শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৪

সমাজের সব উদারতা কি কেবল পুরুষদের জন্য?


আমার লেখাটির শুরুতেই তসলিমা নাসরিনের নির্বাচিত কলামের একটি কলাম উল্লেখ করছি-

প্রোসটেট নামে পুরুষের শরীরে একপ্রকার গ্ল্যান্ড থাকে পঞ্চাশের অধিক বয়স বিশেষত ষাট সত্তর বছর বয়সে পুরুষের প্রোসটেট গ্ল্যান্ড আকারে বড় হয় প্রোসটেট গ্ল্যান্ড, দুটো হরমোনের গতিবিধি পরিচালনা করে একটি এন্ড্রোজেন, অপরটি এস্ট্রোজেন বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে এন্ড্রোজেন হরমোন ক্রমশ কমে আসে কিন্তু এস্ট্রোজেন একই অনুপাতে কমে না এস্ট্রোজেন হরমোনের আধিক্যে প্রোসটেট গ্ল্যান্ড বড় হয়ে যায়, মোদ্দা কথা এন্ড্রোজেন এবং এস্ট্রোজেন হরমোন দুটোর পরিমাণগত অসামঞ্জস্যই প্রোসটেট বড় হওয়ার মূল কারণ

এই রোগের প্রধান উপসর্গ ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ, প্রথমে রাতে, এরপর রাত এবং দিন উভয় সময়ে পুনঃ পুনঃ এবং দুতিন ফোঁটা প্রস্রাবের অস্বস্তি, তার উপর প্রস্রাব করার সময় বিষম জ্বালাপোড়াও অনুভূত হয় নিজ ইচ্ছায় প্রস্রাবের আরম্ভ, গতি ও সমাপ্তি ঘটানো সম্ভব হয় না ধীরে ধীরে কিডনি আক্রান্ত হলে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় প্রস্রাব শুরু ও শেষ হওয়ার সময় কিছু রক্ত যাওয়াও এসময় বিচিত্র কিছু নয় প্রোসটেট বড় হওয়ার প্রথম দিকে পুরুষের যৌন উত্তেজনা হঠাৎ বৃদ্ধি পায় যদিও শেষদিকে পুরুষত্বহীনতাই স্থায়ী হয়

মজার ব্যপার হচ্ছে, বুড়ো কুকুরের মধ্যেও প্রোসটেট বড় হওয়ার লক্ষন খুব দেখা দেয় প্রোসটেট উপরের দিকে ঠেলে বড় হওয়ার কারণে কুকুরের মলনালী সঙ্কুচিত হয় এর ফলে মলনালী সারাক্ষণ ভরা ভরা ঠেকে এবং মলত্যাগের যে চেষ্টা বুড়ো কুকুরেরা করে যায় তা অর্থহীন এবং যন্ত্রণাদায়ক প্রোসটেটের পরিবর্ধন এবং প্রতিকার আমার বিষয় নয় আমার বিষয় প্রোসটেট হঠাৎ রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণে ষাট-সত্তর বয়সের সেইসব বুড়ো পুরুষ, যারা কামোদ্দীপনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠে অনেকে এই বিয়েকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য নানারকম যুক্তি তৈরি করেন যেমন বুড়ো বয়সে যত্ন করবার কেও নেই অথবা আমাদের রসুলুল্লাহ নবী, দৃষ্টান্ত দিয়ে গেছেন-ইত্যাদি শারীরিক অসুস্থতার কারণে সাময়িক যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, তাই তারা কোনও বয়স্ক মহিলা নয়, কিশোরী থেকে যুবতী পর্যন্ত মেয়েদের বিয়ে করবার আগ্রহ প্রকাশ করে

পৃথিবীর যত বুড়ো রোগী এই অবস্থায় বিয়ে করে, সাময়িক কামোত্তেজনা নির্বাপিত হলেই তারা পুরুষত্বহীনতায় ভোগে তখন সেইসব বালিকা, কিশোরী এবং যুবতীর জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে আসে তা এমন কেউ নেই যে না জানে এমন কে আছে যে জানে না একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে সচ্ছলতার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়, শেষ অবধি সেই মেয়ে জীবনের দায়ভার অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে কেবল দুটো ভাত-কাপড়ের জন্য কি নির্মম ভাবে বেঁচে থাকে!

