সোমবার, ১৩ জুন, ২০১৬

ট্যাবুঃ সমকামিতা, পিরিয়ড!

১. আমেরিকার ফ্লোরিডায় সমকামীদের ক্লাবে মুসলমান জঙ্গির বন্দুক হামলায় নিহত ৫০, আহত ৫৩। ফ্রান্সে বোমা হামলা, বেলজিয়ামে হামলা, বাংলাদেশে প্রতিদিন সংখ্যালঘু-নাস্তিক-প্রগতিশীলদের হত্যা। প্রতিদিন এত এত মানুষের মৃত্যুর খবর, অসহনীয় হয়ে উঠছে দিন দিন। ধর্ম নামক একটি রূপকথা প্রতিষ্ঠা করতে এই হত্যাযজ্ঞ! ভাবা যায় না, একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ এসব রূপকথায় বিশ্বাস করে সহিংসতা করে বেড়াচ্ছে। অনেকে হয়তো বলবেন, এর পেছনে ধর্ম নয়, আছে রাজনীতি। আমেরিকা আলকায়দা-আইএস সৃষ্টি করেছে নিজেদের স্বার্থে, ধর্মের কোন দোষ নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি ভারতের সৃষ্টি ছিল? বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শুরু করার পরই ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। ঠিক একই ভাবে সব দোষ রাজনীতির উপর দিয়ে ধর্মকে মহান কিছু বানানোর উপায় নেই। সমকামীদের ক্লাবে হামলার প্রসঙ্গে যারা বলছে, ইসলামে হত্যার কথা বলা নেই। তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন সমকামীতার শাস্তি ইসলামে কী আছে। তাহলেই বুঝে যাবেন। প্রকৃতিতে ৪৫০ থেকে মতান্তরে ৪৮০ প্রজাতির মধ্যে সমকামীতা পরিলক্ষিত হয়। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী আলফ্রেড কিন্সের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি দশ জন ব্যক্তির একজন সমকামী। সমকামীতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ কিছু নয়। এটিকে জটিলভাবে দেখে ধর্মের নিয়ম মেনে তাদেরকে আপনি হত্যা করছেন। পশুপাখিদের সমাজে ধর্ম নামক রূপকথাটির অস্তিত্ব নেই বলে, ধর্মের বর্বর নিয়ম মেনে তাদের কাউকে হত্যা করার প্রয়োজন হয় না। এদিক থেকে পশুপাখিরা আমাদের চেয়ে অনেকটাই সভ্য বলা যায়।

২. নাস্তিকদের ভিন্নমতের কারণে তাদেরকে খুন করাকে প্রশ্রয় দিয়েছি। এখন তাদের হত্যার লিস্ট আর নাস্তিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভিন্ন মতের জন্য যদি হত্যা করাকে আপনি প্রশ্রয় দেন, তাহলে একদিন হত্যাকারীরা আপনাকেও হত্যা করতে আসবে, কারণ হত্যাকারীদের সব মতের সাথে আপনিও একমত নন, একমত হওয়া সম্ভব না। একসময় দেখা যাবে হত্যাকারীরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করছে, কারণ তাদের মধ্যেও মতের পার্থক্য দেখা যাবে। আমাদের সকলেরই বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের আলাদা মত রয়েছে। নাস্তিকদের মধ্যেও নানা বিষয়ে একেক জনের একেক মত, এ নিয়ে প্রতিনিয়ত অনলাইনে যুক্তি তর্ক হচ্ছে। আমি নিজের কথা বলতে পারি, আমি অনলাইনে এসে অনেক কিছু জেনেছি-শিখেছি এই যৌক্তিক তর্কে অংশ নিয়ে। দেশের চলমান অবস্থায়, প্রত্যেকেই আতংকিত। নাস্তিক হত্যার সময় আপনার নীরব সমর্থনই আপনাকে আজকের এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আমরা আসলে একটা স্বার্থপর জাতি। যতদিন নিজের ঘাড়ে কোপ না আসে, ততদিন বুঝি না কোপের যন্ত্রণা।

