজন ছাড়া মেয়েরা সাধারণত বাইরে যায় না। কারণ বাইরে গেলে সুস্থ ভাবে ফিরে আসতে পারবে এর নিশ্চয়তা কে দিবে? বাইরের জগতে মেয়েদের কোন বিনোদন নেই, বিনোদন তবে কোথায়? কেউ কেউ বিনোদন খুঁজে নেয় টিভি সিরিয়ালে। সিরিয়ালে বৌ-শাশুড়ির ঝগড়া দেখে সবাই নিশ্চিত হয়, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু আর জগতের সব সমস্যার স্রষ্টা মেয়েরাই। যদিও বৌ-শাশুড়ির ঝগড়ার স্ক্রিপ্ট লেখক, পরিচালক যে অধিকাংশ সময় পুরুষেরাই হয় সেটা কারও খেয়াল থাকে না।

আপনারা মেয়েদের বাইরে খেলাধুলা মেনে নিতে পারেন না, ইভ টিজিং করে মজা লুটেন, গলির মুখে মেয়েরা আড্ডা দিলে মেয়ের চরিত্র নিয়ে পাড়ায় গবেষণা করাকে সামাজিক দায়িত্ব মনে করেন। আপনারাই মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী, এই আপনারাই নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে মেয়েকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। আবার ঘরে বসে সিরিয়াল দেখলেও আপনাদের আপত্তি। আপনারা আসলে চানটা কী?

পুরুষত্বে সিগারেটের ছেঁকা

সুন্দরবন রক্ষার হরতালে একটি মেয়েকে ক্যামেরা হাতে সিগারেট ফুঁকতে দেখা গেল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি ছড়িয়ে পড়লে মেয়েটি তীব্র সমালোচনাও নিন্দার মুখোমুখি হয়। যেন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রও এতটা পরিবেশ দূষণ করতে পারবে না, যতটা একটি মেয়ে সিগারেট ধরিয়ে করে ফেলেছে।

সিগারেট খাওয়া তো বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। ছেলে মানেই সিগারেট মদ একটু আধটু হলেও খাবে। সিগারেট খায় নি এমন ছেলের সংখ্যা হাতে গোণা কয়েকজন হবে হয়তো। অনেককেই দেখি সিগারেট ফুঁকছে, ধোয়া উড়ছে এমন ছবি ডিএসএলআর ক্যামেরায় তুলে সেসব প্রোফাইল পিকচার দেয়। কাউকে তো সমালোচনা করতে দেখি নি। তবে এই মেয়েটির ছবি নিয়ে এত নিন্দের কারণ কী? মেয়েটি কি এমন কিছু করেছে যা সমাজে নিষিদ্ধ? এর উত্তর একইসাথে হ্যাঁ এবং না। কারণ সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ না হলেও মেয়েটির জন্য নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর বেশ কয়েকটি বিখ্যাত ছবির মধ্যে অন্যতম হল, পাইপ হাতে মুজিব। মুজিব কন্যা’র যদি এমন কোনও ছবি পাওয়া যায়? প্রধানমন্ত্রীত্ব যাবে, বঙ্গবন্ধু তার মেয়েকে সুশিক্ষা দিতে পারেননি বলে তিনিও সমালোচিত হবেন। নিজের পাইপ হাতে ছবি’তে কিন্তু তার কোনও সম্মানহানি হয় নি, মেয়েরটিতে হবে। এ কেমন নিয়ম?

সুশীল সমাজ মেয়েটিকে বোঝাচ্ছেন, সিগারেট খাওয়া কতটা ক্ষতিকর। যেন এই প্রথম সবাই মিলে বুঝতে পারলেন, সিগারেট খাওয়া ক্ষতিকর কিছু! রাস্তাঘাটে এত পুরুষ সিগারেট খায়। কই, কেউ তো কখনো তাদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে আসেন না, মেয়ে হলেই উপদেশ দিতে ছুটে আসতে হবে? মজার ব্যাপার হল- সিগারেট বলে নয়, মেয়েদের যেকোনো কাজেই পুরুষেরা ছুটে আসে উপদেশ দিতে। দুপায়ের ফাঁকের অঙ্গটির কারণে নিজেকে সকল বিষয়ে বোদ্ধা ভেবে ফেলেন বোধহয়। যখন বিদেশী সিগারেট আমদানী করা হয়, তখন আপনাদের কেন মনে হয় না দেশের, সমাজের জন্য ক্ষতিকর এই জিনিসটির আমদানী বন্ধ করা উচিত? তামাক চাষ বন্ধের আন্দোলনে আপনাদের পাওয়া যায় না কেন?