(নির্বাচিত কলাম--তসলিমা নাসরিন, পৃষ্ঠাঃ ২৬-২৭)
-------------------------------------------

রেলমন্ত্রীর বিয়ে করার মূল কারনটা সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে আশা করি
অনেকে বলছেন, 'রেল মন্ত্রীর ইচ্ছা হয়েছে বিয়ে করার, করছে, উনি তো কাউরে কামড়াইতে যায় নায়, আপনাদের সমস্যা কোথায়?' আমি ও মানি যে মন্ত্রীর ইচ্ছা হয়েছে উনি বিয়ে করতেই পারেন, তার স্বাধীনতা আছে বিয়ে করার বর্তমানে রেলমন্ত্রীর বিয়ের ঘটনায় মন্ত্রী কিছুটা সমালোচিত হয়েছেন বটে, কিন্তু তাকে বিয়েতে কেউ বাঁধা দিতে যাচ্ছে না কোন মূর্খের দল 'নষ্ট পুরুষ' বা 'সমাজে বিশৃঙ্খলাকারী পুরুষ' উপাধি দিয়ে শ্লোগান দিয়ে তার বিরুদ্ধে মিছিল করতে যাচ্ছে না, তাই ভোট হারানোর ভয় না থাকায় সরকার ও তাকে শুভেচ্ছা জানাতে যাচ্ছে

কিন্তু ভাবুন তো ৬৭ বছরের রেলমন্ত্রী যদি একজন নারী হত, ২৮ বছরের একজন যুবককে বিয়ে করত, এখন রেলমন্ত্রীর জন্য যে উদার সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, নারী মন্ত্রীর ক্ষেত্রে এই অতি উদার-ব্যাক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সমাজ (?) সেটা মেনে নিত?

কখনই না আমার সমস্যা হল ঠিক এইখানে কোন নারী, সে কুমারী হোক আর যাই হোক ৬৭ বছর বয়সে বিয়ের কথা ভবাতেই পারতো না, কারন সে বিয়ের কথা তুললেই সমাজে তার আর মুখ দেখানোর অবস্থা থাকবে না, তাকে নষ্ট- বেশ্যা- খাঙ্কি- মাগী বুড়ি এইসব উপাধি দেয়া হত শুধু সমাজই নয়, এখন যে মন্ত্রীসভার লোকেরা গিয়ে রেলমন্ত্রী কে শুভেচ্ছা, অভিবাদন জানিয়ে এলো, সেই মন্ত্রী সভাই হইত, নারী মন্ত্রীর ক্ষেত্রে তাকে মন্ত্রীসভা থেকে বাতিল করতো, সমাজের মূর্খদের দাবী রক্ষার্থে

আমাদের সমাজের সব উদারতা, ব্যাক্তি স্বাধীনতা কেবল পুরুষদের জন্য, অথচ এই সমাজের কারিগর হল নারী নারীর তৈরি সমাজে নারীকে পুরুষেরা নিজেদের হাতে বন্দী করে রেখে, নিজেরা ভোগ করছে সব ধরনের স্বাধীনতা!!! সমাজে যারা নারীবিরধী কাজগুলো করে তারা ভুলে যায় যে, তারাও একজন নারীর গর্ভ থেকে সৃষ্ট নারী বিরোধী পুরুষ গুলোকে তাই নিমক হারামের জাত বলতে আমার একটু ও আপত্তি হয় না

রেলমন্ত্রী'কে সমালোচনা করে আমি কিছুই বলছি না... কিন্তু একজন নারী যদি এইরকম করে.. তাহলে সমাজ সেটাকে কিভাবে নেয় সেটা বোঝানোর জন্যই আমি লিখেছি মানে সোজা কথায় সমাজে নারী'র অবস্থা বোঝানোনোর জন্য আমি লিখেছি, রেলমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনা করা কোন ভাবেই আমার  লেখার উদ্দেশ্য নয় রেলমন্ত্রী তো তাও তুলনামূলক ভাবে অনেক ভালো মানুষ চিরকুমার থেকে রাজনীতি করে গেছেন, তার বিরুদ্ধে তেমন দুর্নীতির অভিযোগ ও শুনি নি কিন্তু সাবেক প্রেসিডেন্টে এরশাদের কথা যদি বলি? এরশাদের এত কাণ্ডের পরও সে বাংলাদেশের একজন জনপ্রতিনিধি, সে কেবল একজন পুরুষ বলেই সম্ভব

