বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বেঁচে ফিরার গল্প

আমি প্রায় বিশ দিনের বেশি সময় ধরে অনলাইনে নেই। অনেকে হয়তো ভেবেছেন আমার আইডি রিপোর্টের কারনে বন্ধ, আসলে তা নয়। আমি আমার অপরাধের সাজা স্বরূপ এতদিন অজ্ঞাত জীবনে গিয়েছিলাম। নিশ্চয়ই জানতে চাইছেন কি আমার অপরাধ? আমার অপরাধ, ৯৯ পারসেন্ট মূর্খের দেশে জন্মে মুক্তচিন্তার চর্চা করা, নিজের মতামত স্বাধীন ভাবে প্রকাশ করা, ধর্মে নয় বরং মানবতার মধ্যেই সকল সমস্যার সমধান খোঁজা। আমি আসলে স্বেচ্ছায় চোখ বন্ধ করে থাকতে ভালোবাসে যারা সেইসব অন্ধের দেশে চশমা বিলি করছিলাম, অথচ আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে যাদের চোখ খুলে দেখার ক্ষমতা নেই, তাদের চশমার কি প্রয়োজন? আমার এই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের শাস্তি প্রদানের ‘মহান’ দায়িত্ব যারা পেয়েছেন তারা গত দুই মাস ধরে আমাকে নিয়মিত ফলো করে যাচ্ছিলেন। না ফেইসবুক-টুইটার-ব্লগে ফলো করছেন না, আমার আদর্শকেও ফলো করছেন না। তারা ফলো করছিলেন আমাকে, আমি কোথায় থাকি, কোথায় পড়ি, কখন কোথায় যাই, সরাসরি আসমান থেকে আসা সেই ‘মহান’ দায়িত্ব কিভাবে সফল করবেন তারই ছক আঁকা হচ্ছিল নানাভাবে।

প্রায় দুই মাস আগে আমি প্রথম বুঝতে পারি আমাকে ফলো করা হচ্ছে। খুব ভোরে, সকাল সাড়ে ছয়টায় আমি কলেজের জন্য বাসা থেকে বের হতাম, নির্দিষ্ট স্থানে আমার কলেজ বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম। প্রায় দুই মাস আগে, একদিন আমি লক্ষ্য করলাম একজন লোক বেশ কয়েকদিন ধরে আমি যেখানে বাসের জন্য অপেক্ষা করি তার পাশে মুখে হাত দিয়ে গৌতম বুদ্ধের ন্যায় মৌন ভাব ধারন করে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আমার দিকে লক্ষ্য রাখে। আমার বাস চলে এলে সেই ব্যক্তি মৌন ভাব ভঙ্গ করে হাঁটা শুরু করে। সে যেমন আমাকে লক্ষ্য রাখছিল আমিও তার কর্মকান্ড পর্যবেক্ষন করে যাচ্ছিলাম। একদিন দেখি ওই ব্যক্তি একা নয়, তার সাথে আরো দুইজন যারা আমার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে এবং আমাকে কোণা চোখে লক্ষ্য রাখে। আর প্রথম ব্যক্তি হাঁটা ধরলে অন্য দুইজন ও তার পিছনে পিছনে চলে যায়। এরপর আমার কলেজ রোজার কারনে সময় বদল করলে তাদেরকে আর দেখি নি। রোজার ছুটি শেষ হলে আমি আবার কলেজে যাতায়ত শুরু করি। পরে কলেজে যাতায়তের জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করি। এরপর আমার বাসার আশেপাশে কিছু অচেনা লোকের আনাগোনা দেখতে পাই। যেহেতু এসব নিয়ে ভেবে আমি কিছুই করতে পারব না, রাষ্ট্র যেহেতু খুনীদের পক্ষে কাজেই আমি এসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমার কাজে মনযোগী হই। নীল হত্যার ঘটনায় যখন আমরা সবাই স্তব্ধ তখন আমার এক বন্ধু ফোন করে জানায়, তাদের কোচিং ছুটির পর দুজন মোটর সাইকেল আরোহী আমার খোঁজ করছিল, তারা কোচিং এর কয়েকজন স্টুডেন্টকে জিজ্ঞেস করছিল আমার সম্পর্কে। আমি কোন এলাকায় থাকি, কোন সিম ইউজ করি, আমার ফোন নাম্বার সবই তাদের জানা, শুধু জানা নেই- কোন বিল্ডিং, কত নম্বর ফ্ল্যাট। ওই দুই মোটরবাইক আরোহী নাকি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, ‘ইনশাল্লাহ, এই সপ্তাহ না পারলে এই মাসের মধ্যেই সব দেখাই দিব’।