৩. ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুললেই মন্তব্য আসে, ‘সকল মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত’। আমি স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করব, আপনিও আপনার মত প্রকাশ করবেন। আপনার মত আমার কাছে যত জঘন্যই মনে হোক না কেন, আপনার মত প্রকাশে আমি বাধা হয়ে দাঁড়াব না, এটিই হলো বাকস্বাধীনতা, এখানেই আপনার মতের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিহিত। অথচ আমরা মনে করি, আপনার মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে, আমার মত প্রকাশ করলে আপনার অনুভূতিতে আঘাত লাগবে এজন্য এখন আমাকে চুপ থেকে আপনার মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে!
ধার্মিকেরা অন্য ধর্মের নিন্দা শুনতে পছন্দ করে, নিজের ধর্ম নিয়ে কিছু বললেই অনুভূতিতে আঘাত লাগে। হিন্দুরা অনেকে বলে থাকেন, হিন্দু ধর্মে পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। কারও কিছু মানতেই হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এই ধর্মে এমন কোন কথা বলা নেই যা সরাসরি ঈশ্বর বলেছেন, এই ধর্মের সব গ্রন্থই মুনিঋষিরা নিজেদের অর্জিত জ্ঞান থেকে লিখেছেন, যা সবাইকে মানতে হবে এমন কোন কথা নেই। এখন প্রশ্ন হল, যেহেতু তাদের নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম বা বাধ্যবাধকতা নেই, কাজেই তারা তো নিজেদের মত নিজেরা স্বাধীন থাকতে পারে, 'সনাতন ধর্ম’কে ব্যানার করে আলাদা একটা গোষ্ঠী বানানোর কী প্রয়োজন?
আমরা অনেক সময় বলি, ‘লোকটা খুব ভালো’ প্রমাণ হিসেবে বলি, ‘৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন’ নামাজ রোজা করার সাথে কারোর ভালো হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। ধর্মের সাথে নৈতিকতার কোন সম্পর্ক নেই। নামাজ রোজা কাদের মোল্লা, কামারুজ্জমান সহ সকল যুদ্ধাপরাধীরাও করতো। নামাজ-রোজা জঙ্গিরাও করে। বরং সাধারণের চেয়ে একটু বেশিই করে। আমি বরং ধার্মিক ব্যক্তির কথা শুনলে সাবধান হই। কারণ তার নিশ্চিয়ই ধর্মানুভূতি নামক একটা তীব্র অনুভূতি আছে, যেটা কথায়-কথায় আহত হয়, আর এই অনুভূতি আহত হলে সে আমাকে খুন পর্যন্ত করতে পারে।
গতকাল পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ইফতারের আগে খাদ্যগ্রহণ করায় এক অশীতিপর বৃদ্ধ হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে পাকিস্তানের এক পুলিশ কনস্টেবল ও তার ভাই বেধড়ক পিটিয়েছে। এই ঘটনায় কনস্টেবল পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তার ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ঘটনা যদি বাংলাদেশে ঘটতো, তবে কাউকে গ্রেফতারের প্রশ্নই আসে না। উল্টো নির্ধারিত সময়ের আগে রোজাদারদের সামনে বিরিয়ানী খেয়ে ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো।

৪. রোজার মাসে আরেকটা কমন প্রশ্ন, আপনি কি রোজা? মেয়েদেরকে সাধারণত এই ধরণের প্রশ্ন করা হয়। ‘না’ উত্তর শুনে ‘না’ এর কারণটা কল্পনা করে অনেকে সুখ পায়। কী নোংরা আমাদের মানসিকতা! পিরিয়ডের মত স্বাভাবিক একটি বিষয়কে ট্যাবু বানিয়ে রেখেছি।
আমাদের কলেজে স্টুডেন্টদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা ছিল। এক বান্ধবীর পিরিয়ড হলে আমরা মেডিকেলে গেলাম প্যাড আনতে। মেডিকেল রুমে ডাক্তারের সামনে বসে ছিল আমাদেরই একজন ছেলে সহপাঠী।তার মাথা ব্যথা জাতীয় কোন সমস্যা। নার্সকে জানালাম প্যাড লাগবে। উনি আমাদেরকে চুপ থাকতে বললেন। ওই ছেলে চলে যাওয়ার পরই নার্স প্যাড দিলেন। ওই ছেলের সামনে প্যাড হাতে নিতে তিনি লজ্জা পাচ্ছিলেন।
প্রতি মাসে মেয়েদের শরীরে একাধিক ডিম্বাণু বড় হতে থাকে এবং মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি পরিণত অবস্থায় স্ফুরিত হয়। ডিম্বাশয় থেকে বের হয়ে আসা ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হলে ভ্রূণ তৈরি হয়, আর তা না হলে ডিম্বাণু ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে মিলিয়ে যায়। আবার নতুন ডিম্বাণু বড় হতে থাকে। ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণুটি বের হওয়ার সময় কিছুটা তরল পদার্থ বের হয়ে আসে, সেটিই পিরিয়ড। আর এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা নিয়ে যারা মুচকি হাসতে পছন্দ করে, আপনি বরং তাদের অজ্ঞতা নিয়ে হাসতে পারেন। রোজা রেখেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলে অনেকে বিব্রত হয়ে যান। সবচেয়ে ভালো হয় ধর্মমুক্ত হয়ে এসব ট্যাবুর বিরুদ্ধে যাওয়া, কারণ এসব ট্যাবু ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের সৃষ্টি। যদি তা না পারেন অন্তত স্পষ্ট কন্ঠে জানান, আপনার পিরিয়ড চলছে। পিরিয়ড চলাকালে অনেকে পরিবারের সাথে সেহেরী খেতে উঠে। সারাদিন কিছু খায় না। কারণ পরিবারের বাবা-ভাইয়েরা যদি বুঝতে পারে যে, সে আসলে রোজা রাখে নি, তার পিরিয়ড চলছে। তবে এটা খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। লজ্জা ভাঙ্গুন। পিরিয়ড নিয়ে লুকোচুরি খেলা বন্ধ করুন।

বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১৬

পুরুষানুভূতি ও তসলিমার নির্বাসনের ইতিকথা

'তসলিমা নাসরিন’ নামটির পাশে বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিকেরা ‘বিতর্কিত লেখিকা’ শব্দটি লিখে খুব আনন্দ পায়। তসলিমা নাসরিনের একটি বইও যে পড়ে নি, তাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তসলিমা নাসরিন’কে সে চিনে কিনা, সে হয়তো বলবে, ‘ওই যে ইসলাম বিদ্বেষী বিতর্কিত লেখিকার কথা বলছেন?’ তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়ে আমার কখনো মনে হয় নি তিনি বিতর্কিত কিছু লিখেছেন। আমার কাছে তাঁর আদর্শ, চিন্তা -চেতনা একেবারেই স্পষ্ট ও সঠিক মনে হয়েছে। অবশ্য যারা নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী নন, যারা নারীকে কেবল মা-বোন-বধূ রূপেই দেখতে পছন্দ করেন তাদের কাছে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়গুলো বেশ বিতর্কিতই মনে হবে। তবে আশার কথা, ইদানীং বেশকিছু পত্রিকা বিতর্কিত শব্দটির জায়গায় ‘জনপ্রিয় লেখিকা’ শব্দটি ব্যবহার করছে।