নির্বাচিত কলামের ওই লেখাটুকু তসলিমা নাসরিন ১৯৮৬ সালের দিকে লিখেছিলেন, কিন্তু কি দারুন মিলে যায় আমাদের সমাজে এরশাদের মত লোকেদের জীবনের সাথে তসলিমার কথা গুলো বাস্তব সত্য বলেই তাকে সইতে পারে না পুরুষগুলো কারন তাদের ভালো মানুষের মুখোশ টেনে ছিড়ে ফেলার জন্য তসলিমা একাই যথেষ্ট তাই তো ওরা ভয় পায় তসলিমার কলম'কে। তাকে দেশে ফিরতে দেয় না নিজেদের ভণ্ডামি ধরা পরার ভয়ে








মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৪

ঢিল ছুঁড়লে পাটকেলটি খেতে হবে, আমি 'সুইট সিক্সটিন' নই, 'ডেঞ্জারাস সিক্সটিন'

কিছুদিন আগে 'ডিঅক্সি রাইবোনিউক্লিক এসিড' নামে একটি আইডি থেকে ম্যাসেজ আসে
ম্যাসেজটি হলঃ ''আপনি অনেক শুন্দরী ভালবেসে ফেলছি আপনাকেআপনি এত মেয়ে থাকতে তসলিমা মাগির গুনগান করেন কেন?ওকে লাথি মারেন ''

আমি তসলিমা পক্ষে কাজ করি, তসলিমা নাসরিনকে ভালোবাসি আর কোথাকার কোন ছাগল এসে বলে, 'ওকে লাথি মারেন' সে তসলিমা নাসরিনকে অপমান করছে তাও আবার আমার ইনবক্সে এসে যাই হোক লাথিটা আমি ওই ছাগল টাকেই মারলাম

আমি রিপ্লায় দিলাম, ''তর ভালবাসা'র গুষ্টিরে চুদি আমি....'' ছাগল গেল ক্ষেপে
সে জবাব দিলো, ''আমাকে কেমনি চুদবি খানকি মাগি?তোর মাংগে কুত্তাও চুদবে নাআর কিছুদিন পরে তোকে জনগন লাথি দিবেতুই পোলা,মাইয়া না হিজরাতোর তো দুধ নাইতসলিমার কথা অনুসারে ৪-৫ টাকে চোদা দিয়ে তারপর ভালটাকে বিয়া করিস''

পাল্টা উত্তরে আমি লিখলাম, ''ক্যামনে চুদমু ? যখন লাত্থির চোটে বিচি ফাটাইয়া দিয়া আন্ডা বিচির রস সব বাইর কইরা দিমু তখন বুঝবি..'' এই বলে ব্লক করলাম এইসব ছাগলের পালের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার সময় নেই

তারপর রাতের দিকে সে Hridoy Khan নামে একটা আইডি থেকে ম্যাসেজ দিলো,
''বেশ্যা মাগিমেসেজ দিয়া ব্লক মারিস কেনআমি কি তোর মায়ের ভাতারখানকি মাগি তোর মাংগে এসিড ঢালবোতোর মুখে গরম বির্য দিবতুই চুষে খাবিতোকে কুকুর দিয়ে চুদে নিবোতোর চেহারা কুকুরের মততসলিমাকে ওর খালু মামা চুদিছিলতুই ও বাপ ভাই দিয়ে চুদে পেট করিসনা পারলে রিকশাচালক দিয়ে চুদে নিসমাগি'' এই বলে সেই এইবার ব্লক দিলো আমাকে

আমার ইনবক্সে এসে নোংরামি করে এইবার সে স্ট্যাটাস দিলো, 'ইতু ইত্তিলা নামে এক নাস্তিক মাইয়া আমারে গালি দিয়া ব্লক মারছে মাইয়া মানুষের মুখ এত খারাপ জানা ছিল না'

