বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৭

কপি পেস্ট লেখিকা

তসলিমা নাসরিনের একটি কলামে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন। জান্নাতুন নাঈম প্রীতি তাঁর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে এ কথা বলেছেন, হুমায়ুন আহমেদ আসলে পুরুষতান্ত্রিক নন।

যখন ক্লাস ৬-৭ এ পড়ি, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসগুলো পাগলের মত পড়তাম। হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র ‘হিমু’। টানা হিমু পড়তে পড়তে ঠিক করে ফেললাম আমিও হিমু হবো। নিজেকে তখন হিমু ভাবতে শুরু করলাম। তখন সবেমাত্র ফেসবুক একাউন্ট খুলেছি। সার্চ করে পেয়ে গেলাম হিমুদের কয়েকটি গ্রুপ। একটি গ্রুপে মেম্বার ও হয়ে গেলাম। আমার মত আরও অনেক হিমুরা আছে গ্রুপে। আমরা সবাই হিমু, সে কী উচ্ছ্বাস! গ্রুপে হিমুদের পোস্ট পড়তে পড়তে আমিও একদিন সাহস করে পোস্ট করলাম, মেয়ে হিমু কে কে আছে জানতে চেয়ে। তখন গ্রুপের কয়েকজন আমাকে জানালেন, মেয়েদের আসলে হিমু হওয়া সম্ভব না। মেয়েরা তবে কী হয়? মেয়েরা রূপা হয়। রূপার মত রূপবতী হবে, রূপার মত হিমুদেরকে ভালোবাসবে, নীল শাড়ি পরে নীল পদ্ম হাতে হিমুদের জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু আমি তো রূপা হতে চাই না, আমি হিমু হতে চাই। হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে মাঝরাতে হেঁটে বেড়াতে চাই। শুরু করলাম তর্ক। তখন গ্রুপের কয়েকজন আমাকে হিমু উপন্যাস থেকে লাইন কোট করে দেখালেন, মেয়েদের সম্পর্কে হিমুর কী ধারণা। আর হিমুর পিতা অর্থাৎ হিমুর লেখক মেয়েদের চরিত্র নিয়ে যেসব বাণী দিয়েছেন, যেগুলো অনলাইনে সার্চ করলেই পাওয়া যায়, আমাকে সেসব দেখালেন অনেকে। যেমন- মেয়েদের দুটি জিনিস খুব খারাপ, একটি হচ্ছে সাহস অন্যটি গুয়ার্তুমি/ মেয়েদের বেশি বুদ্ধি ভাল না।বেশি বুদ্ধির মেয়ে কখনো সুখী হয় না। সংসারে যে মেয়ের বুদ্ধি যত কম সে তত সুখী ইত্যাদি ইত্যাদি। সব হিমুরা মিলে প্রমাণ করে দিলেন আমার হিমু হওয়া আসলে সম্ভব নয়। আমি রাগে দুঃখে অপমানে গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর একসময় হিমুর নেশা কেটে গেল, ভুলেও গেলাম সব।

হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ গল্পের মূল চরিত্রের মেয়েটি থাকে অত্যন্ত রূপবতী। তাদের রূপই তাদের গুণ। তাঁর গল্পগুলোর মত তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁর পুরুষতান্ত্রিকতার পরিচয় মিলেছে। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এইচএসসিতে হলিক্রসে পড়তাম। পরীক্ষার ৩ মাস আগে আমার বাচ্চাদের বাবা (হুমায়ূন আহমেদ) আমাকে জোর করে ইউএসএ নিয়ে গেল। পরীক্ষা দেওয়া হল না। আমি যেতে চাইনি। শেষে আমার দাদাকে চিঠি লিখে আমাকে যেতে বাধ্য করল। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। মেডিকেলে পড়তে পারলাম না।'
এইচএসসির মত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষায় হুমায়ূন আহমেদ চাইছিলেন না তাঁর স্ত্রী অংশগ্রহণ করুক।

যাইহোক তিনি পরবর্তীতে এইচএসসি পাশ করলেন। গুলতেকিন লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে হুমায়ূন আহমেদ জানালেন, ‘তোমাকে ইডেনে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছি। মেডিকেলতো পারছোই না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও না।’

গুলতেকিন আহমেদ পরে জানতে পারলেন লং গ্যাপ হলেও তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ আছে। হুমায়ুন আহমেদের কাছে এ ব্যাপারে বললে, তিনি সোজা জানিয়ে দিলেন, তিনি এ বিষয়ে কোনও হেল্প করতে পারবেন না। গুলতেকিন হুমায়ূন আহমেদকে অবাক করে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেন এবং বেশ ভালো নম্বর পেয়েই চান্স পেয়েছেন। গুলতেকিন আহমেদকে হুমায়ুন আহমেদ পরামর্শ দিলেন সোশ্যালজি নিয়ে পড়তে। এ বিষয়ে গুলতেকিন আহম্মেদ তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভাইভার দিন স্যার আমাকে বললেন, তুমি ইংলিশে পড়। আমি বললাম- না। আমি সোশ্যালজি লিখে দিয়ে আসলাম। বিকেলে আমার এক্স হাজবেন্ড আসলেন। বললাম, তোমার কথায় সাবজেক্ট সোশ্যালজি দিয়েছি।সে বলল, খুব ভাল। তুমি ইংলিশ পারবে না। তোমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। ..আমার খুব ইগোতে লাগল। কেন বলল, আমি ইংলিশ পারবো না! আমি ডায়েরি থেকে ফোন নম্বর নিয়ে যে স্যার ভাইভা নিয়েছিলেন তাকে ফোন করলাম। বললাম, স্যার আমি কি সোশ্যালজির পরিবর্তে ইংলিশ নিতে পারি? তিনি বললেন- হ্যাঁ। আর একটা কথা খুব ইগোতে লেগেছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হুমায়ূন বলেছিল, আমাকে সে পোষ্য কোটায় ভর্তি করাতে চেয়েছিল। আমি কেন পোষ্য কোটায় ভর্তি হব!’