এসব জানতে পেরে আমার মা-বাবা ভীত হয়ে সেদিন রাতের অন্ধকারে আমাকে এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আমার ফোন বন্ধ, নেট অফ, সবকিছু অফ, আমি কোথায় আছি সেসব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও জানতো না। এভাবেই কাটছিল আমার দিন। এরপর আমার বাবা মা লক্ষ্য করল, আমার বাবা মা অফিসে যাওয়ার পথে তাদেরকেও ফলো করা হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছিল, আমি লুকিয়ে আছি, কিন্তু কোথায় আছি তা বুঝতে পারছিল না। বাসায় আছি কিনা তা নিশ্চিত করতে দুইজন ছদ্মবেশে আমার বাসায় কলিংবেল দেয়, আমার পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পেরে দারোয়ানকে ফোন করে তাদেরকে নামিয়ে নিয়ে যায়। আমার খোঁজ বের করতে তারা আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত ফলো করে যাচ্ছিল। তাদের দুই মাসের প্ররিশ্রম এভাবে পন্ড হয়ে যাবে তা তারা কিছুতেই মানতে পারছিল না। তাই তারা আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজছিল।

আর এদিকে আমি নিরাপত্তার জন্য একের পর এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছি। ওড়নার আড়ালে মুখ লুকিয়ে চলাফেরা করছিলাম। এরমধ্যে দেশের বাইরের ভিসার কাজ চলছিল। ভিসা পেতেই আর দেরী না করে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জীবন রক্ষার জন্যে দেশ ত্যাগ করি।

‘কি দরকার ছিল এসব লেখালেখির?’ এইপ্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে হতে হয়েছিল এই কয়দিন। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেয়ার কারনেই হত্যা করা হয়েছে অভিজিত-বাবু-অনন্ত-নীলয়দের। কোন ব্লগার হত্যার পর সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করে, ‘কেন? কি লিখতো সে?’ যেন এমন কিছু কথা আছে যা লিখলে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়। আর ব্লগার হত্যার নমুনা দেখে মনে হচ্ছে যেন, বাংলাদেশে সব নাস্তিক কেবল হিন্দু পরিবার থেকে আসা। আসলে হিন্দু পরিবার থেকে নাস্তিক হওয়া ব্লগারদের হত্যা করলে সেটা সাধারন মানুষের মধ্যে গ্রহনযোগ্যতা পায় বেশি। ‘হেন্দু হইয়া আমাগো ধর্মের বিরুদ্ধে কয়, এত বড় সাহস, যা করছে ঠিক করছে’- হিন্দু পরিবার থেকে নাস্তিক হওয়া ব্লগারদের হত্যা করলে এই এক্সট্রা সুবিধাটুকু পাওয়া যায়। আসলে ব্লগাররা কি লিখে না লিখে, আস্তিক নাকি নাস্তিক এইসব ব্যাপারে খুব বেশি চিন্তিত নয় খুনীরা।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কোন বাঁধা না পেয়েই নিজেদেরকে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী করেছে। এতদিন কোন বাঁধা পায় নি, কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করে নি, তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ একটি শব্দ ও উচ্চারণ করে নি। একজন তসলিমা নাসরিন প্রতিবাদ শুরু করেছিল বলে আমরা সবাই মিলে তাঁকে দেশ ছাড়া করলাম। কিন্তু এখন অনেকেই প্রতিবাদ করতে শিখে গেছে। কাজেই যখন থেকে বাঁধা পেতে শুরু হল, যখনই আন্দোলন প্রতিবাদ শুরু হল তখনই তারা বুঝতে পেরেছে, এত বছর তারা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারলেও এখন তা আর সম্ভব হবে না। কাজেই যারা ভবিষ্যতে তাদের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছে তাদেরকেই তারা সরিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রথমে তারা ‘নাস্তিক ব্লগার’ ট্যাগ লাগিয়ে মুক্তচিন্তক ও স্বাধীনতার পক্ষের ব্লগারদের হত্যা শুরু করছে। এই হত্যাকে জায়েজ করতে ‘নাস্তিক ব্লগার’ ট্যাগটা খুব কাজে দিয়েছে, নাস্তিক হত্যার বিচার করতে গিয়ে সরকার ভোট কমাতে চায় না, সাধারণ জনগন ‘নাস্তিক মরছে, তাতে আমার কি?’ এই ভাব নিয়ে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করছে। আর এছাড়া ধার্মিক খুনিরা নাস্তিক হত্যা করে ধর্মমতে কিছু পুণ্য ও অর্জন করে নিচ্ছে। কোন ব্লগারকে হত্যা করা হবে, কারা করবে এইসবই প্রশাসনের জানা। প্রশাসন জানে না, এ আমি বিশ্বাস করি না। শেখ হাসিনাকে নিয়ে অনলাইনেকে কটূক্তি করল তাকে দেশের আরেক প্রান্ত থেকে খুঁজে নিয়ে আসতে পারে আর একেরপর এক খুন হচ্ছে, এসব খুনীদের ধরতে পারে না? হয়তো বলবেন, অভিজিৎ হত্যার সাথে জড়িত তিনজনকে তো গ্রেফতার করা হল। হ্যা। অভিজিৎ যুক্তরাস্ট্রের নাগরিক, এই কেইস নিয়ে এফবিআই ও গবেষনা করছে। সঙ্গত কারনেই এই কেইস নিয়ে সরকার চাপে আছে। তাই অভিজিৎ হত্যার তিনজন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাও প্রকৃত কাউকে ধরছে কিনা তা ও তো বলা যায় না। এফবিআই নীলয় হত্যার ব্যাপারে সাহায্য করতে চাইলে সরকার সাহায্য নিবে না বলে জানায়। নিজেরা অপরাধী ধরতে পারছে না, আবার কেউ সাহায্য করতে চাইলে সাহায্য ও নিচ্ছে না। এতে স্পষ্ট বুঝা যায়, কোন হত্যার রহস্যই প্রশাসনের অজানা নয়।