ছাগল ক্ষেপার কারন বুঝতে পারলাম সে ভেবেছিল গালি দেয়া পুরুষের একচেটিয়া অধিকার ' মাইয়া মানুষ' গালি দিতে পারে না, 'মাইয়া মানুষের' মুখ খারাপ করতে নেই পুরুষেরা মেয়েদের খাঙ্কি মাগী যা খুশি বলে গালি দিবে, আর মেয়েরা নিজের চরিত্রে কালি লাগার ভয়ে চুপ করে থাকবে আর মেয়েদের এই চুপ করে থাকাকে নোংরা পুরুষগুলো নিজেদের জয় বলে ধরে নিবে এবং তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে এইসবেই তারা অভস্থ্য কিন্তু হটাত এমন পাল্টা গালি খাবে বুঝতে পারে নি আমাকে চিনতে ভুল করেছে সে 'নাস্তিক মাইয়া'রে ভালোবাসা জানানোর আগে সেটা ভাবা দরকার ছিলও হারামজাদাটার

ভেবেছে আমি বুঝি 'সুইটসিক্সটিন'। আমি সুইট সিক্সটিন নই আমি 'ডেঞ্জারাসসিক্সটিন'
সে আমাকে বাজে ভাষায় গালাগালি করে, ধর্ষণের হুমকি দিয়ে, উল্টা আমাকে নিয়ে পোস্ট দিয়েছে তার ম্যাসেজের স্ক্রিন শর্ট সহ কমেন্ট করল আমার বন্ধু সাজু ও পাল্লা দা , সে পাল্লা ও সাজুর কমেন্ট ডিলিট করে এবং তাদের ব্লক করে সেখানে 'নাজমুল হোসাইন ইরফান' নামে একজন একজন কমেন্টে বলে যে , সে নাকি আমাকে খুঁজছে, বাট পাচ্ছে না বাপ্পি নামে একজন কমেন্ট করে যে, সে ও নাকি ভুক্তভোগী, তাদের নাকি কিছু একটা করা দরকার, কি করা যায় সেটা নিয়ে প্ল্যান করছে 'ডিঅক্সি রাইবোনিউক্লিক এসিড' এর উত্তরে জানায় যে, সে একটু বিজি আছে ব্যাংকের পরীক্ষা নিয়ে ফ্রি হলেই নাকি আমাদেরকে ধরবে, আমাদেরকে শান্তিতে থাকতে দিবে না ডিঅক্সি'র প্রোফাইল দেখে জানতে পারলাম সে গন জাগরণ মঞ্চের সাথে জড়িত সে Blogger and Online Activist Network -BOAN এর মেম্বার তার আইডিটি পাবেন এই লিঙ্কে, ডিঅক্সি

আমি অনলাইনে লেখালিখি করি, আমার মূল বিষয় নারীবাদ, আমি তসলিমা পক্ষ করি এতে তাদের খুব অসুবিধা করে ফেলেছি আমি ছাগল কে নিয়ে কিছু লিখতাম না ছাগল ছাগলামী করবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু কয়েকদিন আগে আমার আরেক বন্ধু 'অপ্রিয় বচন' কে একটি আইডি থেকে কিছু আজেবাজে ছবিতে ট্যাগ করা হয়, সে ও নারীবাদ নিয়ে লিখালিখি করে আমার বন্ধুটি এসব দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে ফেইসবুকে নারীবাদ নিয়ে লিখে এমন মেয়েদেরকে দমানোর জন্য তাদেরকে গালি দিয়ে, উল্টাপাল্টা কমেন্ট করে, ছবি দিয়ে মানসিক ভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করে অনেক মেয়েরা এতে ভয় পেয়ে যায়, তারা এসব অপমান মুখ বুজে সহ্য করে, লেখালিখি বন্ধ করে দেয় কারন লোকে তো ওই মেয়েরই দোষ খুঁজে বের করবে চরিত্র তো মেয়েদেরই নষ্ট হবে, সে কিছু করুক আর না করুক, পুরুষের চরিত্র নষ্ট হবে না হাজারো অন্যায় করলেও কারন পুরুষের চরিত্র রক্ষা করতে পুরুষকে রক্ষা কবচ পরিয়েছে স্বয়ং ঈশ্বর, ধর্ম গুলো পুরুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে সমাজ-রাষ্ট্র সেসব মেনে নিয়ে নিয়ম কানুন বানিয়েছে


