আমি একজন নাস্তিক। ঈশ্বর নামক কাল্পনিক কিছুতে আমার বিশ্বাস নেই। কাজেই মূর্তিপূজা, ধর্মানুভূতি পূজা এসব আমাকে দিয়ে হয় না। মূর্তিতে যেহেতু আমি কাল্পনিক কোনও শক্তিকে কল্পনা করতে পারি না তাই মূর্তি আমার কাছে শুধুই মূর্তি। পুতুলও বলা যায়। আবার শিল্প হিসেবেও নেয়া যায়। তবে শিল্প যখন সংরক্ষণ না করে পানিতে ভাসানো হয় সেটাকে অর্থ এবং শিল্পের অপচয় বলেই মনে হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন সবাই শারদীয় দুর্গা উৎসবের শুভেচ্ছা জানানো চলছে তখন আমি পুতুলখেলা উৎসবের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। আগেই বলেছি, আমি মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নই, আর পুতুল (মূর্তি) নিয়ে যা করা হয় সেটা আমার কাছে পুতুল খেলা উৎসব। এতে অনেকেরই ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে। যদিও এটি রাষ্ট্রধর্মানুভূতি নয় বলে আমাকে ৫৭ ধারা নিয়ে ভাবতে হয়নি। রাষ্ট্রধর্ম ছাড়া বাকি সব ধর্ম নিয়ে যা খুশি বলার চর্চাটা বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ভালো ভাবেই হয়।
আমার পরিচিত একজন ছোটবেলায় পুতুল নিয়ে খেলা করত। তার পুতুল খেলার বয়স অতিক্রম হওয়ার পরও দেখলাম সে পুতুলের সাথে কথা বলছে, পুতুলটাকে নিজের বোন বলছে। সর্বক্ষণ পাশেপাশে রাখছে। কারও হাত লেগে যেন ব্যথা না পায় সেসব দিকেও তার কড়া নজর। পুতুলকে খাওয়াচ্ছে, পুতুলের সাথে খেলছে, হাসছে, কথা বলছে- এসব দেখে বিভিন্নজনের কি হাসি! হাসি আমারও পেত, তার পুতুলপ্রেম নিয়ে সবসময় তাকে বিরক্ত করতে পছন্দ করতাম। পুতুলের সাথে তার এই অদ্ভুত কাল্পনিক সম্পর্ক দেখে আমি মাঝেমাঝে তাকে অটিস্টিকও মনে করতাম। যদিও এখন তার সেসব কেটে গেছে। তবে সেসময় তার পুতুল প্রেম নিয়ে যারা হাসতেন, ‘এখনও বাচ্চা রয়ে গেছে, পুতুল নিয়ে খেলে’ এরকম ভাব দেখাতেন, তাদের সকলেই সকাল বিকাল মূর্তিকে ফুল বেলপাতা দিয়ে পূজা করে। মূর্তিকে খেতে দেয়। তারপর সেসব খাদ্য পচে অলমোস্ট খাদ্য অযোগ্য হলে সেসবকে ‘প্রসাদ’ বলে ঠাকুরের নাম নিয়ে নমঃ নমঃ বলে খেয়ে ফেলে। ওই পরিচিতের পুতুলপ্রেম নিয়ে হাসাহাসি করলে সে যেভাবে রেগে যেত, বড়দের মূর্তিপূজা নিয়ে হাসলে তারা দ্বিগুণ রেগে যান, সাথে ‘ধর্মানুভূতি’ জাতীয় গুরুগম্ভীর টার্ম যুক্ত হয়।
ধর্মে আমার বিশ্বাস না থাকলেও সবার নিজ নিজ মত ও বিশ্বাস নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের অধিকারে আমি বিশ্বাসী। যদিও ধার্মিকদের কাছে ‘আমার ধর্মই একমাত্র সত্য, বাকিসব মিথ্যা’। এটা একদিকে ঠিকই আছে। প্রত্যেক ধর্মের নিয়মকানুনই ভিন্ন এবং কিছু কিছু নিয়ম আবার সাংঘর্ষিকও বটে। যেমন: হিন্দুরা গরুকে তাদের দেবতা রূপে পূজা করে, আর মুসলমানরা কোরবানিতে গরু কেটে উৎসব করে। যে গরুকে দেবতা মনে করে তার গরু কাটা উৎসবে সমর্থন করার কোনও কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, দূর্গাপূজাকে বাঙ্গালীর