আমি মিশুক স্বভাবের ছিলাম না, আমি কখনও বিকালে ছাদে উঠে প্রতিবেশীদের সাথে আড্ডা দিতে যাই নি, কোন প্রতিবেশীর বাসায় যাই নি। আমার সাথে কেউ কথা বললে তবেই আমি কথা বলতাম, নিজে থেকে কখনও কথা বলি নি। একদিন সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ইতু কেমন আছো?’ আমি বললাম, ‘আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না’। তারপর উনি আমার ছোট বোনের নাম বলে বললেন যে, ‘তুমি ওর বোন না?’ আমি বললাম, ‘হ্যা’। তারপর বললেন, ‘আমি তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি’। ‘ও আচ্ছা, আমি ভালো আছি’ এইটুকু বলেই আমি চলে গেলাম। আমি অসামাজিক ছিলাম। অথচ আমার মা-বাবা-বোন আমার সম্পূর্ণ বিপরীত। পাশের বাসার বাচ্চাটাকে দেখলেই বাবা আদর করতেন, তার সাথে শিশুতোষ কথা বলতেন। মা সবসময় আশেপাশের সবার খোঁজখবর রাখতেন। আমি দেশ ছাড়ার পর আমার প্রতিবেশীরাও জানতে পারলেন যে, আমি নাস্তিক ব্লগার ছিলাম। তারা এখন আমার বাবা-মা’কে আড়চোখে দেখে।
আমার স্কুলের টিচার্স টেবিলে আমাকে নিয়ে আলোচনা উঠেছে। আমার একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকার মতে, ‘আরে ওকে আমি চিনি, ফাজিল একটা। বড় বড় ব্লগারদেরকে মারার জন্য লিস্ট করছে, ওর মতো চুনোপুঁটি আবার কিসের ব্লগার? সব নাটক’। টিচারের এই কথাও আমার কানে চলে এলো। আমি তো পুরাই ‘বেয়াক্কেল’ হয়ে গেলাম। আমার এক বন্ধু বলল, ‘এই টিচাররে তো স্যালুট দেয়া দরকার। সাধারণ স্যালুটে কাজ হবে না। এক্কেরে পতাকার বাঁশের লগে বাইন্ধ্যা বাঁশটা ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া উনারা স্যালুট দেয়া দরকার’। আমি ব্যাপার গুলোকে হাস্যকর ভাবে নিলেও, আমার মা-বাবা এসবে কষ্ট পান। আমার মা-বাবা যারা কিনা রাতদিন আমার জন্য চোখের পানি ফেলেন, তাদের কানে যখন এসব কথা যায় তখন তারা নিজেদেরকে আরও অসহায় ভাবতে শুরু করেন।
কলেজের স্যারেরা শুনেছি আমার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে, অনুভূতিতে আঘাত দেয়া ঠিক না, এই জাতীয় কথাবার্তা বলেছেন। একের পর এক ব্লগার হত্যায় নিশ্চয়ই তাদের কারও ‘অনুভূতিতে আঘাত’ লাগে নি।
আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীরা আমার পরিবারের সাথে দূরত্ব রেখে চললেও আমার বাবার এক বন্ধু যার বাসায় আমি বেশ কয়েকদিন লুকিয়ে ছিলাম, সেই বন্ধু ও বন্ধুর পরিবারের সদস্যরা আমার খোঁজ নেন সবসময়। আমার বাবা-মা’কে সাহস দেন।
আমার বন্ধুরাও আমাকে ভুলে নি, আমাকে সবসময় ফেইসবুকে তাদের জীবনের খবর জানায়, আমি থাকলে আরও কি কি হতে পারতো, সেসব বলে।