আমার আশেপাশের সাহসী বন্ধুরা যারা অনলাইনে লেখালিখি করেন, তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা এইসব মূর্খদের ভয়ে চুপ হয়ে যাবেন না যেনও আপনারা চুপ হয়ে গেলে জয় ওদেরই হবে বরং সাহসের সাথে এসব নোংরামি মোকাবেলা করুন এরপর আরেকটা ছাগু যেন আপনাকে গালি দেয়ার আগে ১০ বার ভাবে এমন ভাবে জবাব দিন, পুরুষতন্ত্রিক সমাজের তৈরি তথকথিত চরিত্র নিয়ে ভাববেন না

     স্ক্রীন শর্ট ১


স্ক্রীন শর্ট ২


রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৪

আমার আমি এবং তসলিমা নাসরিন‘কে নিয়ে আমার অদ্ভুত কিছু অনুভূতি..


আমার জন্মের আগে আমাকে নিয়ে পরিবারে জল্পনা কল্পনা চলছিল, বংশের প্রথম সন্তান। ছেলে হবে নাকি মেয়ে। বাবা কাকাদের ইচ্ছা, মেয়ে হোক। মায়ের ইচ্ছা ছেলে। যাই হোক, হলাম মেয়ে। তাই বাবা আমাকে যেভাবে দেখতে পছন্দ করতেন সেইরকম পোশাক পড়িয়ে আনন্দ পেতেন। আর মা মায়ের পছন্দ মত জিন্স টিশার্ট পড়িয়ে আনন্দ পেতেন। যেহেতু প্রথম সন্তান, তাই আদর যত্নের শেষ নেই। যখন যা চাইতাম, তাই পেয়ে যেতাম। প্রচণ্ড জেদী ছিলাম। আমার কথায় সবাই জি হুজুর, জি হুজুর করতো।

আমার জীবনের আটটি বছর আমার মায়ের চাকরির কারনে মামার বাড়ি কাটিয়েছি। গ্রামের গাছে গাছে বানরের মত লাফালাফি করার জন্য বিখ্যাত ছিলাম। ক্রিকেট খেলতাম, খালি গায়ে কাঁদা মাখামাখি করে হৈ হুল্লোড় করতাম সবার সাথে।

ধীরে ধীরে বড় হচ্ছি আমি। আমার নিজের ইচ্ছা, নিজের স্বাধীনতা জন্ম নিচ্ছে মনের মধ্যে। পোশাকের ক্ষেত্রে বাবা মায়ের পছন্দ আমার কাছে প্রধান্য পাচ্ছে না। প্রাধান্য পাচ্ছে আমার ইচ্ছা,আমার সুবিধা। যেহেতু টি শার্ট জিন্স পড়তে অভ্যস্ত ছিলাম, তাই আমি বুঝতাম এই পোশাকের সুবিধা। আমি এই পোশাকেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। সাথে সাথে বাঁধা পাচ্ছি সমাজের মানুষ গুলোর কাছ থেকে।
বাবা বলে, তোমার ওই আঙ্কেল কি বলেছে দেখেছ? তুমি এখন বড় হচ্ছ, এই পোশাক আর পড়বে না। তোমার জন্য সুন্দর সুন্দর জামা কিনে দিবো, টিশার্ট জিন্স এইসব না। আগেই বলেছি জেদী ছিলাম। আমি মানতাম না। আস্তে আস্তে আমার খেলাধুলায় বাঁধা সৃষ্টি হল।

মা'র চাকরি বদলি করিয়ে চিটাগাং শহরে এলাম। আমরা যেই বিল্ডিং এ থাকতাম তার নিচে একটু খানি খোলা জায়গা ছিল, সেখানে পাশের বাসার ছেলেদের সাথে খেলতাম। লোকে বলতে লাগলো ওই বাসার মেয়েটা ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলে, ছেলেদের মত ড্রেস পড়ে এইসব।
স্কুলের ফ্রেন্ডরা দেখি আমার মত না, খালি ভয় পায়, এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না। আমি বলি একবার করেই দেখ না। স্কুলের টিচাররা বলতো, মেয়েরা এমন দুষ্ট হতে আগে দেখি নি (এখন কলেজের স্যাররা বলে, তাদের কলেজে এমন অনেক কাজ কখনও কোন মেয়ে করেনি এমন সব কাজ আমি ইতিমধ্যে করে ফেলেছি)। আমার মধ্যে একটা ভাব ছিল, '' আমার কিছু যায় আসে না'' টাইপ।