আইএস ঘোষণা দিয়েছে, পাঁচ বছরের মধ্যেই তারা ভারতসহ সারা বিশ্ব দখলের লক্ষ্যে কাজ করছে। সারা বিশ্ব দখল করতে পারুক কিংবা না পারুক বাংলাদেশ দখল করতে তাদের খুব বেশি সময় লাগবে না। প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, নাস্তিক হত্যা চলছে। আস্তে আস্তে নাস্তিতদের লিস্ট শেষ হলে অন্য লিস্ট আসবে। দেশ নিয়ে আমরা যারা স্বপ্ন দেখি, সভ্য একটি সমাজ ব্যবস্থার জন্য লড়াই করছি তাদের সবাইকেই একে একে হত্যা করা হবে। দেশবাসী নাকে খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে ঘুমান।

‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ আসলেই এমন দেশ আর কোথায় পাবেন? যেখানে খুনীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় আর সতের বছর বয়সী একটা মেয়েকে মুক্তচিন্তা করার অপরাধের শাস্তি দিতে সকলে মিলে চাপাতিতে শান দেয়!

‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’ আমার দেশ নিশ্চয়ই জঙ্গিবাদের রানী। অপরাধীদের জন্য নিরাপদ ভূমি।

যেখানে সরকার-প্রশাসন-অধিকাংশ জনগণ নীরব হয়ে দেশ ধ্বংসের কাজে উৎসাহ যোগাচ্ছে, সেখানে আমরা ক’জন দেশটাকে ভালোবেসে, একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে দেখতে চাপাতির আঘাতে প্রান দিতে পারব, এর বেশি কিছু নয়। তবুও তো আমরা দেশের সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের ন্যায় মুখ বুজে থাকি নি, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কোন অপশক্তির সাথে আপোষ করি নি, এতটুকুই আমাদের সান্ত্বনা।

দেশে আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ালেখা করছিলাম। আগামী বছর ইন্টার পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব কিছু কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। সম্পুর্ন অজানা অচেনা পথে আমি হেঁটে চলছি। এরপর কি হবে আমার জানা নেই।

দেশের কথা ভাবতে গেলেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে। দেশ বলতে দেশের মানুষরা যা বুঝে, পরদেশে বসে দেশ মানে অন্যরকম কিছু মনে হয়, যেন খুব আপন কিছু, অনেকদিনের চেনা, অনেক স্বপ্ন আর ভালোবাসার স্পর্শ।

২টি মন্তব্য: