মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৭

একই আদর্শে নন্দিত রোকেয়া, নিন্দিত তসলিমা



৯ ডিসেম্বর। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস। বেগম রোকেয়া ও তসলিমা নাসরিন উভয়েই নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। বেগম রোকেয়া তাঁর সময়কালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিন্দা কুড়িয়েছিলেন, বর্তমানে তসলিমা নাসরিন কুড়াচ্ছেন। তসলিমা নাসরিন ও বেগম রোকেয়ার লেখার মূল অর্থ এক হলেও তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ নাম আর বেগম রোকেয়া মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে সম্মানিত। পাঠ্যবইয়ে বেগম রোকেয়ার বাছাই করা কিছু লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রোকেয়া হল, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নারী অধিকারের পক্ষে তসলিমা নাসরিনের কোনও লেখা উল্লেখ করলে লোকে বলে তসলিমা নয় বেগম রোকেয়া পড়ো। বেগম রোকেয়াকে অনুসরণ করো। বেগম রোকেয়াকে আমাদের সমাজে একজন মুসলিম নারীর ইমেজ দেয়া হয়েছে। ঘোমটা পরা, স্বামী-পিতা-ভাইদের সকল আদেশ মাথা পেতে নিয়ে কেবল স্কুলে যাওয়ার অধিকার চায় এমন। যদিও বেগম রোকেয়ার বই গুলো ঘাঁটলে তাঁর লেখা ভয়ংকর সব সত্য বেরিয়ে আসে- ধর্ম সম্পর্কে, পুরুষ সম্পর্কে। এতে বোঝা যায় রোকেয়া ও তসলিমার আদর্শ ভিন্ন নয় বরং এক।

বেগম রোকেয়া মৃত। তসলিমা জীবিত। জীবিত তসলিমাকে কবর দিতে মৃত বেগম রোকেয়াকে টেনে আনা হয় নিজেদের মত করে। ভবিষ্যতে হয়তো নতুন কোনও প্রতিবাদী নারী আসবে যাকে নিষিদ্ধ করতে তসলিমাকে হিজাব পরিয়ে মুসলিম নারী সাজানো হবে। একথা তসলিমা নাসরিন তাঁর ‘সেই সব অন্ধকার’ বইটিতেও উল্লেখ করেছিলেন।

তসলিমা নাস্তিক, বেগম রোকেয়া আস্তিক। কাজেই বেগম রোকেয়াকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। এরকম একটি ধারণা প্রচলিত আছে। চলুন দেখি বেগম রোকেয়া ধর্ম সম্পর্কে কী লিখে গেছেন- "আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।... তবেই দেখিতেছেন, এই ধর্মগ্রন্থগুলো পুরুষ রচিত বিধি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। ...কোন স্ত্রী মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন।..যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ় সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।..." ( গ্রন্থঃ মতিচুর) 




এখানে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় রোকেয়া ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। বেগম রোকেয়ার মত তসলিমা নাসরিনও মনে করেন, ধর্ম হল নারীকে দমনের উদ্দেশ্যে পুরুষের সৃষ্ট কিছু বিধান। যেখানে ধর্মের প্রভাব বেশি সেখানে নারীর প্রতি অত্যাচার ও বেশি। এ কথা রোকেয়া বলেছিলেন, তসলিমা তাঁর বিভিন্ন লেখায় নানান তথ্য হাজির করে প্রমাণও করেছেন। 

‘অলঙ্কার না Badge of Slavery’ প্রবন্ধে রোকেয়া লিখেছেন “ ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে। যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণী শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিত না । ... যে কথা পুরাকালে অসভ্য বর্বরগণ বিশ্বাস করিয়াছিল, তাহা বর্তমান কালের সুসভ্যগণ যদি বিশ্বাস করেন, তবে সভ্যতা ও অসভ্যতায় প্রভেদ কি ? যাহা হউক আমরা আর ধর্মের নামে নতমস্তকে নরের প্রভুত্ব সহিব না ।”

ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা পুরুষতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী তাঁরা মনে করেন তসলিমা নাসরিন পুরুষ বিদ্বেষী, আর রোকেয়া তেমনটা নন। কাজেই রোকেয়া অনুসরনীয়, তসলিমা বর্জনীয়। আসুন দেখি পুরুষ সম্পর্কে রোকেয়া কী বলেছেন-




১. নারী যাহা দশ বৎসরে করিতে পারে, পুরুষ তাহা শতবর্ষেও করিতে অক্ষম।

২. নারীস্থানে স্বয়ং শয়তানকেই (পুরুষ জাতি) শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছেন, দেশে আর শয়তানী থাকিবে কি রূপে? (সুলতানার স্বপ্ন, ১৩৪) 

৩. তাহারা কিছুই করিবে না- তাহারা কোন ভালো কাজের উপযুক্ত নহে। তাহাদিগকে ধরিয়া অন্তঃপুরে বন্দি করিয়া রাখুন। (সুলতানার স্বপ্ন, ১৩৫)

৪. কুকুরজাতি পুরুষাপেক্ষা অধিক বিশ্বাসযোগ্য। (ডেলিশিয়া-হত্যা)

যারা পুরুষতন্ত্রকে মনেপ্রাণে ধারণ করে, তাঁরা সাধারণত পুরুষ আর পুরুষতন্ত্র’কে আলাদা করতে পারেন না। তাই তাঁরা নারীবাদ বলতে বুঝেন পুরুষ বিদ্বেষ। ইদানীং অনলাইনে নারীবাদ নিয়ে কিছু লিখলেই সেসব পুরুষেরা স্লোগান তুলেন, ‘সব পুরুষ এক নয়’। নিজেকে এক মনে না করলে, ভিন্ন মনে করলে সেসব কথা নিজের গায়ে না লাগালেই পারেন। হাতেগোনা কয়েকজন ভালো পুরুষ আছেন অবশ্যই। যারা সমানাধিকারে বিশ্বাস করেন, নারী অধিকারে বিশ্বাস করেন। কিন্তু ভুষির বস্তায় দু এক দানা চাল পাওয়া গেলেই তো আর সেটা চালের বস্তা হয়ে যায় না বা সে চালগুলোর কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করতে হয় না। তসলিমা’কে বর্জনের ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের একটি হাস্যকর যুক্তি হলঃ বেগম রোকেয়া মেয়েদের জন্য স্কুল করেছে, ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অভিভাবকদের বুঝিয়েছেন।তসলিমা কি ঘরে ঘরে গিয়ে সবাইকে নারী অধিকার বুঝিয়েছে? মেয়েদের জন্য স্কুল করেছে? না। কাজেই তসলিমা বর্জনীয়। ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষার আলো পৌঁছানোর যুগ পার করে এসেছি আমরা। আর মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্য দেশে এনজিওর অভাব নেই। বেগম রোকেয়ার সময়ে রোকেয়া যা করছেন এবং তসলিমার সময়ে তসলিমা যা করছেন দুজনেই সঠিক। সময়ের পার্থক্যে কাজের পদ্ধতি ভিন্ন হয়েছে শুধু।

বেগম রোকেয়া সমাজের অবস্থা বিবেচনায় তাঁর স্কুলটিকে টিকিয়ে রাখতে অনেক সময় আপোষ করেছেন বটে। তবে বর্তমানে বেগম রোকেয়ার মূল আদর্শকে আড়াল করে ওই আপোষের অংশটুকুকেই রোকেয়ার আদর্শ হিসেবে দেখানো হয়।

১. আমার স্কুলটা আমার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়। একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়ম কানুনগুলিও পালন করছি। (সওগত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনকে দেয়া সাক্ষাৎকার)

২. তবু পর্দা করছি কেন জানেন? বুড়ো হয়ে গেছি, মরে যাব। ইস্কুলটা এতদিন চালিয়ে এলাম, আমার মরার সঙ্গে সঙ্গে এও যদি মরে সেই ভয়ে। (ইব্রাহিম খাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার) 

