শনিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৬

হিন্দুদের পুতুলপূজা এবং মুসলমানদের স্ববিরোধিতা



আমি একজন নাস্তিক। ঈশ্বর নামক কাল্পনিক কিছুতে আমার বিশ্বাস নেই। কাজেই মূর্তিপূজা, ধর্মানুভূতি পূজা এসব আমাকে দিয়ে হয় না। মূর্তিতে যেহেতু আমি কাল্পনিক কোনও শক্তিকে কল্পনা করতে পারি না তাই মূর্তি আমার কাছে শুধুই মূর্তি। পুতুলও বলা যায়। আবার শিল্প হিসেবেও নেয়া যায়। তবে শিল্প যখন সংরক্ষণ না করে পানিতে ভাসানো হয় সেটাকে অর্থ এবং শিল্পের অপচয় বলেই মনে হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন সবাই শারদীয় দুর্গা উৎসবের শুভেচ্ছা জানানো চলছে তখন আমি পুতুলখেলা উৎসবের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। আগেই বলেছি, আমি মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নই, আর পুতুল (মূর্তি) নিয়ে যা করা হয় সেটা আমার কাছে পুতুল খেলা উৎসব। এতে অনেকেরই ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে। যদিও এটি রাষ্ট্রধর্মানুভূতি নয় বলে আমাকে ৫৭ ধারা নিয়ে ভাবতে হয়নি। রাষ্ট্রধর্ম ছাড়া বাকি সব ধর্ম নিয়ে যা খুশি বলার চর্চাটা বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ভালো ভাবেই হয়।

আমার পরিচিত একজন ছোটবেলায় পুতুল নিয়ে খেলা করত। তার পুতুল খেলার বয়স অতিক্রম হওয়ার পরও দেখলাম সে পুতুলের সাথে কথা বলছে, পুতুলটাকে নিজের বোন বলছে। সর্বক্ষণ পাশেপাশে রাখছে। কারও হাত লেগে যেন ব্যথা না পায় সেসব দিকেও তার কড়া নজর। পুতুলকে খাওয়াচ্ছে, পুতুলের সাথে খেলছে, হাসছে, কথা বলছে- এসব দেখে বিভিন্নজনের কি হাসি! হাসি আমারও পেত, তার পুতুলপ্রেম নিয়ে সবসময় তাকে বিরক্ত করতে পছন্দ করতাম। পুতুলের সাথে তার এই অদ্ভুত কাল্পনিক সম্পর্ক দেখে আমি মাঝেমাঝে তাকে অটিস্টিকও মনে করতাম। যদিও এখন তার সেসব কেটে গেছে। তবে সেসময় তার পুতুল প্রেম নিয়ে যারা হাসতেন, ‘এখনও বাচ্চা রয়ে গেছে, পুতুল নিয়ে খেলে’ এরকম ভাব দেখাতেন, তাদের সকলেই সকাল বিকাল মূর্তিকে ফুল বেলপাতা দিয়ে পূজা করে। মূর্তিকে খেতে দেয়। তারপর সেসব খাদ্য পচে অলমোস্ট খাদ্য অযোগ্য হলে সেসবকে ‘প্রসাদ’ বলে ঠাকুরের নাম নিয়ে নমঃ নমঃ বলে খেয়ে ফেলে। ওই পরিচিতের পুতুলপ্রেম নিয়ে হাসাহাসি করলে সে যেভাবে রেগে যেত, বড়দের মূর্তিপূজা নিয়ে হাসলে তারা দ্বিগুণ রেগে যান, সাথে ‘ধর্মানুভূতি’ জাতীয় গুরুগম্ভীর টার্ম যুক্ত হয়। 

ধর্মে আমার বিশ্বাস না থাকলেও সবার নিজ নিজ মত ও বিশ্বাস নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের অধিকারে আমি বিশ্বাসী। যদিও ধার্মিকদের কাছে ‘আমার ধর্মই একমাত্র সত্য, বাকিসব মিথ্যা’। এটা একদিকে ঠিকই আছে। প্রত্যেক ধর্মের নিয়মকানুনই ভিন্ন এবং কিছু কিছু নিয়ম আবার সাংঘর্ষিকও বটে। যেমন: হিন্দুরা গরুকে তাদের দেবতা রূপে পূজা করে, আর মুসলমানরা কোরবানিতে গরু কেটে উৎসব করে। যে গরুকে দেবতা মনে করে তার গরু কাটা উৎসবে সমর্থন করার কোনও কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, দূর্গাপূজাকে বাঙ্গালীর উৎসব বলেছেন এবং আরও বলেছেন, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। দূর্গাপূজার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এটি বাঙ্গালীর উৎসবই বটে। ছোটবেলায় ধর্ম বইয়ে পড়তাম, হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব নাকি দূর্গা পূজা। অথচ ইন্ডিয়ায় কলকাতার বাঙ্গালী হিন্দুরা ছাড়া দূর্গা নামটায় কজনে জানে সন্দেহ আছে, আর পূজা বা উৎসব করা তো দূরের কথা। হিন্দু ধর্মে একেক জায়গায় একেক দেব/দেবীর পূজার রীতি প্রচলিত। কোনও জায়গায় ‘দীপাবলী’ সবচেয়ে বড় উৎসব, কোথাও মকর সংক্রান্তি কোথাও শট পূজা। আরও কত যে পূজা। এখন যেমন পূজা বলতে ঐশ্বরিক ব্যাপার ভাবা হয়, মূর্তির ভিতর ঈশ্বর বা অলৌকিকতার গন্ধ খোঁজা হয় প্রাচীনকালে কিন্তু পূজা ব্যাপারটা এমন ছিলও না। তখন সমাজে যারা বিশেষ কোনও অবদান রাখতো তাদেরকে সম্মান জানাতে এই পূজার প্রচলন হয়। কৃষিকাজ আবিষ্কার করে মেয়েরা। আর কৃষি নির্ভর সমাজগুলোতে মেয়েরাই ক্ষমতাবান, তারাই দেবী। পূজাগুলো সাধারণত কৃষিকাজের অবসরে বিনোদনের অংশ ছিল। 

মূর্তিপূজা ইসলাম ধর্মে হারাম। ইসলাম ধর্মের শুরুটাই হয়েছিল নবী মুহাম্মদের কুরাইশদের ৩৬০টি মূর্তি ভাঙার মধ্য দিয়ে। ইসলাম ধর্মে পাপীদের জন্য সাতটি দোযখ বরাদ্ধ রাখা আছে বলে বিশ্বাস করা হয়। তারমধ্যে তিন নম্বর দোযখটির নাম হল ‘ছাক্কার’। দেব দেবী ও মূর্তির উপাসকদের এই দোযখে পাঠানো হবে। 

কোরআন শরীফ, হাদিস শরীফ, ইজমা ও কিয়াস অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা মোতাবেক প্রাণীর ছবি তৈরি করা, তোলা, তোলানো, আঁকা, রাখা, দেখা, দেখানো ইত্যাদি হারাম ও নাযায়িজ। হাশরের ময়দানে যারা মূর্তি তৈরি করেছেন, প্রাণীর ছবি এঁকেছেন তাদেরকে নিজেদের তৈরি মূর্তি/ছবি’তে প্রাণ সৃষ্টি করতে বলা হবে। আর তারা যখন তা পারবেন না, তখন তাদেরকে ‘ছক্কারে’ পাঠিয়ে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। এ বিষয়ে কিছু হাদিস -


عن ابى معاوية رضى الله تعالى عنه ان من اشد اهل النار يوم القيمة عذابا المصورون.

অর্থ: হযরত আবূ মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হতে বর্ণিত, “নিশ্চয় ক্বিয়ামতের দিন দোযখবাসীদের মধ্যে ঐ ব্যক্তির কঠিন আজাব হবে, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি আঁকে বা তোলে।” (মুসলিম শরীফ ২য় জি: পৃঃ ২০১)


عن جابر رضى الله تعالى عنه قال نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الصورة فى البيت ونهى ان يصنع

ذلك.

অর্থ: হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হাবীবুল্লাহ হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ঘরের মধ্যে প্রাণীর ছবি রাখতে নিষেধ করেছেন এবং ওটা তৈরি করতেও নিষেধ করেছেন। (তিরমিযি ১ম জি: পৃঃ ২০৭)

عن ابن مسعود قال اشد الناس عذابا يوم القيامة رجل قتل نبيا او قتله نبى او رجل يضل الناس بغير العلم او مصور يصور التماثيل.

অর্থ: হযরত ইবনে মাস্উদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তিদের ক্বিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি হবে, যারা কোন নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে শহীদ করেছে অথবা কোন নবী আলাইহিমুস সালাম যাদেরকে হত্যা করেছেন এবং ঐ সমস্ত লোক যারা বিনা ইলমে মানুষদেরকে গোমরাহ করে এবং যারা প্রাণীর ছবি তৈরি করে। (মুসনদে আহমদ ২য় জি: পৃঃ২১৭)


আমার পরিচিত অনেককেই দেখলাম মূর্তি পূজা বিষয়ে অন্য মুসলমানদের সচেতন করছেন। যদিও তারা নিজেরা ছবি আঁকেন, তুলেন এবং নিয়মিত ফেসবুকে আপলোড দেন, প্রেমট্রেমও করেন। আমি তাদেরকে নিজেদের এসব গুনার কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কারণ এসব কাজের জন্যও ওই একই শাস্তি বরাদ্ধ করা আছে। 

আর যারা বলছেন, ইসলামে মূর্তিভাঙ্গার কথা উল্লেখ নেই তারা স্পষ্টভাবে ইসলাম নিয়ে মিথ্যাচার করছেন। কারণ
সহীহ্‌ মুসলিম, হাদিয়াত ৯৬৯ এ আছে, আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন, আলী ইবনে আবী তালেব (রা.) আমাকে বললেন, “আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সকল মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সকল সমাধি-সৌধ ভূমিসাৎ করে দিবে এবং সকল চিত্র মুছে ফেলবে”।

সিলেটে হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক শহীদ মিনারের ওপর আঘাত আসার কারণও আশা করি স্পষ্ট হয়েছে। ইসলামিক বিধি মেনে চললে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, বঙ্গবন্ধুর মূর্তি, মুক্তিযুদ্ধের স্থাপত্য সহ সকল মূর্তি ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া উচিত। এইজন্যই ইসলামিক স্টেট ক্বাবা শরীফ ভেঙে ফেলার কথা বলেছে। ক্বাবা শরীফকে কেন্দ্র করে হাঁটা, একবার ছুঁয়ে দেখা, চুমু খাওয়া, শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মারা এগুলোও তো একরকমের মূর্তিপূজা। 

শুনেছি হজ্বের সময় এখন মানুষকে ছবি ভিডিও সেলফি তুলতে দেখা যায়। এছাড়া হ্বজের সময় সেখানে নাকি অসংখ্য সিসিটিভি লাগানো হয়! অথচ ইসলামে কিন্তু এ সম্পর্কে কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে।

‘ধর্ম যার যার উৎসব তার তার’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের কড়া নিন্দা করেছেন বাংলার জনপ্রিয় হুজুর আল্লামা আহম্মেদ শফি। মডারেটরা হয়তো বলবেন শফী হুজুর সমগ্র বাংলাদেশের ধর্মপ্রান উদার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। যদিও এই শফি হুজুরের ডাকেই লাখ লাখ মানুষের জমায়েত হয়। এমনকি মডারেটরাও ‘যদিও /কিন্ত’ জাতীয় সুর তুলে সময়ে শফি হুজুরের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। নায়ক আলমগীর বলেছেন, ‘ধর্ম যার, উৎসবও তার’। তারমতে সহি ইসলামে অন্য ধর্মের কোনও অনুষ্ঠানে মুসলমানদের যোগ দেয়া ইসলামবিরোধী। যদিও তিনি ঠিক কথা বলছেন, তবে সারাজীবন তিনি যা করে এসেছেন টিভির পর্দায় নায়িকাদের সাথে, তাতে তিনি এরচেয়েও অনেক বড় ইসলাম বিরোধী কাজ করে গেছেন। হারামকাজ করে টাকার পাহাড় বানিয়ে এখন তিনি এসেছেন সহি ইসলামিক জ্ঞান দিতে। ভণ্ডামি আর কাকে বলে!

জার জন্য দেখলাম সরকারি ভাবে বেশ কিছু নিয়ম নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। এসকল নিয়ম মেনেই সবসময় পূজা হয়ে আসছে। নামাজের সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে পুজা করার ফলাফল এদেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকেরা ভালোই জানে। তারপরও সেসব নিয়মগুলোকে সরকারিভাবে উল্লেখ করে দেয়া, পরিস্থিতির ভয়াবহতাকেই নির্দেশ করে। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও চিরস্থায়ী নয়। যুগের সাথে তাল মিলাতে গেলে বদলাতে হয়। সেখানে ধর্মগুলোর চিরস্থায়ী নিয়মগুলো সবাই নিজের সুবিধা মত ব্যবহার করছে। এটা হিপোক্রেসি তো অবশ্যই। এই হিপোক্রেসির বিরুদ্ধে বললেও নাকি ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে! নাস্তিক মানেই কেউ ভালো মানুষ, মানবিক, সমানাধিকারে বিশ্বাসী এমন ভাবাটা খুব ভুল। নাস্তিকতা মানে ঈশ্বরে অবিশ্বাস। অনেকে আছেন, জন্মগত ভাবে পারিবারিক ধর্ম পালন করেন। তবে নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করেন না। সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করেন। আস্তিক হয়েও অনেকে অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতার চর্চা করেন। এটি অবশ্যই ভালো লক্ষণ। এর পেছনে কিন্তু ব্যক্তির ধর্মের কোনও হাত নেই। এটি সম্পূর্ণই ব্যক্তির নৈতিকতার উপর নির্ভর করে। ধর্ম বলতে অনেকে নৈতিক শিক্ষাকে বুঝেন। নৈতিকতার সাথে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। ভালো মানুষ হতে ধার্মিক হওয়া জরুরী নয়। ধর্ম পালন না করেও মানবিক গুণাবলীর চর্চা করা যায়। বরং সেক্ষেত্রে কোনও ধরণের হিপোক্রেসি করতে হয় না।

সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

চুল সমাচার

অনেকদিন পর লিখতে বসেছি। নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম, মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগছে, তাই লেখার সময় হয়ে উঠছিল না। চুল লম্বা হয়ে গেছে, কাটানোর সময় পাচ্ছিলাম না। দুদিন ছুটি পাওয়াতে আজ গিয়েছিলাম চুল কাটাতে। চুল কাটানো নিয়ে আমার জীবনে অনেক ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে। দেশে ছোটবেলা বাবার সাথে যেতাম সেলুনে চুল কাটাতে। একটু বড় হতেই জানতে পারলাম সেলুনে যেহেতু পুরুষ নাপিত থাকে কাজেই আমার সেলুনে চুল কাটা চলবে না। পুরুষ নাপিত একজন মেয়ের চুল কাটছে, ব্যাপারটা আমার ‘অতি উন্নত’ সমাজ ভালোভাবে নেয় না। কিন্তু আমার চুলের কাট তো পার্লারের মেয়েরা জানে না। একজনকে দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করাতে পার্লারে নিয়ে আমি নির্দেশনা দিয়ে তার চুল কাটালাম। উদ্দেশ্য, তারটা যদি ঠিকভাবে কেটে দিতে পারে তবে আমিও কাটাতে বসব। কিন্তু না, পার্লারে আমি যেমনটা চাচ্ছিলাম সেভাবে কাটতে পারলো না। তাই আমি সেই সেলুনেই ফিরে গেলাম। সেলুনের নাপিতেরা আমাকে ছেলে হিসেবে নিয়ে চুল কাটতো। কারও কোনও সমস্যা হতো না।
আজকে একটা ইন্ডিয়ান সেলুনে গিয়েছিলাম চুল কাটাতে। এখানে চুল কাটার দাম অনেক। একটু কম দামে কাটতেই মূলত ইন্ডিয়ান সেলুনে যাওয়া। এখানে ছেলে মেয়ে সবাই চুল কাটাচ্ছে। ছেলে নাপিত যেমন আছে, মেয়ে নাপিতও আছে। ছেলের চুল মেয়ে কাটছে, মেয়ের চুল ছেলে। এতে কারও কোন সমস্যা হচ্ছে না।
আমার চুল যে কাটলো সে জানে আমি মেয়ে। বয় কাট দিতে বললাম। দিলো। বয় কাটের দামটা অন্যগুলোর তুলনায় কম আর মেয়েদের জন্য কিছু কাটের নাম দেখলাম, সেসব অনেক টাকার। কাটানো শেষে বিল দিতে গিয়ে হঠাৎ ক্যাশিয়ারের মনে হল আমি মেয়ে। পরমূহুর্তেই সে আমার কাছ থেকে বয় কাটের তিনগুন দাম চাইল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বয় কাটের দাম তো এত না, আপনি তো একটু আগেই সেই দাম নিচ্ছিলেন। এখন আবার তিন গুন দাম চাইছেন কেনও?’ সে বলল ‘ওটা তো ছেলেদের জন্য। মেয়েদের জন্য অন্য দাম।’ বললাম, ‘দাম তো নির্দিষ্ট হবে। একই কাট ছেলের মাথায় হলে এক দাম, মেয়ের মাথা হলে অন্য দাম কেনও হবে? আপনারা তো কাটের দাম নিবেন, আমি ছেলে নাকি মেয়ে তাতে আপনাদের কী আসে যায়?’ জানালো, এটাই নাকি তাদের নিয়ম। বললাম, ‘এই কাট যদি কোন ট্রান্স জেন্ডারের মাথায় যায় তাহলে কোন দাম দিয়ে তার মাথা ভেঙে খাবেন সেটা তো লিখেন নি’। তারপর সে বলল, ট্রান্সজেন্ডার নাকি মানুষের মনের ভুল। একজন হ্যান্ডসাম,শিক্ষিত লোকের মুখে একথা শুনে তো আমি অবাক! তাকে জানালাম, সে যেই দেশে বসবাস করছে এখানে ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকারের পক্ষে আইন রয়েছে। এমনকি তার নিজের দেশ ইন্ডিয়াতেও ট্রান্সজেন্ডারদের বৈধতা দেয়া হয়েছে। কোনও উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল, তাদের নিয়মই এটা। নিয়মের বাইরে সে যেতে পারবে না। নিয়ম চেইঞ্জ করার পরামর্শ দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
প্রথমত, একই কাট ছেলের মাথায় দিলে এক দাম, মেয়ের মাথায় সেটার তিনগুন দাম কীভাবে হয় সেটা আমার কোনও ভাবেই বোধগম্য হলও না। আর দ্বিতীয়্ত, ওই সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত লোকের মুখে ট্রান্সজেন্ডারের সংজ্ঞা শুনে আমাদের সমাজের অধিকাংশের মানসিকতা আসলে কেমন, সেটা বুঝলাম।
আমার ছোট চুল নিয়ে আমি যথেষ্ঠ স্বাচ্ছেন্দ্যে থাকলেও আমার আশেপাশের মানুষ প্রতিনিয়ত আমার ছোট চুলের ব্যাপারে তাদের ঘোর আপত্তি প্রকাশ করতো। বলতো, এমন ছোট চুল রাখলে আমার ক্লাসে ছেলেরা আমাকে পছন্দ করবে না। নিজেকে অস্বস্তিতে রেখে অন্যের চোখে সুন্দর হওয়ার কাজটা আমার দ্বারা কখনোই হয়ে উঠে নি। বিশাল চুলের যত্ন করার সময় ও ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই। আর কারও চোখের সুখের জন্য আমি আমার মাথাকে উকুনের আবাস ভূমি বানাতে রাজি না।
অন্যের কাছে ভালো মেয়ে খেতাব পেতে আমাদের দেশের মেয়েরা প্রচন্ড গরমেও মাথায় কাপড়ের পাহাড় বানিয়ে চুল ঢাকছে, বোরখা পরছে। নিজের স্বাচ্ছন্দ্য অনুভবের বিষয়টি সম্পর্কেই তাদের ধারণা নেই। একটিই জীবন, সেটাই কাটিয়ে দিচ্ছে অন্যের ইচ্ছেকে মেনে নিয়ে, নিজে কষ্টে থেকে অন্যকে সুখী করে। সমাজে ‘ভালো মেয়ে’ হওয়াটা জরুরী কিনা!

