১. বাচ্চাদেরকে পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা করানো নিয়ে মাঝেমাঝে পত্রিকায় নিউজ দেখি। মানুষ এতটা নির্মম হতে পারে বিশ্বাস হতো না। সেদিন ‘স্ল্যামডগ মিলিয়নিয়ার্স’ মুভিটা দেখছিলাম। মুভিতে সেলিম আর জামাল দুই ভাই সেরকমই একটি চক্রের ফাঁদে পড়ে যায়। তাদেরকে ভালো খাবারের লোভ দেখিয়ে এক জায়গায় আনা হয়। সেখানে তারা দেখে তাদের মত আরও অনেক শিশু। যারা ভাল গান গাইতে পারে তাদেরকে বড় শিল্পী বানানোর স্বপ্ন দেখানো হল। বাছাই পর্ব শুরু হল। খুব ভালো গাইতে পারে এমন একজন বাচ্চাকে একটি গান গেয়ে শোনাতে বলা হল। বাচ্চাটি খুব ভালো গাইল। তারপর তাকে চোখ বেধে অজ্ঞান করে পরে তার চোখ দুটি নষ্ট করে তাকে অন্ধ বানিয়ে দিলো। গান গাইতে পারে এমন অন্ধ ভিক্ষুক তাও আবার বাচ্চা, কামাই খুব ভালো হবে। সেলিম পুরো ব্যাপারটা দেখে ফেলে। এদিকে তার ভাই জামাল বড় শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। অপেক্ষা করছে কবে তার পালা আসবে। জামালের পালা এলে সেলিমকে পাঠানো হয় জামালকে ডেকে আনতে। পথে সেলিম জামালকে ইশারায় বুঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলে, সেলিম ইশারা করলেই যেন দৌঁড়ে পালায়। দু’ভাই পালিয়ে বাঁচে ওই ভয়ংকর চক্রের হাত থেকে। শিশুদের পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা ব্যবসা চালানোর বিরুদ্ধে আমরা সবাই।
পঙ্গু বানিয়ে শুধু কি ভিক্ষা ব্যবসা চলে? না। পঙ্গু বানিয়ে আরও অনেক কিছুই করা হয় যেগুলোকে আমরা অপরাধ মানি না, খারাপ কিছু বলেও মনে হয় না।
পাবলিক বাসে ড্রাইভারের পাশের কিছু সিট নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত। সংরক্ষিত সিট নিয়ে পুরুষের বাঁকা কথার শেষ নেই। কোনও পুরুষ যদি নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন দখল করে তবে তাকে শাস্তি বা জরিমানা গুণতে হবে। কিছুদিন আগে পরিবহণ সংক্রান্ত কিছু বিধি নিষেধে এমন আইন করা হয়। যার কারণে পুরানো তর্ক আবার ঘুরে ফিরে এলো। সমানাধিকারের কথা বলা হয়, অথচ সংরক্ষিত সিট বরাদ্ধ করে নারীরা অতিরিক্ত অধিকার ভোগ করছে! এ নিয়ে প্রায় বাসে পুরুষেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। এ আলোচনা যে কেবল বাসে হয় তা নয়। দৈনন্দিন জীবনে, পথে ঘাটে, ফেসবুকেও হয়। নারীদের জন্য সংরক্ষিত সিটের দরকার হয়। কারণ নারীরা দুর্বল এজন্য তারা দাঁড়িয়ে বাসে চড়তে পারে না, এছাড়াও আছে মহিলা সংক্রান্ত আরও নানান ঝামেলা। মহিলা সংক্রান্ত ঝামেলা গুলো কীরকম? এই যেমন ভিড়ের মধ্যে নারীর শরীর পুরুষের কাম জাগায়। পুরুষ বাধ্য হয়ে নারীদের গায়ে হাত দেয়। অধিকাংশ নারী নীরবে নিজেকে সরিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কোনও কোনও নারী আবার এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের প্রতিবাদ করে যা বাসের সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিনষ্টের কারণ হয়।
কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য নিয়মিত বাসে চলাচল করেন এমন একজন নারীর সাথে কথা হয়েছে। যিনি জানিয়েছেন তাদের দুর্ভোগের কথা। বাসে সিট খালি নেই, তবে দাঁড়ানোর জায়গা আছে, এরকম অবস্থায় নারীরা বাসে উঠতে গেলে গাড়ির হেল্পার জানায়, ‘মহিলা সিট নাই’। বাসের ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, ‘মহিলা তুলিস না’ কারণ মহিলা যাত্রী নিলে আবার যদি তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। ‘সিট লাগবে না, দাঁড়িয়ে যাব’ বলতে বলতে কর্মজীবী নারীরা ভিড় ঠেলে বাসে চড়েন। জানান, ভিড় বাসে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শগুলোর কথা। লজ্জায় প্রতিবাদ করতে পারেন না। যদি বলেন ‘লোকটা অসভ্যতা করছে’ তাহলে জানতে চাওয়া হয় ‘কী ধরণের অসভ্যতা তিনি করছেন?’ অসভ্যটিকে লাথি দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দিতে অসভ্যতার ধরণ জানতে হবে। কারণ পুরো বাসটিই যে ছোটবড় নানান জাতের অসভ্যতে ভরপুর।
কর্মস্থলেও নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অফিস শেষে ভিড় বাসের দুর্ভোগ পোহানোর পর বাড়ি ফিরে রান্না করে স্বামী বাচ্চাদের খাইয়ে, চাকরি ও সংসার সামলে দিন শেষে প্রমাণিত হয় নারী দুর্বল। এটা মেনে নিয়েই তারা ঘুমাতে যায়। আবার ভোর হলেই স্বামী বাচ্চাকে খাইয়ে, অফিস-স্কুলের জন্য প্রস্তুত করে নিজেকে দুর্বল প্রমাণের লড়ায়ে নেমে যায় তারা।
২. মেয়ে মানুষ একা বাইরে যাওয়া ঠিক না।
কেন ঠিক না?
মেয়ে মানুষ বলে।
আমার কাছে সবচেয়ে অপমানজনক মনে হতো যখন, সন্ধ্যার পর বের হতে হলে ছোট ভাই বা কোনও পুরুষকে সাথে নিয়ে বের হতে বলা হতো। যেন আমি একটা যৌনবস্তু, মাংসের দলা ছাড়া আর কিছু না।
হয়তো কোনও ওষুধ আনতে যেতে হবে। বলা হল দারোয়ান চাচাকে সাথে নিয়ে যাবে। সোজা বলে দিতাম, ‘তাহলে দারোয়ান চাচাকেই বলো, আমাকে বলছ কেন?’ জানি আমার নিরাপত্তার জন্যই বাবা-মা এসব বলতেন। মেয়েদের কাছে এটা স্বাভাবিক কারণ ‘তুমি দূর্বল’ ‘তুমি দুর্বল’ শুনতে শুনতে ওরা মেনেই নিয়েছে ওরা দুর্বল, অসহায়। কিন্তু অন্য মেয়েদের মত আমি এটিকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারি নি। তাই কাউকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনলেই প্রচণ্ড রেগে যেতাম।
নারীদের সংরক্ষিত আসনের দরকার হয়, চলাফেরার জন্য পুরুষ সঙ্গীর দরকার হয়, অপরাধের ভুক্তভোগী হওয়ার কারণে লজ্জিত হতে হয়। সুযোগ দেয়া হবে না কিন্তু বলা হবে, পারে না। পুরুষের উপর নির্ভরশীল বানিয়ে রেখে বলা হবে, পুরুষ ছাড়া চলতে পারে না। এটা অনেকটা শিশুদেরকে পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা ব্যবসা চালানোর মত নারীদেরকে পঙ্গু বানিয়ে ‘পুরুষতন্ত্র’ চালানো নয় কি?