‘তসলিমা নাসরিন’ নামটির সাথে আমার পরিচয়, যখন আমি ক্লাস৫ এ পড়ি। ‘লজ্জা’ পড়েছিলাম তখন। তখন ‘হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা’ ব্যাপারটা আসলে কী, এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা না থাকলেও জীবনের আটটি বছর গ্রামে কাটানোর কারণে গ্রামে হিন্দু পাড়ার প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি ভঙ্গি কেমন হয়, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা ছিল।

১৯৯৩ সালে সরকারী এক তথ্যবিবরনীর মাধ্যমে তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। সেই তথ্য বিবরণী অনুযায়ী, জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অঙ্গনে বিঘ্ন ঘটানো এবং রাষ্ট্র বিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্যপ্রকাশিত হওয়ার জন্য ‘লজ্জা’ নামক বইটির সকল সংস্করণ সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদীদের আন্দোলনের কাছে মাথা নত করা সরকার, মৌলবাদীদের খুশি করতে বইটিকে বাজেয়াপ্ত করে।

‘লজ্জা’ বইটি ছিল মূলত তথ্য ভিত্তিক বই। ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর মুসলমানদের বর্বরতার ঘটনাগুলোই লেখক তাঁর লেখায় চিত্রিত করেছিলেন। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও পরবর্তীতে ৩০টিরও বেশি ভাষায় বইটি অনূদিত হয়।

আরও একটু বড় হয়ে পড়েছিলাম ‘নিমন্ত্রণ’ নামের বইটি। ‘নিমন্ত্রণ’ বইটির প্রথম অংশে দুজন মানুষের প্রেমের কথা থাকলেও, এই গল্পের শেষটি ছিল খুবই বাস্তব এবং নির্মম। শেষ অংশটিতে ছিল, প্রেমিকা কীভাবে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রেমিক ও প্রেমিকের বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল সেই কথা। এই সেদিনও খবরে দেখলাম, ঢাকায় প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রেমিক ও তার বন্ধুদের দ্বারা প্রেমিকা ধর্ষিত হয়েছে। এসব ঘটনা অহরহ ঘটছে।

গল্পে প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম থাকবে, প্রেমিকাকে হিরো প্রেমিক সব বিপদ থেকে রক্ষা করছে, এধরণের কাহিনীর লেখকরাই সমাজে হাত তালি পাবেন। কিন্তু সমাজের বাস্তব চিত্র যেই লেখকের লেখায় উঠে আসবে, তিনি হবেন নিষিদ্ধ। কারণ আমাদের নিজেদের বাস্তব রূপটা যে এতটাই কুৎসিত, সেটা আমরা নিজেরাই মেনে নিতে পারি না।
এরপর পড়ি, ‘অপরপক্ষ’। নারীকে মায়ের জাত বলে, মাতৃত্বের জন্য নারীকে মহান করে দেখানো হয়। অথচ, পিতার পরিচয় ছাড়া সন্তানের কোন পরিচয় নেই, সে নাকি হয় ‘জারজ সন্তান’। সমাজের এই ভণ্ডামীটা ‘অপরপক্ষ’ নামক উপন্যাসে অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

কবিতা আমার ভালো লাগে না, বেশির ভাগ কবিতার বইগুলোতে কেবল প্রেম আর প্রেম। বাস্তবে তো নারীর প্রতি পুরুষের প্রেম কোথাও দেখি না। দেখি নারীর শরীরটির প্রতি পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি। ‘নির্বাচিত নারী’ নামক কবিতার বইটিতে বাস্তবভিত্তিক অসাধারণ কিছু কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’ বইটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, ‘নিজেকে এই সমাজের চোখে নষ্ট বলতে আমি ভালোবাসি। কারণ এ-কথা সত্য যে, যদি কোনও নারী নিজের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করতে চায়, যদি কোনও নারী কোনও ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের নোংরা নিয়মের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়, তাঁকে অবদমনের সকল পদ্ধতির প্রতিবাদ করে, যদি কোনও নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়, তবে তাকে নষ্ট বলে সমাজের ভদ্রলোকেরা। নারীর শুদ্ধ হবার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া। নষ্ট না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই। সেই নারী সত্যিকার সুস্থ ও শুদ্ধ মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে’। ঠিকই তো, প্রতিবাদী কোন নারীকে দমিয়ে দিতে প্রথম যেই শব্দগুলো তার দিকে ছুড়ে দেয়া সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘নষ্ট মেয়ে’।

‘যাবো না কেন? যাবো’ বইটির নামের মধ্যেই রয়েছে একপ্রচন্ড সাহসীকতা। ‘নির্বাচিত কলাম’ বইটি মূলত লেখকের নব্বইয়ের দশকের পুরুষতন্ত্র ও ধর্মের ভন্ডামী নিয়ে লেখা অসাধারণ কলামগুলো নিয়ে সাজানো হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে, লেখক হিসেবে তসলিমা নাসরিন ছিলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ৭১এর পর বাংলাদেশে নাস্তিকতা ও নারীবাদের হাতে খড়ি হয়েছে তসলিমা নাসরিনের মাধ্যমে। সেসময় তিনি একাই তার ‘অস্ত্র’ (কলম) তুলে ধরেছিলেন, ধর্মের বিরুদ্ধে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে। অন্য কোন লেখককে তখন এধরণের বিপদজনক লেখা লিখতে দেখা যায় নি। পরে অবশ্য তসলিমা নাসরিনের জনপ্রিয়তাকে হিংসে করে অনেকেই নারীবাদী বই লেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিজে নারী হয়ে, নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা, নারীর দুঃখ কষ্টগুলো অনুভব করে লেখা, আর জনপ্রিয়তা লাভের জন্য, নিজের চরিত্রে চরম পুরুষতান্ত্রিকতা রেখে নারীবাদ লেখা তো আর এক হয় না।

