বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫

পরাধীন বিজয় দিবস‬

বিজয় দিবসে ফেইসবুকে ঢুকেই দেখলাম অনেকে পোস্ট দিচ্ছে, তারা শাহাবাগে যাচ্ছে, সবাই একসাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে, কনসার্ট করবে, বিজয় দিবস উদযাপন করবে। আর আমি দূর দেশে একা বসে ভাবছিলাম, গত বছরে আমি বিজয় দিবসে কি করেছিলাম। ২০১৪ সালের বিজয় দিবসে বন্ধুদের সাথে একটা র‍্যালিতে গিয়েছিলাম, তারপর একটা শপিং সেন্টারের পাশে সবাই মিলে আড্ডা। ২০১৩ সালে কি করেছিলাম? ২০১৩ সালে বন্ধুদের সাথে জামালখান চেরাগী পাহাড়, যেখানে চিটাগাং গণজাগরণ মঞ্চ বসে, সেখানে বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলাম সবাই মিলে একসাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে। স্কুলে যদিও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে, কিভাবে স্কুলে নতুন কোন হাঙ্গামা করা যায়, সেসব প্ল্যান করতাম। কলেজে কড়া নিয়ম থাকার কারণে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় বন্ধুরা যারা চুলে বেনি করে আসে নি, তারা ইন্সট্যান্ট বেনি করে নিতো, কারণ জাতীয় সঙ্গীত শেষ হলেই চেকিং চলতো। আমার যেহেতু চুলের ঝামেলা নেই, তাই আমি জুতা মোজা, আইডি কার্ড, নেইম প্লেট সব ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে নিতাম। আর কোন কারণে আইডি কার্ড বা নেইম প্লেট না আনলে কিভাবে কড়া চেকিং এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সেসব নিয়ে প্ল্যান করতাম।

মাঝেমাঝে খুব কলেজে যেতে ইচ্ছে করে। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চগুলো ছিল আমার এবং আমার মত কিছু হাই লেভেলের ব্রিলিয়েন্টদের জন্য বরাদ্ধ। সকাল সাড়ে ছয়টায় কলেজের জন্য বের হতাম, বাসায় ফিরতাম দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে। দিনের প্রায় নয় ঘন্টা সময় আমি বন্ধুবান্ধব নিয়ে কাটাতাম। কলেজে কখনও একটার বেশি বই নিয়ে যাই নি, কারণ আমি কলেজে পড়তে যেতাম না, বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈহুল্লোড় করতাম, স্কুলেও তাই করতাম। স্কুলে ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত প্রতিবছর আমি নিয়মিত উপস্থিতির জন্য পুরষ্কার পেয়েছিলাম। আমি স্কুলে যাব না, এটা ভাবতেই পারি না। সেই আমি এখন বন্ধুবান্ধব ছাড়া, আমার মজার স্কুল-কলেজ ফেলে একা একটি অনিশ্চিত জীবনযাপন করছি, কেবলমাত্র বাংলাদেশের মত একটি স্বাধীন দেশে বসে নিজের মত প্রকাশ করেছিলাম বলে।

পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে বলে থাকেন, ‘পাকিস্তানিরা বর্বর জাতি। কারণ ৭১ এ তারা আমাদের মা-বোনদের অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, ধর্ষণ করেছে’। পাকিস্তানিরা তাদের মা-বোনদের অত্যাচার-নির্যাতন-ধর্ষণ করেছে বলে পাকিস্তানিদের উপর ঘৃণা। আর প্রতিদিন স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে নারী নির্যাতন, ধর্ষণের পরিসংখ্যান গুলো নিয়ে কারও মাথা ব্যথা আছে? বাংলা ভাষার অধিকাংশ গালি মা বোন দিয়ে শুরু হয়। এইসব গালি আবার তাদের খুব পছন্দের।

‘নারী স্বাধীনতা’ শব্দটি এখনও স্বাধীন দেশটির অধিকাংশ পুরুষকে হাসায়। ‘নারী স্বাধীনতা আবার কি? নারীরা আমাদের মা-বোন-বউ হয়ে থাকবে, আমাদের ইচ্ছায় চলবে, এইতো!’ ইদানিং রাস্তাঘাটে হিজাব বোরখার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা বেড়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, পুরুষের স্বাধীনতা। নারীর উপর যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। ইচ্ছে হলেই রাস্তায় চলতে বিরক্ত করা, ইচ্ছে হলেই ধর্ষণ করা, যৌন হয়রানি করা, ইচ্ছে হলে বিয়ে, ইচ্ছে হলেই তালাক। নারী স্বাধীনতার কথাগুলো স্পষ্ট কন্ঠে জানিয়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। সেই তসলিমা নাসরিন আজ প্রায় একুশ বছর ধরে নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত।

