বাংলাদেশ এই কয়েকবছরে হিজাবী নারীর সংখ্যা প্রচুর পরিমানে বেড়ে গেছে। মনে হয় যেন, হিজাব এইদেশের জাতীয় পোশাক। আমি মিশনারি স্কুলে পড়েছি। তাই ওই স্কুলে হিজাব বোরখা এইসব নিষিদ্ধ ছিল। অনেকে স্কুল থেকে বের হলে হিজাব ওড়না জড়িয়ে নিতো, স্কুলে ঢুকলে সেসব খুলে ফেলতো। কলেজে এসে দেখি হিজাবে চারদিক ছেয়ে গেছে। কলেজের বেশির ভাগ ম্যাডাম হিজাব পরে। আমাদের কলেজে ছেলেদের দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ, তবে মেয়েদের হিজাবের ব্যাপারে কোন নিষেধ নেই।
গত বছর শীতকালে ঠান্ডা থেকে বাঁচতে, কলেজে যাওয়ার সময় একটা মাফলার গলায় জড়িয়ে নিতাম। তবে এর অন্য একটি ব্যবহারও ছিল। আমি যখন ক্লাস পালাতাম তখন দূর থেকে আমার ছোট চুল দেখে আমাকে চিনে ফেলতেন অনেক স্যারেরা। তাই শীতাকাল গলায় মাফলার ঝুলিয়ে রাখতাম যাতে শীতও কম লাগে, আবার প্রয়োজনের সময় মাথা মাফলার দিয়ে ঢেকে ক্লাস পালাতেও সুবিধা হয়। যখন আস্তে আস্তে শীত কমতে শুরু করল, তখন এই মাফলার আমার অস্বস্তির কারন হয়ে দাঁড়ালো। ধরা পড়লে পরব, তবে এই মাফলার পেঁচিয়ে থাকা সম্ভব নয়, এই ভেবে মাফলার ত্যাগ করলাম। তখন আমার মাথায় প্রশ্ন এলো, গরম তখনো শুরু হয় নি, অথচ এতেই মাফলার নিয়ে আমার এত বিরক্তি! আর প্রচন্ড গরমে আমার সমবয়সীরা কিনা মাথায় কাপড়ের বস্তা জড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়, তারা কিভাবে থাকে? ভাবতে গেলে খুব খারাপ লাগে। তাদের কষ্ট হয় কিনা জিজ্ঞেস করলে বলে, অভ্যাস হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দেখি গরমে অতিষ্ঠ হয়ে হিজাবীরা ওয়াশরুমে গিয়ে হিজাব খুলে বসে থাকে।
কেন তারা হিজাব পরে, জানতে চাইলে অধিকাংশই বলেছে, তাদের ধর্মে আছে তাই। আবার কেউ বলেছে, আব্বু বলেছে হিজাব পরতে। কেউ বলে ‘খারাপ দৃষ্টি’ থেকে নিজেকে বাঁচাতে হিজাব পরে।
ধর্মে আছে হিজাব পড়তে তাই পড়েছে, ধর্মে তো আগেও ছিল। আর ধর্মে তো শুধু হিজাব-বোরখা নয়, দাড়ি-টুপি-পায়ের গোড়ালির উপরে প্যান্ট পরার কথা ও আছে। কিন্তু সেসব নিয়ে কয়জন চিন্তিত? তবে হঠাৎ কেবল মেয়েরাই কেন এমন ধর্মকর্মে বিশেষ মনযোগী হয়ে উঠল, এর কারণ আমাকে খুব ভাবিয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা অনেকটা সংক্রামক। কয়েকজন হিজাব পরল, চারপাশের মানুষজন যখন তাদেরকে দেখে যখন ভালো মেয়ে, ধার্মিক মেয়ে ইত্যাদি মন্তব্য করতে লাগলো তখন অন্যেরাও সমাজের চোখে ভালো হতে, ধার্মিক হতে হিজাবের আশ্রয় নিলো। এই যেমন চিত্রনায়িকা হ্যাপি জিন্সের প্যান্ট পড়ে রুবেলের সাথে প্রেম করেছে। যখনই রুবেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মিডিয়ায় এলো তখনই সবাই হ্যাপিকে ‘পতিতা’ উপাধি দিয়ে রুবেলকে জমজমের পানিতে ধোয়া তুলসী পাতা বানিয়ে দিলো। তাই হ্যাপি সমাজের চোখে ভালো হতে জিন্স ছেড়ে হিজাবের আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের সমাজে মেয়েরা সবসময় ভালো মেয়ে, ভদ্র মেয়ে, ধার্মিক মেয়ে হওয়ার চেষ্টা করে। কারণ যা কিছুই হোক না কেন, দোষ তো মেয়েরই হবে। কাজেই মেয়েরা এই বিষয়ে খুব সচেতন।