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এবং তসলিমা নাসরিন উভয়েই স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন, ধর্মের ছায়াতলে কখনও নারীমুক্তি সম্ভব নয়। বর্তমানে অনেকেই আছেন যারা বেগম রোকেয়াকে আদর্শ মনে করেন, লেখাপড়া শিখে স্বামীর আদেশ মেনে হিজাব মাথায় চাপেন। মনে করেন হিজাব পালন তাদের ধর্মীয় নীতি এবং হিজাবে নারীর সম্মান বাড়ে। তারা কেন প্রশ্ন তোলে না, ধর্ম রক্ষা করতে ক’জন পুরুষ দাড়ি রাখে, টুপি পরে, জিন্স টি-শার্ট ফেলে টাকনুর উপর পাজামা পরে? ধর্ম রক্ষার দায় কি শুধু নারীর? তাঁরা প্রশ্ন করেন না, কারণ ধর্ম তাদেরকে প্রশ্ন করতে শেখায় না, মেনে চলতে শেখায়।

ইসলামিক পিস টিভির হুজুর যিনি তাঁর ওয়াজের জন্য বিখ্যাত, নাম আব্দুর রাজ্জাক। এই আব্দুর রাজ্জাকের এক ওয়াজে দেখলাম, তিনি বেগম রোকেয়াকে নারী জাতির কলঙ্ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং হাজারো ধর্মপ্রাণ মুসল্লি সেসব শুনছেন। না, তিনি রোকেয়ার ধর্মবিরোধী লেখা পড়ে তাঁকে ত্যাগের ৯ ডিসেম্বর। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস। বেগম রোকেয়া ও তসলিমা নাসরিন উভয়েই নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। বেগম রোকেয়া তাঁর সময়কালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিন্দা কুড়িয়েছিলেন, বর্তমানে তসলিমা নাসরিন কুড়াচ্ছেন। তসলিমা নাসরিন ও বেগম রোকেয়ার লেখার মূল অর্থ বা উদ্দেশ্য এক হলেও তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ নাম আর বেগম রোকেয়া মুসলিম নারী জাগরণের অঘোষণা দিয়েছেন তা নয়। রোকেয়া নারীকে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হওয়ার কথা বলেছেন বলেই হুজুরের কাছে তিনি নারী জাতির কলঙ্ক উপাধি পেয়েছেন। শফি হুজুর, যিনি মনে করেন মেয়েদের বাইরে কাজ করার অধিকার নেই, আল্লাহ্‌ নারীদের সৃষ্টি করেছেন শুধু ঘরের কাজ ও স্বামী সেবার জন্য। সেই হুজুর লক্ষ জনতা নিয়ে ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে সংবিধান বিরোধী ১৩ দফা দাবী তোলার সাহস পায়। ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার ফল তো এমনই হয়।

বেগম রোকেয়ার সময়কাল থেকে নারীরা একটু করে এগিয়ে প্রথমে পর্দার ভিতরে থেকে স্কুলে গেছে, ধীরে ধীরে শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পর্দা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে, পরবর্তীতে রাজনৈতিক-সামাজিক বিভিন্ন বিপ্লবে ও প্রতিবাদে নিজেরা অংশগ্রহণ করেছে, মতামত দিয়েছে।রোকেয়ার আদর্শ’কে পুরোপুরি মেনে না নিলেও বাছাই করা অংশটুকুকে অন্তত মেনে নেয়া হয়েছিল, রোকেয়া নামটিকে শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণের নীতি চালু হয়েছিল।এই অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বর্তমানে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ আমরা এক পা এক পা করে পিছিয়ে আবার ‘পর্দার ভিতরে থেকে লেখাপড়ার অধিকার’এর যুগে চলে এসেছি। ঠিক যেভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় একটি দেশ সৃষ্টি হয়ে বর্তমানে দেশটি রাষ্ট্রধর্মের অভিশাপ নিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হওয়ার পথে হাঁটছে। এখানেই ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদীদের সার্থকতা।

শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল মেয়েটির?