বুক নিয়ে লজ্জা!



বুক নিয়ে লিখেছিলাম মাসখানেক আগে। মেয়েদের বুক নিয়ে কিসের এত লজ্জা, কী কারণে এ লজ্জা- এসব প্রশ্ন প্রায় আমার মাথায় ঘুরপাক খায়।

একবার কোচিং ক্লাসে কারেন্ট ছিলও না, আইপিএস নষ্ট হয়ে গেছে। প্রচন্ড গরমে ক্লাস করছি। ছেলেরা শার্টের বোতাম খুলে বসেছে। অন্যদিকে মেয়েরা সেলোয়ার কামিজ, ওড়না, হিজাব আরও ভালোভাবে পেঁচিয়ে বসেছে। কারণ ঘামে ভিজে যদি ভিতরের কিছু দেখা যায়! আমি শার্টের একটা বোতাম খুলে বসলাম দেখে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কী ইতু? খুব গরম লাগছে নাকি? আমি আরও দুটো বোতাম খুলতে খুলতে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ স্যার’। হয়তো ভেবেছিলেন, আমি স্যারের প্রশ্নে বিব্রত হয়ে বোতামটা লাগিয়ে নিবো। কিন্তু উল্টো আমাকে আরও দুটো বোতাম খুলতে দেখে স্যার-ই মনে হয় খানিকটা বিব্রত হয়েছিলেন।

আমি আমার শরীর নিয়ে একটুও লজ্জিত নই। ছেলে এবং মেয়ে বেড়ে উঠতে থাকলে ছেলেটির স্বাধীনতা বাড়তে থাকে, আর মেয়েটির কমতে থাকে। মেয়েটির স্বাধীনতা কমে মেয়েটির শরীরের কারণে। শরীর নিয়ে ভয়। এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল, বাজে ইঙ্গিত করল, ধর্ষন করতে এলো। আমি ভেবে পাই না সারাক্ষণ এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে মেয়েরা বাঁচে কীভাবে?

অনেকের কাছে শুনি, নারী স্বাধীনতা মানেই কি শরীরের স্বাধীনতা? অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চাও, শিক্ষার অধিকার চাও ঠিক আছে। কিন্তু শরীরের স্বাধীনতা চেও না। শরীরটা পুরুষের কাছে বন্ধক রেখে বাকি স্বাধীনতা চাও। কিন্তু আমার মতে নারী যতদিন নিজের শরীরকে পুরুষতান্ত্রিক শেকল থেকে মুক্ত করতে না পারছে, ততদিন নারীর কোনও স্বাধীনতাই আসবে না। ধরুন, একজন শিক্ষিত মেয়ে। অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন। সেও কিন্তু রাতের অন্ধকারে, ভীড়ের মাঝে পুরুষের নষ্ট মানসিকতা থেকে রক্ষা পায় না। ওই সচ্ছল মেয়েটিও ধর্ষনের শিকার হলে তার অন্যসব পরিচয় মুছে গিয়ে তার পরিচয় হবে ‘একজন ধর্ষিতা’। আর যতদিন পুরুষ নারীর শরীরকে নিজেদের সম্পত্তি বলে মনে করছে ততদিন এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।

আমি বাসায় গরমকালে সেন্ডোগেঞ্জি পরি। ছোটবেলায় এটা নিয়ে কারও আপত্তি না থাকলেও ধীরে ধীরে পরিবারের সবার আপত্তি শুরু হল। এই পোশাক পরে দরজা খুলতে যাবে না। একদিন বাসায় এক আত্মীয় এলে আমাকে বলা হল, ‘যাও গিয়ে নমস্কার করে এসো’। আমি তো আমার পোশাকেই রওনা হলাম। মা থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘উপরে কিছু একটা পরে নাও’। আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘যেই লোকের আমাকে সেন্ডো গেঞ্জি পরা অবস্থায় দেখলে মাথায় বদ মতলব আসতে পারে বলে তোমার মনে হয় তাকে আমি নমস্কার করতে যাবো? অসম্ভব’।

একদিন মা বললেন, ‘তুমি এখন বড় হচ্ছো, তোমার বাবার সামনে এধরণের পোশাক পরে চলা ঠিক না’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা কি মাঝেমাঝে ভুলে যান যে আমি তার সম্পর্কে মেয়ে হই?’ এরপর থেকে মা আমাকে এসব বিষয় নিয়ে কিছু বলতে কিছুটা ভয় পেতেন সম্ভবত। কারণ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমাকে দিয়ে কোন কিছু করাতে বাধ্য করা সম্ভব নয়। আর প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়াও সম্ভব নয়।

আমার ছোট বোনকেও আস্তে আস্তে ঢেকে চলার পরামর্শ দেয়া শুরু হল। মা’র খুব চিন্তা, বড় বোনের কাছ থেকে শিখে যদি ছোটজনও নষ্ট হয়ে যায়। ছোটবোনকে মা ঢেকে চলার উপদেশ দিতে গেলেই সে আমাকে ডাকতো। আর আমাকে ডাকা মানেই প্রশ্ন। কার জন্য আমাকে ঢাকতে হবে? তার কী কী সমস্যা হয়? তার সমস্যার জন্য আমাকে কেন কাপড়ের বস্তা জড়াতে হবে? মেয়েরা যদি এখন থেকে ছেলেদের ঠোঁট বুক কোমরের দিকে অস্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে থাকে, তবে ছেলেরাও কি বোরখা হিজাব জাতীয় ঢেকে রাখা পোশাক পরবে? নাকি নিজেকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করতে ব্যস্ত হবে?

যেসব মেয়েরা নিজের শরীর নিয়ে অত্যন্ত লজ্জিত, তারা কি একবার এসব প্রশ্ন ভেবে দেখবেন? যারা আপনাকে কাপড়ের বস্তা পেঁচাতে বাধ্য করে তাদের কাছ থেকে একবার এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইবেন?

অলম্পিকের ভারতীয় প্রতিযোগী দীপা কর্মকারের ছবি দিয়ে এক বাংলাদেশী মুসলমান ছেলে পোস্ট দিয়েছে, দীপা নাকি অশ্লীল সব ড্রেস পরে খেলছে। একজন বাঙালি হিসেবে ব্যাপারটা নাকি সে মেনে নিতে পারছে না, সে বাঙালি হিসেবে লজ্জা পাচ্ছে। সাধারণত এদেশীয় মুসলমানরা মনে করে, তারা আগে মুসলমান পরে বাঙালি। এখানে মেয়েটির ড্রেস নিয়ে দুটো জ্ঞানের বাণী শোনাতে নিজের মুসলমান পরিচয়কে পিছনে রেখে বাঙালি পরিচয় নিয়ে হাজির হয়েছেন ওই অসভ্য মালটি।

ফেসবুকে একজন প্র্যাগনেন্ট নারী তার পেটের ছবি দিয়ে জানিয়েছেন, ‘সাত মাস চলছে’। ছবির কমেন্টে দেখলাম ওই নারীকে গালাগাল দিচ্ছে, ছবি সরিয়ে নিতে বলছে। ছবিটি নাকি অত্যন্ত অশ্লীল। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে এমন ছবিও নাকি ভয়ংকর অশ্লীল। যাদের চিন্তাচেতনা অন্ডকোষ দিয়ে পরিচালিত মস্তিষ্ক দিয়ে নয়, তারা সব কিছুতেই অশ্লীলতা খুঁজে পাবেন। স্বাভাবিক।

কিন্তু কোনও অসুস্থ চিন্তা চেতনার মানুষের ভয়ে কেন আমি নিজেকে অস্বস্তিতে রেখে শরীরে কাপড়ের পাহাড় জড়াব? বুক ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা, মাথা কাপড়ের বস্তা দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা, কাপড়ের উপর আবার বোরখা পরে পুরা শরীর ঢাকা। এত ঢাকাঢাকির কারণ আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না।

দেশে হিজাবের পরিমাণ বাড়ছে। হিজাব যেন একটি সংক্রামক ব্যাধি। একজন পরলে তার কাছ থেকে শিখে আরেকজন পরছে। এখন নাকি বোরখা নামক ব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছে দেশের মেয়েরা। হিজাব যদি সংক্রামক হয়, তবে নিজের শরীর নিয়ে লজ্জা না থাকা কোনও মেয়ে যদি তার ব্রা পরা ছবিটি প্রকাশ করে তবে কি অন্য মেয়েরাও এতে সাহস পাবে? এটিও সংক্রামক হবে? লজ্জা ভাঙবে? হয়তো কেউ কেউ সাহস পাবে, নিজের শরীর নিয়ে আর লজ্জিত হবে না। যদিও ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়’ তবুও মেয়েরা আর নিজের শরীর নিয়ে লজ্জিত হচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে না, স্বাধীন জীবন উপভোগ করছে এমন একটি সুন্দর সমাজের স্বপ্ন আমি সবসময় দেখি।

পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়েছি, ধর্মান্ধতা থেকে নয়

প্রতিবার যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের পর ফাঁসির পক্ষে বিপক্ষে মতভেদের সৃষ্টি হয়। যারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির বিপক্ষে তবে নাস্তিকদের ফাঁসি-কতল চান তাদের কথা বলছি না। যারা মানবতাবাদী, যারা মনে করেন প্রত্যেক মানুষের বাঁচার অধিকার আছে আমি তাদের কথা বলছি।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে এ নিয়ে কম আলোচনা তর্ক বিতর্ক হয় নি। এমনই এক আলোচনায় একজন বলছিলেন, ‘এখন যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে চট্টগ্রাম মুক্ত হয়ে নিজেদের স্বাধীনতা চায় তবে তুমি কি এর পক্ষে থাকবে নাকি বিপক্ষে?’
বললাম, ‘বিপক্ষে’।
‘ঠিক একই অপরাধটাই করেছিল ৭১ সালে জামায়েত শিবিরের নেতারা। তারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, তাই আজকে আওয়ামীলীগ এটাতে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে তাদেরকে ফাঁসি দিচ্ছে।’
আমি সাথে সাথে আপত্তি জানালাম। তাকে জানালাম যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা না চাওয়ার জন্য তাদেরকে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না। ৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে তারা নিরীহ বাঙালীদের উপর যে বর্বরতা করেছে, তাদের সেসকল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে।

এসব যুদ্ধাপরাধীরা কেবল ৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেই ক্ষান্ত হয় নি। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশে এসে মেজর জিয়ার শাসনামলে পুনর্বাসিত হয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করে স্বাধীন দেশে তারা দেশবিরোধী রাজনীতি করেছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আশ্রয়ে, ধর্মভীরু জনগণের সহানুভূতি’কে কাজে লাগিয়ে তারা আজ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তিশালী। তারা তাদের মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু বলে ঘোষণা দিলেও ফাঁসি থেকে বাঁচতে কিন্তু কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছে। শেষপর্যন্ত ফাঁসি আটকাতে না পেরে শহীদি মৃত্যুর সান্ত্বনা নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় হয়েছে। তারা মনে করে, ৭১এর মুক্তিযুদ্ধে তারা ইসলাম রক্ষার জন্য গণহত্যা করেছে। একইভাবে বর্তমানে তাদের ফাঁসিকে তারা ইসলামের জন্য মৃত্যু বলেই মনে করে।

যদিও আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষেরই বাঁচার অধিকার আছে, অপরাধী অনুতপ্ত হলে তার সাজা কমিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু এ মৃত্যুতে আমি কোনোভাবেই দুঃখিত নই। এসকল অপরাধীরা মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তাদের অপরাধ স্বীকার করে নি, তাদের কৃত কর্মের জন্য তারা মোটেই অনুতপ্ত নয়। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও কাদের মোল্লা‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে গেছে। কামারুজ্জামানের মৃত্যুর পর তার পরিবার মিডিয়ায় ‘ভি’ চিহ্ন প্রদর্শন করেছে। সাকা-মুজাহিদ ক্ষমা চাওয়ার নাটক করে একদিন বেশি বাঁচার আশা করেছিল। কিন্তু যখন দেখল এতে কাজ হচ্ছে না, তখন তার পরিবারের সদস্যরা বাইরে এসে জানিয়ে দিলো তাদের বাবা ক্ষমা চায় নি। এসব ভয়ংকর অপরাধীদের যদি কোনোভাবে ক্ষমা করা হয় তবে ভবিষ্যতে সরকার বদলের পরই তারা জেল থেকে মুক্ত হয়ে হয়তো ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক সদস্যকে হত্যা করবে। বিচার চলাকালীনই কিছু সাক্ষীকে হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে। কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি মানবতা দেখানোর কোনও কারণ আমি খুঁজে পাই না।
তবে প্রশ্ন হল, এই কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিলেই কি দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে? জামায়েত নিষিদ্ধ হলেই কি দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চিরতরে মুছে যাবে? না।

কিছুদিন আগে ইউটিউবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি টেলিফিল্ম দেখছিলাম। এটাকে টেলিফিল্ম না বলে ডকুমেন্টারি ফিল্মও বলা যায়। কারিগর নামে পরিচিত এক লোক তার গ্রামে মুসলিম ছেলেদের মুসলমানি করাতেন। ৭১এ গ্রামে গ্রামে যখন হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছিল, তখন কারিগর ও তার স্ত্রী মিলে একটি বুদ্ধি বের করলেন। তারা রাত জেগে সকল হিন্দুদের একটি মুসলিম নাম বানিয়ে লিস্ট করলেন। পাকিস্তানি মিলিটারি এলে কারিগর তাদেরকে লিস্টটি দিয়ে জানালেন এরা সবাই মুসলিম, তিনি নিজে এদের মুসলমানি করিয়েছেন। কথার সত্যতা যাচাই করতে মিলিটারিরা তাঁকে কোরান মাথায় নিয়ে একথা বলতে বলল। তিনি বললেন। ওই গ্রামের অনেক হিন্দুই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কোরান মাথায় নিয়ে মিথ্যে বলার কারণে তাঁকে এক ঘরে করা হয়। স্বাধীন দেশে বিচার বসিয়ে তাঁকে অপমানিত করা হয়। আসলে আমরা পাকিস্তান থেকে মুক্ত হলেও সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত হতে পারে নি।

৪৪ বছর ধরে যেই জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক বীজ বপন করা হয়েছে তা এত সহজে দমন হওয়ার নয়। মুক্তমনা, সংখ্যালঘুদের হত্যার পর সরকারের ভূমিকায় আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গুলশানের ঘটনার পর জঙ্গি দমনে সরকারের ভূমিকা কিছুটা আশা জাগিয়েছে। যদিও জানি যে আবার একজন মুক্তমনাকে হত্যা করা হলে নির্লজ্জ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিহতের লেখা খতিয়ে দেখার বিষয়কে গুরুত্ব দিবেন। হাসিনা জানাবেন, লেখার কারণে মেরে ফেললে তার সরকার এর দায় নিতে পারবে না। ঠিক এ কারণেই স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধীরা রাজনীতি করার সাহস পেয়েছিল। আমাদের সমস্যা হল, আমরা এক পা এগিয়ে গেলে আবার তিন পা পিছিয়ে যাই।

দেশ নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে চাই, স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। তাই যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকরে সরকারের সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করার পাশাপাশি সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের দাবী জানাই, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক, মুক্তমনা-সংখ্যালঘু হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হোক, ভিন্নমতের মানুষেরাও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার পাক।

মেয়েদের ফুটবল নাকি মেয়েরাই ফুটবল?

দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনা নারী ফুটবলারদের লোকাল বাসে কুরুচিকর মন্তব্যের মুখোমুখি হওয়া নিয়ে চারদিকে আলোচনা দেখে আমার ক্রিকেট খেলার সময়ে আমাকে এবং আমার খেলোয়াড় বান্ধবীদের কী ধরনের পরিবেশ মোকাবেলা করতে হতো সেসব মনে পড়ে গেল।

খেলাধূলা ব্যাপারগুলো মেয়েদের বিষয় না- সোজাসাপটা এটাই মনে করা হয় আমাদের সমাজে। মেয়েরা বড়জোর পুতুল খেলা, এক্কা দোক্কা এসব খেলতে পারে, তবে ক্রিকেট ফুটবল তো একদমই না! ওসব ছেলেদের খেলা। আমার ক্রিকেট ক্লাবে মেয়ের সংখ্যা ছিল ছেলেদের ১০ ভাগের এক ভাগ। অধিকাংশ মেয়েদের খেলার সরঞ্জাম ঠিকমত ছিল না। না, আর্থিক সমস্যার জন্য নয়। মেয়ের খেলার পেছনে টাকা খরচ করাটা বাবা-মায়েরা অপচয় মনে করে বলেই তাদেরকে ঠিকমত সরঞ্জাম কিনে দেয়া হত না। অনেকেই তাদের বড় ভাইদের খেলার সরঞ্জাম নিয়ে খেলত।

খেলাশেষে মেয়েরা খেলোয়াড়ের পোশাকে বাড়ি ফেরার সময় নানান অশ্লীল মন্তব্য ও অঙ্গভঙ্গির মুখোমুখি হতো। এ অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে কয়েকজন বোরকা পরে মাঠে আসতো এবং খেলার পর বোরখা চাপিয়ে বাড়ি ফিরত। বাংলাদেশে একজন নারী খেলোয়াড়ের কী ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়, সেসবই আমি নিজে দেখেছি বলে সেদিন নারী ফুটবলারদের সঙ্গে যা ঘটেছে তা আমাকে মোটেই অবাক করেনি। আমাদের দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত অধিকাংশের কাছেই ‘মেয়েদের খেলাধূলা’ শব্দটি একটি হাস্যরসাত্মক শব্দ। “মেয়েরা খেলবে? খেলতে হলে শক্তি লাগে, মেয়েদের খেলার শক্তি আছে নাকি, মেয়েদের শরীর তো নরম। খেলার জন্য শক্ত বডি লাগে। কাঠের বল একবার লাগলেই তো তারা চিত”। ২০৬টি হাড় ভাঙার মত ব্যাথা সহ্য করে, পেলেপুষে বড় করে মুখ ফুটার পর তাদের মুখে এ ধরনের মন্তব্য শুনলে ইচ্ছা করে অণ্ডকোষ বরাবর লাথি মেরে বুঝিয়ে দেই, নরম কী জিনিস আর চিত হওয়া কাকে বলে।

একদল ছোটবেলা থেকেই ব্যাটবল হাতে নিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা উপভোগ করে, আরেকদল শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে খেলতে আসে। তাহলে দুজনের খেলায় পার্থক্য তো থাকবেই। ক্রিকেটার সালমা খাতুনের একটি ইন্টারভিউ থেকে জেনেছি, তাদের প্র্যাকটিসের জন্য কোনও মাঠ পর্যন্ত বরাদ্দ নেই, ঠিকমত স্পন্সর পাওয়া যায় না। মেয়েদের কোনও খেলা টিভিতে দেখানো হয় না। ফেসবুকে পুরুষ ক্রিকেটারদের ছবির পোস্টে লাখ লাখ লাইক-কমেন্টের বন্যা। ‘মাশাল্লা ভাই, আপনি এভাবেই খেলে যান’ আর মেয়েদের খেলার কোনও ছবি পোস্ট করলে, ‘চেহারা তো কামের বেটির মত’ ‘**গুলা খুব সুন্দর’ ‘ওইগুলা এত বড় কেন?’। মেয়েরা কেমন খেলছে বা খেলায় উৎসাহ দেয়ার ধারে কাছেই কেউ যায় না! কারণ ‘মেয়েরা আবার কেমনে ক্রিকেট খেলবে?’