স্বাধীন দেশটিতে কেউ যদি ব্লগ, ফেইসবুকে নিজের মতামত প্রকাশ করে তবে তাকে হত্যা করা হয় এবং যার কোন বিচার তো দূরে থাক, রাষ্ট্র এই হত্যাকে কোন অপরাধের আওতায় ফেলে না।

সরকার বদলের সাথে সাথে স্বাধীনতার ঘোষকের নাম পাল্টে যায়, যুদ্ধাপরাধী একটি দল দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়, সেই যুদ্ধাপরাধীদের পাশে দাঁড়ায় দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল, যেটি মুক্তিযোদ্ধার দল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। তাদেরই ডাকা হরতালে ককটেল বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ হারায়, পঙ্গু হয় সাধারণ মানুষ। মুক্তিযোদ্ধারা এদেশে চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারায়, আর কুখ্যাত রাজাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে শান্তিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। বিভিন্ন ইস্যুতে সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা এখানে নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপার। মায়ের পেটেও এদেশে শিশুরা নিরাপদ নয়। স্বাধীন দেশটিতে এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনার খেতাব পায়।

সত্যি বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। এই দেশে স্বাধীনভাবে সব ধরণের অপরাধ করা যায়। অপরাধীদের জন্য এটি একটি স্বাধীন দেশই বটে।

দু'জন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি দেয়ার পর নাশকতার ভয়ে সারাদেশে সব ধরণের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে রাখতে হয়, বিজিবি মোতায়ন করতে হয় বিভিন্ন শহরে- কাদের ভয়ে? এই শত্রুদেরই তো আমরা ৭১এ আমরা পরাজিত করেছিলাম, তবে এত ভয় কেন? ৭১এ নয় মাস যুদ্ধের পর যাদের পরাজিত করেছিলাম বলে ১৬ ডিসেম্বর দিনটিকে আমরা বিজয় দিবস পালন করি, সেই শত্রুদের থেকে কি বাংলাদেশ আজও মুক্ত হতে পেরেছে? আমরা কি ১৬ ডিসেম্বরের মর্যাদা রাখতে পেরেছি? বিজয় দিবস পালনের যোগ্যতা অর্জন করেছি?

‎নাস্তিক হত্যার বিচারেও অনুভূতিতে আঘাত লাগে‬!


অনেকদিন হয়ে গেলও কিছু লিখতে পারছি না। কি লিখব, কাদের জন্য লিখব, লিখে কি হবে--এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। এতগুলো প্রাণ নেই হয়ে গেলও শুধুমাত্র তারা দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, ভাবতো বলে। নাস্তিক মরলে দেশে কার কি যায় আসে? 
লিখতে গেলে কিছু স্বপ্ন লাগে, আশা লাগে। কিন্তু দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে এখন ভয় হয়। অনলাইনে দেশের পত্রিকা পড়ে হতাশ হই। জানি হতাশ হবো, তবুও দেশের পত্রিকাই পড়ি। অথচ আমি এখন যেই দেশে আছি, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামটাও জানি না।

