সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৮

মাসুদা কি ক্ষমা চাইবেন তসলিমার কাছে?



মাসুদা ভাট্টির লেখাটির শুরতেই তিনি তসলিমা নাসরিনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তাঁর সম্পর্কে কথাগুলো বলার জন্য এরকম একটি “মোক্ষম” সময়কে বেছে নিয়েছেন বলে। তসলিমার কথাগুলো যে সত্য তা তিনি মিউ মিউ সুরে অনেকটাই স্বীকার করেছেন, না করে উপায়ও ছিল না অবশ্য।  জবাবে তসলিমা বলেছেন, সত্য বলার জন্য সবসময়ই উপযুক্ত।  যদি ভুল মনে না করে থাকি তাহলে, মাসুদা মোক্ষম সময় বলতে ইঙ্গিত করেছেন যখন তিনি আক্রমণের শিকার, নাজুক অবস্থায় আছেন, সকলের সমর্থন দরকার...এরকম কিছু। মাসুদা আসলে কী অবস্থায় আছেন? বর্তমান সময়ের মইনুল বিতর্কে তাঁর ভূমিকা আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

বিএনপি-জামায়েত পন্থী বুদ্ধিজীবী ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন অনেক দিন ধরেই সরকার বিরোধী নানান কূটচালে জড়িত ছিলেন। অনেকের ভাষায় লোকটার খুব বাড় বেড়েছিল। সবাই যখন তাকে শায়েস্তা করার উপায় খুঁজছিলেন তখন সেই সুযোগটি জনাব মইনুলই করে দিলেন একাত্তর টিভিতে মাসুদা ভাট্টির উদ্দেশ্যে “চরিত্রহীন মনে করতে চাই” মন্তব্য করে। মাসুদার করা প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে এমন মন্তব্য করে ব্যারিস্টার মইনুল অবশ্যই অন্যায় করেছেন। পরবর্তিতে তিনি মাসুদা ভাট্টিকে ফোন করে, চিঠি লিখে নানান ভাবে ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা পাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ ততক্ষণে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, মইনুল সাহেবকে নাকানিচুবানি খাওয়ানো হবে। সে উদ্দেশ্যে সাংবাদিকদের মিটিং হয়েছে, মামলা হয়েছে, টকশো এমনকি টিভিতে তাঁর খবর প্রচার না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারমানে বলা যায় এখানে মইনুলকে শায়েস্তা করতে মাসুদা একজন “উছিলা” মাত্র। তাই মাসুদার ভাষায়, “একটি চরম সংকটকালে যখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কবলে থেকে একদল মানুষ ন্যায়ের জন্য লড়ছে..” এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই মিটিং, বয়কট, মামলার সাথে নারী আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই, পুরোটাই রাজনৈতিক। ব্যারিস্টার মইনুলকে নাকানি চুবানি খাওয়ানো হচ্ছে, আরও খাওয়ানোর নির্দেশ এসেছে কেননা আজকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “মইনুলের বিরুদ্ধে আরও মামলা করুন” এবং শেষ পর্যন্ত মইনুলকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। সংকটকাল মইনুলের, মাসুদার নয়। 

এই একাত্তর টিভিতেই নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হোসেন আইভীকে শামীম ওসমান নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। শুধু কি ভাষায় আক্রমণ? শারিরীক ভাবেও আক্রমণ করতে উদ্ধত হয়েছিলেন। না, এর প্রতিবাদে মিছিল মিটিং, প্রেস কনফারেন্স, প্রতিবাদলিপি, বিবৃতি কিছুই হয়নি। উল্টো ওই অংশটুকু কেটে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়েছিল। কারণ শামীম ওসমান সরকারি দলের লোক। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কোনও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা সম্ভব নয়। তাই একাত্তর টিভি সেসময় অনেকটাই নীরব ভূমিকা নিয়েছিলেন। 