কিছুদিন আগে ঢাকায় মেয়েদের ম্যারাথন নিয়ে বিবিসির একটি রিপোর্টের কমেন্ট সেকশন দেখে বমির উদ্রেক হয়েছিল। মানুষের চিন্তাধারা এত নোংরা কীভাবে হয়? একজন সুস্থ মানুষ কীভাবে এমন মন্তব্য করতে পারে? প্রোফাইল ঘাঁটলে দেখা যাবে তাদের বেশিরভাগই শিক্ষিত, চাকরি জীবনে প্রতিষ্ঠিত, সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি। ভেবেছিলাম তাদের কমেন্টের স্ক্রিনশট নিয়ে যদি তাদের ওয়ালে পোস্ট করি তাহলে কেমন হবে? লজ্জা হবে নিশ্চয়ই? তারপর আবার ভাবলাম, লজ্জা হবে কীভাবে? আমাদের দেশের অধিকাংশ পুরুষেরা তো এমন চিন্তাধারাই লালন করে।

এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে। মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় রেজাল্ট ভালো করেছে। এইচএসসির ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করানো হয়। যেহেতু স্টুডেন্টের তুলনায় পাবলিক ভার্সিটির সংখ্যা নগন্য, তাই বেশির ভাগ ছাত্ররা দেশের প্রায় সব ভার্সিটিতেই পরীক্ষা দেয়। আমার বান্ধবীরা এবার এইচএসসি দিয়েছে। অনেকেই জানিয়েছে, নিজেদের শহরের বাইরে পরীক্ষা দেয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে তাদের। ভার্সিটি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ঢাকার ভালো কোনও কোচিংয়ে ভর্তি করানো হচ্ছে না। মেয়ে মানুষ, কোথায় থাকবে, কী করবে এসব নিয়ে বাবা মায়ের চিন্তা। ছেলেরা কিন্তু বন্ধুবান্ধব দলবল সমেত কিংবা একা মেসে থেকে কোচিং করছে, নিজেদের শহর থেকে অনেক দূরে এসে সেরা কোচিং সুবিধাটুকু নিচ্ছে। আমার এক বান্ধবী জানালো, সে নিজ শহরের বাইরে অন্য শহরেও পরীক্ষা দিবে। যেখানে চান্স পাবে, সেখানেই পড়বে। তারা বাবা-মায়ের এতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তি সমাজের মানুষের। আত্মীয়-প্রতিবেশিরা তার বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, মেয়েকে দূরে একা ছেড়ে পড়ানো উচিত না। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা সমস্যাটাই আমার কাছে প্রধান মনে হয়েছে। আবার অনেক বাবা মায়েরা পড়ালেখা চলাকালীন অথবা অনার্সটা পাশ হলেই ভালো পাত্র পেয়ে গেলে বিয়ে দেয়ার প্ল্যান করেন। তাই মেয়েদের ভালো ভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাপারে আগ্রহী নন। এভাবে এইচএসসিতে দারুণ রেজাল্ট করা অনেক মেয়েরই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ছেলেরা যখন ক্যারিয়ার শুরু করে, ঠিক সেসময়েই একটি মেয়ের ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে বিয়ের মাধ্যমে।

চমক হাসানের ফেসবুক পেজে একটি পরিসংখ্যান পেলাম। সেটি অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭৪ লাখ। এদের মধ্যে নারী ২১%, পুরুষ ৭৯%। নারীর সংখ্যা এত কম শুনে অনেকেই রিপোর্টিকে নকল মনে করতে পারেন। রিপোর্টটির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর সংখ্যা যে ২১-২৫ শতাংশের বেশি নয়, এই তথ্যে কোনও ভুল নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীরা নানাভাবে হেনস্থার শিকার হয়। নকল ছবি, নকল আইডি বানিয়ে অনেক নারীদের বিব্রত করা হয়। আর নারীদের ইনবক্সে যা খুশি তাই লেখার স্বাধীনতা যেন সব পুরুষের মৌলিক অধিকার। এসব কারণে নারীদেশ একটি বড় অংশ ফেসবুক থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পছন্দ করেন। বাইরের জগতে নারীকে ধর্ষণ, তথাকথিত সম্ভ্রমহানির(?) ভয় দেখিয়ে বাইরের স্বাধীন পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভার্চুয়াল জগতে সাইবার ক্রাইম করে নারীদের প্রযুক্তির সুবিধা লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয়।

জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী ঠিক কী কারণে একমাত্র সংসদের স্পিকার আসনে বসলেই ঘোমটা দেন তার কারণ আমার এখনও জানা হল না। তাকে সংসদ ছাড়া অন্য কোনও জায়গায় ঘোমটা দিতে দেখা যায় না। তবে সংসদে মাথা ঢাকাটা জরুরি কেন? যখন বর্তমান রাষ্ট্রপতি সংসদের স্পিকার ছিলেন, তখন তো তাঁকে মাথায় টুপি দিয়ে বসতে দেখি নি। আর বিরোধী দলীয় নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী তো জনসমক্ষে কখনো ঘোমটা ছাড়া আসেনই না। কাজেই প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার সব নারী হওয়ায় নারীর ক্ষমতায়ন হয়ে গেছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কোনও সুযোগ নেই।

সমস্যা যেমন আছে, সমাধানও আছে। সমস্যা নিয়ে লিখছি কিন্তু সমাধান নিয়ে লিখছি না কেন? কারণ সমস্যাগুলো এতছর ধরে চলতে চলতে এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, সমস্যাগুলোকে মানুষ নিয়ম মনে করে। তাই সমস্যাগুলো নিয়ে বেশি লিখি, মানুষকে জানাতে যে এগুলো নিয়ম নয়, ‘সমস্যা’। সমস্যাকে সমস্যা মনে করলে সমাধান দ্রুত ঘটবে বলেই মনে করি।

সোমবার, ১৩ জুন, ২০১৬

ট্যাবুঃ সমকামিতা, পিরিয়ড!

১. আমেরিকার ফ্লোরিডায় সমকামীদের ক্লাবে মুসলমান জঙ্গির বন্দুক হামলায় নিহত ৫০, আহত ৫৩। ফ্রান্সে বোমা হামলা, বেলজিয়ামে হামলা, বাংলাদেশে প্রতিদিন সংখ্যালঘু-নাস্তিক-প্রগতিশীলদের হত্যা। প্রতিদিন এত এত মানুষের মৃত্যুর খবর, অসহনীয় হয়ে উঠছে দিন দিন। ধর্ম নামক একটি রূপকথা প্রতিষ্ঠা করতে এই হত্যাযজ্ঞ! ভাবা যায় না, একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ এসব রূপকথায় বিশ্বাস করে সহিংসতা করে বেড়াচ্ছে। অনেকে হয়তো বলবেন, এর পেছনে ধর্ম নয়, আছে রাজনীতি। আমেরিকা আলকায়দা-আইএস সৃষ্টি করেছে নিজেদের স্বার্থে, ধর্মের কোন দোষ নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি ভারতের সৃষ্টি ছিল? বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শুরু করার পরই ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। ঠিক একই ভাবে সব দোষ রাজনীতির উপর দিয়ে ধর্মকে মহান কিছু বানানোর উপায় নেই। সমকামীদের ক্লাবে হামলার প্রসঙ্গে যারা বলছে, ইসলামে হত্যার কথা বলা নেই। তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন সমকামীতার শাস্তি ইসলামে কী আছে। তাহলেই বুঝে যাবেন। প্রকৃতিতে ৪৫০ থেকে মতান্তরে ৪৮০ প্রজাতির মধ্যে সমকামীতা পরিলক্ষিত হয়। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী আলফ্রেড কিন্সের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি দশ জন ব্যক্তির একজন সমকামী। সমকামীতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ কিছু নয়। এটিকে জটিলভাবে দেখে ধর্মের নিয়ম মেনে তাদেরকে আপনি হত্যা করছেন। পশুপাখিদের সমাজে ধর্ম নামক রূপকথাটির অস্তিত্ব নেই বলে, ধর্মের বর্বর নিয়ম মেনে তাদের কাউকে হত্যা করার প্রয়োজন হয় না। এদিক থেকে পশুপাখিরা আমাদের চেয়ে অনেকটাই সভ্য বলা যায়।

২. নাস্তিকদের ভিন্নমতের কারণে তাদেরকে খুন করাকে প্রশ্রয় দিয়েছি। এখন তাদের হত্যার লিস্ট আর নাস্তিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভিন্ন মতের জন্য যদি হত্যা করাকে আপনি প্রশ্রয় দেন, তাহলে একদিন হত্যাকারীরা আপনাকেও হত্যা করতে আসবে, কারণ হত্যাকারীদের সব মতের সাথে আপনিও একমত নন, একমত হওয়া সম্ভব না। একসময় দেখা যাবে হত্যাকারীরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করছে, কারণ তাদের মধ্যেও মতের পার্থক্য দেখা যাবে। আমাদের সকলেরই বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের আলাদা মত রয়েছে। নাস্তিকদের মধ্যেও নানা বিষয়ে একেক জনের একেক মত, এ নিয়ে প্রতিনিয়ত অনলাইনে যুক্তি তর্ক হচ্ছে। আমি নিজের কথা বলতে পারি, আমি অনলাইনে এসে অনেক কিছু জেনেছি-শিখেছি এই যৌক্তিক তর্কে অংশ নিয়ে। দেশের চলমান অবস্থায়, প্রত্যেকেই আতংকিত। নাস্তিক হত্যার সময় আপনার নীরব সমর্থনই আপনাকে আজকের এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আমরা আসলে একটা স্বার্থপর জাতি। যতদিন নিজের ঘাড়ে কোপ না আসে, ততদিন বুঝি না কোপের যন্ত্রণা।

৩. ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুললেই মন্তব্য আসে, ‘সকল মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত’। আমি স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করব, আপনিও আপনার মত প্রকাশ করবেন। আপনার মত আমার কাছে যত জঘন্যই মনে হোক না কেন, আপনার মত প্রকাশে আমি বাধা হয়ে দাঁড়াব না, এটিই হলো বাকস্বাধীনতা, এখানেই আপনার মতের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিহিত। অথচ আমরা মনে করি, আপনার মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে, আমার মত প্রকাশ করলে আপনার অনুভূতিতে আঘাত লাগবে এজন্য এখন আমাকে চুপ থেকে আপনার মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে!
ধার্মিকেরা অন্য ধর্মের নিন্দা শুনতে পছন্দ করে, নিজের ধর্ম নিয়ে কিছু বললেই অনুভূতিতে আঘাত লাগে। হিন্দুরা অনেকে বলে থাকেন, হিন্দু ধর্মে পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। কারও কিছু মানতেই হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এই ধর্মে এমন কোন কথা বলা নেই যা সরাসরি ঈশ্বর বলেছেন, এই ধর্মের সব গ্রন্থই মুনিঋষিরা নিজেদের অর্জিত জ্ঞান থেকে লিখেছেন, যা সবাইকে মানতে হবে এমন কোন কথা নেই। এখন প্রশ্ন হল, যেহেতু তাদের নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম বা বাধ্যবাধকতা নেই, কাজেই তারা তো নিজেদের মত নিজেরা স্বাধীন থাকতে পারে, 'সনাতন ধর্ম’কে ব্যানার করে আলাদা একটা গোষ্ঠী বানানোর কী প্রয়োজন?
আমরা অনেক সময় বলি, ‘লোকটা খুব ভালো’ প্রমাণ হিসেবে বলি, ‘৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন’ নামাজ রোজা করার সাথে কারোর ভালো হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। ধর্মের সাথে নৈতিকতার কোন সম্পর্ক নেই। নামাজ রোজা কাদের মোল্লা, কামারুজ্জমান সহ সকল যুদ্ধাপরাধীরাও করতো। নামাজ-রোজা জঙ্গিরাও করে। বরং সাধারণের চেয়ে একটু বেশিই করে। আমি বরং ধার্মিক ব্যক্তির কথা শুনলে সাবধান হই। কারণ তার নিশ্চিয়ই ধর্মানুভূতি নামক একটা তীব্র অনুভূতি আছে, যেটা কথায়-কথায় আহত হয়, আর এই অনুভূতি আহত হলে সে আমাকে খুন পর্যন্ত করতে পারে।
গতকাল পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ইফতারের আগে খাদ্যগ্রহণ করায় এক অশীতিপর বৃদ্ধ হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে পাকিস্তানের এক পুলিশ কনস্টেবল ও তার ভাই বেধড়ক পিটিয়েছে। এই ঘটনায় কনস্টেবল পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তার ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ঘটনা যদি বাংলাদেশে ঘটতো, তবে কাউকে গ্রেফতারের প্রশ্নই আসে না। উল্টো নির্ধারিত সময়ের আগে রোজাদারদের সামনে বিরিয়ানী খেয়ে ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো।

৪. রোজার মাসে আরেকটা কমন প্রশ্ন, আপনি কি রোজা? মেয়েদেরকে সাধারণত এই ধরণের প্রশ্ন করা হয়। ‘না’ উত্তর শুনে ‘না’ এর কারণটা কল্পনা করে অনেকে সুখ পায়। কী নোংরা আমাদের মানসিকতা! পিরিয়ডের মত স্বাভাবিক একটি বিষয়কে ট্যাবু বানিয়ে রেখেছি।
আমাদের কলেজে স্টুডেন্টদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা ছিল। এক বান্ধবীর পিরিয়ড হলে আমরা মেডিকেলে গেলাম প্যাড আনতে। মেডিকেল রুমে ডাক্তারের সামনে বসে ছিল আমাদেরই একজন ছেলে সহপাঠী।তার মাথা ব্যথা জাতীয় কোন সমস্যা। নার্সকে জানালাম প্যাড লাগবে। উনি আমাদেরকে চুপ থাকতে বললেন। ওই ছেলে চলে যাওয়ার পরই নার্স প্যাড দিলেন। ওই ছেলের সামনে প্যাড হাতে নিতে তিনি লজ্জা পাচ্ছিলেন।
প্রতি মাসে মেয়েদের শরীরে একাধিক ডিম্বাণু বড় হতে থাকে এবং মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি পরিণত অবস্থায় স্ফুরিত হয়। ডিম্বাশয় থেকে বের হয়ে আসা ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হলে ভ্রূণ তৈরি হয়, আর তা না হলে ডিম্বাণু ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে মিলিয়ে যায়। আবার নতুন ডিম্বাণু বড় হতে থাকে। ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণুটি বের হওয়ার সময় কিছুটা তরল পদার্থ বের হয়ে আসে, সেটিই পিরিয়ড। আর এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা নিয়ে যারা মুচকি হাসতে পছন্দ করে, আপনি বরং তাদের অজ্ঞতা নিয়ে হাসতে পারেন। রোজা রেখেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলে অনেকে বিব্রত হয়ে যান। সবচেয়ে ভালো হয় ধর্মমুক্ত হয়ে এসব ট্যাবুর বিরুদ্ধে যাওয়া, কারণ এসব ট্যাবু ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের সৃষ্টি। যদি তা না পারেন অন্তত স্পষ্ট কন্ঠে জানান, আপনার পিরিয়ড চলছে। পিরিয়ড চলাকালে অনেকে পরিবারের সাথে সেহেরী খেতে উঠে। সারাদিন কিছু খায় না। কারণ পরিবারের বাবা-ভাইয়েরা যদি বুঝতে পারে যে, সে আসলে রোজা রাখে নি, তার পিরিয়ড চলছে। তবে এটা খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। লজ্জা ভাঙ্গুন। পিরিয়ড নিয়ে লুকোচুরি খেলা বন্ধ করুন।

বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১৬

পুরুষানুভূতি ও তসলিমার নির্বাসনের ইতিকথা

'তসলিমা নাসরিন’ নামটির পাশে বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিকেরা ‘বিতর্কিত লেখিকা’ শব্দটি লিখে খুব আনন্দ পায়। তসলিমা নাসরিনের একটি বইও যে পড়ে নি, তাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তসলিমা নাসরিন’কে সে চিনে কিনা, সে হয়তো বলবে, ‘ওই যে ইসলাম বিদ্বেষী বিতর্কিত লেখিকার কথা বলছেন?’ তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়ে আমার কখনো মনে হয় নি তিনি বিতর্কিত কিছু লিখেছেন। আমার কাছে তাঁর আদর্শ, চিন্তা -চেতনা একেবারেই স্পষ্ট ও সঠিক মনে হয়েছে। অবশ্য যারা নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী নন, যারা নারীকে কেবল মা-বোন-বধূ রূপেই দেখতে পছন্দ করেন তাদের কাছে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়গুলো বেশ বিতর্কিতই মনে হবে। তবে আশার কথা, ইদানীং বেশকিছু পত্রিকা বিতর্কিত শব্দটির জায়গায় ‘জনপ্রিয় লেখিকা’ শব্দটি ব্যবহার করছে।