‘ছোট ছোট দুঃখ কথা’, ‘দুঃখবতী মেয়ে’, ‘নারীর কোনও দেশ নেই’, ‘নিষিদ্ধ’, ‘শোধ’, ‘বন্দিনী’ বইগুলো পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাঁর বইগুলো আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। সমাজের নিয়মনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের অধিকারের পক্ষে লড়াই করার সাহসটুকু আমি সেখান থেকেই পেয়েছি।

তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর ৭টি খন্ড পড়লেই বোঝা যায়, লেখক হিসেবে তিনি কতটা সৎ। যদিও ৭টি খণ্ডের মধ্যে ৪টিই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। আত্মজীবনীতে নিজের ভুল ত্রুটি গুলো লিখতে কুন্ঠাবোধ করেন নি। পরবর্তীতে সেসব ভুলগুলো সাহসের সাথে মোকাবেলা করার কথাও তিনি লিখেছেন। ‘উতল হাওয়া’ বইটিতে রুদ্রের সাথে প্রেমের ঘটনা পড়ে আমরা সবাই বলেছি, ‘আহা কী প্রেম!’ রুদ্রের নষ্টামিগুলো পড়ে অনেকে বলেছে, ‘নিজের বাসর ঘরের কাহিনী কেউ এভাবে রাখঢাক না রেখে বর্ণনা করে! ছি কী অশ্লীল!’ অথচ কারও চোখে পরে নি, বাসর ঘরে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে আসা মেয়েটির স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট। ‘ক’ বইটি আমার কাছে মনে হয়েছে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ট একটি বই। এই বইয়ে অন্য বইগুলোর মত নারীর জীবনের কান্না-দুঃখ-কষ্টগুলোর চেয়েও বেশি ফুটে উঠেছে বাধা উপড়ে সামনে এগিয়ে চলার সাহসীকতা। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, ‘মেয়েবেলা’, ‘উতল হাওয়া’ বইগুলো পড়ে যারা হাততালি দিয়েছেন, তাদের অনেকেই আবার এই বইটির বিরুদ্ধে গেছেন। নারী কেবল পুরুষতান্ত্রিক শেকলে বন্দী হয়ে যন্ত্রণায় কাঁদবে, প্রেমিককে সমস্ত প্রেম উজাড় করে দিয়ে প্রতারিত হয়ে হতাশায় ডুবে থাকবে এসব দেখতে আমাদের সমাজ অভ্যস্ত হলেও নারী মেরুদণ্ড সোজা করে উঠে দাঁড়িয়েছে, সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, এটাতে অভ্যস্ত নয় আমাদের সমাজ। তাই সমাজের প্রগতিশীল পুরুষেরা এই বইয়ের বিরুদ্ধে গেছে। সবচেয়ে অবাক হয়েছি বাংলাদেশে প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে পরিচিত হুমায়ুন আজাদের বক্তব্যটি পড়ে। তিনি বলেছেন, ‘সম্প্রতি প্রকাশিত 'ক' বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটি একটি পতিতার নগ্ন আত্মকহন অথবা একজন নিকৃষ্টতম জীবনের কূরুচিপূর্ন বর্ণনা’। তাঁর এই বক্তব্যতেই বুঝতে পেরেছি, তিনি নারীবিরোধী প্রথাগুলো খুব যত্নে নিজের মধ্যে লালন করতেন।

‘ক’ বইটি নিয়ে বাংলাদেশের আরও কয়েজন বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য পড়ে তাদের নোংরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় পেয়েছি।

ইমদাদুল হক মিলন, সাহিত্যিক
ও নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। তার বই আমি পড়িনি। দু একজনের কাছে শুনেছি কী লিখেছে। কিন্তু যাই লিখুক, আমি তাতে ইন্টারেস্ট ফিল করছি না। বাদ দিন ওসব।
মানবজমিন, ১ নভেম্বর, ২০০৩

সৈয়দ শামসুল হক, সাহিত্যিক
তসলিমা আমার চরিত্র হনন করেছে। মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ৫২ বছরে লেখক হিসেবে আমি যে সম্মান কুড়িয়েছিলাম তা আজ ধুলিস্যাৎ। নিশ্চয়ই এর পিছনে কিছু রহস্য আছে। না হলে তিনি দেশের এত সম্মানিত লেখক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে লিখতে সাহস পেতেন না। আমার মনে হয়েছে, প্রতিবাদ করা দরকার। তাই মামলা ঠুকে প্রতিবাদ জানালাম।
সংবাদ প্রতিদিন, ১০ নভেম্বর, ২০০৩

আসাদ চৌধুরী, সাহিত্যিক
‘ক’ বইটি আমি পড়িনি। তবে যার বিরুদ্ধে লেখা হোক না কেন, লেখকের ওপর পাঠকের কতটুকু আস্থা আছে তা অবশ্য মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ ব্যক্তি সমাজ বিশাল জনগোষ্ঠি নিয়েই সাহিত্য, কোনও লাম্পট্যের নির্লজ্জ বর্ণনা কখনও সাহিত্য হতে পারে না।
আজকের কাগজ, ১১ নভেম্বর, ২০০৩