আস্তে আস্তে সবাই একসাথে বলা শুরু করল, এইবার অন্তত তোমার পোশাক বদলাও। আমি বলি, বদলানোর প্রয়োজন দেখি না। আমার যেমন খুশি তেমন থাকবো, তোমাদের প্রবলেমটা কোথায়?? ধর্মের কুসংস্কার আমাকে দমিয়ে রাখতো বলে, ধর্মমুক্ত হয়েছিলাম তখন থেকেই।

কে যেন একবার বাবাকে বলল, আপনার মেয়ে তো দেখি তসলিমা নাসরিন হয়ে যাচ্ছে। তখন আমি ক্লাস ৫ এ পড়ি। ভাবলাম, তসলিমা নাসরিনটা কে? বাবার বুক সেল্ফ ঘাটতে ঘাটতে কিছু বই দেখলাম, বই গুলোর লেখকতসলিমা নাসরিন লজ্জা বইটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। লজ্জা পড়ে মূলভাব বুঝলেও কিছু শব্দ তখন বুঝে উঠতে পারি নি। যেমন পেনিস শব্দটি দেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা পেনিস মানে কি?? বাবা বললেন, এই বই পড়ার বয়স নাকি আমার হয়নি, বড় হলে জানতে পারব।। তারপর কিছুদিন কেটে গেল, আমি নিজের মত করে আমার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম। আর চারপাশের মানুষ গুলোর আচরণ দেখে অবাক হচ্ছিলাম।

তারপর আবার আরেকদিন আরেকটা বই নিয়ে বসলাম তসলিমা নাসরিনের। বই এর নাম ''নিমন্ত্রন'' নিমন্ত্রন পড়ে তো আমি হতবাক!!! মেয়েরা সুদর্শন ছেলে দেখে প্রেমে পড়ে এবং সেই ছেলের দ্বারা প্রতারিত হয়ে তার বন্ধু-বান্ধবদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। আমি সচেতন হয়ে গেলাম তখনই। এরপর একের পর এক তসলিমা নাসরিন এর আরও কিছু বই যেমন: শোধ, অপরপক্ষ, নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য, যাবো না কেন? যাবো, নির্বাচিত নারী, নির্বাচিত কলাম নামক বইগুলো পড়ে শেষ করলাম। বাবার বুক সেল্ফে যা বই থাকতো, সমরেশ মজুমদার, হুমায়ূন আজাদ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, প্রবির ঘোষ, আরজ আলী মাতুব্বর, জাফর ইকবাল........... সব লেখকের বই পড়ে ফেলতাম। বাবাকে বলি তসলিমা নাসরিনের বই কিনে দিতে। বাবা বলেন, তসলিমা নাসরিনের বই এখানে তেমন পাওয়া যায় না। এতদিন তসলিমা নাসরিনের তেমন কোন ছবি দেখি নি। একটা বইয়ের পিছনে দেখেছিলাম,ছোট ছবি। কিন্তু 'আমি ভালো নেই তুমি ভালো থেকো প্রিয় দেশ' বইটাতে প্রথম তসলিমা নাসরিনের বড়-স্পষ্ট একটি ছবি দেখলাম। ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। ছবি দেখে আমার বেশ পছন্দ হল, ভাবলাম আমি যদি উনার মত হতে পারতাম!!!