ছবিটি গতবছর চিটাগাং এর বিনোদন পার্ক ফয়েজলেইক থেকে তোলা |
আমার এক হিজাবী বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম, হিজাব নিয়ে তার বিরক্তির শেষ নেই। সে বলে সব কিছুর মূলে হল তার আম্মু। তার আম্মু তার আব্বুর নির্দেশে বোরখা পড়ে এবং আমার ওই বন্ধুকেও বাধ্য করে হিজাব পরতে। সে সব কিছুর মূলে তার আম্মুর দোষ খুঁজে পায়। কিন্তু আমি খুঁজে পাই, ধর্মের দোষ।
বোরখাওয়ালীরাও আনন্দ করতে চায়, তখন তারা অনুভব করে যে বোরখা খুব বিরক্তিকর। তারা তাদেরকে যে বোরখা পরতে বাধ্য করছে, যেমনঃ বাবা, ভাই, স্বামী, তাদের উপর রাগ দেখায়। তারা ভুলে যায় যে, তাদেরকে বস্তাবন্দী থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ধর্মে। আমরা নাস্তিকরা যদি সেটা দেখিয়ে দিই যে, মূল সমস্যা তোমার পিতা বা স্বামী না, মূল সমস্যা হল ধর্ম, এইসব ধর্মের সৃষ্টিকর্তা হল পুরুষ, তখন এইসব বোরখাওয়ালীরা এর প্রতিবাদ করে, তখন তাদের ধর্ম অনুভুতিতে আঘাত লাগে। তারা মুক্তি চায়, আবার মুক্ত করার রাস্তায় হাঁটতে চায় না। তাদেরই বা দোষ কিভাবে দেই? তারা তো নিজের চিন্তা বুদ্ধি বিবেক বলে যে কিছু আছে, নিজের মতামত বলে যে কিছু একটা আছে, সেটাই জানে না। কারণ জন্মের পর থেকেই তাদের শুধু প্রভুর নির্দেশ অনুযায়ী চলার ট্রেনিংই দেয়া হয়েছে। তারা তাদের নিজস্ব বুদ্ধিবিবেক বিবেচনা বন্ধক রেখেছে ধর্ম আর পুরুষতান্ত্রিকতার হাতে ।
চট্টগ্রামে নার্সিং কলেজের অঞ্জলি নামের এক শিক্ষক তার ছাত্রীদের হিজাব না পরার কথা বললে কয়েকদিন পরই তাকে প্রাণ হারাতে হয় মৌলবাদীদের হাতে। এটা খুব স্পষ্ট যে, এক শ্রেনির মানুষ খুব সচেতন ভাবে মেয়েদের হিজাবী বানানোর ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। কেউ বাধা দিলেই তাকে মেরে ফেলছে।
কেন মেয়েরা সব একসাথে তসলিমা নাসরিনের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলছে না যে, ‘যৌন উত্তেজনা বেড়েছে তোমার, সে তোমার সমস্যা, আমার নয়। তোমার সেটি বাড়ে বলে আমার নাক চোখ মুখ সব বন্ধ করে দেবে, এ হতে পারে না। আমি তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নই’? নিজেকে অন্যের সম্পত্তি ভাবে বলেই মেয়েরা হিজাব পরে, বোরখা পরে, স্বামীর মঙ্গলের জন্য সিঁদুর পরে। নিজের ভালো লাগা ভুলে গিয়ে অন্যের ইচ্ছায় জীবন চালায়। আমাদের দেশের মেয়েদের নিজের বলে কিছু নেই, তারা নিজেরাই অন্যের সম্পত্তি। কি অসহায় তারা, তাই না? ভাবতে খুব কষ্ট হয়।
অনেক সুন্দর লেখা ।
উত্তরমুছুন"আমাদের কলেজে ছেলেদের দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ",কলেজের নামটা কি জানতে পারি?এবং এটি কোথায় অবস্থিত সেটা জানালে আরও উপকৃত হবো...
উত্তরমুছুন