তসলিমা নাসরিনের কোনও বই ঢাকার কয়েকটি মার্কেট ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না। আমি তসলিমা নাসরিনের যেসকল বই পড়েছি, তার বেশিরভাগই বুক শেল্ফের পুরাতন বইয়ের তাকে ছিল। বাকিগুলো ঢাকা থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়েছি। দেশের কোনও দোকানে গিয়ে তসলিমা নাসরিনের বই চাইলে, আপনাকে প্রথমেই দোকানী জানিয়ে দেবে, ওই লেখকের বই তারা বিক্রি করে না। ফ্রিতে একটি উপদেশও দিয়ে দিতে পারে, ওই নাম যেন আপনি মুখে এনে আপনার মুখকে অপবিত্র না করেন। বাংলাদেশে ‘তসলিমা নাসরিন’ নামটি একটি নিষিদ্ধ নাম। নব্বইয়ের দশকে যিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তিনিই কিনা এখন দেশে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ! আপনার কী ধারণা এর পিছনে দায়ী মৌলবাদীরা? মোটেই না। এজন্য দায়ী, ভোটের রাজনীতি আর সুবিধালোভী হীনচরিত্রের মানুষগুলো। মৌলবাদীদের কোনও ক্ষমতা ছিল না তসলিমা নাসরিনকে দেশ থেকে বের করার। তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছিল মৌলবাদ তোষণকারী সরকার।

তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী চতুর্থ খণ্ডটি মূলত ১৯৯৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো নিয়ে।

তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার(বিএনপি) ধর্মানূভুতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ তুলে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি কোরান সংশোধনের কথা বলেছেন। অথচ তিনি শরিয়া নামক বর্বর আইনটি বাতিলের কথা বলেছিলেন, কোরান সংশোধনের কথা নয়। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হলে তিনি আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। এ নিয়ে দৈনিক ভোরের কাগজে ক'জন বিশিষ্ট নাগরিকের মন্তব্য-

হুমায়ুন আজাদ, কবি, অধ্যাপক
নাসরিন নামের একটি তুচ্ছ বস্তুকে বাংলাদেশের অপদার্থ সরকার, আনন্দবাজার আর হিন্দু মুসলমান মৌলবাদীরা আন্তর্জাতিক বস্তুতে পরিণত করেছে। এটা এখনকার সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার।...এই সময়ের একটি বেশ হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, নাসরিনের মত একটি তুচ্ছ বস্তুকে নিয়ে সারা পৃথিবীর মেতে ওঠা। পশ্চিম ইওরোপ তার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে।

আমহদ ছফা, লেখক
তসলিমা নাসরিন ভারতের সৃষ্টি।...তসলিমা এবং তাকে যারা সমর্থন করে তারা মৌলবাদকে এমনভাবে উস্কে দিয়েছে, স্বাধীন চিন্তাভাবনার লোক মস্ত বিপদে পড়ে গেছেন।...তসলিমা এবং তার সমর্থকদের অবিবেচনার কারণে দেশের সমস্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি একটি সঙ্কটের সম্মুখে পড়েছে।...একটি অমঙ্গলের শক্তি।

ফরিদা রহমান, সাংসদ, বিএনপি
ঐসব আজেবাজে লেখা ছেড়ে দিয়ে তসলিমার মাফ চাওয়া উচিত। তারপর সাধারণ জীবনযাপন করা উচিত।... জনগণ যদি ক্ষমা করে তারপর আমরা সাধারণ মহিলারা যেভাবে জীবনযাপন করি সেভাবে তার জীবনযাপন করতে হবে।

সুত্রঃ সেই সব অন্ধকার, তসলিমা নাসরিন।

সেই সময় মৌলবাদীদের তোষণ না করে যদি প্রকাশ্যে তসলিমা নাসরিনের মাথার মূল্য নির্ধারণকারী ধর্মীয় গুরুকে শাস্তির আওতায় আনা হতো, সুবিধাবাদী লেখক প্রগতিশীলেরা যদি সেসময় হিংসের বশবর্তী না হয়ে, সবাই এক হয়ে সেসব মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন, সরকারের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন তবে হয়তো আজকের এই দিন আমাদের দেখতে হতো না। এই প্রগতিশীল লোকেদের অনেকেই পরবর্তীতে মৌলবাদীদের প্রশয় দেয়ার ফল ভোগ করেছেন এবং করছেন। সেই ১৯৯৪ সাল থেকেই তো মৌলবাদীরা প্রশ্রয় পেতে পেতে আজকের এই রূপ নিয়েছে। এজন্য মৌলবাদীরা নয়, বরং দায়ী সুবিধাবাদীরা- এ নিয়ে কারও সন্দেহ আছে কী?