‘তসলিমা নাসরিন’ নামটির সাথে আমার পরিচয়, যখন আমি ক্লাস৫ এ পড়ি। ‘লজ্জা’ পড়েছিলাম তখন। তখন ‘হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা’ ব্যাপারটা আসলে কী, এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা না থাকলেও জীবনের আটটি বছর গ্রামে কাটানোর কারণে গ্রামে হিন্দু পাড়ার প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি ভঙ্গি কেমন হয়, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা ছিল।

১৯৯৩ সালে সরকারী এক তথ্যবিবরনীর মাধ্যমে তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। সেই তথ্য বিবরণী অনুযায়ী, জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অঙ্গনে বিঘ্ন ঘটানো এবং রাষ্ট্র বিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্যপ্রকাশিত হওয়ার জন্য ‘লজ্জা’ নামক বইটির সকল সংস্করণ সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদীদের আন্দোলনের কাছে মাথা নত করা সরকার, মৌলবাদীদের খুশি করতে বইটিকে বাজেয়াপ্ত করে।

‘লজ্জা’ বইটি ছিল মূলত তথ্য ভিত্তিক বই। ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর মুসলমানদের বর্বরতার ঘটনাগুলোই লেখক তাঁর লেখায় চিত্রিত করেছিলেন। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও পরবর্তীতে ৩০টিরও বেশি ভাষায় বইটি অনূদিত হয়।

আরও একটু বড় হয়ে পড়েছিলাম ‘নিমন্ত্রণ’ নামের বইটি। ‘নিমন্ত্রণ’ বইটির প্রথম অংশে দুজন মানুষের প্রেমের কথা থাকলেও, এই গল্পের শেষটি ছিল খুবই বাস্তব এবং নির্মম। শেষ অংশটিতে ছিল, প্রেমিকা কীভাবে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রেমিক ও প্রেমিকের বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল সেই কথা। এই সেদিনও খবরে দেখলাম, ঢাকায় প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রেমিক ও তার বন্ধুদের দ্বারা প্রেমিকা ধর্ষিত হয়েছে। এসব ঘটনা অহরহ ঘটছে।

গল্পে প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম থাকবে, প্রেমিকাকে হিরো প্রেমিক সব বিপদ থেকে রক্ষা করছে, এধরণের কাহিনীর লেখকরাই সমাজে হাত তালি পাবেন। কিন্তু সমাজের বাস্তব চিত্র যেই লেখকের লেখায় উঠে আসবে, তিনি হবেন নিষিদ্ধ। কারণ আমাদের নিজেদের বাস্তব রূপটা যে এতটাই কুৎসিত, সেটা আমরা নিজেরাই মেনে নিতে পারি না।
এরপর পড়ি, ‘অপরপক্ষ’। নারীকে মায়ের জাত বলে, মাতৃত্বের জন্য নারীকে মহান করে দেখানো হয়। অথচ, পিতার পরিচয় ছাড়া সন্তানের কোন পরিচয় নেই, সে নাকি হয় ‘জারজ সন্তান’। সমাজের এই ভণ্ডামীটা ‘অপরপক্ষ’ নামক উপন্যাসে অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

কবিতা আমার ভালো লাগে না, বেশির ভাগ কবিতার বইগুলোতে কেবল প্রেম আর প্রেম। বাস্তবে তো নারীর প্রতি পুরুষের প্রেম কোথাও দেখি না। দেখি নারীর শরীরটির প্রতি পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি। ‘নির্বাচিত নারী’ নামক কবিতার বইটিতে বাস্তবভিত্তিক অসাধারণ কিছু কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’ বইটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, ‘নিজেকে এই সমাজের চোখে নষ্ট বলতে আমি ভালোবাসি। কারণ এ-কথা সত্য যে, যদি কোনও নারী নিজের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করতে চায়, যদি কোনও নারী কোনও ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের নোংরা নিয়মের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়, তাঁকে অবদমনের সকল পদ্ধতির প্রতিবাদ করে, যদি কোনও নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়, তবে তাকে নষ্ট বলে সমাজের ভদ্রলোকেরা। নারীর শুদ্ধ হবার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া। নষ্ট না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই। সেই নারী সত্যিকার সুস্থ ও শুদ্ধ মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে’। ঠিকই তো, প্রতিবাদী কোন নারীকে দমিয়ে দিতে প্রথম যেই শব্দগুলো তার দিকে ছুড়ে দেয়া সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘নষ্ট মেয়ে’।

‘যাবো না কেন? যাবো’ বইটির নামের মধ্যেই রয়েছে একপ্রচন্ড সাহসীকতা। ‘নির্বাচিত কলাম’ বইটি মূলত লেখকের নব্বইয়ের দশকের পুরুষতন্ত্র ও ধর্মের ভন্ডামী নিয়ে লেখা অসাধারণ কলামগুলো নিয়ে সাজানো হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে, লেখক হিসেবে তসলিমা নাসরিন ছিলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ৭১এর পর বাংলাদেশে নাস্তিকতা ও নারীবাদের হাতে খড়ি হয়েছে তসলিমা নাসরিনের মাধ্যমে। সেসময় তিনি একাই তার ‘অস্ত্র’ (কলম) তুলে ধরেছিলেন, ধর্মের বিরুদ্ধে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে। অন্য কোন লেখককে তখন এধরণের বিপদজনক লেখা লিখতে দেখা যায় নি। পরে অবশ্য তসলিমা নাসরিনের জনপ্রিয়তাকে হিংসে করে অনেকেই নারীবাদী বই লেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিজে নারী হয়ে, নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা, নারীর দুঃখ কষ্টগুলো অনুভব করে লেখা, আর জনপ্রিয়তা লাভের জন্য, নিজের চরিত্রে চরম পুরুষতান্ত্রিকতা রেখে নারীবাদ লেখা তো আর এক হয় না।

‘ছোট ছোট দুঃখ কথা’, ‘দুঃখবতী মেয়ে’, ‘নারীর কোনও দেশ নেই’, ‘নিষিদ্ধ’, ‘শোধ’, ‘বন্দিনী’ বইগুলো পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাঁর বইগুলো আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। সমাজের নিয়মনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের অধিকারের পক্ষে লড়াই করার সাহসটুকু আমি সেখান থেকেই পেয়েছি।

তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর ৭টি খন্ড পড়লেই বোঝা যায়, লেখক হিসেবে তিনি কতটা সৎ। যদিও ৭টি খণ্ডের মধ্যে ৪টিই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। আত্মজীবনীতে নিজের ভুল ত্রুটি গুলো লিখতে কুন্ঠাবোধ করেন নি। পরবর্তীতে সেসব ভুলগুলো সাহসের সাথে মোকাবেলা করার কথাও তিনি লিখেছেন। ‘উতল হাওয়া’ বইটিতে রুদ্রের সাথে প্রেমের ঘটনা পড়ে আমরা সবাই বলেছি, ‘আহা কী প্রেম!’ রুদ্রের নষ্টামিগুলো পড়ে অনেকে বলেছে, ‘নিজের বাসর ঘরের কাহিনী কেউ এভাবে রাখঢাক না রেখে বর্ণনা করে! ছি কী অশ্লীল!’ অথচ কারও চোখে পরে নি, বাসর ঘরে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে আসা মেয়েটির স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট। ‘ক’ বইটি আমার কাছে মনে হয়েছে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ট একটি বই। এই বইয়ে অন্য বইগুলোর মত নারীর জীবনের কান্না-দুঃখ-কষ্টগুলোর চেয়েও বেশি ফুটে উঠেছে বাধা উপড়ে সামনে এগিয়ে চলার সাহসীকতা। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, ‘মেয়েবেলা’, ‘উতল হাওয়া’ বইগুলো পড়ে যারা হাততালি দিয়েছেন, তাদের অনেকেই আবার এই বইটির বিরুদ্ধে গেছেন। নারী কেবল পুরুষতান্ত্রিক শেকলে বন্দী হয়ে যন্ত্রণায় কাঁদবে, প্রেমিককে সমস্ত প্রেম উজাড় করে দিয়ে প্রতারিত হয়ে হতাশায় ডুবে থাকবে এসব দেখতে আমাদের সমাজ অভ্যস্ত হলেও নারী মেরুদণ্ড সোজা করে উঠে দাঁড়িয়েছে, সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, এটাতে অভ্যস্ত নয় আমাদের সমাজ। তাই সমাজের প্রগতিশীল পুরুষেরা এই বইয়ের বিরুদ্ধে গেছে। সবচেয়ে অবাক হয়েছি বাংলাদেশে প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে পরিচিত হুমায়ুন আজাদের বক্তব্যটি পড়ে। তিনি বলেছেন, ‘সম্প্রতি প্রকাশিত 'ক' বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটি একটি পতিতার নগ্ন আত্মকহন অথবা একজন নিকৃষ্টতম জীবনের কূরুচিপূর্ন বর্ণনা’। তাঁর এই বক্তব্যতেই বুঝতে পেরেছি, তিনি নারীবিরোধী প্রথাগুলো খুব যত্নে নিজের মধ্যে লালন করতেন।

‘ক’ বইটি নিয়ে বাংলাদেশের আরও কয়েজন বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য পড়ে তাদের নোংরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় পেয়েছি।

ইমদাদুল হক মিলন, সাহিত্যিক
ও নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। তার বই আমি পড়িনি। দু একজনের কাছে শুনেছি কী লিখেছে। কিন্তু যাই লিখুক, আমি তাতে ইন্টারেস্ট ফিল করছি না। বাদ দিন ওসব।
মানবজমিন, ১ নভেম্বর, ২০০৩

সৈয়দ শামসুল হক, সাহিত্যিক
তসলিমা আমার চরিত্র হনন করেছে। মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ৫২ বছরে লেখক হিসেবে আমি যে সম্মান কুড়িয়েছিলাম তা আজ ধুলিস্যাৎ। নিশ্চয়ই এর পিছনে কিছু রহস্য আছে। না হলে তিনি দেশের এত সম্মানিত লেখক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে লিখতে সাহস পেতেন না। আমার মনে হয়েছে, প্রতিবাদ করা দরকার। তাই মামলা ঠুকে প্রতিবাদ জানালাম।
সংবাদ প্রতিদিন, ১০ নভেম্বর, ২০০৩

আসাদ চৌধুরী, সাহিত্যিক
‘ক’ বইটি আমি পড়িনি। তবে যার বিরুদ্ধে লেখা হোক না কেন, লেখকের ওপর পাঠকের কতটুকু আস্থা আছে তা অবশ্য মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ ব্যক্তি সমাজ বিশাল জনগোষ্ঠি নিয়েই সাহিত্য, কোনও লাম্পট্যের নির্লজ্জ বর্ণনা কখনও সাহিত্য হতে পারে না।
আজকের কাগজ, ১১ নভেম্বর, ২০০৩

তসলিমা নাসরিনের কোনও বই ঢাকার কয়েকটি মার্কেট ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না। আমি তসলিমা নাসরিনের যেসকল বই পড়েছি, তার বেশিরভাগই বুক শেল্ফের পুরাতন বইয়ের তাকে ছিল। বাকিগুলো ঢাকা থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়েছি। দেশের কোনও দোকানে গিয়ে তসলিমা নাসরিনের বই চাইলে, আপনাকে প্রথমেই দোকানী জানিয়ে দেবে, ওই লেখকের বই তারা বিক্রি করে না। ফ্রিতে একটি উপদেশও দিয়ে দিতে পারে, ওই নাম যেন আপনি মুখে এনে আপনার মুখকে অপবিত্র না করেন। বাংলাদেশে ‘তসলিমা নাসরিন’ নামটি একটি নিষিদ্ধ নাম। নব্বইয়ের দশকে যিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তিনিই কিনা এখন দেশে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ! আপনার কী ধারণা এর পিছনে দায়ী মৌলবাদীরা? মোটেই না। এজন্য দায়ী, ভোটের রাজনীতি আর সুবিধালোভী হীনচরিত্রের মানুষগুলো। মৌলবাদীদের কোনও ক্ষমতা ছিল না তসলিমা নাসরিনকে দেশ থেকে বের করার। তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছিল মৌলবাদ তোষণকারী সরকার।

তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী চতুর্থ খণ্ডটি মূলত ১৯৯৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো নিয়ে।

তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার(বিএনপি) ধর্মানূভুতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ তুলে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি কোরান সংশোধনের কথা বলেছেন। অথচ তিনি শরিয়া নামক বর্বর আইনটি বাতিলের কথা বলেছিলেন, কোরান সংশোধনের কথা নয়। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হলে তিনি আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। এ নিয়ে দৈনিক ভোরের কাগজে ক'জন বিশিষ্ট নাগরিকের মন্তব্য-

হুমায়ুন আজাদ, কবি, অধ্যাপক
নাসরিন নামের একটি তুচ্ছ বস্তুকে বাংলাদেশের অপদার্থ সরকার, আনন্দবাজার আর হিন্দু মুসলমান মৌলবাদীরা আন্তর্জাতিক বস্তুতে পরিণত করেছে। এটা এখনকার সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার।...এই সময়ের একটি বেশ হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, নাসরিনের মত একটি তুচ্ছ বস্তুকে নিয়ে সারা পৃথিবীর মেতে ওঠা। পশ্চিম ইওরোপ তার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে।

আমহদ ছফা, লেখক
তসলিমা নাসরিন ভারতের সৃষ্টি।...তসলিমা এবং তাকে যারা সমর্থন করে তারা মৌলবাদকে এমনভাবে উস্কে দিয়েছে, স্বাধীন চিন্তাভাবনার লোক মস্ত বিপদে পড়ে গেছেন।...তসলিমা এবং তার সমর্থকদের অবিবেচনার কারণে দেশের সমস্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি একটি সঙ্কটের সম্মুখে পড়েছে।...একটি অমঙ্গলের শক্তি।

ফরিদা রহমান, সাংসদ, বিএনপি
ঐসব আজেবাজে লেখা ছেড়ে দিয়ে তসলিমার মাফ চাওয়া উচিত। তারপর সাধারণ জীবনযাপন করা উচিত।... জনগণ যদি ক্ষমা করে তারপর আমরা সাধারণ মহিলারা যেভাবে জীবনযাপন করি সেভাবে তার জীবনযাপন করতে হবে।

সুত্রঃ সেই সব অন্ধকার, তসলিমা নাসরিন।

সেই সময় মৌলবাদীদের তোষণ না করে যদি প্রকাশ্যে তসলিমা নাসরিনের মাথার মূল্য নির্ধারণকারী ধর্মীয় গুরুকে শাস্তির আওতায় আনা হতো, সুবিধাবাদী লেখক প্রগতিশীলেরা যদি সেসময় হিংসের বশবর্তী না হয়ে, সবাই এক হয়ে সেসব মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন, সরকারের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন তবে হয়তো আজকের এই দিন আমাদের দেখতে হতো না। এই প্রগতিশীল লোকেদের অনেকেই পরবর্তীতে মৌলবাদীদের প্রশয় দেয়ার ফল ভোগ করেছেন এবং করছেন। সেই ১৯৯৪ সাল থেকেই তো মৌলবাদীরা প্রশ্রয় পেতে পেতে আজকের এই রূপ নিয়েছে। এজন্য মৌলবাদীরা নয়, বরং দায়ী সুবিধাবাদীরা- এ নিয়ে কারও সন্দেহ আছে কী?

বর্তমানে ব্লগার-লেখক-প্রকাশক ইত্যাদি প্রগতিশীল মানুষদের হত্যার বিরুদ্ধে দেশের বুদ্ধিজীবিদের তেমন কোন প্রতিবাদ লক্ষ্য করা না গেলেও, লক্ষ মাইল দূরে বসে যিনি একটি আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন, তিনি ঠিকই তাঁর কলমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, সরকারের ভূমিকার বিরুদ্ধে।

অথচ এখনও প্রতিনিয়ত আমরা ‘তসলিমা নাসরিন’ নামটিকে অত্যন্ত সচেতন ভাবে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা, বাক স্বাধীনতার কথা বলি। যিনি বাংলাদেশে নাস্তিকতা ও নারীবাদের সূচনা করেন, যিনি ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লেখার কারণে আজ ২১ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে নিষিদ্ধ হয়ে আছেন, তাঁকে বাদ দিয়ে মুক্তচিন্তা করাটা আদৌ ফলপ্রসু হয়েছে বা হচ্ছে? যে মুক্তচিন্তা পুরুষতান্ত্রিকতা মুক্ত নয়, সে চিন্তাকে আমি মুক্তচিন্তা বলতে পারি না। এটা এক ধরনের ভন্ডামীর নামান্তর।তারা প্রকৃতপক্ষ ধর্মের কুসংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেও, নারীবিরোধী সংস্কারগুলো থেকে মুক্ত হতে পারেননি।

বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের তসলিমা বিষয়ে এমন নীরবতা আমাকে অবাক ও ক্ষুব্ধ করেছে। তাই ২০১৪ সালে, আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে ‘তসলিমা পক্ষ’ নামের একটি ফেসবুক পেজ খুলি। তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মিথ্যা অপপ্রচারগুলো সম্পর্কে মানুষকে জানানো, তসলিমা নাসরিনের লেখাগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াই এই পেজের উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে আমরা তসলিমা নাসরিনের জন্মদিনে, ‘তসলিমা দিবস’ উদযাপন করি। এছাড়াও তসলিমা পক্ষের আয়োজনে মুক্তচিন্তার পক্ষের মানুষদের নিয়ে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রোগ্রাম হয় শাহবাগে। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে, অফলাইন প্রোগ্রামের ঘোষণা না দিয়ে অনলাইনেই তসলিমা নাসরিনের লেখা গুলো নিয়ে ছোট ছোট অনলাইন পোষ্টার বানিয়ে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ধর্মান্ধ সমাজ নারীকে নানা ভাবে দমন করে এসেছে। নারীর কথাগুলো যাতে উচ্চারিত না হয় সে জন্যই উপামহাদেশের শ্রেষ্ঠ নারীবাদী লেখককে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিষিদ্ধ করেছে। তসলিমা নাসরিনকে তাঁর নিজ ভূমি নির্বাসন দণ্ড দিলেও সভ্য দেশগুলো তাঁকে নানা ভাবে সম্মানিত করেছে। তসলিমা’কে নিষিদ্ধ করাতে তসলিমার খুব বেশি ক্ষতি না হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। তসলিমা নাসরিনের নির্বাসন কেবল একজন মানুষ তসলিমার নির্বাসন নয়, এটি মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা আর মানবাধিকারের নির্বাসন।

যেসব কথা বলা নিষেধ, সেসব কথাই তিনি জোর গলায় বলেছেন। যে শব্দ উচ্চারন করা মানা ছিল, সে শব্দই তিনি বারবার উচ্চারন করেছেন। আজ আমরা সেসব শব্দের-ভাষার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। তসলিমা নাসরিন এদেশের নারীদের কথা বলা শিখিয়েছেন, বাধা উপড়ে এগিয়ে চলতে শিখিয়েছেন। আজ আমরা কথা বলতে পারি, প্রতিবাদ করতে পারি। আমরা ভুলি নি তসলিমা নাসরিনকে। নিষিদ্ধ নামটিই আমরা গর্বের সাথে উচ্চারন করি। কারন এই নিষিদ্ধ নামেই আমরা আমাদের শক্তি খুঁজে পাই, প্রতিবাদ করার সাহস পাই।

বুধবার, ১ জুন, ২০১৬

ওরা দোষী নয়, ভুক্তভোগী


কয়েকদিন আগে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের জিপিএ৫ প্রাপ্ত ছাত্রদের নিয়ে বানানো প্রতিবেদনটি সকলেই দেখেছেন। ভিডিওটি দেখে আসলেই খুব দুঃখ পেয়েছি। সাধারণ কিছু বিষয় আমরা পারি না! ক্ষোভে-দুঃখে একটি স্ট্যাটাসও দিয়েছিলাম স্টুডেন্টদের বিরুদ্ধে, পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি এটি করা আমার মোটেই উচিত হয়নি। নিজেও এসএসসি পাশ করেছি কিছু বছর আগে। তাই ওইসব ছাত্রদের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া ঘৃণা আর অপমান আমার গায়েও এসে লেগেছে। অনেক সময় সাধারণ কিছু প্রশ্ন মানুষ নার্ভাস হয়ে ভুল করে ফেলে। এরকম কিছু ঘটনা আমাদের প্রায় সবার জীবনেই ঘটে থাকে। এ নিয়ে আমরা পরে মনে মনে হাসি। কিন্তু এসকল ছাত্রদের তো নিজেদের ভুলের কথা মনে করে নিজের মনে হাসার কোন উপায় নেই, সমগ্র দেশ তাদের নিয়ে হাসছে। এই অপমান সহ্য করতে না পারে তাদের কেউ যদি আত্মহত্যা করে এর দায় কি আমরা নিব?

পীথাগোরাসের উপপাদ্য আমরা পড়েছিলাম ক্লাস এইটে। আমাদের অংক বইয়ে উপপাদ্য ২৪ ছিল সম্ভবত পীথাগোরাসের উপপাদ্য। সেটা উপপাদ্য২৪ হিসেবেই লেখা ছিল। অংক বইয়ের কোথাও পীথাগোরাস কে, এ সম্পর্কে কোন তথ্য ছিল না। সেক্ষেত্রে কোন ছাত্র যদি জানতে না পারে যে সে, যেই উপপাদ্য২৪ লিখে পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছে, সেটা আসলে পীথাগোরাসের সৃষ্টি তবে তাকে কিন্তু দোষ দেয়া যায় না। যেই সাংবাদিক পীথাগোরাস কে সেটা জিজ্ঞেস করেছেন, সেই সাংবাদিককে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, পীথাগোরাসের পুরো নাম কী? আমি নিশ্চিত তিনি উত্তর দিতে পারবেন না।

হুট করে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস গুলিয়ে ফেলবেন অনেকেই। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম না জানাটা কোন অপরাধ না। রাষ্ট্রপতিকে বছরে কয়বার খবরের পাতায় পাওয়া যায়? আপনারাই ভাবুন। বর্তমান বাংলাদেশের বিরোধী দল কোনটি জানতে চাইলে ৮০ ভাগ মানুষ বলবে, বিএনপি। অথচ বর্তমান বিরোধী দল হল, জাতীয় পার্টি। বিরোধী দলের নেতার নামটি কয়জন পারবে এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, বাংলাদেশে রওশন এরশাদকে কয়জন চেনে?

হুমায়ুন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ নাটকটিতে দাদু ক্যারেক্টারটি তার নাতনী টাইপের একজনকে কোন একটা প্রশ্ন করে, নাতনী সেটার উত্তর দিতে পারে নি। এ নিয়ে দাদু সম্ভবত নাতনীকে ‘কিছুই পারিস না’ জাতীয় কিছু কথাবার্তা বলছিলেন। এরপর নাতনী দাদুকে একটা প্রশ্ন করে, দাদু সেটার উত্তর দিতে পারে নি। তখন নাতনী দাদুকে বলে, আমি যেমন অনেককিছু জানি না, তুমিও তেমন অনেক কিছুই জানো না। মুস্তাফিজ’কে তার বোলিং প্রতিভার জন্য মাথায় মুকুট পরাচ্ছি। তারকা খেলোয়াড় মুস্তাফিজকে যদি ওই প্রশ্নগুলো করা হতো, তাহলে তিনিও এসকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। তাঁকে এসব প্রশ্নের উত্তর পারতেই হবে, এমন কোন কথা নেই। তিনি যেই বিষয়ে দক্ষ, সেই বিষয়ে তিনি সেরা। প্রত্যেকেরই নিজের কোন আগ্রহের বিষয় থাকে। নিজের পছন্দের সাবজেক্টে সবাই সেরা। অথচ আমরা সবাইকে সব বিষয়ে সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেই। সবাইকে কেন সবকিছু পারতে হবে?

তের জনেকে ১০ টি করে প্রশ্ন করা হলে, এরমধ্যে ছয়জন যদি ছয়টি প্রশ্নের উত্তর ভুল করে, তবে এখানে অস্বাভাবিক কিছু তো দেখি না। ক্যামেরার সামনে নার্ভাস হয়ে আমি হলে তো কথাই বলতে পারতাম না। জানি, অন্যকে অপমানিত হতে দেখা আমাদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক। অন্যের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে একবার ভেবে দেখুন বিষয়টা। তাহলেই বুঝতে পারবেন।

প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যদেরকে করা সব প্রশ্নের উত্তর আমি পারতাম কিন্তু নিজেরটার উত্তর ঠিকমত দিতে পারতাম না। একবার বায়োলজি পরীক্ষার প্র্যাক্টিক্যালে, আমার আগের রোলের স্টুডেন্টটি’কে তেলাপোকার বৈজ্ঞানিক নাম জিজ্ঞেস করা হলে, সে তেলাপোকার ইংরেজি বলে। শুনে আমি হেহে করে হেসে ফেলি, কারণ তেলাপোকার বৈজ্ঞানিক নাম আমি জানি। কিন্তু যেই মুহূর্তে, টিচার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হাসলে কেন? তুমি বলতো এটার উত্তর? আমি ঘটনার আকস্মিকতায় ও টিচারের ঝাড়ি শুনে পুরাই ব্ল্যাংক হয়ে যাই, পারিনি উত্তর দিতে। এরকম হয়। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। পরীক্ষায় পাশের জন্য শ’খানেক বৈজ্ঞানিক নাম, (বেশিরভাগ মূলত ল্যাটিন শব্দ) মখস্থ করলেও, তেলাপোকা ছাড়া অন্যকোন কিছুর বৈজ্ঞানিক নাম আমার এই মুহূর্তে মনে নেই।
আমার বাসার ক্যামিস্ট্রি স্যার আমাকে পড়া জিজ্ঞেস করতেন প্রতিদিন, একটা প্রশ্নে আটকে গেলে দাঁড় করিয়ে রাখতেন, বলতেন এক পা তুলে দাঁড়াও, এরপর বলতেন, দুই পা তুলে দাঁড়াতে পারলে শাস্তি মাফ করে দিবো, দাঁড়াও তো। দুই রুমের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে আমাকে নিয়ে তিনি এসব মজা করতেন। পাশের রুমে আমার ছোট বোনের টিচার পড়াতেন। আমার ছোট বোন হাসতো, তার টিচার হাসতেন। আমার রাগ হতো, কিন্তু করার কিছুই ছিলও না। শেষে, আমি ঠিক করি, আমি আর পড়া শিখব না। স্যার পড়া জিজ্ঞেস করার আগেই, ‘সরি, পারব না’ বলে আমি কানে ধরে দাঁড়িয়ে যাই। তারপর স্যারকে জিজ্ঞেস করি, স্যার পা তুলে দাঁড়াব নাকি উঠ বস করব। এরপর আমার বাবা মা সেই টিচার’কে বাতিল করতে বাধ্য হয়। ওই সময়টুকু আমি প্রচণ্ড এক মেণ্টাল টর্চারের মধ্যে ছিলাম। স্যার নানারকম অদ্ভুত কথাবার্তা বলতেন, মজা নিতেন, আর আমাকে নানাভাবে বিব্রত করার চেষ্টা করতেন। এরকম মেণ্টাল টর্চারের মধ্যে বাংলাদেশের অনেক স্টুডেন্টই দিন পার করছে। আমার এক ভাইয়ের তো মানসিক সমস্যা শুরু হয়েছে, পড়ার চাপ আর বাবা-মা-শিক্ষকদের দুর্ব্যবহারের কারণে।

আমি যখন কলেজে পড়তাম, তখন আমি কলেজের জন্য বাসা থেকে বের হতাম, সকাল সাড়ে ছয়টায়। ফিরতাম দুপুর সাড়ে তিনটায়। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে সাড়ে চারটার দিকে পরিশ্রান্ত হয়ে যেতাম। কিন্তু ছয়টায় আবার ক্যামিস্ট্রি স্যার, মাঝখানের সময়টুকু স্যারের পড়া শিখে নিতাম। ছয়টা থেকে আটটা সেই স্যার পড়িয়ে গেলে, নয়টা থেকে এগারোটা আরেকজন স্যার পড়াতেন ফিজিক্স ও ম্যাথ। এরপর স্যারের হোমওয়ার্ক, কলেজের হোমওয়ার্ক করে, খেয়ে দেয়ে গভীর রাতে কম্পিউটার নিয়ে বসতাম। ঘুমাতে ২টা বাজুক কিংবা ৪টা, উঠতে হবে ছয়টা বাজার পনের মিনিট আগে। এই ছিল আমার ডেইলি রুটিন। এটা কেবল আমার না, বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার শিকার প্রতিটি স্টুডেন্টের ডেইলি রুটিন। আমি ফাঁকিবাজ টাইপের স্টুডেন্ট ছিলাম বলে, এরমধ্যেই সময় বের করে নিতাম নিজের জন্য। আর কলেজের সময়টুকু পুরোটায় বন্ধুদের সাথে আনন্দ করে কাটাতাম বলে এইরকম কঠিন অবস্থায়ও মুখে হাসি ছিলও। ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, কড়া নিয়মকানুন, আর নিয়ম ভাঙতে পারার আনন্দটাই ছিল অন্যরকম।

মুখস্থ করার কাজটা আমাকে দিয়ে হতো না। আমার ফিজিক্স স্যার লক্ষ্য রাখতেন, পড়া লেখার চাপে যেন আমার মানসিক কোন রোগ সৃষ্টি না হয়, আমি যেন কোনভাবে হতাশ না হই। স্যারের জীবনে এমন ঘটেছিল। স্যারের এক স্টুডেন্টেরও পড়ার চাপে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের কলেজের অনেক ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্টই মানসিক কোন সমস্যায় ভুগছে বলে মনে হতো। তাদের সারাদিনের কথাবার্তার বিষয় কেবল পড়া, কে কত নম্বর পেলো, সবচেয়ে বেশি যে পেয়েছে সে কোন স্যারের কাছে পড়ে, সে কোন টেস্ট পেপার ফলো করে.. এসব। আমাদের স্কুলের ফার্স্ট গার্লকে আমি কখনো কথা বলতে দেখিনি, সারাদিন বইয়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে ‘বিড়বিড়’ করতো।
এসকল কথা বলছি কারণ, অনেকের মনে হতে পারে, বর্তমানে গোল্ডেন জিপিএ৫ এসব পাওয়া কোন ব্যাপার না, না পড়লেও পাওয়া যায়, আসলে তা নয়। আমি এও প্রমাণ করতে চাইছি না যে, জিপিএ৫ পাওয়া ছাত্ররা একেকজন মেধায় অনন্য। তবে এখনের স্টুডেন্টরা পড়ালেখার পিছনে যেই সময় ব্যয় করে আমাদের বড়রা কিন্তু এত সময় মোটেই ব্যয় করতেন না। তারা বিকেল হলে মাঠে ঠিকই খেলতে যেতেন। এখন খেলার মাঠ কই? আর সময় কই? রেজাল্ট যাইহোক, সেটার পিছনে ছুটতে গিয়ে বর্তমানে স্টুডেন্টরা তাদের শৈশব-কৈশোরের আনন্দময় সময় গুলো হারিয়ে ফেলছে। একধরণের বিশ্রী প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেদেরকে ব্যস্ত রেখে প্রকৃত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে রয়েছি আমরা। এজন্য মোটেই স্টুডেন্টরা দায়ী নয়, দায়ী শিক্ষাব্যবস্থা। দায়ী আমাদের শিক্ষকেরা, আমাদের বড়রা।
লেখাপড়াটা আমাদের কাছে ভয়ের বা যনন্ত্রনার বিষয়। লেখাপড়া কি আসলেই তাই? মোটা মোটা বই মুখস্থ করে, সেসব পরীক্ষার খাতায় বমি করাটাই কি শিক্ষা? মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় আপনারা এরচেয়ে ভালো কিছু আশা করেন কী করে? স্টুডেন্টদের ভুল নিয়ে হাসাহাসি না করে বরং এ থেকে পরিত্রাণের কার্যকরী কোন উপায় বের করাই আমাদের গুরুজনদের দায়িত্ব। দায়িত্ব এড়িয়ে কেবল কয়েকজন শিক্ষার্থীর অজ্ঞতা নিয়ে উপহাস করলে আপনাদের প্রতি ছাত্রদের আস্থার জায়গাটি আর থাকবে না।

রবিবার, ২৯ মে, ২০১৬

শ্যামল কান্তি : মালাউন থেকে শিক্ষক হয়ে উঠার কাহিনী

নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত বর্বরতম নিপীড়নের শিকার হয়েছেন স্কুল কমিটি ও স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান দ্বারা। তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা গুজব রটিয়ে একদল লোক তাকে শারীরিকভাবে আঘাত ও অপমানিত করেছেন। শিক্ষক শ্যামল কান্তি ধর্ম অবমাননা করেছেন কিনা প্রথম ক’দিন এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। তাই সবাই ধরে নিয়েছে, নিশ্চয়ই ওই মালাউন ব্যাটা আমাদের আল্লাহ রসুলকে নিয়ে কটুক্তি করেছে। কাজেই তাকে যা করা হয়েছে, তার অপরাধের তুলনায় তা কিছুই না।

তারপর সাংবাদিকেরা তাদের ক্যামারায় খবর নিয়ে এলেন যে, শ্যামল কান্তি ধর্ম নিয়ে কোনো ধরণের মন্তব্য করেননি। যেই ছাত্রের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে অপমানিত করা হয়েছিলো, সেই ছাত্রই পরবর্তীতে ক্যামেরার সামনে বলেছে, “স্যার ধর্ম নিয়ে কিছু বলেননি”। শিক্ষক শ্যামল কান্তি ধর্ম নিয়ে বলেছেন, এলাকাবাসীও এরকম কিছুর প্রমাণ পাননি বলে জানিয়েছেন।

বিষয়টির সাথে নাস্তিকতা জাতীয় ভয়ংকর কোনো কিছুর সম্পর্ক না থাকায় মডারেট মুসলমানগণ ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ নিজেদের কানে ধরা ছবি দিয়ে শ্যামল কান্তির এমন দুরবস্থায় তার পাশে আছেন বলে জানিয়েছেন, তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু হলো, সেলিম ওসমান নামের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ট্যাগ থাকায়, অনেকেই সেলিম ওসমানের শাস্তি দাবী করতেই শ্যামল কান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। হুজুগে বাঙালি, যারা ১২ ঘন্টা আগে মালাউন শ্যামল কান্তির ফাঁসির দাবী করছিলো, তারাই আবার ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়ে শ্যামল কান্তির পক্ষ নিয়েছেন। এভাবেই মালাউনের বাচ্চা থেকে ধীরে ধীরে শ্যামল কান্তি হয়ে গেলেন, আমাদের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত।

যেহেতু জনগণ শ্যামল কান্তির পক্ষে নিয়েছেন, কাজেই সরকারের মন্ত্রী এমপিরাও ধীরে ধীরে এ বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হলো। এটা তো তার প্রাপ্য। কিন্তু অপরাধীদের প্রাপ্যটার তবে কী হবে?

একবার ভাবুন, যদি প্রমাণ করা না যেতো যে শ্যামল কান্তি আসলে ধর্ম নিয়ে কিছুই বলেননি, কিংবা যদি প্রমাণ হতো যে, শ্যামল কান্তি আসলেই ধর্ম নিয়ে কিছু বলেছেন, তবে এইসব প্রতিবাদী কন্ঠরা কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতেন। আর বেচারা শ্যামল কান্তির পরিণতি হতো রাজীব, অভিজিৎদের মতো। প্রতিবাদের তো প্রশ্নই উঠে না, বরং অনেকে সুর তুলতেন, ‘ধর্ম নিয়ে কটুক্তি বরদাস্ত করা হবে না’।

শ্যামল কান্তির ইস্যু নিয়ে যখন আমরা প্রতিবাদ করছি, ঠিক তখন নিবন্ধন পরীক্ষা দিতে গিয়ে প্রধান শিক্ষক দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলেন একজন শিক্ষিকা। যেহেতু হুজুগে বাঙালি তখন অন্য ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত তাই এইদিকে নজর দেয়ার সময় হয়নি। আর কয়েকদিন আগেই তো তনু ধর্ষণের ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদ হলো, এখন নতুন কিছু নিয়ে প্রতিবাদ করা যাক, ধর্ষণের ইস্যু তো পুরাতন।

এরপর ঢাকার ধামরাইয়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকাকে টয়লেট থেকে বের করে মারধর ও লাঞ্ছিতের অভিযোগ উঠেছে ওই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতির বিরুদ্ধে। না, এই বিষয়েও কারও প্রতিবাদ নেই, কাজেই সরকারের কারও এই নিয়ে মুখ খোলার কিংবা কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন হয়নি।

শ্যামল কান্তি ইস্যুটা থেকে ফায়দা লুটতে এখন আবার হেফাজতে ইসলাম মাঠে নেমেছে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত নাটক কোনদিকে মোড় নেয়।

কিছুদিন আগে তনু হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগে দেশ উত্তাল ছিলো। ময়না তদন্তে প্রথমে ধর্ষণের কোনো আলামতই পাওয়া গেলো না। পরে প্রতিবাদের অবস্থা বুঝে, ময়নাতদন্ত পাল্টে গেলো। দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তে তনুর কাপড়ে দুইজনের বীর্য পাওয়া গেছে বলে জানা যায়।

এসব ঘটনাগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে গিয়ে কিছু বিষয় মাথায় এসেছে। প্রথমে যেকোনো অন্যায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়। এরপর যদি দেখা যায়, ওই অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাতি সোচ্চার, তখন সেটিকে অন্যায় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং সরকার-প্রশাসন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

২০১৩ সালে কাদেরমোল্লাকে যাবজ্জীবন দেয়ার কথা কি মনে পড়ে আপনাদের? জনগণ এই রায়ের বিরুদ্ধে গেলে পরবর্তীতে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হয়, দণ্ড কার্যকরও হয়। যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে যদি জনগণ এক না হতো, তবে কিন্তু এসব ভয়ংকর অপরাধীদের কারও ফাঁসি হতো না।

দেখা যাচ্ছে, যেই ইস্যুতে জনগণ সোচ্চার হয়, প্রতিবাদী হয়, সেই ইস্যুতে সরকার কোনো একটা ব্যবস্থা নেয়। এখনও পর্যন্ত যেই ইস্যুতে জনগণের কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি, তা হলো নাস্তিক মুক্তমনাদের হত্যা। কাজেই এগুলো এখনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই রয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, জনগণ যদি নাস্তিক হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নামে, তবে নাস্তিক হত্যার বিচার করার ব্যাপারেও সরকার পদক্ষেপ নেবে।

ইসলাম ধর্মে নাস্তিক হত্যার নির্দেশ দেয়া আছে, এরকম রেফারেন্স হাজির করলে বলা হয়, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম ধর্মে এসব বলা হয়নি, এসব সহিহ অনুবাদ নয়, ইসলাম হত্যাকে সমর্থন করে না’। ইসলাম যদি হত্যাকে সমর্থন না করে, তবে একের পর এক নাস্তিক প্রগতিশীলদের হত্যায় শান্তিকামীদের কোনো প্রতিবাদ দেখি না কেন? ইসলাম যদি এতোই শান্তির ধর্ম হয়, তবে ‘নাস্তিক হত্যা ওয়াজিব হয়ে গেছে’ নাস্তিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দাতাদের বিরুদ্ধে কেন ইসলাম অবমাননার অভিযোগ উঠে না? কেন প্রকাশ্যে এসব হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করেন না? এই কেন-এর উত্তরটা নিজেই বুঝে নিন, আবার রেফারেন্স দিতে পারবো না।

এখন আবার নতুন নাটক, ছয় জঙ্গিকে ধরতে পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। যেহেতু একের পর এক মুক্তমনা হত্যার পর সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে উন্নত দেশগুলো, তাই সরকার এটি নিয়ে কিছুটা চাপের মধ্যেই আছে বলা যায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে এখন সরকার জানিয়ে দিলো যে, আমরা নাস্তিক হত্যার বিষয়গুলো এতোটাই সিরিয়াসলি নিচ্ছি যে, জঙ্গি সনাক্ত করে এখন খুঁজে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে লাখ টাকার পুরষ্কার পর্যন্ত ঘোষণা করে ফেলেছি। আর কী চাও তোমরা?