যদিও একটি আমাদের কাছে নির্মম অন্যটি স্বাভাবিক। মুভিতে সেলিম ও জামাল পালিয়ে নিজেদেরকে পঙ্গু হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। নারীদের মধ্যে যারা পঙ্গুত্ব বরণ করে নি, সচেতন হয়েছে, তারা অন্যদেরকে সচেতন করার চেষ্টা করে। এজন্য আমার মতো কেউ কেউ অনলাইনে লেখালেখির পথ বেছে নিয়েছে। নারীবাদ নিয়ে লিখি বলে Abidur Rahman Maya নামে একজন বললেন, ‘লিঙ্গ নিয়ে এত নাড়াচাড়া করা কি ঠিক?’ উত্তরে বললাম, ‘আমার লিঙ্গ তো নড়াচড়া করে না, ফিক্সড। আপনাদের লিঙ্গের এত নড়াচড়া দেখে বলি। এত নড়াচড়া করলে কেউ যদি লিঙ্গে বাইড়াইয়া আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর অবস্থা না রাখে, তাইলে তো আপনাদেরই বিপদ। আপনাদের ভালোর জন্যই বলি’। আমার উত্তরটি অনেকের কাছে খুব অশ্লীল মনে হতে পারে। কারণ অন্যায়টা সমাজে স্বাভাবিক হয়ে গেছে প্রতিবাদটা বরং অস্বাভাবিক, যা অনেকের কাছে বাড়াবাড়িও মনে হয়।
সেদিন Taibur Rahaman নামে একজন আমার একটি লেখায় মন্তব্য করল, ‘এ কেমন দুনিয়া এসে গেল। দাদী নানীর পোশাক ছেড়ে সব শর্ট পোশাক পরলে ইভটিজিং ধর্ষণ হবে না কেন? এ যেন বাঘের সামনে মাংস রেখে মানবতার কথা বলা হা হা হা আজব দুনিয়া’। ধর্ষণ করাটাকে উনি সম্ভবত ওনার মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছেন। উত্তর দিলাম, ‘নিজেকে বাঘ আর মেয়েদেরকে মাংসের দলা মনে করা প্রজাতির স্থান জঙ্গলে। যদিও জঙ্গলের পশুরা তাকে মেনে নিলে আরকি! মেনে না নিলে তাদের জন্য রয়েছে চিড়িয়াখানা, রয়েছে খাঁচা।’
‘সেক্স চ্যাট করতে পারেন?’ এর উত্তরে, ‘না ভাই, আমি খালি বিচি ছ্যাঁচতে পারি। লাগবে ছ্যাঁচা?’ গুণীজনেরা বলেন, এ ধরণের মন্তব্যকারীদের সাথে তর্কে যেও না। কুকুর তোমাকে কামড় দিলে তুমিও কি কুকুরকে কামড়াতে যাবে?’ আমার কাছে আসলে এধরণের মন্তব্যগুলোর উত্তর দেয়া জরুরী মনে হয়। আমি প্রতিবাদী হতে প্রেরণা জাগানো বিশাল লেখা লিখে ফেললাম। আমার লেখা অনুযায়ী কেউ চলতে গেলে তাকে ঠিক এ ধরণেরই মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হবে যা আমার লেখার মন্তব্যে আমি পেয়ে থাকি। আরেকজনকে প্রতিবাদী হতে বলে একই ধরণের মন্তব্যের মুখোমুখি করলাম, অথচ আমি নিজে সেসব এড়িয়ে গেলাম। এটা অনেকটা নিজেকে বাঁচিয়ে অন্যকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার মত। আমি এই থিউরিতে বিশ্বাসী নই। আমার মতে, প্রতিবাদ করতে সাহস জোগাতে বড় বড় লেখার চেয়ে একজনকে প্রতিবাদ করতে দেখলেই বরং অনেকটা সাহস সৃষ্টি হয়ে যায় যা ওই লেখায় হয় না। ইদানীং আমার উত্তর পেয়ে কেউ কেউ নিজেদের কমেন্টটাই ডিলিট করে দেয়, কেউ আবার ক্ষমা চায় বাজে মন্তব্যের জন্য। আমি এড়িয়ে গেলে অনেক মেয়েরা নিজেরা সেসবের উত্তর দেয়। পাল্টা আঘাত না এলে ওদের হুশ ফিরবে না, দুর্বল বানিয়ে দুর্বল প্রমাণের এসব প্রথা চলতেই থাকবে। আর পাল্টা আঘাতের শুরুটা বোধ হয় এভাবেই হয়।