উৎসব বলেছেন এবং আরও বলেছেন, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। দূর্গাপূজার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এটি বাঙ্গালীর উৎসবই বটে। ছোটবেলায় ধর্ম বইয়ে পড়তাম, হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব নাকি দূর্গা পূজা। অথচ ইন্ডিয়ায় কলকাতার বাঙ্গালী হিন্দুরা ছাড়া দূর্গা নামটায় কজনে জানে সন্দেহ আছে, আর পূজা বা উৎসব করা তো দূরের কথা। হিন্দু ধর্মে একেক জায়গায় একেক দেব/দেবীর পূজার রীতি প্রচলিত। কোনও জায়গায় ‘দীপাবলী’ সবচেয়ে বড় উৎসব, কোথাও মকর সংক্রান্তি কোথাও শট পূজা। আরও কত যে পূজা। এখন যেমন পূজা বলতে ঐশ্বরিক ব্যাপার ভাবা হয়, মূর্তির ভিতর ঈশ্বর বা অলৌকিকতার গন্ধ খোঁজা হয় প্রাচীনকালে কিন্তু পূজা ব্যাপারটা এমন ছিলও না। তখন সমাজে যারা বিশেষ কোনও অবদান রাখতো তাদেরকে সম্মান জানাতে এই পূজার প্রচলন হয়। কৃষিকাজ আবিষ্কার করে মেয়েরা। আর কৃষি নির্ভর সমাজগুলোতে মেয়েরাই ক্ষমতাবান, তারাই দেবী। পূজাগুলো সাধারণত কৃষিকাজের অবসরে বিনোদনের অংশ ছিল।
মূর্তিপূজা ইসলাম ধর্মে হারাম। ইসলাম ধর্মের শুরুটাই হয়েছিল নবী মুহাম্মদের কুরাইশদের ৩৬০টি মূর্তি ভাঙার মধ্য দিয়ে। ইসলাম ধর্মে পাপীদের জন্য সাতটি দোযখ বরাদ্ধ রাখা আছে বলে বিশ্বাস করা হয়। তারমধ্যে তিন নম্বর দোযখটির নাম হল ‘ছাক্কার’। দেব দেবী ও মূর্তির উপাসকদের এই দোযখে পাঠানো হবে।
কোরআন শরীফ, হাদিস শরীফ, ইজমা ও কিয়াস অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা মোতাবেক প্রাণীর ছবি তৈরি করা, তোলা, তোলানো, আঁকা, রাখা, দেখা, দেখানো ইত্যাদি হারাম ও নাযায়িজ। হাশরের ময়দানে যারা মূর্তি তৈরি করেছেন, প্রাণীর ছবি এঁকেছেন তাদেরকে নিজেদের তৈরি মূর্তি/ছবি’তে প্রাণ সৃষ্টি করতে বলা হবে। আর তারা যখন তা পারবেন না, তখন তাদেরকে ‘ছক্কারে’ পাঠিয়ে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। এ বিষয়ে কিছু হাদিস -
عن ابى معاوية رضى الله تعالى عنه ان من اشد اهل النار يوم القيمة عذابا المصورون.
অর্থ: হযরত আবূ মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হতে বর্ণিত, “নিশ্চয় ক্বিয়ামতের দিন দোযখবাসীদের মধ্যে ঐ ব্যক্তির কঠিন আজাব হবে, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি আঁকে বা তোলে।” (মুসলিম শরীফ ২য় জি: পৃঃ ২০১)
عن جابر رضى الله تعالى عنه قال نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الصورة فى البيت ونهى ان يصنع
ذلك.
অর্থ: হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হাবীবুল্লাহ হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ঘরের মধ্যে প্রাণীর ছবি রাখতে নিষেধ করেছেন এবং ওটা তৈরি করতেও নিষেধ করেছেন। (তিরমিযি ১ম জি: পৃঃ ২০৭)
عن ابن مسعود قال اشد الناس عذابا يوم القيامة رجل قتل نبيا او قتله نبى او رجل يضل الناس بغير العلم او مصور يصور التماثيل.