আর যেসব জঙ্গিকে হাতে নাতে ধরা হলো, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হলো? বাবু হত্যায় দুই জঙ্গিকে ধরে দিয়েছিলো ভিন্ন লিঙ্গের দুইজন মানুষ। ওই দুই জঙ্গির অপরাধীর কোনো শাস্তি না হলেও খুনি ধরিয়ে দেয়ার অপরাধে সেই ভিন্ন লিঙ্গের দুজনকে হুমকির মুখে ঢাকা ছাড়তে হয়েছে। অভিজিতের খুনীদের নাকি চিহ্নিত করা হয়েছে, নজরদারিতে রয়েছে, এরকম খবর শুনে আসছিলাম। এরপর খবর এলো, খুনীরা বিদেশে পালিয়ে গেছে।

হয়তো শিক্ষক লাঞ্ছনার ইস্যু চাপা দিতেই এই জঙ্গি শনাক্ত ও পুরস্কারের নাটক শুরু হলো। এতে ইস্যু চাপা পরলে তো খুব ভালো। নয়তো একটা নাস্তিক কিংবা প্রগতিশীল কাউকে বলি করা হবে। পুরাতন ইস্যু পাল্টে নতুন ইস্যু হেডলাইনে আসতে বাধ্য।

জুম্মাবারের আপডেট, কুষ্টিয়া সদরের বটতৈলে সানোয়ার রহমান নামে এক হোমিও চিকিৎসককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। জানা যায়, নিহত ‌‌সানাউর রহমান একজন বাউল ভক্ত ছিলেন। একসময় বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একটা হোমিও দোকান দিয়েছিলেন যেখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দেয়া হতো। তার দোকানে সম্ভবত প্রগতিশীল ও বাউলতত্বে বিশ্বাসী লোকজনের আড্ডা হতো। দেখা যাক, এই ইস্যু নিয়ে কী ধরনের নাটক হয়।

এভাবেই ইস্যু যায়, ইস্যু আসে। এসব ইস্যুর স্রোতেই আমরা হারিয়েছি রাজীব, অভিজিৎ, বাবু, অনন্ত, নীল, দীপন, নাজিমউদ্দীন, রেজাউল করিম, জুলহাজ, তনয়, সানোয়ারদের….

পুরুষের আত্মত্যাগ গৌরবের, নারীর আত্মত্যাগ লজ্জার!

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের গৌরবের ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশের বীর সন্তান। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখা আছে অনলাইনে। আমি সেসব আবার নতুন করে বলতে চাই না। আজ আমার লেখার বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উপেক্ষিত একটি অংশ।

বীরাঙ্গনা। যারা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের দ্বারা নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে গর্ববোধ করেন। নিশ্চয়ই এটি গর্বের বিষয়। কিন্তু জানেন কি বীরাঙ্গনা পরিচয়টি আমাদের সমাজে, লজ্জা ও অপমানের। যুদ্ধ প্রক্রিয়ার কৌশলগত দিক হিসেবে নির্যাতিত হয়েছেন এইসব বীর নারীরা, নিঃসন্দেহে তারা মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এই বীর নারীরা কী পেয়েছে স্বাধীন দেশটির কাছ থেকে ঘৃণা আর অপমান ছাড়া?

যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হল, এক বুক কষ্ট-দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়ে বীরাঙ্গনারাও তাদের আপনজনদের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু হায়! ধর্ষকেরা নাকি তার ইজ্জত নষ্ট করে ফেলেছে, তার আর ইজ্জত নেই, কাজেই স্বামী তাকে ঘরে তুলবে না। হ্যাঁ, বেশির ভাগ নারীর সাথে এটিই ঘটেছিল। তারা বাড়ি হারা, স্বামী হারা, সন্তান হারা হয়েছেন এই স্বাধীন দেশে। কতটা নির্মম, কতটা বর্বর জাতি আমরা, ভাবতে পারেন?

বঙ্গবন্ধু এসকল বীর নারীদের জন্য ‘নারী পুনর্বাসন’ অফিস খুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেসবও বন্ধ হয়ে গেল। তাদের অনেকে মানুষের বাড়িতে কাজ করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করেছিলেন। সেখানেও অনেককে কুকুরের মত তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের সম্পর্কে এলাকায় কথা বলতে গেলেই, মুক্তিযুদ্ধে তাদেরকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে কয়জন কী করেছে, সেসব কথা আগে উঠে আসে। এসবই তাদের পরিচয়। তাদের জীবন ঠিক ওই সময়টাতেই থেমে আছে।

এক বীরাঙ্গনা মায়ের মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল তার বীরাঙ্গনা পরিচয়ের কারণে। অন্যদিকে আমাদের পরিবারে কেউ মুক্তিযোদ্ধা থাকলে সেই সার্টিফিকেটের সুবিধা নিয়ে সেরা স্কুল-কলেজে ভর্তি হই। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরী নিই। অন্যদিকে বীরাঙ্গনার সন্তানের, বীরাঙ্গনা কোটায় বিয়ে ভেঙে যায়। বেগম খালেদা জিয়া, হোক তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, আমরা কিন্তু ৭১এ তাকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার ধর্ষণ করাকে মজার কোন বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করে মুখ টিপে হাসি।

একাত্তরে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় আচরণ তাদেরকে যতটা না কষ্ট দেয়, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কষ্ট দেয়, যুদ্ধের পর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া নির্যাতন,বঞ্চনা ও উদাসীনতা। সমগ্র জীবন তারা পার করে দিলেন, এক বুক বেদনা নিয়ে। সমাজের বাঁকা চোখ তাদেরকে বাধ্য করছে, মানবেতর জীবনযাপন করতে। যেন বীরাঙ্গনা হওয়া অপরাধ। দেশের জন্য পুরুষের আত্মত্যাগ মহান হলেও, নারীর আত্মত্যাগ লজ্জার।
একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে শোক গাঁথার অন্যতম অধ্যায় বীরাঙ্গনা। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সহ সমস্ত ক্ষতিগ্রস্তরা বিভিন্ন সময় আলোচনায় এলেও সবসময় উপেক্ষিত থেকে গেছেন বীরাঙ্গনারা। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বইগুলোতেও এসকল বীর নারীদের আত্মত্যাগের কথা খুব বেশি পাওয়া যায় না। ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা হয়। বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু একটি বাক্য থাকে, ‘২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হানি’ দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হানি মোটেই ঘটে নি। সম্ভ্রম যোনির ভেতরে থাকে না।

দুই লক্ষ মা-বোনের সাথে কী ঘটেছিল ৭১ এ, সেসব বলে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীকে আমরা আরও লোমহর্ষক ভাবে উপস্থাপন করি, পাক হানাদারদের নির্মমতাকে বুঝানোর জন্য ধর্ষণের কথা তুলে ধরি, কিন্তু যুদ্ধের পর তাদের সাথে কী ধরণের নির্মম আচরণ করেছি নিজেরা, এজন্য কি আমাদেরকে কেউ নির্মম- অকৃতজ্ঞ - বর্বর জাতি বললে, খুব বেশি ভুল বলা হবে?

বীরাঙ্গনার সংখ্যা নিয়েও আছে দ্বন্দ্ব। তখনকার সরকারি জরিপ মতে বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা ২ লাখ। সেই সময়ের নির্যাতিত নারীদের গর্ভপাতের চিকিৎসার কাজে বাংলাদেশে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার জেফ্রি ডেভিস। নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও গ্রাম প্রতি গর্ভপাতের গড় হার হিসেব করে তিনি প্রমাণ করেছেন, এই সংখ্যা সাড়ে ৪ লাখের বেশি, যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ছিল ২০ বছরের নিচে।

সাড়ে চার লাখ বীরাঙ্গনাদের অনেকেই হয়তো আজ বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন, তারা আজ মুখ লুকিয়ে থাকেন, বীরাঙ্গনা পরিচয় কাউকে জানাতে চান না। কারণ পাকিস্তানিদের বর্বরতা তাঁরা দেখেছেন, কিন্তু বর্বরতার দিক থেকে বাঙ্গালী জাতিও যে কোন অংশ কম নয়, সেটাও তাঁরা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪০ বছরের বেশি সময় পর আওয়ামীলীগ সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে প্রাথমিক ভাবে ৪১ জন নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম গ্যাজেট হিসেবে প্রকাশ করে, আরও ৫০০ জনের একটি তালিকা তদন্তাধীন রয়েছে। সরকারের উচিত দ্রুত সকল বীর নারীদের নাম প্রকাশ করে তাদের ভাতার ব্যবস্থা করা সাথে তাদের সন্তানদেরকেও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, সকল সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা।

স্ব ভূমির জন্য আত্মত্যাগ লজ্জার নয়, গৌরবের। ইতিহাসে উপেক্ষিত এসব নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি হতে পারে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল।

এখন এসবের মূল নিয়ে কথা বলা যাক। কিছুদিন আগে সাবিরা নামের এক নারী মডেল আত্মহত্যা করেছে ঠিক একই কারণে। প্রভা-রাজীবের ঘটনা তো আমরা জানি, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সবাই ছি ছি করেছে প্রভাকে, রাজীবকে নয়। হ্যাপি-রুবেলের কাহিনীতে রুবেল কিন্তু আমাদের হিরোই থেকে গেছে, নষ্ট হয়েছে হ্যাপি।

ধর্ষণ সেটা মুক্তিযুদ্ধে করা হোক কিংবা স্বাধীন দেশে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষিতা মানেই, ইজ্জত-সম্ভ্রম নষ্ট হওয়া এক নারী। পুরুষের ইজ্জত-সম্ভ্রম তাদের কর্মে, চিন্তায়, জ্ঞানে। নারীর ইজ্জতটা তবে কোথায় থাকে? কোন অসভ্য পুরুষের নষ্টামির ফল কেন একটি মেয়েকে বয়ে বেড়াতে হবে? দুজন মানুষের স্বেচ্ছায় যৌন মিলনে পুরুষের কিছু না হলেও নারীর ইজ্জত যায় কেন? কীভাবে?

এইসব প্রশ্ন দূর হয়ে যাবে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, নারীকে মানুষ ভাবতে পারলে। কোন অংশে কম মানুষ কিংবা দুর্বল প্রজাতির কিছু ভাবলে এসব সমস্যা চলতেই থাকবে। কিন্তু পুরুষের চিন্তার দৈন্যতার কারণে নারীকে আজও তারা মানুষ ভাবতে পারে না। আর কতকাল ‘আমরাও মানুষ’ ‘আমরাও পারি’ ‘নারী মায়ের জাত, মায়ের জাতকে সম্মান করো’ ইত্যাদি ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে সম্মান ভিক্ষা চলবে? পুরুষের চেতন ফেরাতে হলে আঘাতের বিপরীতে পাল্টা আঘাতের বিকল্প কিছু আছে কি?

শুক্রবার, ১৩ মে, ২০১৬

ভেদাভেদের মাধ্যম রেজাল্ট!

ক্লাস টেনের কেমিস্ট্রি ক্লাস চলছে। মোটু পাতলু দুই বন্ধু সদ্য নাইন পাশ করে ক্লাস টেনে উত্তীর্ন হলো। কেমিস্ট্রি স্যার প্রায় দুই সপ্তাহ পড়িয়ে একটি অধ্যায় শেষ করেছেন। এবার পড়া নেয়ার পালা। স্যার সামনের কয়েকজনকে প্রশ্ন করে সঠিক উত্তর না পেয়ে হতাশ হয়ে সারা ক্লাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এতোদিন ধরে আমি কী পড়িয়েছি তোমাদের’ বলে স্যার মাইক্রোফোনটা পড়া না পারা একজন স্টুডেন্টের কাছে দিয়ে বললেন, ‘নাও স্যার, এটা দিয়ে আমাকে মারো, আমি তোমাদেরকে পড়া বোঝাতে ব্যর্থ’। ওই স্টুডেন্ট লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলো। এরপর স্যার একে একে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে চলেছেন, আর যারা পারছে না তাদেরকে মাইক্রোফোন হাতে দিয়ে বলছেন, ‘আমাকে মারো’ আর স্টুডেন্টরা লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মোটু পাতলুর ব্যাপারটা খুব পছন্দ হয়েছে, ওরা ঝটপট একটা প্ল্যান করে নিলো। এরপর স্যার একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বললেন, কে পারবে? ওদের আশেপাশের সব স্টুডেন্টকে মোটু শিখিয়ে দিলো যাতে সবাই পাতলুর নাম নেয়। তাই হলো, সবাই পতলুর নাম বললো। স্যার সাবাসি দিতে দিতে পাতলুর দিকে মাইক্রোফোন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সামনের বেঞ্চের কয়েকজন বলে উঠলো, ‘স্যার ও পড়া পারবে না’। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও পড়া পারবে না, তুমি কীভাবে জানো? নিজে পারো না সেটা বলো’। স্টুডেন্টটি বললো, ‘স্যার, আপনি পড়া না পারলে মাইক্রোফোন দিয়ে আপনাকে মারতে বলেন, তাই ওরা আপনাকে পড়া জিজ্ঞেস করতে বলছে, যাতে ও পড়া না পারলে, মাইক্রোফোন দিয়ে আপনাকে…..’। স্যার থামিয়ে দিলেন তাকে। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, এরকম কিছু হতে পারে স্যারের কল্পনাতেও আসেনি। এবার স্যার মোটু পাতলু গ্যাংয়ের দিকে তাকালেন, ওদের চোখ-মুখের ভাষা পড়েই বুঝে ফেললেন ওদের উদ্দেশ্যটা আসলে কী ছিলো। গম্ভীর মুখ করে স্যার বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না, দুষ্টু স্টুডেন্টদের কাণ্ড দেখে হেসে ফেললেন। ক্লাসটা শেষ হলেই মোটু-পাতলু গ্যাং সামনের বেঞ্চের স্টুডেন্টদের উত্তম মধ্যম দিয়ে গেলো, ওদের কারণেই স্যারকে মারার প্ল্যানটা তাদের নষ্ট হয়ে গেলো। এই হলো ক্লাসে সবচেয়ে ফাজিল মোটু,পাতলু ও তাদের গ্যাং। স্কুল তাদের খুব প্রিয়। কারণ স্কুলে তারা কেউ লেখাপড়া করে না; আড্ডা, ফাজলামো করেই কাটায়।

এবার বলি পাতলুর কথা। পাতলুর পড়ালেখা বলতে মূলত সেটা বাসার স্যারের কাছেই। স্যার হোমওয়ার্ক দেয়, পরদিন জিজ্ঞেস করে, ‘হোম ওয়ার্ক করেছো?’ পাতলু প্রতিদিন হোমওয়ার্ক না করার নিত্যনতুন অজুহাত দেখায়। অজুহাতের ঝুড়ি যখন প্রায় শেষের দিকে, তখন একদিন সে স্যারকে বললো, ‘আচ্ছা স্যার, এটা তো আমারই হোম, আমি তো এখনও চাইলে কালকের পড়াগুলো এখানেই শেষ করতে পারি, এটা তো হোমওয়ার্কের মধ্যেই পরে’। স্যার বেচারা আর কী করবেন। বললেন, ‘ঠিকই তো, এটা তো তোমারই হোম, তোমার হোমে যখনই করো, সেটাকে তো হোমওয়ার্কই বলতে হবে, ঠিক আছে, করো’।
স্কুলে রেজাল্টের পর তার বাবা-মা যখন হিসেব দিতে শুরু করে যে, তার পিছনে কত টাকা খরচ করা হয়েছে, আর সে কিনা এই রেজাল্ট করল? তখন পাতলুর উত্তর, ‘আমি কি বলেছিলাম নাকি আমার জন্য এত টাকা খরচ করতে? তোমাদের ভালো রেজাল্টের প্রতি লোভ তাই করেছো, আমার তো ওসব লোভ নেই। তোমার লোভ করেছ, লোভে পরে লস খেলে, আমি কী করব?’