মাঝে মাঝে মনে হয়, ঘুম থেকে উঠে যদি শুনি বাংলাদেশ বলতে কোন দেশ কখনও ছিল না, তবে খুব খুশি হবো। আমার সমস্ত ভাবনা জুড়েই বাংলাদেশ। দেশটা আমাকে হতাশা ছাড়া আর কিছুই দেয় না। দেশটা যদি নেই হয়ে যেতো, তাহলে হয়তো একটা চিন্তা মাথা থেকে দূর হতো।
আগে রাতে টিভিতে টক শো দেখতাম, আর রাজনীতি নিয়ে বাবার সাথে কঠিন আলাপ করতাম। এখন রাজনীতি নিয়ে নিজেই ভাবি, যদিও ভেবে কোন কূল কিনারা পাই না। জিয়া পরিবার দেশে খাল কেটে কুমির আনলো। কাজেই বিএনপির কাছে কারও কোন কিছু চাওয়ার নেই। তখন সব আশা ভরসা হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামীলীগ। কিন্তু ভোটের রাজনীতিটা এখন আওয়ামীলীগও শিখে ফেলেছে। এদেশের অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে ভোট দেয়। কাজেই যেই দলের ব্যানারে আল্লাহ খোদার নাম পাওয়া যায়, তাদের মার্কায় ভোট দিয়ে ভাবে যে, ‘যাক আল্লাহ্‌র পথেই আছি’। বিএনপি-জামায়েত ভোট পায় শুধুমাত্র এই কারণে। আওয়ামীলীগও বুঝে গেছে ভোট পেতে হলে তাদেরও ধর্মকে ব্যবহার করতে হবে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান এদেরকে আওয়ামীলীগ যতই লাথি-জুতা মারুক না কেনও, ভোট তারা আওয়ামীলীগকেই দিবে। কাজেই এদের নিয়ে আওয়ামীলীগের কোন চিন্তা নেই। চিন্তা এখন বাকি ৯০ পার্সেন্টের ভোট নিয়ে। তাই বিএনপি-জামায়েতের সাথে তাল মিলাতে আওয়ামীলীগ এখন মাঠে নামিয়েছে ওলামীলীগকে। নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যু নিয়ে তারা আর ঘাটাচ্ছে না। সজীব ওয়াজেদ জয় তো বলেই দিলেন যে, এটা নাকি একটা ‘সেন্সিটিভ’ ইস্যু। নাস্তিক হত্যার বিচার করলেও তো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। আর অনুভূতিতে আঘাত লাগা মানেই ভোট কমে যাওয়া। তাতো হতে দেয়া যায় না। কাজেই মরুক কিছু নাস্তিক।
প্রতিবার কোন নাস্তিক হত্যার পর মন্ত্রী-মিনিস্টাররা স্ক্রিপটে লেখা কিছু বক্তব্য গেয়ে চলে যান, প্রতিবারই বিচারের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে, তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে, আবার বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তদন্তের কোন অগ্রগতি নেই। ব্লগার রাজীবের খুনীরা এখন জামিনে মুক্ত হয়ে নতুন কোন ব্লগার হত্যায় মনযোগী হয়েছে। অভিজিৎ হত্যা মামলায় ও একই রকম কিছু নাটক দেখলাম। বাবু হত্যাকারীদের দুইজন পথচারী পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিলেও পরবর্তিতে সেসবের কোন খবর পেলাম না। হয়তো তারাও এখন মুক্ত হয়ে নতুন লিস্ট নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এরপর অনন্ত হত্যা, নীলয় হত্যা- এসব মামলারও কোন খবর জানা নেই। এসব দেখে প্রকাশক দীপনের বাবা ক্ষোভে বলেছেন যে, তিনি পুত্র হত্যার বিচার চান না। হানিফ সাহবে নাকি দীপনের বাবাকে খুনীদের আদর্শের একজন বলে মন্তব্য করেছেন। আর এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, দেশে কোন জঙ্গি নেই, দেশের আইন শৃঙ্খলার অবস্থা খুব ভালো। যা ঘটছে, সবই বিচ্ছিন্ন। এরপর আর বিচার চাওয়ার কোন মানে হয়? এদিকে দেশের মানুষও সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। প্রতিটি ব্লগারের মৃত্যুর পর তারা জানতে যায়, ‘কেন মারল? কি লিখছিল? ইসলাম নিয়ে না লিখলেই তো হয়’। দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে কারও কোন ভাবনা নেই।

শুনেছি, মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে বিচার প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি দিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাকামীদের বিচার চাইলো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এসব ছাতারমাথা সংগঠনগুলো কথা বলছে, নিজেদের দাবী জানাচ্ছে। এত স্পর্ধা তাদের!
স্পর্ধা হবে নাই বা কেনও? আমাদের এখানে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে বিচার চাইতে যায় উন্নতদেশগুলোর কাছে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নালিশ করতে যায় উন্নতদেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের কাছে। আমরাই বুঝিয়ে দিয়েছি যে, আমরা একটা মেরুদন্ডহীন জাতি, দেশের আভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে কথা বলার সাহস তো আমরাই তাদেরকে দিয়েছি।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে এত সময় ব্যয় সহ্য হয় না। ৪২ বছর পর বিচার হচ্ছে, তাও আবার ট্রাইবুনালের রায়, এরপর সুপ্রীম কোর্টে আপিল, তারপর আবার রিভিউ। রিভিউয়ের পর আবার ক্ষমা- আরও কতকিছু। এরমধ্যে আবার রায়ের কপি নাকি লেখা শেষ হয় না। এইসব কাহিনী করতে গিয়ে জেলের ভিতরেই যুদ্ধাপরাধীদের অধিকাংশ মারা যাবে। তাও ভালো যে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মারা যাবে, মন্ত্রী হিসেবে নয়। আওয়ামীলীগের কাছে পাওয়া বলতে এতটুকুই। আর বাকি সবকিছুই এখন দুইদলেরই এক। দেশ নিয়ে এখন আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে হয় না। কাকে ভরসা করে দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখব? দেশের স্বার্থেই আওয়ামীলীগ-বিএনপির বিকল্প কিছু ভাবার সময় এসেছে কি?