কেউ কেউ বলছেন, ‘সিগারেট খেলেই কি পুরুষ হওয়া যায় ? কাজেকর্মে পুরুষ হও।’ হেসে বাঁচি না। তাদের ধারণা মেয়েটি পুরুষ হতে প্যান্ট শার্ট পরেছে, পুরুষ হতেই সিগারেট খাচ্ছে। যেন পুরুষ হওয়া গর্বের কিছু! শিশ্ন আর অণ্ডকোষ নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। প্যান্টশার্ট পরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তাই পরেছে। সিগারেট খেতে ইচ্ছে হয়েছে তাই খেয়েছে- এ ব্যাপারটা তাদের চিন্তায় আসে না কেন? প্যান্ট,শার্ট, সিগারেট এসবে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার এমন ধারণার কারণ কী?

সিগারেট হাতে মেয়ের জন্য ‘সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ এই উপদেশ নিয়ে হাজির হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ শুভাকাঙ্ক্ষী । ইভটিজিং, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার নারীদের পাশে কেন শুভাকাঙ্ক্ষীরা সংখ্যায় নগণ্য হয়?

সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে পুরুষতন্ত্র ধ্বংস করা যায় না, বিপ্লব হয় না- এসব আমি জানি। আমি সিগারেট খাওয়া’কে ভালো বলছি না। কিন্তু একটি মেয়ের ক্ষেত্রে, মেয়েটি কী খাবে, কী পরবে এসব নিয়ে সমাজের মাথা ঘামানো, চোখ রাঙানোর স্বভাবটির প্রতিবাদ করছি। সিগারেট যেহেতু বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কিছু নয়, তাই ছেলেমেয়ে যেকেউ চাইলে সিগারেট খেতে পারে। কিন্তু একজন ছেলে ধূমপায়ীকে কেউ খারাপ চরিত্রের অধিকারী ভাববে না। কিন্তু একজন মেয়ে ধূমপায়ীর শুধুমাত্র ধূমপান করে বলে চরিত্রের দোষ ধরা হবে কেন? ধূমপানের সাথে ছেলের চরিত্রের সম্পর্ক না থাকলে মেয়ের চরিত্রের সম্পর্ক থাকে কী করে? একই কাজ ছেলে করলে এক নিয়ম, মেয়ে করলে ভিন্ন নিয়ম হবে কেন?

আম্মু তোমার কোলে তোমার বলে

আজকাল অনেকেই স্মার্ট সাজতে কথা বলার সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি। এরই প্রতিবাদে বায়ান্ন নিয়ে একটি গান শুনছিলাম। শিল্পীর নাম নাজির মাহামুদ। না, শিল্পীর নামে বাংলার চিহ্ন নেই। এতে অবশ্য শিল্পীর কোনো দোষ নেই। বাঙালি মুসলমানের নাম মানেই যেন অদ্ভুত অর্থের আরবি শব্দ। বেশিরভাগ আবার আরবি শব্দগুলোর অর্থ না বুঝেই আরবির প্রতি গভীর প্রেম থেকে নামগুলো রাখে। আরবি শব্দ এত্তেলা থেকে ইত্তিলা শব্দটি এসেছে যার অর্থ সংবাদ। স্কুল কলেজে অনেকেই আমার নামের অর্থ জানতে চেয়েছে। কারণ এ শব্দ তারা আগে শোনে নি। বাংলা ডিকশনারিতে আছে নাকি? -প্রশ্ন অনেকের। নামটা অপরিচিত বলেই বাংলা ডিকশেনারিতে আছে কিনা জানার ইচ্ছে। যদিও বিভিন্ন অদ্ভুত অর্থের আরবি নাম অহরহ শুনে এতটাই পরিচিত হয়ে গেছে, সেগুলোর সাথে যে বাংলা ডিকশনারির কোনো সম্পর্ক নেই সেদিকে নজর নেই। নজর নেই বলাটা বোধহয় ভুল হবে। আরবি নাম মানে ইসলামিক নাম, এ ধারণা থেকেই তো সবাই আরবিতে নাম রাখে। এখন আরবিতে সেই শব্দের অর্থ ছাগল হোক বা ভেড়া, তাতে কী যায় আসে? আরবি তো আরবিই। আর তাছাড়া বাংলা নামগুলো অনেকটা ‘হিন্দু হিন্দু’ শোনায়। মুসলমানের নামে ‘হিন্দু হিন্দু’ গন্ধ, একজন মুসলমানের জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু হয় না।