লেখাপড়া-রেজাল্ট ব্যাপারগুলোকে তাদের বাবা মায়েরা যতোটা সিরিয়াসলি নেন, তারা ততোটাই অবেহলা করে।  এসএসসির আগে মোটু পাতলু একটা কোচিংয়ে ভর্তি হয়। সেখানে প্রতিদিন দুইটা সাবজেক্টের পরীক্ষা নেয়া হয়। আর পাতলুর বাবা প্রতিটা পরীক্ষার খাতা নিয়ে গবেষণা করেন, প্রতিটা খাতার নাম্বার টুকে রাখেন, কোনটাতে কেমন উন্নতি-অবনতি হচ্ছে, অবনতি কেন হলো, সেসব নিয়ে বাসার স্যারদের নিয়ে মিটিং বসান। কোনো কারণে একটা পরীক্ষা দিতে না পারলে পরদিন কোচিং থেকে প্রশ্ন নিয়ে এসে বাবা বাসায় পরীক্ষা নেন। আর এদিকে পাতলু কোচিংয়ে নিয়মিত পরীক্ষা দেয় না। সংগঠন করে বেড়ায়, এছাড়া পড়ালেখার চাপে অতিষ্ঠ হয়ে প্রায়ই এদিক সেদিক ঘুরতে চলে যায় তারা। কিন্তু পাতলুর বাসায় তো খাতা দেখাতে হবে। তাই কোচিংয়ের সিল দেয়া কিছু খাতা যোগাড় করে সেসবে নিজে লিখে, নিজেই নাম্বার বসিয়ে পাতলু তার বাবাকে সন্তুষ্ট করে। 

কিন্তু এরপর কোচিংয়ে নিয়ম করা হলো এক সপ্তাহের সব পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। পাতলু পরলো মহাবিপদে। এখন থেকে তো সব পরীক্ষা সিরিয়াসলি দিতে হবে। নিয়মিত পরীক্ষা দেয়া শুরু করলো তারা। কিন্তু পরীক্ষায় এতো কম সময় দেয়া হয় যে, টাইমের মধ্যে লেখা শেষ করা সম্ভব হয় না। তাই মোটু অবজেক্টিভ দাগিয়ে পাতলুকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তার শিট দিয়ে দেয়, আর পাতলু সৃজনশীল লেখে। মোটুর বাসায় পরীক্ষা নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নাই। কোচিংয়ে পরীক্ষা চলাকালীন সিসিটিভির দিকে কড়া নজর রাখেন একজন স্যার, আর গার্ড তো আছেই। এভাবে রোবোটিক সিস্টেমে পরীক্ষা দিতে দিতে একপর্যায়ে তারা বিরক্ত হয়ে গেলো। তারপর তারা কোচিংয়ের কয়েকজনকে ধরলো। পাতলুর বায়না, ‘তোরা আমার নামে পরীক্ষা দিবি’। মাঝেমাঝে ওরা কোচিংয়ে না গিয়ে, প্রক্সি পরীক্ষার্থীকে ফোনে সেটা জানিয়ে দিয়ে ওরা ঘুরতে চলে যায়।  

কোচিংয়ের স্যারেরা হঠাৎ পাতলুকে বিশেষ নজরে রাখা শুরু করলেন। পাতলুর খাতাটা সবার আগে চেক করা শুরু করলেন। সে কতো পেয়েছে, কেন খারাপ করলো, এসব নিয়ে আগে তাদের এতো মাথাব্যাথা ছিলো না। মোটু পাতলু বুঝতে পারলো, সবই পাতলুর পিতার কর্ম। পাতলুর অজান্তে বাবা কোচিংয়ে গিয়ে স্যারদের সঙ্গে তার ব্যাপারে কথা বলেন, খাতা দেখেন। এমনিতেই যথেষ্ট যন্ত্রণায় ছিলো, এখন আবার নতুন বিপদ শুরু হলো। মোটু পাতলু গ্যাংয়ের আরেক সদস্যকে কোচিংয়ে আনা নেয়ার জন্য একজন মহিলা নিয়োজিত আছেন। যতোক্ষণ কোচিং চলে, ততোক্ষন উনি বাইরেই বসে থাকতেন। একদিন ওই মহিলাকে পাতলুর বাবার একটা ছবি দেখিয়ে পাতলু বললো, ‘এই লোকটা আমাকে বেশ কিছুদিন ধরে ফলো করছে। এই লোকটাকে কোচিংয়ের আশেপাশে দেখলে জানাবেন, উনি কোচিংয়ে কার সঙ্গে কথা বলে, কী করে সব খেয়াল করবেন’। এরপর থেকে পাতলুর বাবা কখন কোচিংয়ে আসেন, কোন স্যারের সঙ্গে কথা বলেন, সব খবর পাতলুর কাছে চলে আসে। একদিন বাবাকে গিয়ে পাতলু বললো, ‘তুমি আজকে কোচিংয়ে গেছিলা?’ বাবা জিজ্ঞেস করে, ‘কে বললো?’ পাতলু বলল, ‘জানি, গেছো, সব খবর আমার কাছে চলে আসে।’ বাবাকে বুঝিয়ে দিলো যে, পাতলুর অজান্তে তার উপর নজরদারি করে সুবিধা করা যাবে না। এই করেই চলছিলো।

এসএসসি পরীক্ষার কয়েকমাস আগে তাদের মনে ভয় ধরে গেলো। রেজাল্ট নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই, কিন্তু তাদেরকে ঘিরে সবার এতো আশা। তারা তো সেসব আশা পূরণ করতে পারবে না। আর সবার এতো আশা পূরণ না হলে তাদের উপর কী ধরনের ঘুর্নিঝড় আছড়ে পড়বে, সেটা ভেবে দুজনেই পড়ায় মনযোগী হলো। 

পরীক্ষায় সময় পরীক্ষা দিলো দুজনে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করলে, তাদের উত্তর, 'পরীক্ষা তো সবসময়ই ভালো হয়, কিন্ত রেজাল্টটাই কেনো জানি খারাপ হয়ে যায়, আর সব ভালো হতে হবে এমন তো কথা নেই। যেকোন একটা ভালো হলেই হলো'। 
পরীক্ষা পর্ব শেষ, এবার রেজাল্ট। রেজাল্টের আগের দিন তারা ঠিক করলো, যদি ৪ পয়েন্ট পায় তবে বাসা থেকে পালাবে। মা-বাবার হাতে খুন হওয়ার কোনো মানে হয় না। প্ল্যান হলো, কক্সবাজার যাওয়ার। তারা সমুদ্রে ঘুরবে কিছুদিন। তারপর বাবা-মাকে ম্যাসেজ করে জানাবে, যদি রেজাল্টের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না করে তাহলে বাসায় ফিরতে রাজি তারা। পরদিন সকাল ৯টায়, পাতলুর ফোন বেজে উঠলো। এক বন্ধু ফোন করে জানালো, সে বোর্ডে গিয়ে রেজাল্ট নিয়ে এসেছে, মোটু পাতলু দুজনেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। পাতলু তখন গভীর ঘুমে, ঘুমন্ত অবস্থাতেই মোটুকে জানালো, আপাতত কক্সবাজারের ট্রিপটা তাদের মিস।

 এদিকে বাসায় পাতলুর বাবা-মার ফোনে একের পর এক আত্মীয়স্বজনের কল। ‘পাতলু কি টেনশন করছে? ওকে বলেন টেনশন না করতে, এসময় এরকম লাগে সবার’। পাতলুর মা-বাবার উত্তর, ‘ও ঘুমাচ্ছে’। শুনে তো ওদের মাথা নষ্ট। পাতলু টেনশন করছে না কেন— এটা নিয়ে তাদের টেনশন শুরু হলো। সাড়ে দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠে, পিসি অন করলো সে। পাতলুর বাবা তার একটা ছবি তুলে বললেন, ‘কোনো এসএসসি পরীক্ষার্থী রেজাল্টের দিন, দিনের বারোটা বাজে ঘুম থেকে উঠে, কম্পিউটার নিয়ে বসছে, এ ঘটনা তো সচরাচর ঘটে না, তাই ছবি তুলে রাখলাম’। বুঝলো বাসায় আর বেশিক্ষণ শান্তিতে থাকা যাবে না। মোটুকে ফোন করে বললো, ‘গোল্ডেন না হলে তো কপালে খাওয়া জুটবে না, চল কোথাও খেয়ে আসি।’ বাসায় জানিয়ে গেলো, স্কুলে যাচ্ছে।

ভালো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে অনেককিছু অর্ডার দিলো। কিন্তু শান্তিমতো খাওয়ার উপায় নেই। স্কুলের টিচারদের ফোন। তারা জানালো, ‘যাচ্ছি স্কুলে’। খেয়ে, কিছুক্ষণ ঘুরে তারা স্কুলে গেলো তিনটার দিকে।
গিয়ে দেখে স্কুল ফাঁকা, সবাই রেজাল্ট জেনে চলে গেছে। এরপর তারা মোটুর মামার বাসার ছাদে গিয়ে উঠলো, সাথে কিছু চিপস-চকলেট-আইসক্রিম। গোল্ডেন কনফার্ম না হওয়া পর্যন্ত বাসায় যাওয়া উচিত হবে কিনা বুঝে উঠতে পারছে না তারা। বিকালের দিকে গোল্ডেনের রেজাল্ট নেটে পাওয়া যাবে, ফোনের নেট সর্বক্ষণ অন। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, মামার বাসার ছাদের তালা বন্ধ করে দিতে পারে তাই কতক্ষণ এদিক সেদিক হেঁটে, দুজনে মোটুর বাসার ছাদে গিয়ে বসলো। নেটে সার্চ দিতে দিতে হঠাৎ পাতলুর রেজাল্ট পেয়ে গেলো, ‘গোল্ডেন’ আর মোটুরটা সার্চ দিয়ে দেখলো, বাংলায় মিস। ঠিক সেই মূহুর্তে মাথায় আকাশ ভাঙলো দুজনের। তারা এতোদিন পর্যন্ত যা কিছু করেছে সব দুইজনে মিলে, একসঙ্গে করেছে। এই প্রথম দুইজনের ভিন্ন রেজাল্ট। মোটুর চেহারার দিকে তাকিয়ে পাতলু কি বলবে বুঝতে পারছে না। এদিকে পাতলুর বাবা-মা বাসায় নেটে রেজাল্ট দেখে ফোন করে বাসায় যেতে বললেন। পাতলু মোটুকে ছাদে রেখে বাসায় চলে গেলো। মোটু ওখানে কতক্ষণ স্থির বসেছিলো, পাতলুর জানা নেই। বাসায় ফিরে পাতলুর মাথার ভেতরটা কেমন যেন করছে! মোটুর বাংলায় মিস— এটা মেনে নিতে পারছে না। আর দুইজনই মিস করলে হয়তো এতক্ষণে তারা কক্সবাজার যাওয়ার টিকেট কাটতো। এরপর সাহস করে মোটুকে ফোন করতে পারলো না পাতলু। রাতে ফোন করলে, মোটু কিছু কড়া কথা শুনিয়ে ফোন কেটে দিলো। মোটু পাতলুর কাহিনী আর না টানি।


আমি জানি এই কাহিনী অনেকের বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যাবে। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল দুই দিন হলো। সব দিকে শুধু রেজাল্ট আর রেজাল্ট। কার ছেলে মেয়ে কেমন করলো, গোল্ডেন পেলো নাকি শুধু এ+ নাকি তাও পেলো না
এইসব নিয়ে আলোচনা চারদিকে। যাদের সন্তান ভাল করলো তারা সবাইকে গর্ব করে রেজাল্ট বলছে, আর যাদের সন্তান প্রত্যাশা অনুযায়ী রেজাল্ট করতে পারেনি, সেসব বাবা-মায়েরা মুখ লুকাচ্ছে আর সন্তানকে বোঝাচ্ছে, সে কতটা অযোগ্য! স্কুল লাইফের প্রিয় বন্ধুরা যারা একসঙ্গে খেলতো, একসঙ্গে আড্ডা দিতো তারা হঠাৎ একদিনে আলাদা হয়ে গেল। এক বন্ধু গোল্ডেন পেলো অন্য বন্ধু পেলো না। তাদের মধ্যে নিজেদের অজান্তেই এক ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। তাদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তৈরি করে দেয় এই রেজাল্ট। এতোদিনের বন্ধুত্ব ধ্বংস করতে এই রেজাল্টই যথেষ্ট। সব পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলেই পত্রিকায় কিছু আত্মহত্যার খবরও বের হয়। এইবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। এইরকম আরও কিছু খবর এই কিছুদিন নিয়মিত পাবেন। প্রতিটা পরীক্ষার ফলাফল মানে অবধারিতভাবে কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ের মৃত্যু পারোয়ানা। আমাদের সবকিছু কেমন যেন সফলতা-কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। তুমি ভালো রেজাল্ট করেছো, ‘তুমি সফল’। তোমাকে সবাই মাথায় তুলে নাচবে। স্তুতিবাক্য ফুলঝুড়ি হয়ে ঝরে পড়বে। রেজাল্ট খারাপ কিংবা প্রত্যাশার তুলনায় খারাপ হলে সব শেষ। সমাজ, পরিবার, আত্মীয়, স্বজন কানে বারবার মনে করিয়ে দিতে থাকে, ‘তুমি অযোগ্য’। বাবা-মা হিসেব দিতে শুরু করেন এতোদিন তার পেছনে কতো টাকা খরচ হয়েছে। বাবা মায়েরা ছেলেমেয়ের সফল বন্ধুটিকে দেখিয়ে সন্তানকে বলে, ‘তুই কি করলি?’ এই কথাগুলা তাদের মানসিকভাবে কতোটা পীড়া দেয়, সেটা শুধু সেই সন্তানই জানে।
 এভাবেই সন্তানের মনে জন্ম নেয় প্রবল হীনমন্যতা, নিজের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ। একটা মানুষ নিজেকে কতোটা ঘেন্না করলে, কতোটা অসহায় বোধ করলে আত্মহত্যা করে তা আমাদের ধারনারও বাইরে।
এ কেমন সমাজে আমরা বাস করি, কেমন শিক্ষা ব্যবস্থা; যেখানে জীবনের মূল্য শেখানো হয় না? যেখানে সফলতার কাছে মানুষ দাস হয়ে যায়।

 ঘুণেধরা শিক্ষাব্যবস্থায় রেজাল্ট হচ্ছে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টির মাধ্যেম মাত্র। আমি চাই এইসব ফালতু রেজাল্টের কারবার বন্ধ হোক। ভেদাভেদ দূর হোক। কিসের রেজাল্ট নিয়ে আমরা গর্ব করবো? আমাদের দেশে প্রতি বছর এতো এতো গোল্ডেনপ্রাপ্ত স্টুডেন্ট বের হচ্ছে, কি লাভ হচ্ছে আমাদের দেশের? তারা দেশের জন্য কি করছে? সবাই তো সেই টাকার পেছনে ছুটছে। সব যেন একেকটা গোল্ডেন রোবট তৈরি হচ্ছে।

সোমবার, ৯ মে, ২০১৬

বেশ্যা!

‘বেশ্যা’ শব্দটাকে আমরা সাধারণত গালি হিসেবে ব্যবহার করি। আমার ধারণা বেশ্যারা খুব সাহসী হয়। আমাদের সমাজে নারীকে দমিয়ে রাখার প্রধান অস্ত্রটি হল ‘চরিত্র’। পুরুষ নাকি চাইলে পারে, নারীর চরিত্র ‘নষ্ট’ করতে। সীমার বাইরে গেলেই নারীকে ‘সম্ভ্রম’ হারানোর ভয় দেখানো হয়। নারীর সম্ভ্রমটির অবস্থানটা ঠিক কোথায়? যোনির ভেতরে নাকি?

একমাত্র এই ভয়ের কাছে পরাজিত হয়েই নারী আজও বন্দী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কাছে। এই ভয়ই নারীকে বাধ্য করছে পুরুষের আধিপত্য মেনে নিতে।
ঘরে বাইরে সব জায়গায় যৌন সন্ত্রাসীরা ওঁত পেতে থাকে, নারীর চরিত্র নষ্ট(!) করতে। আর যৌনসন্ত্রাসীদের চরিত্র নষ্ট হয় কিসে শুনি?

বেশ্যাদের তো এসব ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বেশ্যারা তথাকথিত ‘চরিত্র’ ‘সম্ভ্রম’ এর তোয়াক্কা করে না। তাই তারা অন্য যে কোন নারীর চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন ও সাহসী। বেশ্যাদেরকে পুরুষের সৃষ্ট চরিত্র রক্ষা করতে হয় না বলে, তারা তাদের জীবনে পুরুষের আধিপত্য মেনে নিতেও বাধ্য নয়।

আর নির্লজ্জ পুরুষজাতটার কথা আর কি বলব। দিনে যাদের বেশ্যা বলে থুতু ছিটায়, রাতে তাদের খদ্দের হয়ে থুতু চাটতে যায়। বেহায়া হলে কি আর এতটা বেহায়া হতে হয়!

পুরুষের প্রয়োজনেই নারী বেশ্যা হয়। কিন্তু বেশ্যা হওয়ার পর বেশ্যা নারীর কাছে ওসব চরিত্র-টরিত্র কোন পাত্তা পায় না। চরিত্রকে তোয়াক্কা না করার এই সাহসটাকেই পুরুষ ভয় পায়, ঘৃণা করে। ওই সাহসের অংশটুকু বাদ দিলে বেশ্যা ব্যাপারটা বেশ মজাদার হয়ে উঠে।

বেশ্যা মানে যদি বহুগামী নারী হয় বহুগামী পুরুষকে তবে কি বলা যায়? পুরুষ নারীকে মাতৃত্ব, সতীত্বের গুন শোনায়। অথচ সমাজের অধিকাংশ পুরুষই বহুগামী। পুরুষের বহুগামীতা আবার একটা বিশেষ গুণ। এটা নাকি পুরুষের সক্ষমতাকে বোঝায়! আর নারী বহুগামী হলেই নাকি বেশ্যা!

কিছুদিন আগে কিছু অনলাইন পত্রিকায় নিউজ দেখলাম, ঢাকায় নাকি ধনী ঘরের মেয়েরা বয়ফ্রেন্ড ভাড়া করছে। ধনী মেয়েরা ছেলেদের ভাড়া করছে নিজেদের যৌন চাহিদা মেটাতে। এই খবর কতটা সত্য জানি না। হয়তো সত্য, হয়তো মিথ্যা। এই খবরের শিরোনাম করা হয়েছে ‘কোথায় যাচ্ছে এই সমাজ’। আপনারা আমাকে বলুন তো, ‘কোথায় ছিলো এই সমাজ’? বেশ্যালয়গুলোর খদ্দের হয় কারা? কারা টিকিয়ে রাখছে পতিতাবৃত্তি? বেশ্যালয় বন্ধের কথা বললে, সমাজে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখানো হয়, ইনিয়ে বিনিয়ে বেশ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। তখন কোথায় যায় এই সমাজ-প্রশ্ন তুলেছেন কি? তখন এই শিরোনাম দানকারীরাই বা কোথায় থাকে?

শেখ হাসিনা নাস্তিক হত্যার দায় নিবেন না বলাতে চারদিকে সমালোচিত হচ্ছেন। আমরা বলছি, তিনি হত্যাকারীদের উৎসাহিত করছেন। কেউ একবার ভেবে দেখছেন, যুগ যুগ ধরে পুরুষ নারীর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে নারীকে অত্যাচার করেছে, ধর্ষন করেছে, এর দায় যে শুধুই পুরুষের, এটা আমরা কয়জন মানি? উল্টো পুরুষকেই বানিয়েছি নারীর রক্ষাকর্তা! পুরুষ নারীর রক্ষক হলে, ভক্ষকটা তবে কে?