হুমায়ূন আহমেদ চান নি তাঁর স্ত্রী লেখাপড়া করুক, স্বাবলম্বী হোক। চেয়েছিলেন, স্ত্রী যেন অল্প শিক্ষিত হয়, যেন স্বামীর উপর নির্ভরশীল থাকে, আর নির্ভরশীল থাকা মানেই স্বামীর সকল অন্যায় মুখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হওয়া। সেটি শেষপর্যন্ত হল না। গুলতেকিন শিক্ষিত হলেন, স্বাবলম্বী হলেন। কাজেই অন্যায় আর মুখে বুজে মেনে নেয়ার কারণ নেই।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মেয়ের বয়সী একজনের প্রেমে পড়লেন। গুলতেকিনের সাথে তাঁর ডিভোর্স হল। তাদের সন্তানদের নামে হুমায়ূন আহমেদের নামের চিহ্ন থাকলেও সন্তানদের দায়িত্ব গেল গুলতেকিনের কাছে, যার নামের কোনও চিহ্ন নেই সন্তানদের নামের পাশে।

এত কিছুর পরও লেখিকা প্রীতি মনে করেন হুমায়ূন আহমেদ পুরুষতান্ত্রিক নন। তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে হুমায়ূন আহমেদকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তিনি একটি ছবি দেখেছেন যেখানে তসলিমা নাসরিন হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন, কাজেই এটি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ না হয়ে যায় না। অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তি। আর ওই ছবিটির প্রেক্ষাপট তসলিমা নাসরিন আগেও বলেছেন। ওইদিন প্রীতির স্ট্যাটাসে তসলিমা নাসরিনের ছোট বোন রোকসানা ইয়াসমিন আবার সেইদিনের কথা প্রীতিকে জানালেন। কারণ ওই সময় ইয়াসমিনও তসলিমা নাসরিনের সাথে ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের আমন্ত্রণে তসলিমা ও ইয়াসমিন বইমেলা থেকে একটি চায়ের স্টলে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কিছু ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন এবং তসলিমা নাসরিন ও তাঁর বোন অপেক্ষা করছিলেন। এই তথ্যটি জেনেও প্রীতি স্ট্যাটাসটি এডিট করবেন না, কারণ তিনি মনে করেন না তিনি কোনও ভুল তথ্য লিখেছেন, তিনি বরং মনে করেন তসলিমা নাসরিন এবং তাঁর বোন মিথ্যে বলছেন। আমি সেখানে কমেন্ট করলে প্রীতি বললেন, আমি নাকি নাক গলাচ্ছি। পাবলিক কমেন্টে যার যা ইচ্ছে কমেন্ট করে, সেখানে আমি ওই স্ট্যাটাসের সাথেই প্রাসঙ্গিক একটি কমেন্ট করলে প্রীতি বড়ই বিরক্ত হলেন। যুক্তি তর্ক আলোচনা এসবে তিনি বড়ই বিরক্ত হোন তা অবশ্য কয়েকদিন আগে বুঝেছি। আমি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছি, যাতে তিনি মনে করলেন আমি তাঁর বাণী নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, সাথে সাথে তিনি আমাকে আনফ্রেন্ড করলেন এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্লক করতে ভোলেন নি।

আবার ফিরে যেতে হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে। কারণ লেখিকা প্রীতি এটি নিয়ে এরমধ্যে আরও একটি স্ট্যাটাস লিখেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মেয়ের বয়সীর সাথে বিয়ে করে সংসার করতে লাগলেন। এতে তাঁর জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়ে নি। পুরুষ বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। কোনও নারীর পক্ষে কি সম্ভব ছিল ছেলের বয়সী কাউকে নিয়ে সংসার পাতানো, কোনও রকম সামাজিক সম্মানহানি ছাড়া? এ কথাটিই তসলিমা নাসরিন তাঁর লেখায় বলেছেন। কিন্তু লেখিকা প্রীতি মনে করেন, অবশ্যই সম্ভব। উদাহরণ দেখালেন সুবর্ণা মোস্তফার। সুবর্ণা মোস্তফা তাঁর চেয়ে কম বয়সী পুরুষকে বিয়ে করেছেন। ৪৮ বছর বয়সী পুরুষ ২০-২৫ বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করছে এতো সমাজে অহরহ ঘটছে। সেখানে সুবর্ণার বয়স যখন ৪৮ তখন তিনি বিয়ে করলেন ৩২ বছর বয়সী পুরুষকে। তারপরও সুবর্ণার কি কম সমস্যা পোহাতে হয়েছে বা হচ্ছে? এখনও সুবর্ণাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রশ্ন আসে সুবর্ণার চরিত্র নিয়ে, কারণ তিনি তাঁর চেয়ে কম বয়সী একজন পুরুষের সাথে প্রেম করেছেন। যেন তসলিমা নাসরিন এটি জানতেন না। সুবর্ণা সেলেব্রেটি হয়েও এত বিতর্কিত হলেন সেখানে একজন সাধারণ নারীর পক্ষে আমাদের সমাজে এটি সম্ভব? তসলিমাকে তিনি ভুল প্রমাণ করে বললেন, প্রেম ভালোবাসা গোপন রাখতে নেই, অন্যায় নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথা আমরা তসলিমা নাসরিনের বই পড়ে আগেই জেনেছি। তসলিমাকে ভুল প্রমাণ করে যেসব জ্ঞানের কথা তিনি বললেন সেসব আসলে তসলিমার কাছ থেকে ধার করা। অবশ্য এগুলো যে তসলিমা বলেছেন তা তিনি উল্লেখ করেন নি। বিশ্বাস করুন, যদি ফেসবুকের বাইরে দু একটা বই আমার পড়া না থাকতো তাহলে আমিও প্রীতির ভক্ত হয়ে যেতাম। যেহেতু কিছু বই পড়েছি তাই শাহরুখ খান, আমির খান, অমিতাভ বচ্চন, হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর ভাই পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী(তাঁর ভাষ্যমতে) মাসুম আব্দুল্লাহকে নিয়ে প্রীতির লেখা অনুপ্রেরণামূলক গল্পগুলো ছাড়া বাকি অধিকাংশ লেখা পড়লেই স্মৃতি নড়েচড়ে উঠে। মনে হয় কোথায় যেন পড়েছি। হয়তো একটু এদিক সেদিক হতে পারে, তবে ঘটনাটা এটাই।
আমরা ফেসবুকে যা লিখি এসব আসলে নতুন কিছু নয়। কেউ নিজেদের নামের জন্যে, পুরষ্কারের জন্য লিখি না। তাই একই কথা যদি লিখেও থাকে নিজের মত করে সেটাও অনেক সময় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু যখন আপনি যার কাছ থেকে শিখেছেন, যার লেখা কপি করছেন নিজের ভাষায়, তাঁকেই ভুল প্রমাণ করতে মাঠে নামেন? 

আপনি যা লেখেন তা যে আপনি কপি করছেন না, এটা প্রমাণের জন্য যার কাছ থেকে কপি করছেন তাঁর বিরুদ্ধে মাঝেমাঝে বলা খুব জরুরী হতে পারে। তবে এটা খুব অন্যায়। পাঠকের সাথে এবং আদর্শের সাথে ভণ্ডামী।

শুরুতে তসলিমার নাম নিয়ে আলোচনায় আসা, যথেষ্ট আলোচনা হল, এখন তসলিমার নিন্দা করে সম্মান পেতে হবে। অন্যদের মত সুর ধরলেন ‘তসলিমা নাসরিনের সব বিষয়ের সাথে একমত নই’ তসলিমা নারীবাদ, মানবতাবাদ, সমতায় বিশ্বাসী। প্রীতি এরমধ্যে কোনটির সাথে একমত নন সেটা প্রীতিই ভালো বলতে পারবেন। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন- এই কথা যখন বলেছেন একসময় হয়তো বলবেন পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে তসলিমা যা বলেছেন তা আসলে পুরুষবিদ্বেষ থেকে বলেছেন। এসব বলে হয়তো সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যাবে কিন্তু আদর্শের লড়াই থেকে অনেক দূরে সরে যাবেন।

মানবতা যখন ধর্ষকের শিশ্নের ডগায়!

মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার কিছুদিন আগে তার ডাক্তারী জীবনের একটি ভীষণ অমানবিক অভিজ্ঞতার কথা তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে শেয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর ডাক্তারী জীবনে একটি কেইস পেয়েছিলেন যেখানে একজন ধর্ষক ধর্ষণ করতে গিয়ে তাঁর যৌনাঙ্গটি ক্ষতবিক্ষত করে নিয়ে এসেছিলেন। ভিক্টিম নারীটি ধর্ষকের পুরুষ যৌনাঙ্গটি সম্পূর্ণ কর্তন করতে পারেননি। কিন্তু হাসপাতালে দেরী করে আসার কারণে অধ্যাপক তাঁর অর্ধকর্তিত যৌনাঙ্গটি মেরামত করতে পারেননি। কেটে ফেলতে হয়েছিলো তাঁর পুরুষাঙ্গটির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। যারা ডাক্তার নন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার চাইতে একজন মানুষের মৃত্যু হওয়াও ভালো। কেননা, এটা শুধুমাত্র পুরুষের যৌনতা হারানো নয়, এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কাজ মুত্র ত্যাগের এর সাথে জড়িত। স্বাভাবিক মুত্র ত্যাগের ব্যাঘাত ঘটলে একজন মানুষ মারাও যেতে পারেন। তাঁর চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে এই ধরনের রিপেয়ার বা মেরামতের পরে রোগীকে প্রায় প্রতিমাসেই হাসপাতালে হাজিরা দিতে হয় তাঁর মুত্রনালীকে সচল রাখার জন্য এবং এই কাজটি তাকে প্রায় সারাজীবন করতে হয়।” তিনি আরও বলেছেন,“এর পেছনে টাকা খরচ আছে, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট আছে। এটা অমানবিক। এটা ভীষণ অমানবিক।”

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? ভিক্টিম নারীটি যদি কোনও রকম আত্মরক্ষার চেষ্টা না করে ধর্ষণের শিকার হয়ে যেতো তাহলে তাকে আমরা ‘ধর্ষিতা’ হিসেবে সহানুভূতির চোখে দেখতাম। তিনি যদি ধর্ষণের বিচার চেয়ে বছরের পর বছর আদালতে হাজিরা দিতেন, অর্থ, শারিরীক ও মানসিক কষ্টে দিন যাপন করতেন তাহলে তাঁর দুঃখে চুক চুক করে দুঃখ প্রকাশ করতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু নারীটি ধর্ষককে প্রতিরোধ করতে ধর্ষকের যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছেন সেক্ষেত্রে আমাদের মানবতার নেক নজরে উনি আসবেন না, আসবে ধর্ষক। কারন তাঁর মহামূল্যবান যন্ত্রটি, যার গর্বে তিনি ‘তরে চুদি, তর মায়েরে চুদি, বোইনরে চুদি’ নিত্ত নৈমিত্তিক কথা বলতেন সেই কনফিডেন্সটি তাঁর থাকছে না। তাই এক্ষেত্রে সারওয়ার সাহেব নারীটিকে কাঠ গড়ায় দাঁড় করালেন। নারীটি যে কত বড় অমানবিক তা জানালেন। ধর্ষণ করতে গিয়ে লিঙ্গ হারানো মানুষের বেদনা সম্পর্কে জানালেন। তাঁর ডাক্তারী জীবনে হয়তো কোনও গণধর্ষণের শিকার হওয়া নারীকে তিনি দেখেন নি, দেখন নি পূজার মত শিশু, যাদেরকে ধর্ষণ করতে যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কাটা হয়, দেখেন নি ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রাণ হারানো কারও শরীর, ধর্ষণের পর যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়ার কাহিনীগুলোও হয়তো ওনার কানে আসে নি কখনো।

একজন মানুষ আক্রন্ত হলে সে নিজেকে বাঁচাতে ওই মুহূর্তে কী করতে পারে তা আমি আপনি বলে দিতে পারি না। আমাকে কেউ ধর্ষণ করতে আসলে আমি অবশ্যই সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তাকে প্রতিরোধ করার, এতে তার বিচি গেল না দণ্ড গেল সেটা নিয়ে ভাবতে যাব না। ধর্ষকের লিঙ্গ যেমন গুরুত্বপূর্ণ আমারটাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সারওয়ার সাহেবেরা মনে করেন, আর যাই করো ধর্ষকের লিঙ্গ মেরামোত অযোগ্য করো না, এ বড় অমনাবিক।


এ বিষয়ে ওমর ফারুক লুক্স একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আইনকানুন-শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে যা বলেছেন সেসবের সাথে একমত না হওয়ার কারন নেই। তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে কি ধর্ষণের হার কমানো যায়?’ অবশ্যই না। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে বছর খানেক হল। তাহলে তিনি কেন মনে করলেন, ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে লিঙ্গ কেটে ফেলার মত কোনও বর্বর আইন হতে যাচ্ছে? এরকম আইনের জন্য কোনও মিছিল সমাবেশ ও বাংলাদেশে হয় নি কখনো। ‘ধর্ষণ করা উচিত হয় নি। কিন্তু কোনও ভদ্র ঘরের মেয়ে সন্ধ্যায় ছেলেদের পার্টির দাওয়াতে যায়?’ সন্ধ্যায় ছেলেদের পার্টির দাওয়াতে যাওয়া মানেই ধরে নেয়া হয় তারা ধর্ষণের অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। ‘এসব মেয়েরা আসলে ধর্ষিত হতেই যায়।’ ‘ধর্ষণ করা ঠিক হয় নি, কিন্তু আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ধর্ষকের বিচি ছ্যাচে দেয়াও ঠিক না। এ ভীষণ অমানবিক।’ - এই মানসিকতা যতদিন সমাজে থাকবে ততদিন ধর্ষণ নানা ভাবে বৈধতা পাবে।

তিনি আরও বলেছেন, “ধর্ষণের আগেই ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। আসলেই ধর্ষণ হয়েছে কিনা, পুরুষটির ধর্ষণের উদ্দেশ্য ছিলো কিনা- আদালত সেটা কিভাবে প্রমাণ করবে?”

তাহালে আমরা জানলাম, ধর্ষক যে আসলেই ধর্ষণ করতে এসেছিল এটি মহামান্য আদলতে প্রমাণের স্বার্থে ধর্ষিত হয়ে আদালতে যেতে হবে। আগে ভাবতাম মাথায় মগজের জায়গায় বিচি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর পক্ষেই এধরণের কথা বলা সম্ভব। এখন জানলাম,মাথায় মানবতা থাকলেও এধরণের কথা বলা যায়। কত কিছু যে জানার বাকি!

‘মওলানা দূরের পাখি’ নামের একটি আইডি চোর, ছিনতাইকারী, ছেলেধরা সন্দেহে গনপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা অপরাধগুলোর সাথে ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষায় যৌনাঙ্গে আঘাত করার তুলনা দিলেন। চোর ছিনতাইকারীদের সন্দেহ করে গণপিটুনি দেয়া হয়, ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষক যদি আপনাকে লিঙ্গের জোর প্রদর্শন করতে না আসে কেবল ইশারা ইঙ্গিতে ধর্ষণের সন্দেহ করে লিঙ্গ কেটে ফেলা কি সম্ভব? আর যেই স্ট্যাটাসটি থেকে এই ইস্যুর সুত্রপাত সেখানে সারওয়ার সাহেব স্পষ্টই বলেছেন, ওই ব্যক্তি ধর্ষণ করতে গিয়ে লিঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে এনেছেন।

১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের মধ্যে ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে।

২০১০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৪২৭টি। এর মধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে ২ হাজার ৭৩৪টি। গত ছয় বছরে ধর্ষণের পর ৫০৮ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। তবে হত্যা করার পরও সব পরিবার মামলা বা আইনি আশ্রয় নেয়নি। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ২৮০টি ঘটনায়। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৬৮ নারী এবং মামলা হয়েছে মাত্র ১১৩টি।

http://www.prothom-alo.com/we-are/article/813160/

মানবাধিকার ও আইন সহায়তাকারী বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিভিন্ন গণমাধ্যম পর্যলোচনা করে নারী ও শিশু নির্যাতনের নানা ঘটনা সংরক্ষণ করে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৭২৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সী শিশু ৬২ জন, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ১৭৮ জন এবং ১৩ থেকে আঠারো বছর বয়সীর সংখ্যা ২৫১ জন। অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার হওয়া প্রায় সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত মোট ২৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যাদের ২০ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ রকম বিভিন্ন সংস্থার হিসাবেও একথা স্পষ্ট যে ধর্ষণের মতো নির্মম ঘটনার শিকার হওয়াদের অধিকাংশই শিশু।

https://www.jugantor.com/online/national/2017/03/21/42653/

২০১৭ সালটা শেষ হলেই ১৭ সালের তালিকাটাও পেয়ে যাবেন। আমি জানি লেখাটা পড়ার সময় অনেকেই এই সংখ্যার তথ্যগুলো এড়িয়ে যাবেন। এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। কারন এগুলো পত্রপত্রিকায়-প্রশাসনের খাতায় লিপিবদ্ধ হওয়া ধর্ষণগুলোর একটি পরিসংখ্যান মাত্র। ধর্ষণ যখন দেশে নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে, এরকম অবস্থায় কোনও মেয়ে যদি আত্মরক্ষার্থে ধর্ষককে আঘাত করে, সেটা মাথায় হোক কিংবা ধর্ষকের বিচির মাথায় আমি মেয়েটিকে বাহাবাই দিব। কারন সমাজে মেয়েরা নিজেদের সম্পর্কে ‘দূর্বল, কোমল, শক্তি নেই’ ইত্যাদি শুনতে শুনতে অনেক সময় নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তাই ধর্ষনের হাত থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু না করে নিজের শরীরের উপর সকল অত্যাচার নির্যাতন সয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কোনও মেয়ে যদি আত্মরক্ষার্থে ধর্ষককে আঘাত, ক্ষতবিক্ষত করে নিজেকে মুক্ত করতে পারে তাহলে অন্য মেয়েরাও জানবে পাল্টা আঘাতের ক্ষমতা মেয়েদের আছে। পুরুষাঙ্গের গর্বে যারা মেয়েদেরকে দূর্বল, যৌনবস্তু ভাবে তারাও জানবে ওটি হাত, পা, চোখ, মাথার মত নিরীহ একটি অঙ্গ মাত্র। আর বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১০১ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের সময় আত্মরক্ষার্থে ভিকটিম যদি ধর্ষককে মেরে ফেলে বা শরীরের খুব “গুরুত্বপূর্ণ কোনও অংশ” পারমানেন্টলি ড্যামেজ করে দেয়, আত্মরক্ষার অধিকারবলে (Right to Private Defence) সে আইনের পূর্ণ সুরক্ষা পাবে।

নারীবাদীরা কি পুরুষাতঙ্ক ছড়াচ্ছে?

অভিযোগ উঠেছে, অনলাইনের নারীবাদীরা নাকি নারীবাদের নামে পুরুষাতঙ্ক ছড়িয়ে কিশোরীদের পুরুষবিদ্বেষী করে ফেলছে।


যে পোশাকই পরুক, বুকের ওপর ওড়না নামক অতিরিক্ত কাপড়টি মেয়েরা কাদের আতঙ্কে জড়ায়? মেয়ে সময় মত বাড়ি না ফিরলে অভিভাবকের দুঃশ্চিন্তা বাড়ে কাদের আতঙ্কে? কলেজের ছেলে বন্ধুরা কত জায়গায় ঘুরতে যেত। অথচ শহরের ভিতরেই একটা জায়গায় বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায় না, কীসের আশংকায় অভিভাবকেরা অনুমতি দেন না? কাদের আতঙ্কে? ওড়না, হিজাব, বোরকা এতসব পোশাকের বস্তা পরতে হয় কাদের হাত থেকে বাঁচতে? পুরুষাতঙ্ক ছড়ানোর জন্য পুরুষেরাই কি যথেষ্ট নয়? এখন নিশ্চয়ই জিকির ধরবেন, সব পুরুষ এক না। সেটা আমরা খুব জানি। সব পুরুষ ধর্ষণ করেন না। কেউ কেউ করেন। কেউ কনডম পরে করেন, কেউ না পরে করেন। কেউ হোটেলে নিয়ে করেন, কেউ বন্ধুর বাসায় করেন। কেউ সৎ মেয়েকে করেন, কেউ নিজের মেয়েকে করেন। কোনও পুরুষ চিমটি দেন, কেউ খামচি, কেউ আবার ‘পাছা হাতান’। কেউ বাসে হাতান, কেউ রাস্তায় হাতান। কেউ হিজাবে আকর্ষিত হন, কেউ ওড়নায় আকর্ষণ পান। কোনও কোনও পুরুষ আবার খুব ভাল। এসব কিছুই করেন না। এরা বউ নিয়ে থাকেন। ইচ্ছে হলে বউকে চাকরী করার অনুমতি দেন, ইচ্ছা না হলে দেন না। ইচ্ছে হলে বউকে শাড়ি পরান, ইচ্ছা হলে বউএর শাড়ি খুলেন। কাজেই সব পুরুষ কোনও ভাবেই এক হতে পারেন না। কিন্তু সমস্যাটা হল, সব পুরুষই আমাদের সমাজে বসবাস করেন, বিয়ে করেন, সংসার করেন, বউ আছে, বাচ্চা আছে, চাকরী করেন, ফেসবুক করেন, ভালো ভালো স্ট্যাটাস শেয়ার দেন, কমেন্টে ভালো উপদেশ দেন, লাইক দিয়ে পাশে থাকেন। এখন ভালো পুরুষ- খারাপ পুরুষ আলাদা করার উপায় কী? আর ভাল খারাপের সংজ্ঞাটাই বা কী? যিনি ধর্ষণ করেন তিনি খারাপ পুরুষ, আর যারা ধর্ষণের কারণ হিসেবে ভিক্টিমের দোষ খুঁজে বের করেন তারা কী? যিনি এসবের মধ্যে নেই কিন্তু ঘরে বউ নামক একটা সেবাদাসী রাখেন, নিজেরা ইচ্ছেতে বউকে চলতে বাধ্য করেন তিনি কেমন পুরুষ? ছোটবেলায় সমাজ বইয়ে পরিবারের শ্রেণিবিভাগ পড়েছি। ‘আমাদের সমাজের পরিবারগুলো পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। পরিবারের কর্তা থাকেন একজন পুরুষ। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে পুরুষের হাতে।’ পিতৃতন্ত্র ব্যাপারটা বইয়ে পড়তে পড়তে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পিতৃ্তন্ত্রের জায়গায় পুরুষতন্ত্র পড়ে দেখুন। নারীর কর্তা সাজা, নারীকে দাসী বানানো যে সমাজে সামাজিক নিয়ম সে সমাজে ভালো পুরুষটি কে? আর এরকম ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বষী সমাজে পুরুষাতঙ্ক ছড়ানোর দায় নাকি নারীবাদীদের! যেন নারীদের আতংকিত করার মত যথেষ্ট পরিমাণ ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা, অত্যাচার, নির্যাতন এখনও তারা করে উঠতে পারেন নি। আরও কিছু বাকি আছে।

নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে। এরকম খারাপ পরিস্থিতিতেও আশা রাখছিলাম, ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেক মেয়েই এখন তাদের জীবনের কথা লিখছে। নিজের মত করে নারীবাদের চর্চা করছে। সবার মতের সাথে যে আমি একমত তা না। কেউ হিজাব পরে নারীবাদের কথা বলে, কেউ ওড়না পরে। কেউ ধার্মিক, কেউ নাস্তিক। কেউ তসলিমার মতাদর্শকে সঠিক মনে করেন, কেউ করেন না। যার যাই মত থাকুক, তসলিমা নাসরিন একা সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে ‘নারীর কথা, নারী বলবে’ এটার চর্চা শুরু করেছিলেন। এর ফল আমরা সবাই ভোগ করছি।

মেয়েরা কথা বলছে এটা আমার কাছে যখন স্বস্তির বিষয় অন্যদিকে অনেকের কাছে এটিই এখন ভয়ংকর অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো পুরুষ, খারাপ পুরুষ সব একজোট হয়ে এখন মেয়েদের কথা বলা বন্ধের চেষ্টা চালাচ্ছেন। খারাপ পুরুষেরা জোরে করে আর ভালো পুরুষেরা নানান অভিযোগ তুলে। এখানেও আরেকবার প্রমাণিত হয়ে যায় সব পুরুষ এক না।

ভালো পুরুষ, খারাপ পুরুষ নির্বিশেষে উপসংহার টানেন এই বলে যে, নারীরাই নারীর শত্রু। নারী মুক্তিতে যেহেতু তাদের কোনও স্বার্থ নেই, তাই নারীমুক্তির জন্য নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। তারা কি আসলে বলতে চান, পুরুষতন্ত্র যেহেতু পুরুষের স্বার্থ রক্ষা করে তাই তারা পুরুষতান্ত্রিক হবেনই। ধর্ষণ যেহেতু পুরুষকে মজা দেয় তাই পুরুষ ধর্ষণ করবেই। নারীকেই বরং রেখে ঢেকে চলতে হবে? সংসারে নারী পুরুষের অবাধ্য হলে যেহেতু পুরুষ অসন্তুষ্ট হয়ে নারী নির্যাতন করবে, তাই নারী নির্যাতন রুখতে নারীকেই পুরুষের বাধ্য হতে হবে?