তারপর আস্তে আস্তে ক্লাস-এইট এ উঠলাম। এর মধ্যে আমি আমার বাবার বুক সেল্ফের বইগুলো ৪ থেকে ৫ বার রিভিশানও দিয়ে দিয়েছি, তসলিমা নাসরিনের বই গুলোও। যতই পড়ি, আরও ভালভাবে বুঝি। বন্ধুদের পাল্লায় পরে হুমায়ুন আহমেদ এর বইয়ের নেশায় পেলো। স্কুলের বন্ধুরা জানে আমি গল্প বইয়ের পাগল। কারো গল্প বই লাগলে আমার কাছে আসতো। আমি তাদেরকে তসলিমা নাসরিনের বই দিতাম। তারা বলে গল্পের বই দে, গল্প। মজার মজার গল্প। কি আর করার, তখন আবার হুমায়ুন আহম্মদ, গোয়েন্দা বই দিতাম তাদের।
এর মধ্যে আমার এক বন্ধু আর আমি দুইজনে মিলে একটা ফেইসবুক আইডি চালাতাম। কিন্তু আস্তে আস্তে ওর পছন্দ আমার ভাল লাগছিলো না। আমার একটা নিজের ফেইসবুক আইডি খুলি। নিয়মিত বসি না ফেবুতে। দুই তিন মাস পরে হটাত মনে পরতো যে আমারও একটা ফেবু আইডি আছে।

ক্লাস-৯ এ আস্তে আস্তে ফেবু কি বুঝে উঠতে শুরু করলাম। ইন্টারনেট নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। আমার প্রিয় মানুষ, তসলিমা নাসরিনকে খুঁজতে শুরু করলাম। এর মধ্যে রেজাল্টে বাবার আশা পূর্ণ না হওয়ায় বাবা নেট কেটে দিলো, ক্লাস টেনের মাঝামাঝি সময়ে আবার নেট কানেকশান লাগালে, আমি আস্তে আস্তে অনলাইন জগত নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। তসলিমা নাসরিনের যা কথাবার্তা ভিডিও পেতাম সব লোড করে নিতাম। এরই মাঝে mean sazu নামে একটা আইডি পেলাম যার আইডিতে, তার মুল কভার পিকচারে, তার স্ট্যাটাসে এবং তার ছবির এ্যালবামে তসলিমা নাসরিন এর অনেক ছবি। বুঝলাম সেও তসলিমা ভক্ত। সাজুর কাছে জানতে পারি, তসলিমা নাসরিন টুইটারে twitter একটিভ, আমিও একটি টুইটার আইডি খুলি। সাজুকে তসলিমা নাসরিন চিনতেন, তার কথায় তনা আমাকে টুইটারে ফলো দিলেন। আমার আনন্দ আর দেখে কে! তখনও আমি নিজে কোনও লেখালেখি করিনি।

আমার বন্ধুরা সারাদিন অনলাইনে আড্ডা, ফাইজলামি করতো। কিন্তু ওদের ওইরকম মজা গুলো আমার ভালো লাগতো না। নারীবাদী একটা পেইজে আমাকে এডমিন বানিয়ে দিলো একজন। আমি সেখানে লিখতাম। আমার বন্ধুরা কেউ জানতো না সেসব। আমার নারীবাদ আর ওই ব্যাক্তির নারীবাদে অনেক পার্থক্য ছিল। তাই ওই পেইজ থেকে আমি সরে আসি।

এরপর আমি নিজের আইডি থেকেই লেখালেখি শুরু করি। এরপর তসলিমা পক্ষ পেইজ খুলি। (আমদের পেইজ মেম্বার এখন দশ হাজারেরও উপরে ছাড়িয়ে যায় অল্পদিনেই)। টুইটারে তসলিমা নাসরিনের সাথে একটা দুইটা কথা বলতে পারি। আমার সীমাহীন আনন্দ, তসলিমা নাসরিনের সাথে কথা বলছি!! আমার স্বপ্নের মানুষটি, যাকে আমি এত এত ভালোবাসি। অন্যরকম এক অনুভূতি।

আমার লেখালিখির এক পর্যায়ে  Etu's Voice নামে একটি পেইজ খুলি। তসলিমা পক্ষের পাশাপাশি ইতুস ভয়েজ পেইজে চলছে আমার ব্যাক্তিগত চিন্তাভাবনার জগতের লেখালিখি। আমার যা কিছু ভালো লাগা, আমি মেয়ে বলে যা সব বাঁধা পাই সমাজ ও পরিবার থেকে সেসব নিয়ে লিখতে থাকি, অনেক বাঁধা আমি ছোটবেলা থেকে জেনে না জেনে যুদ্ধ করে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, আমার বাবা মাকে আমার সমর্থনে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আমার আশেপাশে মেয়েরা তা পারে নি, তাদের জন্য লিখি।