বর্তমানে ব্লগার-লেখক-প্রকাশক ইত্যাদি প্রগতিশীল মানুষদের হত্যার বিরুদ্ধে দেশের বুদ্ধিজীবিদের তেমন কোন প্রতিবাদ লক্ষ্য করা না গেলেও, লক্ষ মাইল দূরে বসে যিনি একটি আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন, তিনি ঠিকই তাঁর কলমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, সরকারের ভূমিকার বিরুদ্ধে।

অথচ এখনও প্রতিনিয়ত আমরা ‘তসলিমা নাসরিন’ নামটিকে অত্যন্ত সচেতন ভাবে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা, বাক স্বাধীনতার কথা বলি। যিনি বাংলাদেশে নাস্তিকতা ও নারীবাদের সূচনা করেন, যিনি ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লেখার কারণে আজ ২১ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে নিষিদ্ধ হয়ে আছেন, তাঁকে বাদ দিয়ে মুক্তচিন্তা করাটা আদৌ ফলপ্রসু হয়েছে বা হচ্ছে? যে মুক্তচিন্তা পুরুষতান্ত্রিকতা মুক্ত নয়, সে চিন্তাকে আমি মুক্তচিন্তা বলতে পারি না। এটা এক ধরনের ভন্ডামীর নামান্তর।তারা প্রকৃতপক্ষ ধর্মের কুসংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেও, নারীবিরোধী সংস্কারগুলো থেকে মুক্ত হতে পারেননি।

বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের তসলিমা বিষয়ে এমন নীরবতা আমাকে অবাক ও ক্ষুব্ধ করেছে। তাই ২০১৪ সালে, আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে ‘তসলিমা পক্ষ’ নামের একটি ফেসবুক পেজ খুলি। তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মিথ্যা অপপ্রচারগুলো সম্পর্কে মানুষকে জানানো, তসলিমা নাসরিনের লেখাগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াই এই পেজের উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে আমরা তসলিমা নাসরিনের জন্মদিনে, ‘তসলিমা দিবস’ উদযাপন করি। এছাড়াও তসলিমা পক্ষের আয়োজনে মুক্তচিন্তার পক্ষের মানুষদের নিয়ে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রোগ্রাম হয় শাহবাগে। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে, অফলাইন প্রোগ্রামের ঘোষণা না দিয়ে অনলাইনেই তসলিমা নাসরিনের লেখা গুলো নিয়ে ছোট ছোট অনলাইন পোষ্টার বানিয়ে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ধর্মান্ধ সমাজ নারীকে নানা ভাবে দমন করে এসেছে। নারীর কথাগুলো যাতে উচ্চারিত না হয় সে জন্যই উপামহাদেশের শ্রেষ্ঠ নারীবাদী লেখককে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিষিদ্ধ করেছে। তসলিমা নাসরিনকে তাঁর নিজ ভূমি নির্বাসন দণ্ড দিলেও সভ্য দেশগুলো তাঁকে নানা ভাবে সম্মানিত করেছে। তসলিমা’কে নিষিদ্ধ করাতে তসলিমার খুব বেশি ক্ষতি না হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। তসলিমা নাসরিনের নির্বাসন কেবল একজন মানুষ তসলিমার নির্বাসন নয়, এটি মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা আর মানবাধিকারের নির্বাসন।

যেসব কথা বলা নিষেধ, সেসব কথাই তিনি জোর গলায় বলেছেন। যে শব্দ উচ্চারন করা মানা ছিল, সে শব্দই তিনি বারবার উচ্চারন করেছেন। আজ আমরা সেসব শব্দের-ভাষার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। তসলিমা নাসরিন এদেশের নারীদের কথা বলা শিখিয়েছেন, বাধা উপড়ে এগিয়ে চলতে শিখিয়েছেন। আজ আমরা কথা বলতে পারি, প্রতিবাদ করতে পারি। আমরা ভুলি নি তসলিমা নাসরিনকে। নিষিদ্ধ নামটিই আমরা গর্বের সাথে উচ্চারন করি। কারন এই নিষিদ্ধ নামেই আমরা আমাদের শক্তি খুঁজে পাই, প্রতিবাদ করার সাহস পাই।

বুধবার, ১ জুন, ২০১৬

ওরা দোষী নয়, ভুক্তভোগী


কয়েকদিন আগে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের জিপিএ৫ প্রাপ্ত ছাত্রদের নিয়ে বানানো প্রতিবেদনটি সকলেই দেখেছেন। ভিডিওটি দেখে আসলেই খুব দুঃখ পেয়েছি। সাধারণ কিছু বিষয় আমরা পারি না! ক্ষোভে-দুঃখে একটি স্ট্যাটাসও দিয়েছিলাম স্টুডেন্টদের বিরুদ্ধে, পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি এটি করা আমার মোটেই উচিত হয়নি। নিজেও এসএসসি পাশ করেছি কিছু বছর আগে। তাই ওইসব ছাত্রদের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া ঘৃণা আর অপমান আমার গায়েও এসে লেগেছে। অনেক সময় সাধারণ কিছু প্রশ্ন মানুষ নার্ভাস হয়ে ভুল করে ফেলে। এরকম কিছু ঘটনা আমাদের প্রায় সবার জীবনেই ঘটে থাকে। এ নিয়ে আমরা পরে মনে মনে হাসি। কিন্তু এসকল ছাত্রদের তো নিজেদের ভুলের কথা মনে করে নিজের মনে হাসার কোন উপায় নেই, সমগ্র দেশ তাদের নিয়ে হাসছে। এই অপমান সহ্য করতে না পারে তাদের কেউ যদি আত্মহত্যা করে এর দায় কি আমরা নিব?