কিছুদিন আগে অনলাইনে একজন ছাত্রীর সাথে স্কুল শিক্ষকের কথোপকথন শুনছিলাম। ওই শিক্ষক ক্লাস এইটে কিংবা নাইনে পড়ে এমন একজন বাচ্চা মেয়েকে বিছানায় নেয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছিলেন। কথোপকথনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরছি-

স্যারঃ তুমি কি আমার কথা রাখবা না? আমাকে একটু সময় দাও, আসো কথা বলি। 

ছাত্রীঃ কী কথা স্যার? শিক্ষা বিষয়ক কথা? 

স্যারঃ তোমাকে কেনাকাটা করে দিব। 

ছাত্রীঃ আমার বাপ কি আমারে টাকা দেয় না? আপনের টাকা কেন নিব? 

স্যারঃ তোমাকে আমার ভালো লাগে। মনটা উথাল পাতাল করে তোমাকে দেখলে। 

ছাত্রীঃ ছিঃ ছিঃ স্যার। আপনি এসব কী বলেন? স্যার আপনার বউ নাই? 

স্যারঃ বউ আছে, কিন্তু বউ কী সবসময় ভালো লাগে? 

ছাত্রীঃ বউকে সবসময় ভালো না লাগলে আরেকটা বিয়া করেন। 

স্যারঃ তুমি কী পারবা না? তুমি পারবে কিনা বলো। 

ছাত্রীঃ আমি পারব মানে? কয়লা ধুইলে কখনো ময়লা যায় না। আমি যদি এখন এই কথা গুলো সবাইকে শোনাই? স্যারঃ না, প্লিজ। আমি আর বলব না। 

ছাত্রীঃ বলবেন না কেন স্যার? আজকে আপনি আমাকে বলছেন, কালকে আরেকজন স্টুডেন্টকে বলবেন। 

স্যারঃ আমি যা বলছি ভুল করছি। আর কখনো বলব না। 

ছাত্রীঃ স্যারদের একটা আলাদা নলেজ থাকে, আর একজন স্টুডেন্টের কথায় যদি স্যারের নলেজ হয় তাহলে সেই স্যারের কোনও যোগ্যতাই নাই স্কুলে শিক্ষকতা করার। আমি সব হেডমাস্টার স্যারকে শুনাইয়া দিব।

একজন শিক্ষক কী নোংরাভাবে বাচ্চা মেয়েটিকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দিলো! ভাবতে অবাক লাগে শিক্ষকদের মধ্যে এই মানসিকতার মানুষও আছেন। হেড স্যারের কাছে জানিয়ে কোনও ফল পেয়েছে কিনা জানি না। তবে মেয়েটির বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রেই মেয়েরা সমাজে সম্মানী ব্যক্তিদের নষ্ট চরিত্রের কথা প্রকাশ করে কোনও ফল পায় না। উল্টো মেয়েটির চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠে, দোষ দেওয়া হয় মেয়েটিকে। এই ভয়ে অনেকে অভিযোগ করতেও ভয় পায়।

আমি ফেসবুকে এরকম একজন ব্যক্তিকে চিনি, যিনি নিজেকে নাস্তিক দাবি করেন, টুকটাক কপিপেস্ট নারীবাদী লেখা লিখেন, আবার মাঝেমাঝে নারী নিয়ে মস্করাও করেন। তিনি সাধারণত নারীকে দুর্বল দাবি করে তার একটি লেখা বিভিন্ন মেয়েদের ইনবক্সে পাঠান। যেসব মেয়েরা ওই লেখার কোনও প্রতিবাদ করে না তাদেরকে তিনি নিয়মিত ইনবক্সে নক দিয়ে রূপের প্রশংসা, শরীরের প্রশংসা ইত্যাদি করে সম্পর্ক বিছানা পর্যন্ত নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আর নিজের সম্পর্কে সবাইকে বলেন, তিনি ইয়াং হ্যান্ডসাম, বিয়ে একবার করেছিলেন তবে বৌয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি, একা থাকেন। যদিও আমি তার বাসায় গিয়ে তার স্ত্রীর হাতের রান্না খেয়ে এসেছি। নিজেকে ইয়াং দাবি করলেও তার মেয়ের বয়স এখন ত্রিশের কাছাকাছি।