আর তসলিমা পক্ষে কাজ করতে করতে বুঝে উঠতে থাকি তসলিমাকে। আসতে আসতে আবিস্কার করতে থাকি একটি মানুষ সারাটি জীবন কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছেন সমাজ সংস্কারের জন্য, দেখি আমাদের সমাজের মানুষ গুলো কত নোংরা। মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে, একটা মানুষ যে কারো কোন ক্ষতি করতে যায় না, কারো সাতে ও নেই পাঁচে ও নেই এমন একটা মানুষকে নিয়ে কতরকমের অপপ্রচার হতে পারে, মানুষের প্রশংসার পাশাপাশি চারপাশ থেকে ভেসে আসে বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ শব্দ। বাংলা অভিধানে কতপ্রকার গালি আছে, প্রগতিশীল মানুষ কত প্রকার ও কি কি........ এইসব দেখছি, শিখছি........

Etu's Voice কে যারা ভয় পাচ্ছে, তারা আমাকে নিয়ে কুৎসা রটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু আমার কিছু যায় আসে না, আমি তসলিমা নাসরিনের 'চরিত্র' 'ও মেয়ে শুনো' কবিতাগুলো বারবার নিজেকে নিজে বলি। মাঝে মাঝে আমার লেখা গুলোতে তসলিমা নাসরিনের লাইক পাই। মাঝে মাঝে টুইটারে, ফেবুতে একটি দুইটি পোস্ট শেয়ার করেন। বুঝি যে উনি পড়েছেন। ভালো লাগে খুব। কালকে দুঃখে একটি স্ট্যাটাস লিখলাম, তসলিমা নাসরিন কে নিয়ে অপ্প্রচারের বিরুদ্ধে। লেখাটির শিরোনাম ছিল- 'তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি বিবেকবান বোধবুদ্ধি সম্পন্ন সচেতন মানুষদের প্রতি'মেয়েরা নাকি তসলিমা বিরোধী, সেটা নিয়ে লিখি, অনেকে প্রশ্ন করে তসলিমা পক্ষের কাজ কি, সেটা নিয়ে লিখি। সবাই ঈদ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারনে আমার লেখাটি অনেকেরই নজরে পরে নি।

গতকাল রাত ২ টা বা তার বেশি। আমার মাথা ব্যাথা করছিলো প্রচণ্ড, ঘুমাতে পারছিলাম না। কি মনে করে যেন বালিশের পাশে থাকা মোবাইলটা নিলাম, ফেবুতে লগইন করলাম। দেখলাম তসলিমা নাসরিন, আমার লেখাটি শেয়ার করলেন। ভালো লাগলো। তখন খেয়াল করি নি, উনি কি লিখেছেন আমার সম্পর্কে।

তারপর হটাত খেয়াল করলাম উনি লিখছেন, '' ইতু, তুমি এত ছোট্ট একটা মেয়ে! মাত্র সতেরো বছরে পা দিয়েছো কী দাওনি। কিন্তু এত ভালো লেখ, এত ভালো বোঝো। মাঝে মাঝে সত্যি অবাক হই। অনেক বড় হবে, দেখে নিও।''



বারবার পড়লাম লেখাটি। মাথা ব্যাথাটা হাওয়া হয়ে গেলও। এত খুশি লাগলো যে, সকাল হতেই মাকে বললাম। দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছি বলে মা বকাবকি করছিলো তসলিমা নাসরিন কি বলেছেন সেটা মা কে বলাতে, মা একটু খানি হাসি দিয়ে চলে গেলেন রান্না ঘরে। আর আমি আনন্দে কি করব বুঝতে না পেরে, দাঁত ব্রাশ করতে গেলাম। আর ভাবতে লাগলাম, খুশি , আনন্দ ,মানে যদি ঈদ- পূজা- বড়দিন- পূর্ণিমা হয়, তবে আজকে আমার ঈদ- আজকে আমার পূজা- আজকে আমার বড়দিন- আজকে আমার পূর্ণিমা।