মাসুদা ভাট্টি সহ আরও অনেকের মতে তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত ক্ষোভ ঝেড়েছেন। তসলিমার সাথে মাসুদার ব্যক্তিগত সম্পর্কটা কতটুকু?  একসময় তসলিমার কল্যাণে মাসুদার ব্রিটেনে নাগরিকত্ব মিলেছিল। পরবর্তিতে তসলিমার ‘ক’ বইটি প্রকাশিত হলে সেখানে বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের উল্লেখ এসেছে। তাঁদের কারও কারও সম্পর্কে সত্য সামনে আসায় তাঁরা অস্বস্তিতে পড়েছিলেন।  তাই বই ব্যান করতে, কুৎসা রটাতে মাঠে নামেন তাঁদের অনেকেই। তখন মাসুদা ভাট্টিও তাঁদের সাথে তাঁর কুৎসার ঝুলি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। ২০০৩ সালে নভেম্বরের ২০,২১,২২ তিনদিন ধরে মাসুদা ভাট্টির সেই কুৎসা ছাপানো হয় দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায়, যার শিরোনাম ছিল, “তসলিমা নাসরিনের লেখা ‘ক’ ফুরিয়ে যাওয়ার বেদনাঘন আত্মযৌবনিক কামশাস্ত্র”। মাসুদা তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেছেন সেসময় তাঁর নারীবাদ, নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে একাডেমিক জ্ঞান না থাকায় তিনি সেসব গালিগালাজ লিখেছিলেন। তিনি অবশ্য এসব গালাগালকে ব্যক্তিগত আক্রমণ মানতে নারাজ। কী লিখেছিলেন তিনি সেসময় তার কিছু অংশ তুলে ধরা হল-

“তসলিমা নাসরিনের কঃ ফুরিয়ে যাওয়ার বেদনাঘন আত্মযৌবনিক কামশাস্ত্র:..... দূর্বল চিত্রের যে কেউ বইটি পাঠে ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে উদ্বেল হবেন, বিশেষ করে কলেজ ছাত্রদের কাছে বইটি হতে পারে রাতের ঘুম হরণকারী। আত্মজৈবনিক কোন গ্রন্থে এইরকম রগরগে ভাষায় ব্যক্তিগত যৌনতার বর্ণনা খুব কম লেখাতেই খুঁজে পাবেন কেউ। সেদিক থেকে তসলিমা নাসরিনের বইটি অবশ্যই অনেকের কাছে অবশ্য পাঠ্য হবে। এর আগেও এমনটি হয়েছে, তার আমার মেয়েবেলা, উতল হাওয়া পাঠে কামশাস্ত্রের চৌষট্টি কলা তিনি শিখিয়েছেন বাঙালি পাঠককে।…. ক বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের প্রথম বর্ণ বটে। কিন্তু সেটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য। কিন্তু তসলিমা নাসরিন তার ক হয়তো কামশাস্ত্রকেই বুঝিয়েছেন এবং সেটাও এই সাধারণের জন্যই। আশ্চর্য, কোথায় একজন লেখক ক বর্ণানুক্রম দিয়ে কলমের শক্তির কথা বলবেন তা না, তিনি নেমেছেন ক দিয়ে কামশাস্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে।”


তসলিমা তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ‘ক’ বইয়ের নামকরণের কারণ বলেছিলেন, বকুলি নামে একটি কিশোরী মেয়ে গণধর্ষণের স্বীকার হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মা বারবার তাকে বলছিলো, “কথা ক, কথা ক বকুলি”। তবুও সে কথা বলেনি। সেই “বকুলি কথা ক” থেকেই  তসলিমা নিজের বইয়ের নামকরণ করেছিলেন ‘ক’। আর মাসুদা ভাট্টি ‘ক’ নামকরণের পেছনে পেয়েছেন কামশাস্ত্রের গন্ধ। যার যেমন চিন্তা। যারা ‘ক’ পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই জানবেন বইটির মূল আলোচ্য ছিল মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। আরও ছিল, লেখকের নারীবাদী ভাবনা, কর্মকাণ্ড, দেশের নানা ঘটনা, তাঁর লেখক জীবন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, কবি লেখক বুদ্ধিজীবিদের সহচর্যের প্রসঙ্গে নানান আলোচনা। 