সরকারি চাকরি করেন, টাকা পয়সা ভালোই আছে, সমাজে সম্মান আছে, শুধু চরিত্রের ঠিক নেই। অনলাইনে নাস্তিকতা নিয়ে টুকটাক লিখেন বলে ঝুঁকির কথা চিন্তা করে আমি তার নাম ঠিকানা প্রকাশ না করে তার সম্পর্কে একবার লিখেছিলাম, অন্যদের সচেতন করতে। বদলা নিতে তিনি আমার নাম ঠিকানা সব প্রকাশ করতে বেশ কিছু ফেক আইডি, ফেক চ্যাট বানিয়েছিলে। যদিও শেষ পর্যন্ত খুব বেশিদূর আগাতে পারেননি। আমি যদি তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে তার নাম প্রকাশ করে তার সম্পর্কে লিখতাম, তবে অধিকাংশ মানুষই আমার কথা বিশ্বাস করতেন না। পুরুষ হওয়ার এই এক সুবিধা। সব ধরনের নোংরা কাজ করেও সমাজের চোখে সম্মানী পুরুষ হিসেবে সমর্থন পাওয়া যায়।

খাদিজাকে কোপানোর ভিডিওটা পাওয়া না গেলে হয়তো খুনি বদরুলের ফেসবুকে মায়াভরা ‘পবিত্র’ চেহারা আর স্ট্যাটাস হিসেবে দেয়া জ্ঞানের কথাগুলো দেখে খাদিজার পোশাকের দোষ ত্রুটি খোঁজার চেষ্টা করতাম। ভাগ্যিস কেউ একজন সেদিন ভিডিও করেছিলেন! প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার কারণে এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ এসব প্রতিদিন খবরের পাতার কোণায় অবহেলিত ভাবে থাকে, আমাদের নজর এড়িয়ে যায় । প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ায় কুপিয়ে হত্যা- ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এসব খবর আবার পত্রিকার মাঝখান থেকে ছোট্ট কোনও কোণায় স্থান পাবে।

মের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ার ব্যাপারটা সমাজের পুরুষেরা অনেকেই মেনে নিতে পারে না। পুরুষের আধিপত্য সমাজের প্রতিটি স্তরে। পরিবার, স্কুল কলেজ, কর্মস্থল সব জায়গাতে সিদ্ধান্ত বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো থাকে পুরুষের দখলে। তাই নারী, পুরুষের হ্যাঁ তে হ্যাঁ, না তে না মেলাচ্ছে এমনটাতেই অভ্যস্ত পুরুষ। এর ব্যতিক্রম তারা সহ্য করতে পারে না। তাদের কোনও প্রস্তাবে নারী ‘না’ বলছে, এটা মেনে নিতে পারে না। নারী স্বাধীনতার মূল কথাই হল, নারীর স্বেচ্ছায় ‘না’ বা ‘হ্যাঁ’ বলার অধিকার। বদরুলের বিচার চাওয়ার মিছিলে পুরুষের সংখ্যা দেখে অনেকে মনে করতে পারেন সমাজে বদরুলদের সংখ্যা কম। যদিও বাস্তবে ওই মিছিলে অংশ নেয়া পুরুষদের অনেকেই নারীর এই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলার স্বাধীনতাতে বিশ্বাস করে না। সমাজে পুরুষের আধিপত্য যতদিন জারি থাকবে ততদিন সমাজে নতুন নতুন বদরুলের সৃষ্টি হবে এতে কোনও সন্দেহ নেই।