নাজির মাহামুদ গানের একটি লাইন অনেকটা এরকম, ওরা মাকে ডাকে মাম্মি আর বাবাকে ডাকে ড্যাড/….. আমি হাসবো না কাঁদবো ওরে ও ও বায়ান্ন, তোর জন্য; যদিও মাম্মি আর ড্যাড ডাকার সংখ্যা খুব বেশি নয়। বরং অধিকাংশই মাকে আম্মু/আম্মা/আম্মি, বাবাকে আব্বু/আব্বা ডাকে। অথচ আগে কিন্তু সবাই মাকে মা, বাবাকে বাবা-ই ডাকতো। কে কার বাবা-মা’কে কী ডাকবে সেটা যার যার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু সবাই মিলে একসাথে বাবা-মা নামক দু’টি অতিপ্রিয় শব্দকে অন্য ভাষায় আপন করে নেয়া মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। আরো দুঃখের বিষয়, শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা মাম্মি আর আম্মি ডাকের সংখ্যা সম্পর্কে জেনেও শুধুমাত্র মাম্মি ডাকেরই প্রতিবাদ করেন।

কথায় কথায় ইনশাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, মাশাল্লাহ, সোবাহানাল্লাহ, খোদাহাফেজের ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে। না, এ নিয়ে আমরা কথা বলবো না। এ যে সুন্নত! রাজনৈতিক নেতারা কথায় কথায় ‘ইনশাল্লাহ’ শব্দটি ব্যবহার করে। আমরা ক্ষমতায় গেলে- ‘ইনশাল্লাহ, ব্রিজ হবে’,‘ইনশাল্লাহ, হাসপাতাল হবে, ‘ইনশাল্লাহ, উন্নয়নের জোয়ার বইবে’। ইনশাল্লাহ মানে হল, আল্লাহ চাইলে। ব্যাস আল্লাহও চায় না, উন্নয়নের গল্পও ধীরে ধীরে রূপকথার পাতায় চলে যায়। আল্লাহ চায় না বলাতে রাগ করতে পারেন অনেকেই। তবে অর্থটা তো এমনই দাঁড়ায়।

‘মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ, চেহারা হ্যায় মাশাল্লাহ...’ এরকম একটা হিন্দি গান ক্লাসে বসে কলেজের এক বান্ধবী গাইছিল। স্যার তার সামনে হাঁটছে সে খেয়াল নেই। স্যার প্রথম দু’টা শব্দ শুনেই বললেন, ‘দেখছো দেখছো, মেয়েটা কতো ভালো গজল গাচ্ছে’। হাসতে হাসতে স্যারকে বললাম, স্যার পুরো গজলটা শুনে যান। দেখলাম স্যার একরকম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করলেন। যার অর্থ, নিজে তো এসব ভালো কাজের মধ্যে নেই, অন্য কেউ ভালো কিছু করলে তাকে নিয়ে ফাজলামো, বেয়াদব মেয়ে!

‘এখানে প্রস্রাব করবেন না’ এ দেয়াল লিখনের তোয়াক্কা ছেলেরা করে না। অনলাইনে একটি ছবি দেখলাম, প্রস্রাব না করার অনুরোধটি আরবিতে লেখা হয়েছে। ব্যাস, আর কেউ ভুলেও ওদিকে মূত্রত্যাগ করতে যায় না। এতেই বোঝা যায়, মানুষের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। আসল প্রেম অন্য ভাষায়।

কথায় অপ্রয়োজনীয় আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে বলছি, ইংরেজির বিরুদ্ধে কিছুই বলিনি। কারণ আজকের দিনটিই তো সুশীল সমাজের ইংরেজির বিরুদ্ধে বলার দিন। এ নিয়ে বলার লোকের অভাব হবে না। তবুও বলি, নিজেদের স্মার্টনেস জাহির করতে আমার বয়সী অনেকেই কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি, বাংলা শব্দকে ইংরেজির মতো উচ্চারণ করি, যা খুব বাজে শোনায়। আমরা হয়তো বুঝতে পারি না সেটা। কারণ ইংরেজি জানা মানেই বিশাল জ্ঞানী কিছু, এ ধারণা তো আমরা বড়দের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমি ইংরেজি বর্জন করতে বলছি না। বাংলা ভাষায় অনেক ইংরেজি শব্দ আছে সেসবও ত্যাগ করতে বলছি না। আমি বলতে চাইছি, বাংলা বলতে গিয়ে ন্যাকামো করে অপ্রয়োজনীয় ভাবে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে নিজেকে জাহির করার ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। একইভাবে বাংলার সাথে অপ্রয়োজনীয় ভাবে আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহার করে নিজেকে ধার্মিক বা অতিভদ্র জাতীয় কিছু দেখানোটার অভ্যাসটাও বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালীর জন্য শুভ কিছু বয়ে আনবে না।