পীথাগোরাসের উপপাদ্য আমরা পড়েছিলাম ক্লাস এইটে। আমাদের অংক বইয়ে উপপাদ্য ২৪ ছিল সম্ভবত পীথাগোরাসের উপপাদ্য। সেটা উপপাদ্য২৪ হিসেবেই লেখা ছিল। অংক বইয়ের কোথাও পীথাগোরাস কে, এ সম্পর্কে কোন তথ্য ছিল না। সেক্ষেত্রে কোন ছাত্র যদি জানতে না পারে যে সে, যেই উপপাদ্য২৪ লিখে পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছে, সেটা আসলে পীথাগোরাসের সৃষ্টি তবে তাকে কিন্তু দোষ দেয়া যায় না। যেই সাংবাদিক পীথাগোরাস কে সেটা জিজ্ঞেস করেছেন, সেই সাংবাদিককে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, পীথাগোরাসের পুরো নাম কী? আমি নিশ্চিত তিনি উত্তর দিতে পারবেন না।

হুট করে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস গুলিয়ে ফেলবেন অনেকেই। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম না জানাটা কোন অপরাধ না। রাষ্ট্রপতিকে বছরে কয়বার খবরের পাতায় পাওয়া যায়? আপনারাই ভাবুন। বর্তমান বাংলাদেশের বিরোধী দল কোনটি জানতে চাইলে ৮০ ভাগ মানুষ বলবে, বিএনপি। অথচ বর্তমান বিরোধী দল হল, জাতীয় পার্টি। বিরোধী দলের নেতার নামটি কয়জন পারবে এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, বাংলাদেশে রওশন এরশাদকে কয়জন চেনে?

হুমায়ুন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ নাটকটিতে দাদু ক্যারেক্টারটি তার নাতনী টাইপের একজনকে কোন একটা প্রশ্ন করে, নাতনী সেটার উত্তর দিতে পারে নি। এ নিয়ে দাদু সম্ভবত নাতনীকে ‘কিছুই পারিস না’ জাতীয় কিছু কথাবার্তা বলছিলেন। এরপর নাতনী দাদুকে একটা প্রশ্ন করে, দাদু সেটার উত্তর দিতে পারে নি। তখন নাতনী দাদুকে বলে, আমি যেমন অনেককিছু জানি না, তুমিও তেমন অনেক কিছুই জানো না। মুস্তাফিজ’কে তার বোলিং প্রতিভার জন্য মাথায় মুকুট পরাচ্ছি। তারকা খেলোয়াড় মুস্তাফিজকে যদি ওই প্রশ্নগুলো করা হতো, তাহলে তিনিও এসকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। তাঁকে এসব প্রশ্নের উত্তর পারতেই হবে, এমন কোন কথা নেই। তিনি যেই বিষয়ে দক্ষ, সেই বিষয়ে তিনি সেরা। প্রত্যেকেরই নিজের কোন আগ্রহের বিষয় থাকে। নিজের পছন্দের সাবজেক্টে সবাই সেরা। অথচ আমরা সবাইকে সব বিষয়ে সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেই। সবাইকে কেন সবকিছু পারতে হবে?

তের জনেকে ১০ টি করে প্রশ্ন করা হলে, এরমধ্যে ছয়জন যদি ছয়টি প্রশ্নের উত্তর ভুল করে, তবে এখানে অস্বাভাবিক কিছু তো দেখি না। ক্যামেরার সামনে নার্ভাস হয়ে আমি হলে তো কথাই বলতে পারতাম না। জানি, অন্যকে অপমানিত হতে দেখা আমাদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক। অন্যের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে একবার ভেবে দেখুন বিষয়টা। তাহলেই বুঝতে পারবেন।

প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যদেরকে করা সব প্রশ্নের উত্তর আমি পারতাম কিন্তু নিজেরটার উত্তর ঠিকমত দিতে পারতাম না। একবার বায়োলজি পরীক্ষার প্র্যাক্টিক্যালে, আমার আগের রোলের স্টুডেন্টটি’কে তেলাপোকার বৈজ্ঞানিক নাম জিজ্ঞেস করা হলে, সে তেলাপোকার ইংরেজি বলে। শুনে আমি হেহে করে হেসে ফেলি, কারণ তেলাপোকার বৈজ্ঞানিক নাম আমি জানি। কিন্তু যেই মুহূর্তে, টিচার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হাসলে কেন? তুমি বলতো এটার উত্তর? আমি ঘটনার আকস্মিকতায় ও টিচারের ঝাড়ি শুনে পুরাই ব্ল্যাংক হয়ে যাই, পারিনি উত্তর দিতে। এরকম হয়। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। পরীক্ষায় পাশের জন্য শ’খানেক বৈজ্ঞানিক নাম, (বেশিরভাগ মূলত ল্যাটিন শব্দ) মখস্থ করলেও, তেলাপোকা ছাড়া অন্যকোন কিছুর বৈজ্ঞানিক নাম আমার এই মুহূর্তে মনে নেই।
আমার বাসার ক্যামিস্ট্রি স্যার আমাকে পড়া জিজ্ঞেস করতেন প্রতিদিন, একটা প্রশ্নে আটকে গেলে দাঁড় করিয়ে রাখতেন, বলতেন এক পা তুলে দাঁড়াও, এরপর বলতেন, দুই পা তুলে দাঁড়াতে পারলে শাস্তি মাফ করে দিবো, দাঁড়াও তো। দুই রুমের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে আমাকে নিয়ে তিনি এসব মজা করতেন। পাশের রুমে আমার ছোট বোনের টিচার পড়াতেন। আমার ছোট বোন হাসতো, তার টিচার হাসতেন। আমার রাগ হতো, কিন্তু করার কিছুই ছিলও না। শেষে, আমি ঠিক করি, আমি আর পড়া শিখব না। স্যার পড়া জিজ্ঞেস করার আগেই, ‘সরি, পারব না’ বলে আমি কানে ধরে দাঁড়িয়ে যাই। তারপর স্যারকে জিজ্ঞেস করি, স্যার পা তুলে দাঁড়াব নাকি উঠ বস করব। এরপর আমার বাবা মা সেই টিচার’কে বাতিল করতে বাধ্য হয়। ওই সময়টুকু আমি প্রচণ্ড এক মেণ্টাল টর্চারের মধ্যে ছিলাম। স্যার নানারকম অদ্ভুত কথাবার্তা বলতেন, মজা নিতেন, আর আমাকে নানাভাবে বিব্রত করার চেষ্টা করতেন। এরকম মেণ্টাল টর্চারের মধ্যে বাংলাদেশের অনেক স্টুডেন্টই দিন পার করছে। আমার এক ভাইয়ের তো মানসিক সমস্যা শুরু হয়েছে, পড়ার চাপ আর বাবা-মা-শিক্ষকদের দুর্ব্যবহারের কারণে।