বিয়ের বাজার

মাসখানেক আগে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। আমারও এবছর এইচএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে এখন আমি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাঁটছি। সেসব কথা থাক।
আমার বন্ধুরা সবাই এইচএসসি দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ এর ওপরই নির্ভর করে ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার। ক্যারিয়ার গড়ার প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু বৈষম্য ভবিষ্যতে কীভাবে বিরাট পার্থক্য গড়ে দেয় সেই চিত্রটা আজকের লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশে মোট ৩৭টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটি গুলোর ডিমান্ড চাকরির বাজারে বেশি বলে সবার লক্ষ্য থাকে ঐ ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়। মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় এসব ইউনিভার্সিটিতে সিটের সংখ্যা নগণ্য। তাই প্রত্যেককেই অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। নিজের শহরের বাইরে গিয়ে এসব পরীক্ষা দেয়া ছেলেদের পক্ষে সম্ভব হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশাল সমস্যা।
ছেলেরা সাধারণত বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে যায়, অভিভাবক যাওয়ার দরকার হয় না। আর মেয়েরা? বন্ধুদের সাথে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় এক ইউনিভার্সিটি থেকে আরেক ইউনিভার্সিটিতে দল বেঁধে যাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেনা। অভিভাবকদের সাহায্য নিতে হয়, অনুমতি নিতে হয়, অভিভাবকদের কাজের ফাঁকে সময় বের করতে পারবে কিনা সেই চিন্তাও করতে হয়। অভিভাবকরা যদি বলে, তোমার সাথে যাওয়ার মতো আমার সময় নেই, কাজের চাপ, ছুটি নিতে পারছি না, ব্যবসার ক্ষতি হয়ে যাবে অতএব পরীক্ষা দিতে হবে না। পরীক্ষা দেয়া বন্ধ। কাছের কোনো ইউনিভার্সিটিতে চেষ্টা করো। না হলে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হও। শেষ পর্যন্ত পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।
স্বপ্ন বাস্তবতার মুখ না দেখার একটি অন্যতম কারণ, নিরাপত্তা সমস্যা। আর অনার্সের মাঝামাঝি সময় একটা ভালো পাত্র পেয়ে গেলেই মেয়ের আসল ঠিকানা অর্থাৎ ‘স্বামীর সংসার’এ পাঠিয়ে দেয়ার মানসিকতা তো আছেই। ভালো পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, বিয়ের পিঁড়িতে বসও। ব্যস, সংসার পেতে বসতে হয়। তখন স্বাবলম্বী হওয়ার সুখ স্বপ্ন ভুলে, হাঁড়ি পাতিল, বাচ্চাকাচ্চা স্বামী সেবায় সুখ খোঁজে।
আমার এক মেয়ে বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। তার মা-বাবার কোনও আপত্তি নেই মেয়েকে অন্য শহরে রেখে পড়াতে। তবে তার জ্ঞানীগুণী আত্মীয় স্বজনেরা নাকি প্রায় তার মা-বাবাকে বাস্তবতা বোঝাতে আসতেন। মেয়েকে চোখের আড়াল করে লেখাপড়া করতে পাঠানো কতটা ভুল সিদ্ধান্ত সেটা জানাতেন।
নিরাপত্তা সমস্যা এবং মানসিকতা সমস্যা, এই দুটো সমস্যার কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সারাদেশে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ফলাফল ভাল হওয়া স্বত্বেও ভবিষ্যতে ভালো ক্যারিয়ারের রাস্তাটাতে ছেলেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়।