এখানেই আত্মীয় আর বন্ধুদের মধ্যে পার্থক্য। আত্মীয় হল তারা যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক আছে বলে জোর করে আত্মীয়তা রাখতে হয়। আর বন্ধু তো বন্ধুই। বন্ধুত্বের কোন সংজ্ঞা হয় না।
মাঝেমাঝে মনে হয় কোন দুঃখে যে লেখালেখি করতে গিয়েছিলাম! স্বাধীনতার কোন কমতি ছিলও না আমার জীবনে। লিখতে গিয়ে বরং আমি আমার স্বাধীন জীবনটাকে হারিয়েছি। মেয়েদের সাধারণত কোথাও বের হতে গেলে, ‘বাসায় ম্যানেজ’ করার একটা ব্যাপার থাকলেও আমার সেটা কখনোই ছিলও না। যখন তখন বের হতাম, আড্ডা দিতাম, ঘুরে বেড়াতাম, বাবা-মায়ের বকুনি’কে পাত্তা দিই নি কখনও।
জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ফলো করা শুরু হল, তখন থেকে কলেজ আর বাসা ছাড়া আর সব জায়গায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলও। ঠিকমত কলেজে পৌঁছালাম কিনা- এই নিয়ে বাবা-মা’র চিন্তার শেষ ছিল না। বন্ধুরা কোথাও বের হওয়ার কথা বললে এড়িয়ে যেতাম। বন্ধুরা সবাই বলতো, ‘ইতু বদলে গেছে, আগে তো এমন ছিলি না’। স্কুলের বন্ধুরা ভাবতো আমি কলেজে গিয়ে স্কুলের বন্ধুদের অবহেলা করছি। আর কলেজের বন্ধুরা ভাবতো, আমার কাছে স্কুলের বন্ধুরাই সব, কলেজের বন্ধুরা কিছুই না। কিন্তু আমার করার কিছুই ছিলও না। কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। এসব কথা বাবা-মা আর ফেইসবুকের কিছু প্রিয় বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানতো না। বাবা-মা’কে এইরকম চিন্তায় ফেলেছি বলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো, এরমধ্যে বাবা যেদিন বললেন, ‘আমাদের অপরাধ, আমরা তোমার বাবা-মা’। সেদিন থেকে কারও সাথে এ নিয়ে একটি কথাও বলি নি।
ভেবেছিলাম, শীঘ্রই দেশের পরিস্থিতি ভালো হবে। হাসিনা সরকার নিশ্চয়ই ব্লগার হত্যাকারীদের শনাক্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করবে, আর কাউকে ব্লগে লিখার জন্য চাপাতির কোপে মৃত্যুবরণ করতে হবে না। প্রতিমুহুর্তে ভাবতাম, খুব তাড়াতাড়ি আমি আগের সেই স্বাধীন জীবণে ফিরে যাবো। কিন্তু আমার ভাবনা দিয়ে কি আর রাজনীতি চলে? রাজনীতি চলে ভোট দিয়ে। কাজেই নাস্তিক হত্যার বিচার করে কে-ই-বা ভোট হারাতে চায়? সরকারের কাছে দেশে ঘটে যাওয়া সবধরনের অপরাধগুলো কেবলই বিছিন্ন ঘটনা মাত্র। নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, প্রশ্ন ফাঁস, একের পর এক ব্লগার হত্যা, বিদেশী নাগরিক হত্যা এসব ঘটনা সরকারকে মোটেই বিব্রত করে না। বিব্রত করে শুধু ব্লগাররা, যারা এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। জঙ্গিরা ব্লগারদের মেরে ফেলার হিট লিস্ট বানায়, আর সরকার বিব্রতকারী ব্লগারদের লিস্ট বানায়, ৫৭ধারায় গ্রেফতারের জন্য!
অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। আত্মীয়স্বজন বাবা-মা’কে ফোন করে বলতে শুরু করেন, ‘আপনার মেয়েকে থামান, এই মেয়েকে তো বেশিদিন ঘরে রাখা যাবে না, কিসব লিখে সে?’ বাবা-মা ঠিক করলেন, ইন্টারটা শেষ করে দেশের বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিবেন। যদিও দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি সিরিয়াসলি নিতাম না। এর আগে ২০১০ সালে, তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়তাম। ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটা প্রজেক্টে অংশ নিয়েছিলাম, সেখানে নাটকে
প্রথম হয়ে আমি সহ বাংলাদেশ থেকে আমরা পাঁচজন ইংল্যান্ড গিয়েছিলাম দশ দিনের জন্য। যদিও বন্ধুদের সাথে মজা করেই দিন কাটছিলও তবুও ইংল্যান্ডে পা রেখেই আমরা প্রত্যেকেই দেশকে প্রচন্ডভাবে মিস করতে লাগলাম। দেশে বসে দেশের যতই সমালোচনা করি না কেন, দেশ যে কি, সেটা তখনই বুঝেছিলাম। কাজেই দেশের বাইরে যাওয়াটা আমার কাছে তখন থেকেই প্রচন্ড আতংকের মত ছিলও।
প্রথম হয়ে আমি সহ বাংলাদেশ থেকে আমরা পাঁচজন ইংল্যান্ড গিয়েছিলাম দশ দিনের জন্য। যদিও বন্ধুদের সাথে মজা করেই দিন কাটছিলও তবুও ইংল্যান্ডে পা রেখেই আমরা প্রত্যেকেই দেশকে প্রচন্ডভাবে মিস করতে লাগলাম। দেশে বসে দেশের যতই সমালোচনা করি না কেন, দেশ যে কি, সেটা তখনই বুঝেছিলাম। কাজেই দেশের বাইরে যাওয়াটা আমার কাছে তখন থেকেই প্রচন্ড আতংকের মত ছিলও।
কিন্তু এরমধ্যেই ফলোর মাত্র বেড়ে গেলও, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে গিয়ে আমার ফলোয়ারেরা আমার সম্পর্কে তথ্য চাইতে লাগলো, আর বন্ধুরা ফোন করে জানাতে লাগলো যে আমাকে খুঁজতে নাকি কারা যেন কোচিং এ যায়। না, আমি এসব আর কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করি নি, কারণ আমি জানি এসব বলে কেবলই চিন্তা বাড়বে, আমাদের কারোর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু কোন এক কোচিং এ গিয়ে আমার ফলোয়ারেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিল, ‘এই মাসের মধ্যেই ইনশাল্লাহ …….’ তাদের এই কথা আমার এক বন্ধু শুনে সাথে সাথে বাসায় ফোন করে, তখন আমি বাসায় স্যারের কাছে পড়ছিলাম বলে ফোনটা বাবা ধরে। বাবা সব জানতে পেরে ওইদিন আমাকে রাতের আঁধারে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়। দুইটা প্যান্ট, আর দুইটা টি’শার্ট নিয়ে ৯ আগস্ট রাত ১২টার দিকে বাসা থেকে বেড়িয়ে যাই, তখনও ভাবি নি যে আর কখনও আমি ঘরে ফিরতে পারব না। আমার কাছে এসব এখনও স্বপ্ন বলে মনে হয়। এখনও সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলে আমাকে কয়েক মিনিট ভাবতে হয়, ‘আমি কোথায় আছি’।
দেশের অনেকের ধারণা প্রবাসী ব্লগার’রা ডলার-পাউন্ডের উপর শুয়ে শুয়ে ব্লগ লিখছে। ‘বিদেশ’ কি জিনিস সে সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তারাই এধরণের কিছু ভাবতে পারে। প্রবাসী ব্লগারেরা এখানে দিনের ১২ ঘন্টা ব্যয় করে জীবিকা নির্বাহের অর্থ জোগাতে, দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে রুমে ফিরে কারও কারও ভাগ্যে ঘুমের জন্য বিছানাটুকু জোটে না। অনেকেই লেখালেখি ভুলে গিয়ে জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
দেশে ব্লগারদের মৃত্যু ভয় নিয়ে বাঁচতে হয় আর প্রবাসী ব্লগারেরা প্রতিমুহুর্তে মৃতের মত বাঁচে। ভয়াবহ একাকীত্বে প্রতিমুহুর্তে তাদের মৃত্যু হয়। বন্ধুদের সাথে রাস্তার মোড়ে নালার পাশে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে দিতেই কখন বিকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে যেতো টের পেতাম না। আর এখন উন্নতদেশের বড় বড় বিল্ডিং আর পার্ক গুলো দেখলেও আমার কোন ধরণের ভালো লাগা তো দূরে থাক, একবার ঘুরে দেখতেও ইচ্ছা হয় না। ভালো লাগা, খারাপ লাগা কোন ধরণের অনুভুতিই কাজ করে না। অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের কাছে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বললে, তাঁরা আঁতকে উঠে। জিজ্ঞেস করে, মাথায় সমস্যা আছে কিনা! আগে আমার অনেক চাহিদা ছিলও, বাবা-মায়ের কাছে এটাওটা কিনে দেয়ার বায়না ধরতাম, এখন আমার একটাই চাহিদা, যদি একবারের জন্য দেশে ফিরতে পারতাম।