নারীবাদ যখন শিশ্নের আগায়

নাস্তিক মানেই মানবিক হবে, নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করবে এরকম ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নাস্তিকতা যেহেতু একটি লড়াইয়ের অংশ, প্রগতির অংশ সেখানে অনেকেই ভাবতে পারেন প্রগতিশীল নাস্তিকরা নিশ্চয়ই নারীবাদী। আমিও একসময় এমনটি ভাবতাম। ইদানীং আমার ভুল ধারণা ভাঙ্গতে বসেছে। ধর্মের বিরুদ্ধে লিখে বাস্তব জগতের অনেক বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হলেও ভার্চুয়াল জগতে পেয়েছি অনেক বন্ধু, যাদেরকে আমি এতদিন সমমনা বন্ধু ভেবে এসেছি। ভেবেছিলাম আমরা বুঝি একই লড়াই লড়ছি। কিন্তু না, আমাদের লড়াইটা ভিন্ন- এটা বুঝতে শুরু করেছি যখন থেকে ধর্মের ভণ্ডামি তুলে ধরার পাশাপাশি পুরুষতন্ত্রের বর্বরতা নিয়ে লিখতে শুরু করেছি।

আমার নাস্তিক বন্ধুরা আমাকে নারীবাদের একটি সীমারেখা এঁকে দিয়েছেন, এর বাইরে কিছু বললে তাঁরা আমাকে 'উগ্রনারী' আমার নারীবাদ'কে 'উগ্রনারীবাদ' বলেন। পুরুষতন্ত্রের স্রষ্টা যেহেতু পুরুষ সেহেতু পুরুষতন্ত্রের কথা লিখতে পুরুষের কথাও এসেছে। আমার একসময়ের সমমনা বন্ধুরা আমাকে অবাক করে বললেন, আমি নাকি সরলীকরণ করছি। যারা পুরুষতান্ত্রিক চেতনার মানুষ নন তাঁদের কেন আমার কথা গায়ে লাগাতে হয় আমি বুঝে উঠতে পারি না। বাঙ্গালি লেখকদের লেখায় কত পড়েছি বাঙ্গালি নারী নিয়ে নানান কথা। বাঙ্গালি মেয়ে শাড়ি পরতে পছন্দ করে, শাড়ির সাথে মিলিয়ে একটা টিপ পরে, সাথে চুড়ি... আমি শাড়ি পরি না, টিপ চুড়িও না। কিন্তু আমার কখনো নিজেকে বাঙ্গালি মেয়ে নয় বলে মনে হয় নি। অথচ আমার নাস্তিক পুরুষ বন্ধুরা যুক্তি দেখান, আমি যখন পুরুষ লিখে পুরুষের সমালোচনা করি তখন নাকি তাঁরাও অপমানিত বোধ করেন। অন্য পুরুষদের দোষ তাঁদের গায়ে এসেও লাগে। এমন সরলীকরণ নাকি উগ্রতার লক্ষণ। আমাকে বলতে হবে 'কিছু পুরুষ' 'কিছু ছেলে'। আচ্ছা, স্কুলে যখন স্যারেরা বলতেন, ক্লাস সেভেনের ছেলেগুলো হল বদমাশের হাড্ডি, একেকজন বিচ্ছুর সেরা। এর মানে কি এই যে ক্লাস সেভেনের প্রতিটা ছেলেই বিচ্ছু, ওই ক্লাসে একজন ভালো ছেলেও নেই? তখন কি আপনাদের মনে হয়েছিল, স্যার সরলীকরণ করে খুব অন্যায় করে ফেলেছেন? উনি একজন উগ্র শিক্ষক? ক্লাসের ভালো ছাত্রটি ঠিক জানে কথাগুলো স্যার তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন নি। আবার ক্লাসের বিচ্ছুরাও জানে কথাগুলো স্যার তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন। কিন্তু আমার মুক্তমনা, প্রগতিশীল, নাস্তিক পুরুষ বন্ধুরা এই সহজ বিষয়টি বুঝতে পারেন না কেন? হয়তো বুঝতে পারেন বলেই প্রতিবাদ করেন। নাকি নিজেদের ভিতরের পুরুষতন্ত্রকে আড়াল করে, নারীবাদীর মুখোশে পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার এটি একটি নতুন কৌশল? উগ্র নারীবাদীদের কারণে শুনেছি অনেক নারীবাদী পুরুষ পুরুষতান্ত্রিক আচরণ করছে, এই উগ্র নারীবাদীরা নারীবাদের জন্য ক্ষতিকর! যারা উগ্র নারীবাদীদের জন্য পুরুষতান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছেন বলে দাবী করছেন তাঁরা কি নারীদের দয়া বা করুণা করতেন বলে নারীবাদী হয়েছিলেন যে, উগ্র নারীবাদীদের কারো দয়া দরকার হয় না বলে জানিয়ে দেয়াতে আপনারা আবার আপনাদের আসল রূপে ফিরে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন? উগ্র নারীবাদীরা আপনাদের দয়া দেখিয়ে ভালো পুরুষটি সাজার সুযোগ দিচ্ছে না, আপনাদের দয়া করুণা প্রার্থনা করছে না। আর এটিই বোধহয় আপনাদের চোখে উগ্র নারীবাদীদের মূল উগ্রতা।