‪ফেইসবুকহীন নিরাপদ দেশটির গল্প‬


কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী, মুজাহিদ এই পর্যন্ত চারজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। আমার জন্য, যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর মানেই ছিল বইখাতা বন্ধ করে টিভির সামনে বসে থাকা। কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের দিন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে কুখ্যাত ঘাতকের বিচার হচ্ছে!বিভিন্ন চ্যানেলে তার কুকর্মের কথাগুলো বর্নণা করা হচ্ছিল, সেসব দেখছিলাম, আর রাগে ফেটে পড়ছিলাম। কামারুজ্জামানের রায় কার্যকরের দিন বিনা নোটিশে স্যার পড়াতে চলে এলেন। স্যারকে সাথে নিয়েই সেদিন কামারুজ্জামানের কুকর্মের কাহিনী শুনলাম, স্যারের সাথে রাজনৈতিক আলাপ করলাম, সাথে বাবাও এসে যোগ দিলেন। গত ২২শে নভেম্বর, কুখ্যাত দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহাসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হল। আমি দেশের বাইরে। জাগো বিডি ওয়েব সাইট থেকেই সাধারণ আমি বাংলাদেশের চ্যানেল গুলো দেখি, কিন্তু সেদিন জাগো বিডি সাইটটা স্লো হয়ে গেলও। প্রবাসীরা সবাই নিশ্চয়ই এই একটি ওয়েব সাইটের মাধ্যমে দেশের খবর শুনছিল। সাইট স্লো, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর শোনার সময় বারবার আটকে যাচ্ছিল, রেগে গিয়ে হয়তো ল্যাপটপ ভেঙ্গে ফেলতে পারি, এই ভয়ে ল্যাপটপটা হাতের নাগালের বাইরে রেখে, নাওয়া খাওয়া বন্ধ রেখে নিউজ শুনছিলাম। ভেবেছিলাম রাত ১০টার মধ্যেই হয়তো ঝুলিয়ে দেয়া হবে। ১১টায়ও যখন ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে না, তখন মনে মনে খুব চাইছিলাম আরেকটু দেরী হোক, ১২টা ক্রস করুক। ফাঁসির তারিখটা ২১শে নভেম্বর না হয়ে যেন ২২শে নভেম্বর হয়। অবশেষে বাংলাদেশ সময়ে ১২টা ৫৫ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হল। কাজেই দিনটাকে ২২শে নভেম্বর ধরাই যায়। ২২শে নভেম্বর আমার জন্মদিন। জন্মদিনটা ফেইসবুক প্রোফাইলে হাইড করে দিয়েছিলাম যাতে কেউ দেখতে না পায়। কিন্তু কয়েকজন বন্ধু মনে রেখেছিল, তারা ওয়ালে পোস্ট করার পর, অনেকেই শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাতে শুরু করল। জানা যখন হয়েই গেলও, ভাবছিলাম সুকান্ত ভট্টাচার্যের আঠারো বছর বয়স কবিতাটা পোস্ট করব, শেষ পর্যন্ত আর করা হল না। এই বয়স নিয়ে কম ভোগান্তি হয় নি। তবে ছোট থাকার অনেক উপকারিতাও আছে। সব ভুলত্রুটিগুলো ছোট বলে মাফ পাওয়া যায়। কিন্তু বড় হয়ে গেলে এই সুবিধাটুকু আর পাওয়া যায় না। জগতের জটিল সব বিষয়গুলো নিয়ে ছোটদের ভাবতে হয় না। কিন্তু আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলেই মানুষ নিজেকে জটিল সবকিছুতে জড়িয়ে ফেলে। আমি ছোট থাকতে চাই, ভুল করার পর বয়সের অজুহাতে ক্ষমা পাওয়ার সুবিধাটুকু পেতে চাই সবসময়। জটিল কোনকিছুতে নিজেকে জড়াতে চাই না।

শুনেছি কিশোরী ঐশীর নাকি ফাঁসির রায় হয়েছে? ঐশী তার পুলিশ বাবা ও মাকে খুন করেছে। ঐশী মাদকাশক্ত ছিল। খুনের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছরের কম। বয়স বিবেচনায়, ঘাতক গোলাম আজম যাবজ্জীবন সাজা পেলও, অথচ ঐশীর বেলায় বয়স বিবেচনায় আনা হল না!