আপাত দৃষ্টিতে এটাকে তুচ্ছ কিছু মনে হলেও এটা কিন্তু ভয়াবহ একটি সমস্যা। দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। শিক্ষিতের অর্ধেক অংশ নিজের বিদ্যা বুদ্ধিকে কাপড় ধোয়ার সেরা সাবান, আর সেরা মেলামাইন বাছাইয়ের ক্ষেত্রেই শুধু ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে।
আমার এক ডাক্তারি পড়ুয়া দাদার সাথে কথা বলছিলাম। সে বিয়ের ক্ষেত্রে কী ধরনের মেয়ে পছন্দ করবে সেসব নিয়েই মূলত আলোচনা। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, সহপাঠীদের মধ্যে কাউকে পছন্দ হয় কিনা। বলল, তা হয়। তবে সে সহপাঠীদের কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারবে না। তার মায়ের বয়স হচ্ছে, বাড়িতে মায়ের একজন সাহায্যকারী লাগবে, সেই উদ্দেশ্যেই সে বিয়ে করবে। আর ডাক্তারি পড়া একজন মেয়েকে সে বাড়িতে বসিয়ে রাখবে? তার একটা বিবেক আছে না? তাই সে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ কাউকে বিয়ে করবে। যাকে বাড়িতে মায়ের সাহায্যকারী বানানো যাবে।
বাংলাদেশে কয়জন ছেলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়? বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ কোনও বিষয় নিয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করে ভালো চাকরিও করে। কিন্তু ডাক্তার স্বামীর বিশ্ববিদ্যালয় পাশ স্ত্রীকে সাধারণত ঘরের কাজেই দেখা যায়। অর্থের দরকার না থাকলে মেয়েদের চাকরির প্রয়োজনীয়তা তেমন থাকে না বলে অনুমতিও পাওয়া যায় না।
ফেসবুকে প্রায় স্ট্যাটাস দেখি, ছেলে বিয়ে করতে চায়। কারণ তার রান্না করার কেউ নেই,কাপড় ধোয়ার কেউ নেই, ঘর গোছানোর কেউ নেই। তাই তার একজন বউ লাগবে। আমি বুঝি না, এধরনের ছেলেরা বিয়ে করতে গিয়ে শিক্ষিত মেয়ে খুঁজে কেন! ঘরের কাজ করে এরকম কাজের খালাদের কাউকে বিয়ে করে নিলেই পারে। কারণ ঘরের কাজের দক্ষতা তো শিক্ষিত বউদের চেয়ে তাদেরই বেশি থাকার কথা। আমার মনে হয়, কে কত শিক্ষিত একটি মেয়েকে নিজের দখলে নিতে পেরেছে সেরকম একটা প্রতিযোগিতা বাজারে চালু আছে। তাই বিয়ের সময় তাদের শিক্ষিত মেয়ে দরকার হয়।
এতো গেল শিক্ষিত ছেলেদের শিক্ষিত মেয়ে খোঁজার কথা। দেশের প্রায় সব ছেলেই বিয়ের সময় শিক্ষিত মেয়ের চেয়ে সুন্দরী মেয়ে খোঁজে বেশি। যাতে করে আড্ডায় বন্ধুদের সাথে বড় মুখ করে বলতে পারে, আমার বউ সবচেয়ে সুন্দরী! মেয়ে দেখতে গিয়ে- মেয়ে হাঁটতে পারে কিনা, কথা বলতে পারে কিনা, গলার স্বর কেমন, শরীরে কোথাও কোনও খুঁত আছে কিনা ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। যেন মাছের বাজারে মাছ টিপে টিপে দেখছে। পছন্দ না হলে নতুন কোনো মেয়ে দেখে, পছন্দ হলে শুরু হয় দরদাম। বিয়েতে মেয়ের বাবা কী দিবে। কয় ভরি সোনা, কোন ব্র্যান্ডের বাইক নাকি কার, ঘর সাজানোর খাট, ফ্রিজ, টেলিভিশন। তর্কবিতর্ক করে কত টাকায় বা কত সস্তায় দেনমোহরের নামে মেয়ে কেনা যায়! এ যে মেয়েদের জন্যে কত লজ্জার, কত অপমানের তা কি সে সব ‘শিক্ষিত’ (?), টাকাওয়ালা, একের পর এক পাত্রী দেখে যাওয়া ছেলেরা ভেবে দেখেছে কখনো?
মেয়েদের ন্যূনতম সম্মান আছে, অধিকার আছে এমন সমাজেও এ ধরনের বর্বর নিয়ম নেই যা আমাদের সমাজে গর্ব ও ঐতিহ্য নিয়ে যুগযুগ ধরে চলে আসছে।