বুক ঢেকে রাখতে হবে, নিজের শরীর নিয়ে লজ্জিত বা বিব্রত থাকতে হবে-- বাংলাদেশের সমাজের নিয়মটি যখন এই, সেখানে আমি যখন মেয়েদের শরীর ঢেকে রাখার এই বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে লিখি আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি নাস্তিক পুরুষদের বদলে যাওয়া রূপ। না, তাঁরা হিজাব-বোরখার বিরুদ্ধে, যেহেতু এটি ইসলামি পোশাক। কেউ কেউ আবার ওড়নারও বিরুদ্ধে। কিন্তু তাঁদের প্রগতি আটকে যায় যখন একটি ১৮ বছর বয়সী মেয়ে প্রশ্ন তুলে তারই সমবয়সী একটি ছেলে খালি গাঁয়ে দৌঁড়ঝাঁপ করে ঘুরে বেড়াতে পারলে সে পারবে না কেন? বাংলাদেশের মতো ইসলামিক দেশে একটি মেয়ে যখন তার ব্রা পরা ছবি পাবলিকলি দিয়ে বুঝান যে তিনি তাঁর শরীর নিয়ে লজ্জিত নন, বিব্রত নন, তখন আমার নাস্তিক বন্ধুরা ব্যঙ্গ সুরে জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা যদি এখন তাঁদের শিশ্নের ছবি পোস্ট করেন তাতে কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগবে কিনা। শিশ্ন কি গোপন কিছু? রাস্তা ঘাটে লুঙ্গি তুলে প্রস্রাব করতে বসে যাওয়া কত শিশ্নই তো দেখেছি। দেখেও না দেখার ভান করেছি, চোখ সরিয়ে নিয়েছি। বাংলাদেশে কোথাও দেখেছেন কোনও মা'কে সবার সামনে স্তন না ঢেকে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে? বাংলাদেশের মত একটি সমাজে যেখানে মেয়েদের ওড়না ঠিক বুকে না থাকলে একশ পুরুষ ছুটে আসে মেয়েটির স্তন খুবলে খেতে, যেখানে মা বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে ঢেকে খাওয়াতে হয় যেন কোনও ফাঁকে আবার স্তন দেখা না যায়- সেখানে মেয়েদের বুকের সাথে নিজেদের শিশ্নের তুলনা দিয়ে আমার নারীবাদ গবেষক নাস্তিক পুরুষ বন্ধুরা কোন ধরণের নারীবাদের চর্চা করেন?

'আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে, 

এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।' এরকম উক্তির ব্যাখায় শিক্ষক ও লেখক হুমায়ুন আজাদ যখন বলেন, 'কানন বালা ছিলেন এক সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী; প্রখ্যাত নায়িকা। আমাদের বাঙলায় অভিনয়ের যে ইতিহাস, তাতে দেখা যায় পতিতা পল্লী থেকেই প্রথম নায়িকাদের মঞ্চে নেয়া হয়েছে। ..বিশ্ববিদ্যালয় অভিনেত্রী তৈরির স্থান নয়, জ্ঞানী তৈরির স্থান। অভিনেত্রী হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের ভোগ্যপণ্য, আমি চাই না আমার ছাত্রী ভোগ্যপণ্য হোক।' তখন শফি হুজুর আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মধ্যে আমি পার্থক্য করতে পারি না। অভিনয়ে তাঁরা উভয়েই কোনও শিল্প খুঁজে পান না, খুঁজে পান শুধু নারীর দেহ, যাকে তাঁরা ভোগ্যপণ্য বলেন। প্রগতিশীল শিক্ষক চান না তাঁর ছাত্রীরা কেউ অভিনেত্রী হোক। আচ্ছা, উনি কি তাঁর ছাত্রদের অভিনয়ে কোনও শিল্প খুঁজে পেয়েছিলেন? নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন। কারণ তিনি কাননবালাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাওয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন কেবল। নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিন'কে যখন মোল্লারা এবং প্রথাবিরোধী লেখক নামে পরিচিত কেউ একই সুরে পতিতা বলে গালি দেয় তখন আমি প্রথাবিরোধী লেখক আর মোল্লাদের মধ্যে পার্থক্য কীভাবে করি? শুধু বুঝে নিই, প্রথাবিরোধীরাও নারীবিরোধী প্রথাগুলোকে যত্নে লালন করেন। এদিক থেকে শফি হুজুররা আমার চোখে অনেকটাই সৎ। ধর্ম মতে তাঁদের নাটক, গান, সিনেমা হারাম, মেয়েরা তাঁদের কাছে শস্য ক্ষেত্রে- এটি তাঁরা স্বীকার করেন। অথচ প্রগতির মুখোশে আমাদের প্রগতিশীলেরা নারীদেরকে শস্য ক্ষেত্র বানিয়ে রাখেন বটে কিন্তু অভিনয় করেন যেন তাঁরা নারীর কর্তা নয় বন্ধু হতে চান।

আমার লেখাটি পড়ে যাদের মনে হচ্ছে, আমি লেখাটি তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে লিখেছি, তাহলে নিঃসন্দেহে লেখাটি তাঁদের মতো প্রগতির মুখোশে পুরুষতান্ত্রিক পুরুষের জন্যই লেখা।

একসময় আমি যা জানতাম না বা নতুন কিছু শুনলে হেসে উঠতাম, 'এও আবার হয় নাকি?' 'এটা তো পাগলের কাজ' এরকম ভাব নিতাম। এখন ভাবলে বুঝি, তখন আমি কতটা বোকা ও বদ্ধ মানসিকতার ছিলাম। নতুন কি দেখলে সেটা নিয়ে ব্যঙ্গ করা, হেসে উড়িয়ে দেয়া মূলত আমার চিন্তার সীমাবদ্ধতাকেই প্রকাশ করে। এখন দেখছি, এধরণের চিন্তার সীমাবদ্ধতা সম্পন্ন মানুষগুলোই নাকি প্রথাবিরোধী, একেকজন বড় মুক্তমনা। লড়াইটা কেবল বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীদের মধ্যে নয়। লড়াইটা নিজের সাথে নিজেরও। আমাদের সকলের মনেই বিভিন্ন সংস্কার রয়ে গেছে যা আমরা ছোট থেকে দেখে বড় হয়েছি, সেসব সংস্কার থেকে প্রতিনিয়ত মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে যাওয়া, ভুল শুধরে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা, নিজেকে ভেঙ্গে গড়ে প্রতিনিয়ত শুদ্ধ হওয়ার লড়াইটা কিন্তু আমরা অনেকেই লড়তে চাই না। এজন্যই বোধহয় আমরা অনেক প্রথার বিরুদ্ধে গিয়েও শেষ পর্যন্ত কোনও না কোনও প্রথার জালে আটকে যাই।

পুরুষ হওয়া কি খুব গর্বের কিছু?