অর্থ: হযরত ইবনে মাস্উদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তিদের ক্বিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি হবে, যারা কোন নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে শহীদ করেছে অথবা কোন নবী আলাইহিমুস সালাম যাদেরকে হত্যা করেছেন এবং ঐ সমস্ত লোক যারা বিনা ইলমে মানুষদেরকে গোমরাহ করে এবং যারা প্রাণীর ছবি তৈরি করে। (মুসনদে আহমদ ২য় জি: পৃঃ২১৭)
আমার পরিচিত অনেককেই দেখলাম মূর্তি পূজা বিষয়ে অন্য মুসলমানদের সচেতন করছেন। যদিও তারা নিজেরা ছবি আঁকেন, তুলেন এবং নিয়মিত ফেসবুকে আপলোড দেন, প্রেমট্রেমও করেন। আমি তাদেরকে নিজেদের এসব গুনার কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কারণ এসব কাজের জন্যও ওই একই শাস্তি বরাদ্ধ করা আছে।
আর যারা বলছেন, ইসলামে মূর্তিভাঙ্গার কথা উল্লেখ নেই তারা স্পষ্টভাবে ইসলাম নিয়ে মিথ্যাচার করছেন। কারণ
সহীহ্ মুসলিম, হাদিয়াত ৯৬৯ এ আছে, আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন, আলী ইবনে আবী তালেব (রা.) আমাকে বললেন, “আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সকল মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সকল সমাধি-সৌধ ভূমিসাৎ করে দিবে এবং সকল চিত্র মুছে ফেলবে”।
সিলেটে হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক শহীদ মিনারের ওপর আঘাত আসার কারণও আশা করি স্পষ্ট হয়েছে। ইসলামিক বিধি মেনে চললে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, বঙ্গবন্ধুর মূর্তি, মুক্তিযুদ্ধের স্থাপত্য সহ সকল মূর্তি ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া উচিত। এইজন্যই ইসলামিক স্টেট ক্বাবা শরীফ ভেঙে ফেলার কথা বলেছে। ক্বাবা শরীফকে কেন্দ্র করে হাঁটা, একবার ছুঁয়ে দেখা, চুমু খাওয়া, শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মারা এগুলোও তো একরকমের মূর্তিপূজা।
শুনেছি হজ্বের সময় এখন মানুষকে ছবি ভিডিও সেলফি তুলতে দেখা যায়। এছাড়া হ্বজের সময় সেখানে নাকি অসংখ্য সিসিটিভি লাগানো হয়! অথচ ইসলামে কিন্তু এ সম্পর্কে কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে।
‘ধর্ম যার যার উৎসব তার তার’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের কড়া নিন্দা করেছেন বাংলার জনপ্রিয় হুজুর আল্লামা আহম্মেদ শফি। মডারেটরা হয়তো বলবেন শফী হুজুর সমগ্র বাংলাদেশের ধর্মপ্রান উদার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। যদিও এই শফি হুজুরের ডাকেই লাখ লাখ মানুষের জমায়েত হয়। এমনকি মডারেটরাও ‘যদিও /কিন্ত’ জাতীয় সুর তুলে সময়ে শফি হুজুরের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। নায়ক আলমগীর বলেছেন, ‘ধর্ম যার, উৎসবও তার’। তারমতে সহি ইসলামে অন্য ধর্মের কোনও অনুষ্ঠানে মুসলমানদের যোগ দেয়া ইসলামবিরোধী। যদিও তিনি ঠিক কথা বলছেন, তবে সারাজীবন তিনি যা করে এসেছেন টিভির পর্দায় নায়িকাদের সাথে, তাতে তিনি এরচেয়েও অনেক বড় ইসলাম বিরোধী কাজ করে গেছেন। হারামকাজ করে টাকার পাহাড় বানিয়ে এখন তিনি এসেছেন সহি ইসলামিক জ্ঞান দিতে। ভণ্ডামি আর কাকে বলে!
জার জন্য দেখলাম সরকারি ভাবে বেশ কিছু নিয়ম নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। এসকল নিয়ম মেনেই সবসময় পূজা হয়ে আসছে। নামাজের সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে পুজা করার ফলাফল এদেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকেরা ভালোই জানে। তারপরও সেসব নিয়মগুলোকে সরকারিভাবে উল্লেখ করে দেয়া, পরিস্থিতির ভয়াবহতাকেই নির্দেশ করে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও চিরস্থায়ী নয়। যুগের সাথে তাল মিলাতে গেলে বদলাতে হয়। সেখানে ধর্মগুলোর চিরস্থায়ী নিয়মগুলো সবাই নিজের সুবিধা মত ব্যবহার করছে। এটা হিপোক্রেসি তো অবশ্যই। এই হিপোক্রেসির বিরুদ্ধে বললেও নাকি ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে! নাস্তিক মানেই কেউ ভালো মানুষ, মানবিক, সমানাধিকারে বিশ্বাসী এমন ভাবাটা খুব ভুল। নাস্তিকতা মানে ঈশ্বরে অবিশ্বাস। অনেকে আছেন, জন্মগত ভাবে পারিবারিক ধর্ম পালন করেন। তবে নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করেন না। সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করেন। আস্তিক হয়েও অনেকে অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতার চর্চা করেন। এটি অবশ্যই ভালো লক্ষণ। এর পেছনে কিন্তু ব্যক্তির ধর্মের কোনও হাত নেই। এটি সম্পূর্ণই ব্যক্তির নৈতিকতার উপর নির্ভর করে। ধর্ম বলতে অনেকে নৈতিক শিক্ষাকে বুঝেন। নৈতিকতার সাথে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। ভালো মানুষ হতে ধার্মিক হওয়া জরুরী নয়। ধর্ম পালন না করেও মানবিক গুণাবলীর চর্চা করা যায়। বরং সেক্ষেত্রে কোনও ধরণের হিপোক্রেসি করতে হয় না।