ঐশীর এই পরিণতিতে ঐশী একা দায়ী নয়, একজন ঐশীকে ফাঁসি দিলেই সমাজে আরেকজন ঐশী সৃষ্টি হবে না, এমন নিশ্চয়তা কি দেয়া সম্ভব হবে? ঐশীর বয়স অল্প ছিল, সে যে ভুল করেছে সেটাই তাকে বুঝতে দেয়া হল না, তাকে তার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হল না। হ্যাঁ, আমি ঐশীর ফাঁসির বিপক্ষে। কেবল ঐশী না, আমি চাই সব মানুষকেই নিজের ভুল বোঝার, অনুতপ্ত হওয়ার, ভুল সংশোধের সুযোগ দেয়া হোক। তবে যুদ্ধাপরাধীর কথা আলাদা।

মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কাদের মোল্লা নিজের কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত তো দূরের কথা, ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে গেলও। কামারুজ্জামানের মৃত্যুর পর তার পরিবার মিডিয়ায় ‘ভি’ চিহ্ন প্রদর্শন করেছে। সাকা-মুজাহিদ ক্ষমা চাওয়ার নাটকটা করে, চেয়েছিল হয়তো একদিন বেশি বাঁচতে পারবে, কিন্তু যখন দেখল এতে কাজ হচ্ছে না, তখন তার পরিবারের সদস্যরা বাইরে এসে জানিয়ে দিলো তাদের বাবা ক্ষমা চায় নি। এইসব যুদ্ধাপরাধীরা কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময়ই অপরাধ করে নি, যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে দেশে এসে তারা বিএনপি সরকারের আমলে পুনর্বাসিত হয়ে নিজেদের কুকর্ম অব্যাহত রেখেছে। আর এই অপরাধীদের যদি কোন ভাবে ক্ষমা করা হয়, তবে ভবিষ্যতে সরকার বদলের পরই তারা জেল থেকে মুক্ত হয়ে, ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যের সাথে জড়িত প্রত্যেক সদস্যকে হত্যা করবে। বিচার চলাকালীনই কিছু সাক্ষীকে হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে। কাজেই এইসব পশুর প্রতি মানবতা দেখানোর ভুলটা আমি করছি না। তবে কথা হল, এই কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিলেই কি দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে যাবে? তা কিন্তু না। দেশে জঙ্গিবাদের চাষ ঠিকই হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদের চাষের দিকে নজর না দিয়ে আমাদেরকে ঢেড়স চাষের পরামর্শ দিয়েছেন। বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের এই জাতীয় মন্তব্য শুনেই বুঝতে পারি, ৭১ এ ঘাতকরা জাতিকে অনেকটুকুই মেধাশুণ্য করতে পেরেছে।

একের পর এক মুক্তমনা মানুষ হত্যা চলছে, কেবল নাস্তিক মুক্তমনা নয়, বিদেশী নাগরিক হত্যা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া—এসবই নির্বিঘ্নে ঘটে চলেছে। সরকার যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দিচ্ছে, এর জন্য ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এইসব ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনাগুলোর দিকেও কি তারা একটু নজর দিবেন? নাকি এখনও ৪৪ বছর হয়নি বলে বিচার কার্য শুরু করা যাচ্ছে না?

আবার দেশের মানুষের নিরাপত্তার দোহায় দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এই অবস্থাতেও হত্যা উৎসব চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে কি কোন ফল পেয়েছে? দেশের মসজিদ মাদ্রাসায় মগজ ধোলায় চলছে, নাস্তিক হত্যাকে ‘সেন্সিটিভ’ ইস্যু আখ্যা দিয়ে অপরাধীদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে—এইগুলো যদি পারেন বন্ধ করেন, সুফল পাবেনই, নিশ্চিত।