‘নারীরা কি চাইলে খাড়াইয়া মুততে পারবে? পারবে না, কাজেই পুরুষ যে অধিকার ভোগ করবে সেটা নারীরা ভোগ করার অধিকার রাখে না।’ এরকম মন্তব্য প্রতিনিয়ত শুনছি। যেন দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা ভয়ংকর গর্বের একটি কাজ। এরকম মন্তব্যকারীরা মনে করেন, নারীরা সমানাধিকার চায় মানে হল তারা পুরুষ হতে চায়, পুরুষের মত দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে চায়। ‘নারীবাদ মানে পুরুষ হবার চেষ্টা নয়’। এধরণের মন্তব্য তাদের মুখেই শোভা পায়। প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত কেউ এধরণের মন্তব্য করলে বুঝতে হবে, তিনিও দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার গর্বে গর্ভবতী হওয়া গ্রুপের একজন গর্বিত সদস্য। তাদের ধারণা, পুরুষ হওয়া গর্বের কিছু। তাই নারীরা শুধু পুরুষ হতে চায়। আহা! ভেবে কী সুখটাই না পায় তারা!

বাঙালি নারীর পোশাক শাড়ি। এখন অনেকে শাড়ির সাথে হিজাব পরছে। অথচ কিছু নারী হিজাব তো দূরে থাক, শাড়ি পর্যন্ত পরে না! পরে জিন্স, টি শার্ট! আজ্ঞে, বাঙালি পুরুষের পোশাকটি যেন কী? কে পরে ওই ধুতি,ফতুয়া,পাঞ্জাবী? কোনও মেয়ের ছোট চুল রাখা, প্যান্ট,শার্ট পরার মানে দাঁড় করানো হয়েছে, মেয়েটি পুরুষ হতে চায়। প্যান্ট শার্টকে বাঙালি পুরুষদের নিজেদের বাপদাদার সম্পত্তি ভেবে ফেলার কারণটা কী? আপনি চুল ছোট রেখে, প্যান্ট শার্টের মত ঝামেলা মুক্ত পোশাকটিকে আপনি নিজের পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কেউ যদি, চুল ছোট রাখে, প্যান্টশার্ট পরে তবে সে আপনার মত পুরুষ হতে চায় না, বরং আপনার মত ঝামেলা মুক্ত হতে চায়। নিজের ভালোটা শুধু আপনিই বোঝেন এবং বোঝার অধিকার রাখেন- আপনার যদি এমন ধারণা হয়ে থাকে তবে জেনে রাখুন ধারণাটি একশ ভাগ ভুল। মেয়েরা কীভাবে চলবে, কীভাবে বলবে, প্রস্রাব দাঁড়িয়ে করবে নাকি বসে করবে, চুল ছোট রাখবে নাকি বড় রাখবে, পর্দা করবে কি করবে না-- এসব কিছু মেয়েদের উপরই ছেড়ে দিন। মেয়েরা কী করবে মেয়েদেরকেই বুঝতে দিন। ঠিক যেভাবে আপনি কী পরবেন, কীভাবে চলবেন সেটা নিজে ঠিক করে থাকেন।

নারীবাদ মানে, "এটা নয়, ওটা নয়, সেটা নয়” এসব হল নারীবাদ’কে পুরুষের নিজস্ব সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করে ফেলার চেষ্টা। বাংলাদেশের মত একটি ঘোর নারী বিদ্বেষী সমাজে নারীবাদ নিয়ে লিখতে গেলেই বলে, ‘পুরুষ বিদ্বেষী’। নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা পেলে এতদিন ধরে নারীর অধিকার খর্ব করে যে রাজত্ব করেছেন সেটি আর চলবে না। ধর্ষণ করে দোষ দিয়েছেন-মেয়ের চরিত্রের, চলাফেরার, পোশাকের। পতিতাদের সাথে সমাজের বাবুরা শুয়ে পতিতাদের নষ্ট করে, বেশ্যা মাগী বানান। অথচ বাবুর চরিত্র, সামাজিক মর্যাদার কোনও হেরফের হয় না। পতিতালয় বন্ধের দাবী তুললে নির্লজ্জ ভাবে তারা জানান- ‘এতে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে’। নিজেদের নষ্টামির দোষ ভুক্তভোগীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার এ সুযোগ যারা আপনাদের দিতে চায় না, আপনাদের দৃষ্টিতে তারা নিশ্চয়ই ঘোর পুরুষ বিদ্বেষী।