আসলে রক্ষক-ভক্ষক সব একই সুত্রে গাঁথা। রক্ষক পুরুষ চায় না নারী স্বাধীন ভাবে চলুক, নিজের কথা নিজে বলুক, নিজের দায়িত্ব নিজে নিক। রক্ষক চায় নারী ভয় পাক, ভয়ে গুটিয়ে থাকুক, নিজেকে দূর্বল ভেবে তার কাছে ছুটে যাক নিরাপত্তার জন্য, তার আধিপত্য মেনে নিক। আর রক্ষকের এই চাওয়াগুলো বাস্তবে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে ভক্ষক পুরুষ।

পুরুষতন্ত্র রক্ষার স্বার্থেই কেউ রক্ষক, কেউ বা ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। যেদিন নারীর আর রক্ষকের প্রয়োজন হবে না, সেদিন থেকে আর নারীকে পুরুষের আধিপত্য মেনে নিতে হবে না।

নারী জানুক যে, তার নিরাপত্তার জন্য কোন পুরুষের প্রয়োজন নেই। নারী নিজেই নিজের রক্ষক হয়ে উঠুক। নারী জানুক তার সম্ভ্রম তার যোনিতে নয়, নারীর সম্ভ্রম নারীর কর্মে, জ্ঞানে।

মঙ্গলবার, ৩ মে, ২০১৬

ব্লগার ও লেখক হত্যা - ব্লগারদের যৌথ বিবৃতি


আমরা, গভীর বেদনা ও উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে বাংলাদেশে মুক্তমনা, নাস্তিক লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তি ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ব্যক্তিবর্গ ইসলামি জঙ্গিবাদের হাতে একের পর এক হত্যা ও আক্রমণের শিকার হলেও এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো কার্যকর আইনি ও প্রশাসনিক উদ্যোগ নেবার পরিবর্তে নিহত ও আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের উপর দায় চাপানোর এক নতুন সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী দেশের সকল নাগরিক আইন দ্বারা সুরক্ষা লাভের অধিকারী এবং সবার মত প্রকাশের অধিকার থাকা সত্ত্বেও গত ১৪ এপ্রিল ২০১৬ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে বলেছেন, কেউ ধর্মের সমালোচনামূলক লেখালেখির কারণে খুন হলে সরকার তার দায়িত্ব নেবে না। এই ঘোষণার দ্বারা নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব অস্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী সংবিধান এবং নাগরিকদের প্রতি তাঁর অঙ্গিকার থেকে স্পষ্টত সরে গেছেন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, অনলাইন এক্টিভিস্ট খুন হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, “সে ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর লেখালেখি করত কী না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন... আগের যে হত্যাকাণ্ডগুলো হয়েছে তাদের ব্লগ যদি দেখেন, এভাবে মানুষের ধর্মে আঘাত দেওয়া, বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া, পৃথিবীর কোনো দেশেই তা গ্রহণযোগ্য নয়”। ইসলামি জঙ্গীদের আক্রমণে সমকামী আন্দোলনের দু’জন কর্মী খুন হলে একই কায়দায় তিনি মন্তব্য করেন “আমাদের সমাজে সমকামিতা মানানসই নয়”। পুলিশের মহাপরিদর্শক জনাব এ কে এম শহীদুল হক গত ২৬ এপ্রিল ব্লগারদের নিরাপত্তা প্রদান এবং গুপ্ত ঘাতকচক্র দমনে তার বাহিনীর অপারগতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “পুলিশ ঘরে ঘরে পাহারা দিতে পারবে না, নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদেরকেই নিতে হবে"। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধানের এহেন বক্তব্য দায়িত্বহীন, অপেশাদারসুলভ এবং উদ্বেগজনক। এছাড়াও সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া স্বীকার করেছেন যে, তাদের নজরদারীতে থাকা লেখক অভিজিৎ রায় ও প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের কয়েকজন খুনী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে! পুলিশের নজরদারীতে থাকা খুনীদের দেশ ছেড়ে পালানোর ঘটনা থেকে যৌক্তিকভাবেই সন্দেহ হয় যে, ব্লগার হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারে সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহের ইচ্ছা ও আগ্রহের অভাব রয়েছে। এছাড়া সরকার ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের এই ধরনের মন্তব্য ও বিবৃতি উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এবং জঙ্গীবাদকে উস্কে দেয়ার পাশাপাশি হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রাখতে খুনিচক্রকে অধিক মাত্রায় উৎসাহিত করছে। অন্য দিকে ভিন্নমত ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর হামলাকারীকে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ হিসেবে দেখিয়ে দায় থেকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে; অথচ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের ইসলাম নিয়ে কথিত কটুক্তির অভিযোগ এনে জেলে ভরা হচ্ছে।

হেফাজতে ইসলাম এর আমীর আল্লামা আহমদ শফি যখন প্রকাশ্যে “নাস্তিকদের কতল করা ওয়াজিব হয়ে গেছে” বলে ফতোয়া দেন এবং সারাদেশে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল, খুৎবায় নানাস্তরের জঙ্গীবাদী ইমাম, আলেম, খতিবরা নাস্তিকদের খুনের প্রকাশ্য ফতোয়া দিতে থাকেন, তখনও আমরা সরকারকে কোনো আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখি না। একই সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের অঙ্গসংগঠন পরিচয় দিয়ে ‘আওয়ামী ওলামালীগ’ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তারে পাল্লা দিয়ে কাজ করছে। হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের যোগাযোগ এবং তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করার বিষয়টিও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। উপরন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ উগ্র মৌলবাদীদের সাথে দফায় দফায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী চুক্তি করছে এবং রাষ্ট্র ও সমাজকে সাম্প্রদায়িকীকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামীলীগসহ ক্ষমতাসীন ১৪ দল তথা মহাজোট এবং তাদের সহযোগী সংগঠনসমূহ এসকল হত্যা-খুনের প্রতিকার প্রশ্নে নীরব থাকছে অথবা দলীয় ও জোট নেত্রীর দেখানো পথে আক্রান্তদেরই দোষারোপ করা হচ্ছে। পাশাপাশি, সংঘটিত হামলাগুলোর দায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার-আল ইসলাম (আল-কায়েদার ভারত উপমহাদেশীয় নেটওয়ার্কের বাংলাদেশ শাখা) এবং আইএস স্বীকার করলেও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ওস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে আইএস, আল কায়দা প্রভৃতি জঙ্গী সংগঠনের উপস্থিতিকে অব্যাহতভাবে অস্বীকার করে চলেছেন, যা মূলত সত্যকে আড়াল করে সরকারের উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের সাথে সমঝোতা করে চলার কৌশল বলে আমরা মনে করি। অপরদিকে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় ২০ টি ইসলামপন্থী দলের সাথে রাজনৈতিক জোট গঠন করেছে, যাদের অধিকাংশই জঙ্গীবাদের মদদদাতা কিংবা সরাসরি যুক্ত। ফলে সরকারি কিংবা বিরোধীদল কোনো পক্ষ থেকেই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জঙ্গীবাদ মোকাবেলার কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

জঙ্গী গুপ্তঘাতকদের আক্রমণের পাশাপাশি সরকার লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও মুক্তচিন্তার মানুষদের গ্রেফতার ও হয়রানি করছে। ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এর ৫৭ ধারা প্রয়োগ করে লেখক ও ব্লগারদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। ফলে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ভয়াবহ হুমকীর মুখে পড়েছে। ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলামের দাবির প্রেক্ষিতে ৪ জন ব্লগারকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথিত অপরাধে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। হেফাজতকে সন্তুষ্ট করতেই ২০১৩ সালে ‘তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬’ এর সংশোধনী এনে সর্বোচ্চ সাজা বাড়িয়ে ১৪ বছর এবং সর্বনিম্ন সাজা ৭ বছর করা হয়। হেফাজতে ইসলাম ও ওলামা লীগের মতো উগ্র মৌলবাদীদের দাবির মুখে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি ২০১৫ সালে রোদেলা প্রকাশনী এবং ২০১৬ সালে ব-দ্বীপ প্রকাশনীকে বইমেলা থেকে নিষিদ্ধ করে। এছাড়া ২০১৬ সালে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর প্রকাশককে ৫৭ ধারায় গ্রেফতারও করা হয়। বস্তুত ২০১৩ সাল থেকেই ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে’ আঘাতের এইরকম কথিত অভিযোগে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। স্কুলশিক্ষক, দর্জি, আদিবাসী, ছাত্র, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এরকম ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগের মাধ্যমে গ্রেফতারের ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। কেউ একবার এই অভিযোগে গ্রেফতার হলে, তিনি ধর্ম অবমাননাকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যান এবং তাকে প্রাণনাশের হুমকী মাথায় নিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। সর্বশেষ আক্রমণে এরকমই একজন, ৫৭ ধারায় মামলাপ্রাপ্ত হিন্দু দর্জি জঙ্গীদের চাপাতির আঘাতে খুন হন। এসব কালাকানুন এবং সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ক্রমাগত ‘সীমা লংঘন’ না করার হুমকি, বিপন্ন লেখক ও ব্লগারদের নিরাপত্তা সহায়তার জন্যে পুলিশের শরণাপন্ন হওয়ার সকল পথ বন্ধ করা হয়েছে। একদিকে জঙ্গীদের ভয়, অন্যদিকে ৫৭ ধারায় গ্রেফতারের ভয় - উভয় সংকটে পড়ে আজ মুক্তমনা লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিক জীবন মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত।
আমরা ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া বাংলাদেশের লেখক, ব্লগার, প্রকাশক ও এক্টিভিস্টদের লেখালেখির জন্য দায়ি করে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় হতে প্রদত্ত বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি - তারা যেন ধর্ম, বিশ্বাস ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষায় দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী তথা যাবতীয় ইসলামপন্থী ও জঙ্গীবাদী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করার জন্য সরকার ও ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রতি জোরালো আহ্বান জানাই। ইসলামপন্থী ও জঙ্গীবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য দেশের বৃহত্তম বিরোধীদল বিএনপি’র প্রতি আহ্বান জানাই। আমরা বিবদমান রাজনৈতিক শক্তিসমুহকে জঙ্গীবাদ দমনের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে সামিল হওয়ার জন্য দেশের বুদ্ধিজীবি, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র, সংস্কৃতি কর্মীসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতি আহ্বান জানাই।

একই সাথে আমরা দাবি জানাচ্ছি-

১। বাংলাদেশে এ যাবৎ সংঘটিত লেখক, ব্লগার, অনলাইন একটিভিস্ট, ভিন্ন ধর্ম ও মতে বিশ্বাসী, সমকামী আন্দোলনের কর্মী এবং নাস্তিক- মুক্তমনাদের হত্যা ও হত্যাপ্রচেষ্টার সাথে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
২। দেশের সর্বস্তরের মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার সকল দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। ধারাবাহিক আক্রমণের শিকার মুক্তমনা ও সেক্যুলার লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, ভিন্ন ধর্ম ও মত-পথে বিশ্বাসী, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তায় কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। সরাসরি হুমকিপ্রাপ্ত লেখক, ব্লগার, শিক্ষক, আন্দোলনকর্মী, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, সংখ্যালঘু সংগঠনের সাথে জড়িতদের জন্য জরুরি উদ্যোগে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। সংবিধান বর্ণিত বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমানভাবে ধর্ম পালন ও প্রচারের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় ও অবিশ্বাসী- নাস্তিক- মুক্তমনাদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। সংবিধানের ৮, ১২ ও ২৮ ধারার সাথে সাংঘর্ষিক ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সম্বলিত ২(ক) ধারা বাতিল করতে হবে। সংবিধানের ৩৯ ধারার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-ভাব প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬’ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এর ৫৭ ধারা বাতিল করতে হবে।
৪। ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সেক্যুলার ব্লগারদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকী প্রদানকারী উগ্র মৌলবাদী ব্যক্তিবর্গকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। অনলাইন, মুদ্রিত গণমাধ্যম এবং টিভি চ্যানেলে জঙ্গীবাদী প্রবণতা এবং লেখক- ব্লগার- শিক্ষক- সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি হুমকিমূলক উস্কানি প্রভৃতিকঠোরহস্তে দমন করতে হবে।
৫। জামায়াতে ইসলামী, ওলামালীগ ও হেফাজতে ইসলামসহ জঙ্গীবাদের সাথে যুক্ত সকল সাম্প্রদায়িক দল এবং ইসলামি উগ্রপন্থী গোষ্ঠী নিষিদ্ধ করতে হবে এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীর সকল ধরনের কর্মতৎপরতা প্রতিহত করতে সরকারকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে।
৬। সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত ও আক্রান্ত ব্যক্তিদের লেখালেখির জন্য কিংবা তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য দোষারোপ বন্ধ করতে হবে। মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষকসহ পেশাজীবি ব্যক্তিদের কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে এবং ব-দ্বীপ প্রকাশনীর প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিকসহ গ্রেফতারকৃত সকল সেক্যুলার লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, অনলাইন এক্টিভিস্ট এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবি ব্যক্তিদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
৭। কওমি মাদ্রাসাসমূহের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি থেকে সকল প্রকার সালাফি, ওহাবি ও মওদুদীবাদী মতাদর্শ বাতিল করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠন পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কিন্ডার গার্টেন স্কুল, কোচিং সেন্টার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে বিশেষ কোনও ধর্ম শিক্ষা দিয়ে গোড়ামী এবং ধর্মান্ধতা সৃষ্টির পরিবর্তে সকল ধর্মমত ও যুক্তিসিদ্ধ মতবাদসমূহ যুগপৎ শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। জঙ্গী উৎপাদনের সুযোগ বন্ধ করতে, প্রয়োজনে মাদ্রাসাসমূহ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৮। জুম্মাহর খুৎবা ও ওয়াজ মাহফিলে উগ্র মৌলবাদী প্রচারণা, অন্য ধর্মালম্বীদের প্রতি বিষোদগার ও জঙ্গীবাদ সংগঠিত করার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। গণমাধ্যমে একক ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করে ধর্মান্ধতা সৃষ্টির পরিবর্তে মানুষকে নির্মোহভাবে সকল ধর্মমত জানার সুযোগ দিতে হবে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, নাস্তিক্যবাদ, মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ, দর্শন এবং বিজ্ঞানের উন্মুক্ত প্রচারণার সুযোগ দিতে হবে।
৯। যুদ্ধাপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করতে হবে।


                                                        বিবৃতিদাতা ব্লগ ও ব্লগারদের তালিকা
ব্লগসমূহ:
নবযুগ ব্লগ, ইস্টিশন ব্লগ, উইমেন চ্যাপ্টার, মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট, চুতরাপাতা, ধর্মকারী, ইতুর ব্লগ, অগ্নিরথ প্রমুখ 

লেখক, কবি, ব্লগার ও অনলাইন একটিভিস্ট:
(জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, ইংরেজি বানানের বর্ণনানুক্রমিকভাবে নাম সাজানো হয়েছে)
A.Z Hossain (এ,জেড হোসেন)
Abul Kashem (আবুল কাশেম)
Ahmedur Rashid Tutul (আহমেদুর রশীদ টুটুল )
Ajanta Deb Roy (অজান্তা দেব রায়)
Akash Malik (আকাশ মালিক)
Alamgir Hussain (আলমগীর হুসেন)
Allama Shoitan (আল্লামা শয়তান)
Ananya Azad (অনন্য আজাদ)
Anju Ferdousy (আঞ্জু ফেরদৌসী)
Arif Rahman (আরিফ রহমান)
Arifur Rahman (আরিফুর রহমান)
Arpita Roychoudhury (অর্পিতা রায়চৌধুরী)
Ashraful Alam (আশরাফুল আলম)
Asif Mohiuddin (আসিফ মহিউদ্দীন)
Bhajan Sarker (ভজন সরকার)
Bonya Ahmed (বন্যা আহমেদ)
Camelia (ক্যামেলিয়া)
Chorom Udash (চরম উদাস)
Daripalla Dhomadam (দাঁড়িপাল্লা ধমাধম)
Daud Haider (দাউদ হায়দার)
Deepaboli Chowdhury (দীপাবলী চৌধুরী)
Dhrubo Tara (ধ্রুব তারা)
Ekush Tapader (একুশ তাপাদার)
Ettila Etu (ইত্তিলা ইতু)
Farzana Kabir Khan (ফারজানা কবীর খান)
Horus (হোরাস)
Iswar Kona (ঈশ্বর কণা)
Kazi Mamun (কাজী মামুন)
Khalid Hasan Alo (খালিদ হাসান আলো)
Mahbub Leelen (মাহবুব লীলেন)
Mahmudun Nabi (মাহমুদুন নবী)
Mahsina Khatun (মহসিনা খাতুন)
Maskwaith Ahsan (মাস্কাওয়াথ আহসান)
Md. Mumin Banda (মোঃ মুমিন বান্দা)
Milan Farabi (মিলন ফারাবী)
Mohiuddin Sharif (মহিউদ্দিন শরীফ)
Monika Muna (মণিকা মুনা)
Muhammad Golam Sarowar (মোহাম্মদ গোলাম সারওয়ার)
Nastiker Dharmakatha (নাস্তিকের ধর্মকথা)
Nur Nobi Dulal (নুর নবী দুলাল)
Omar Farooq Lux (ওমর ফারুক লুক্স)
Poruya (পড়ুয়া)
Prithu Sanyal (পৃথু স্যন্যাল)
Raihan Abir (রায়হান আবীর)
Rubina Khanam (রুবিনা খানম)
Sabbir Hossain (সাব্বির হোসাইন)
Saikat Barua (সৈকত বড়ুয়া)
Sannyasi Ratan (সন্যাসী রতন)
Sezan Mahmud (সেজান মাহমুদ)
Shahzahan Bachchu (শাহজাহান বাচ্চু)
Shamim Runa (শামীম রুনা)
Shamima Mitu (শামীমা মিতু)
Shammi Haque (শাম্মি হক)
Shantanu Adib (শান্তনু আদিব)
Shohiduzzaman Paplu (সহিদুজ্জামান পাপলু)
Shoikot Chawdhury (সৈকত চৌধুরী)
Shravan Akash (শ্রাবণ আকাশ)
Shubhajit Bhowmik (শুভজিৎ ভৌমিক)
Sobak (সবাক)
Subrata Shuva (সুব্রত শুভ)
Supriti Dhar (সুপ্রীতি ধর)
Susupto Pathok (সুষুপ্ত পাঠক)
Swapan Majhi (স্বপন মাঝি)
Syed Kamran Mirza (সৈয়দ কামরান মির্জা)
Syed Zamal (সৈয়দ জামাল)
Tahsib Hasan (তাহসিব হাসান)
Juliyas Caesar (জুলিয়াস সিজার)
Moon Taslima Sheikh (মুন তাসলিমা শেখ)