আমি যখন কলেজে পড়তাম, তখন আমি কলেজের জন্য বাসা থেকে বের হতাম, সকাল সাড়ে ছয়টায়। ফিরতাম দুপুর সাড়ে তিনটায়। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে সাড়ে চারটার দিকে পরিশ্রান্ত হয়ে যেতাম। কিন্তু ছয়টায় আবার ক্যামিস্ট্রি স্যার, মাঝখানের সময়টুকু স্যারের পড়া শিখে নিতাম। ছয়টা থেকে আটটা সেই স্যার পড়িয়ে গেলে, নয়টা থেকে এগারোটা আরেকজন স্যার পড়াতেন ফিজিক্স ও ম্যাথ। এরপর স্যারের হোমওয়ার্ক, কলেজের হোমওয়ার্ক করে, খেয়ে দেয়ে গভীর রাতে কম্পিউটার নিয়ে বসতাম। ঘুমাতে ২টা বাজুক কিংবা ৪টা, উঠতে হবে ছয়টা বাজার পনের মিনিট আগে। এই ছিল আমার ডেইলি রুটিন। এটা কেবল আমার না, বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার শিকার প্রতিটি স্টুডেন্টের ডেইলি রুটিন। আমি ফাঁকিবাজ টাইপের স্টুডেন্ট ছিলাম বলে, এরমধ্যেই সময় বের করে নিতাম নিজের জন্য। আর কলেজের সময়টুকু পুরোটায় বন্ধুদের সাথে আনন্দ করে কাটাতাম বলে এইরকম কঠিন অবস্থায়ও মুখে হাসি ছিলও। ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, কড়া নিয়মকানুন, আর নিয়ম ভাঙতে পারার আনন্দটাই ছিল অন্যরকম।

মুখস্থ করার কাজটা আমাকে দিয়ে হতো না। আমার ফিজিক্স স্যার লক্ষ্য রাখতেন, পড়া লেখার চাপে যেন আমার মানসিক কোন রোগ সৃষ্টি না হয়, আমি যেন কোনভাবে হতাশ না হই। স্যারের জীবনে এমন ঘটেছিল। স্যারের এক স্টুডেন্টেরও পড়ার চাপে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের কলেজের অনেক ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্টই মানসিক কোন সমস্যায় ভুগছে বলে মনে হতো। তাদের সারাদিনের কথাবার্তার বিষয় কেবল পড়া, কে কত নম্বর পেলো, সবচেয়ে বেশি যে পেয়েছে সে কোন স্যারের কাছে পড়ে, সে কোন টেস্ট পেপার ফলো করে.. এসব। আমাদের স্কুলের ফার্স্ট গার্লকে আমি কখনো কথা বলতে দেখিনি, সারাদিন বইয়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে ‘বিড়বিড়’ করতো।
এসকল কথা বলছি কারণ, অনেকের মনে হতে পারে, বর্তমানে গোল্ডেন জিপিএ৫ এসব পাওয়া কোন ব্যাপার না, না পড়লেও পাওয়া যায়, আসলে তা নয়। আমি এও প্রমাণ করতে চাইছি না যে, জিপিএ৫ পাওয়া ছাত্ররা একেকজন মেধায় অনন্য। তবে এখনের স্টুডেন্টরা পড়ালেখার পিছনে যেই সময় ব্যয় করে আমাদের বড়রা কিন্তু এত সময় মোটেই ব্যয় করতেন না। তারা বিকেল হলে মাঠে ঠিকই খেলতে যেতেন। এখন খেলার মাঠ কই? আর সময় কই? রেজাল্ট যাইহোক, সেটার পিছনে ছুটতে গিয়ে বর্তমানে স্টুডেন্টরা তাদের শৈশব-কৈশোরের আনন্দময় সময় গুলো হারিয়ে ফেলছে। একধরণের বিশ্রী প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেদেরকে ব্যস্ত রেখে প্রকৃত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে রয়েছি আমরা। এজন্য মোটেই স্টুডেন্টরা দায়ী নয়, দায়ী শিক্ষাব্যবস্থা। দায়ী আমাদের শিক্ষকেরা, আমাদের বড়রা।
লেখাপড়াটা আমাদের কাছে ভয়ের বা যনন্ত্রনার বিষয়। লেখাপড়া কি আসলেই তাই? মোটা মোটা বই মুখস্থ করে, সেসব পরীক্ষার খাতায় বমি করাটাই কি শিক্ষা? মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় আপনারা এরচেয়ে ভালো কিছু আশা করেন কী করে? স্টুডেন্টদের ভুল নিয়ে হাসাহাসি না করে বরং এ থেকে পরিত্রাণের কার্যকরী কোন উপায় বের করাই আমাদের গুরুজনদের দায়িত্ব। দায়িত্ব এড়িয়ে কেবল কয়েকজন শিক্ষার্থীর অজ্ঞতা নিয়ে উপহাস করলে আপনাদের প্রতি ছাত্রদের আস্থার জায়গাটি আর থাকবে না।