মেয়েরা বড় হলে মায়েরা সাধারণত তাদের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলে থাকেন, ‘শত হলেও পুরুষ, পুরুষ মানুষের বিশ্বাস নাই’। মামা, চাচা, খালু,ফুপা, এমনকি বাবা, ভাই দ্বারা যৌন হেনস্থার স্বীকার হচ্ছে নারীরা। এমন কোনও মেয়ে হয়তো পাওয়া যাবে না, যে তার সমগ্র জীবনে কোনও রকমের যৌন হেনস্থার স্বীকার হয় নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এটি নিকট আত্মীয়ের দ্বারা ঘটে থাকে। আমি গরমকালে বাসায় পাতলা হাতকাটা গেঞ্জি পরতাম। যা আমার মায়ের খুব অপছন্দ ছিল। ‘বাসায় বাবার সামনে এধরণের কাপড় পরতে নেই’ এই কথার উত্তরে আমি যখন বলেছি, ‘কেন? বাবা কি মাঝেমধ্যে ভুলে যান যে, আমি তার সম্পর্কে মেয়ে হই’। নিশ্চিত ভাবে আমার উত্তরটি শুনতে খুব বাজে লাগছে। যদিও বাবার সামনে, ভাইয়ের সামনে ঢেকে চলার কথাটিকে খারাপ বা বাজে কথা বলে আপনাদের মনে হয়নি। বাবা বা ভাইয়ের চোখ যদি মেয়ে বা বোনের শরীরের দিকে যায় তবে তাদের দ্বারাও ভুল কিছু হয়ে যেতে পারে-- এই ভয়েই তো মেয়েরা, বোনেরা তাদের বাবা-ভাই-নিকট পুরুষ আত্মীয়দের সামনে শরীর ঢেকে চলে।

আমাকে দেখে কেউ ভয় পাচ্ছে, আমি আছি বলে অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে পোশাক পরছে, আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না-- এরকম কিছু আমার জন্য নিঃসন্দেহে লজ্জার। আচ্ছা, ছেলেদেরও কি লজ্জা হয়, যখন একটি মেয়ে তাকে ধর্ষক ভেবে ভয় পায়, তাকে দেখে সতর্ক হয়, ওড়না টানে? সমগ্র নারী জাতি যখন পুরুষ জাতিটিকে ভয় পেয়ে চলে, বিশ্বাস করতে পারে না, ধর্ষক কামুক ভাবে তখন পুরুষ হিসেবে লজ্জিত না হয়ে তারা কীসের গুণে গর্বিত হয়?

মনে মনে নিশ্চয়ই আপনাদের রণ সংগীতটি বাজছে, ‘সব পুরুষ এক নয়’। জেনে রাখুন, সব পুরুষ এক না হলেও, সব নারীরাই সব পুরুষকে অবিশ্বাস করে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেই ৭৬টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৩৬৫জন নারী ও কন্যাশিশুকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। দেশে প্রকাশিত ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

তাদের প্রকাশিত তথ্যানুসারে ৭৬টি ধর্ষণের মধ্যে ১৪ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪ জনকে, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৪ জন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫ জন। এছাড়া এসিডদগ্ধ হয়েছেন ৩ জন। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ৫ জন, তন্মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১ জনের। ৮ জন নারী অপহরণের শিকার হয়েছেন। পাচারের শিকার হয়েছে ৯ জন নারী ও কন্যাশিশু। এদের মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে ২ জনকে। বিভিন্ন কারণে ৬৩ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে।এছাড়া যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩১ জন, এদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ১২ জনকে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১ জন। উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ২৩ জনকে। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ৩৩ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন এবং ৯ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। জানুয়ারি মাসে বাল্য বিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ২২টি, এদের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১২ জন এবং ৩১ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ২১ জনকে। পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছে ০৪ জন। বে-আইনি ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ২টি। 

ফেব্রুয়ারি মাসে মোট নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৭৬টি। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৭৯ টি। বিভিন্ন কারণে ৫৯ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন নির্যাতনের কারনে ২৫ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এবং ০৮ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।

এছাড়াও প্রতিনিয়ত, রাস্তায় ঘাটে, যানবাহনে, কর্মস্থলে, নিজের ঘরে যেসকল যৌন হেনস্থা হয় সেগুলা অধিকাংশই অজানা থাকে। যৌন নিপীড়ককে রক্ষা করতে সবাই উঠে পরে লাগে, ঘটনা জানাজানি হলে মেয়ের জন্য ভালো হবে না- এই অজুহাতে চেপে যেতে বলা হয়। যেন, মেয়ের ভালোর কথা কতই না ভাবেন তারা। মেয়েদের এমন শুভাকাঙ্ক্ষী থাকলে আর শত্রুর দরকার কী?