তিনি আরও বলেছেন, “এখন প্রতিবছর তাঁর দুটি একটি বই বেরুচ্ছে, হৈ চৈ ফেলে দিচ্ছে শুধুমাত্র যৌনতার কারণেই, কিন্তু যখন তাঁর শরীরে ও কলমে ডেফিসিট হবে, তখন? নিজেকে পরিত্যক্ত ল্যাম্পপোস্ট তসলিমা কেন বানাতে গেলেন বুঝিনা। তাঁর ‘ক’ তাঁকে এরকমই একটি ল্যাম্পপোস্ট বানিয়েছে যেখানে আর কোন দিন হয়ত বাতি জ্বলবে না। কিন্তু পরিত্যক্ত ল্যাম্পপোস্ট পেলে সারমেয়রা যা করে সেটা ভেবে কষ্ট লাগছে।” 

মাসুদার কথা মতে, নারীবাদ সম্পর্কে একাডেমিক জ্ঞান ছিল না বলেই নাকি তিনি  তসলিমাকে পরিত্যক্ত ল্যাম্পপোষ্ট বলেছেন। পরিত্যক্ত ল্যাম্পপোষ্টে সারমেয়রা অর্থাৎ কুকুররা যা করে সেটি ভেবে তিনি দু:খ করেছেন। তাঁর মতে, ‘ক’ বইটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে শরীরে ঘিনঘিনে ঘা ওলা রাস্তায় পড়ে থাকা এক বুড়ি বেশ্যার আত্মরতি। তসলিমার ১ম ও ২য় আত্মজীবনী আমার মেয়েবেলা ও উতল হাওয়ার মত সাহসী বই সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল, এসব বইয়ে নাকি  তিনি বাঙালিকে কামশাস্ত্রের চোষট্টিকলা শিখিয়েছেন। বলে রাখা ভাল, আমার মেয়েবেলা বইটির জন্য তসলিমা নাসরিন দ্বিতীয় বারের মত  আনন্দ পুরষ্কার পেয়েছিলেন। 

 ব্যারিস্টার মইনুল মাসুদা ভাট্টিকে চরিত্রহীন বললে সেটি যদি হয় নারী আন্দোলনের বিষয় তাহলে মাসুদা ভাট্টি সমগ্র লেখাজুড়ে তসলিমাকে চরিত্রহীন থেকে শুরু করে যতসব নোংরা আশোভন ভাষায় গালাগালের ব্যাপারটা কীভাবে তসলিমা-মাসুদার ব্যক্তিগত বিষয় হয়? যারা তসলিমার লেখাকে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে লেখা বলেছিলেন, তারা আশা করি  সুবিচার করবেন। 

২০ বছর আগে তসলিমাকে দেয়া গালাগাল তসলিমা এখনও মনে রেখেছেন বলে মাসুদা অনেকটা গোস্বা করেছেন। প্রশ্ন হল, তসলিমার কাছে কি তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন? না,চান নি। ক্ষমা না চেয়েই তিনি ‘যা হয়েছে ভুলে যান’ জাতীয় মামাবাড়ির আবদারটা কীভাবে করলেন? আর এদিকে যেই মইনুলকে নিয়ে এত শোরগোল সেই মইনুল ফোনে ক্ষমা চেয়ে এমনকি চিঠি পাঠিয়েও ক্ষমা পাননি। 

তাই মাসুদা তসলিমাকে উদ্দেশ্য করে তাঁর স্ট্যাটাসে, মাথা পেতে নিলাম, কোনও বিদ্বেষ নেই, ব্যক্তিগত আক্রমণ করিনি- জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে পাঠকের কাছে সুবোধ বালিকা সেজে যে সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টা সেটি তাঁর চরিত্রের আরেকটি দিককে উন্মোচিত করে, যাকে সোজা বাংলায় বলে ‘ধূর্ত’।