পুরুষ চায় পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে। পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে নারীদের দমিয়ে রাখতে হবে। নারীর শরীরকে অশুচি, যৌনবস্তু, মাংসপিণ্ড বলে প্রচার করতে হবে। একইভাবে পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে নারীর কথা বলা বন্ধ করতে হবে। নারীর কথা বলা বন্ধ রাখতে মাঝেমাঝে নারীর দুঃখে চুকচুক করতে হবে, ধর্ষণের কারণে নারীর ইজ্জত-সম্ভ্রম চলে গেল বলে গভীর দুঃখ প্রকাশ করতে হবে, ধর্ষকের ফাঁসির মাধ্যমেই সমস্ত সমস্যার সমাধান করে ফেলার ভান করতে হবে। আমাদের সমাজের তথাকথিত ভালো পুরুষেরা সেটিই করে থাকেন। এরপরেও নারীরা কথা বলতে চাইলে, প্রতিবাদ করতে চাইলে তাদেরকে পুরুষবিদ্বেষী উপাধি দিতে হবে। ভয়ংকর নারীবিদ্বেষী সমাজে বসবাস করে যখন কেউ নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষবিদ্বেষের অভিযোগ তোলে, তখন হেসে বাঁচি না। ধর্মের বিরুদ্ধে বললে যেমন ধার্মিকেরা ধর্মবিদ্বেষী শব্দটি এড়িয়ে মুসলমান বিদ্বেষী কিংবা হিন্দু বিদ্বেষী, খ্রিষ্টান বিদ্বেষী ইত্যাদি অভিযোগ তোলে, তেমনি পুরুষের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বললে পুরুষেরা পুরুষতন্ত্র বিদ্বেষী শব্দটি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলে পুরুষ বিদ্বেষী। একবার ভেবে দেখে না, নারীরা পুরুষ বিদ্বেষী হলে ভ্রূণ অবস্থা থেকে জন্ম নিয়ে, মাতৃদুগ্ধ খেয়ে পুরুষ হয়ে, নারীর দিকে এই অভিযোগ তোলার সুযোগ হতো না।

শফি হুজুররা আসলে কতটা ক্ষমতাবান?

বাংলাদেশের রাস্তায় বের হলে খেয়াল করে দেখবেন রাস্তায় চলাফেরা করছে মানুষদের মধ্যে ৯০ ভাগ পুরুষ, আর ১০ ভাগ নারী। যেন বাইরের জগতটা কেবল পুরুষের। পুরুষের জগতে নারী অনিরাপত্তায় ভুগে।

খুব সকালে যখন কলেজ বাসের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করতাম, তখন যেন একটি অন্য জগৎ দেখতাম। রাস্তার অধিকাংশ মানুষ নারী, বাসের অধিকাংশ যাত্রী নারী। নারী শ্রমিক তারা। বিভিন্ন গার্মেন্টসে কাজ করেন। বাসের হেল্পার তাদেরকে বলতে পারে না, ‘মহিলা তুলি না, মহিলা সিট নাই’।

উচ্চবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ নারীরাই চাকরী করেন না, যেহেতু পরিবারে অতিরিক্ত অর্থের দরকার হয় না। মধ্যবিত্ত পরিবারেরও খুব কম সংখ্যক নারীই চাকরীর সাথে যুক্ত। তবে নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ নারীরাই স্বচ্ছল জীবনের আশায় চাকরী করেন। তাদের শ্রম ও মেধা দেশের কাজে লাগান। সকালে গার্মেন্টসে কাজের জন্য এবং সন্ধ্যায় কাজের ছুটির পর দলে দলে মেয়েরা যখন রাস্তায় হাঁটে, সেই দৃশ্যটি আমাকে মুগ্ধ করে। শুরুর দিকে পথে পথে হাজারো নারীবিদ্বেষী লোকের হেনস্থা ও টিজিং সহ্য করে গার্মেন্টস এর মেয়েরা আজকে এই পর্যায় এসেছে।


মনে আছে, আমরা প্রথম যখন আল্লামা শফি’কে চিনতে শুরু করি, তখন তার একটি ওয়াজের বক্তব্য অনলাইনে ছড়িয়ে গিয়েছিল? শফি তাঁর সেই বক্তব্যে গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকদের সম্পর্কে কী বলেছিলেন মনে আছে? বলেছিলেন, “আপনার মেয়েকে কেন দিচ্ছেন গার্মেন্টসে কাজ করার জন্য? চাকরি তো অনেক করতেসেন। আপনি নিজে করতেসেন, আপনার বউ করতেসে, মেয়েরা করতেসে। কিন্তু কুলাইতে তো পারতেসেন না। খালি অভাব আর অভাব। আগের যুগে রোজগার করত একজন, স্বামী। সবাই মিইলা খাইত। এখন বরকত নাই। সবাই মিইলা এতো টাকা কামাইয়াও তো কুলাইতে পারতেসেন না। গার্মেন্টসে কেন দিচ্ছেন আপনার মেয়েকে? সকাল ৭/৮ টায় যায়, রাত ১০/১২ টায়ও আসেনা। কোন পুরুষের সাথে ঘোরাফেরা করে তুমি তো জান না। কতজনের সাথে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে তা তো জানেন না। জেনা কইরা টাকা কামাই করতেসে, বরকত থাকবে কেমনে?”

মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে গেলে তো আবার শফি হুজুরদের সমস্যা, দরিদ্র অল্প বয়সী মেয়েরা গার্মেন্টসে চাকরী করলে শফি হুজুরেরা বিয়া করার জন্য কচি মেয়ে পাবেন কীভাবে!

যাদের পরিশ্রমের ঘামে ঘুরছে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা, যাদের তৈরী কাপড় পরে হুজুর ওয়াজে যান, যাদের শ্রমের বিনিময়ে রাষ্ট্র বিদেশী মুদ্রা পায়, বিদেশী নানান পণ্য কিনে, সেসব দিয়ে তৈরী হেলিকপ্টারে চড়ে হুজুর সমাবেশে গিয়ে বলে আসেন, মেয়েদেরকে যেন ঘরে বন্দী করে। গার্মেন্টসে তারা ‘জেনা কইরা টাকা কামাই করতেসে’। একটি দেশের অর্থনীতি যাদের জন্য টিকে আছে তাদের’কে অপমান করে এধরণের ঘৃণ্য কথা বলেও সে কীভাবে পার পেয়ে যায়? শুধু যে পার পেয়েছে তা না। পেয়েছে- রেলের জমি, দখল করা পুকুরের মালিকানা, কওমি মাদ্রাসায় তিনি যেসব মূর্খ ও ধর্মান্ধ তৈরী করেন তাদেরকে পাইয়ে দিয়েছেন মাস্টার্সের সমমান সনদ।

প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রী, সরকারি আমলা, বড় বড় ব্যবসায়ী, পুঁজিপতি, এনজিও কর্তা সবার ঠাটবাট এইসব নারী শ্রমিকদের ১২ ঘন্টা শ্রমের ঘামে গড়া। দেশ চালানোর অর্থ আসে শ্রমিকদের কাছ থেকে, আর দেশ চালানোর পদ্ধতি আসে শফি হুজুরের কাছ থেকে। আর শফি হুজুরের আদর্শ বাস্তবায়নে হুজুরের ব্যক্তিগত পুতুল হিসেবে চেয়ারে বসেছেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!

হাসিনা ভোট পাবার আশায় নয়, বিএনপির ভোট কাটার আশায় শফি হুজুরের সাথে আপোষ করছেন। শুনেছি, আগামী নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের কিছু নেতা ৩০টি আসনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবেন। তবে হেফাজত’কে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন প্রমাণ করতে তারা দলের নাম ব্যবহার করবেন না। হাসিনা যদি ধারণা করে থাকেন যে ওই ৩০টি আসনে বিএনপির ভোটগুলো ভাগ হয়ে কিছু হেফাজতের কাছে কিছু বিএনপির কাছে যাবে এবং বিএনপি এতে হেরে গেলেই হাসিনার জয় নিশ্চিত হয়ে যাবে, তবে হাসিনা খুব ভুল ভাবছেন। ৩০টি আসনে যেসব হেফাজতের নেতারা দাঁড়াবেন, তারা কেউ নিজেরা নিজেদেরকে ভোট দিবে কিনা আমার সন্দেহ হয়। হাসিনার মত একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ কি এটা বুঝেন না? ভোট নিয়ে হাসিনার এত চিন্তা! যার জন্য তিনি শফি হুজুরের মত একজন নোংরা লোকের সাথেও আপোষ করতে প্রস্তুত। কিন্তু ভোট নিয়ে তিনি এত ভাবছেন কেন? যারা হৈ-চৈ, দাঙ্গা- হাঙ্গামা করে নিজেদের সংখ্যা জানান দেয় তাদের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। সংখ্যায় কম বলেই সবসময় কোনও না কোনও ঝামেলা সৃষ্টি করে রাস্তায় জড়ো হয়ে নিজেদের সংখ্যা ও ক্ষমতা দেখাতে চায় তারা। সংখ্যায় এই নগণ্য গোষ্ঠীর সন্ত্রাস আর লুটপাট করা ছাড়া তেমন কোনও ক্ষমতা নেই। যদিও তাদের সন্ত্রাসী ও লুটপাটের ক্ষমতার গুণেই আড়ালে চলে যায় আসল ক্ষমতাবান মানুষেরা, যারা বাঁচিয়ে রাখছেন দেশটাকে।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত করেছেন বলে গর্ব করে জানান। কাদের ক্ষমতায় বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ? বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান দুইটি খাতের প্রথম হল গার্মেন্টস শিল্প এবং দ্বিতীয় প্রবাসী শ্রমিক। যাদের ক্ষমতায় হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশ বানানোর স্বপ্ন দেখেন তাদের ক্ষমতা হাসিনার নজরে আসবে কবে? কবে থেকে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের ভোটের মায়া ভুলে আসল ক্ষমতাবানদের ভোটের জন্য হাসিনা রাজনীতি করবেন?