শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৫

মূর্তি ভাঙলে ভগবানের অক্ষমতা প্রমাণ পায়, আর মসজিদ ভাঙলে?

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এ জাতীয় একটা কথা ঈদ-পূজার আগে প্রায় শুনি। সত্যি কি তাই? চলুন দেখা যাক।
মন্দিরের সামনে গরু কোরবানী

ইদুল আযহা, মুসলমানদের একটি ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবটি মূলত পশু কোরাবনীর মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। কোরবানীর পশু হিসেবে থাকে গরু, ছাগল ইত্যাদি। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গরুকে তাদের দেবতা রূপে পূজা করে। আর মুসলমানরা কোরবানী ঈদে আনন্দের সাথে গরু কোরবানী করে। এতে সনাতান ধর্মের অনুসারীদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। যদিও দেশে ধর্মানুভূতির আদর-যত্নের জন্য ৫৭ ধারা রয়েছে। কিন্তু সেটি এক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়।

হিন্দুরা মাটির মূর্তি বানিয়ে তাদের কল্পিত দেবদেবীদের পূজা করে। আবার মূর্তি পূজা ইসলামে নিষিদ্ধ। শুধুই নিষিদ্ধ নয়, এ বিষয়ে সহীহ্‌ বুখারী, হাদিয়াত ২২৩৬ এ উল্লেখ আছে, ‘হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় মক্কায় থাকা অবস্থায় এই ঘোষণা দিয়েছেন যে, আল্লাহ ও তার রাসূল মদ ও মূর্তি এবং ও শুকর বিক্রি করা হারাম করেছেন’।

সহীহ্‌ মুসলিম, হাদিয়াত ৯৬৯ এ আছে, আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন, আলী ইবনে আবী তালেব (রা.) আমাকে বললেন, “আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সকল মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সকল সমাধি-সৌধ ভূমিসাৎ করে দিবে এবং সকল চিত্র মুছে ফেলবে”।

এছাড়াও মুসনাদে আহমাদ এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘আলী ইবনে আবী তালেব রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদীনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো প্রাণীর মূর্তি পাবে তা ভেঙে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধি-সৌধ পাবে তা ভূমিসাৎ করে দিবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দিবে?” আলী রা. এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে কেউ পুনরায় উপরোক্ত কোনো কিছু তৈরী করতে প্রবৃত্ত হবে সে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি নাযিলকৃত দ্বীনকে অস্বীকারকারী।”
স্থানঃ সাতক্ষীরা, মুর্তি ভাঙ্গা উৎসব, ২০১৫।
  কাজেই, ইসলাম ধর্ম মতে, মূর্তি ভাঙা  প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব।  প্রতিবছর বিশেষ করে শারদীয় দুর্গা  পূজায়, বাংলাদেশে অনেক আদর্শ  মুসলমান নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্ব  পালন করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে  মূর্তি ভাঙা পাপ হলেও ইসলাম ধর্ম মতে এটিকে সোয়াবের কাজ বলাই যায়।

 অথচ মূর্তি ভাঙার খবরগুলোতে যারা মূর্তি ভেঙেছে তাদেরকে দুর্বৃত্ত হিসেবে  চিহ্নিত করা হয়। এ নিয়ে যখন টকশো’তে আলোচনা হয় তখন মডারেট  মুসলমানেরা বলে থাকেন, এসকল দুর্বৃত্তদের কোন ধর্ম নেই, ইসলাম শান্তির  কথা বলে, ইসলামে মূর্তি ভাঙার কথা বলা হয় নি। অথচ ইসলাম ধর্মের সূচনা হয়েছিল কোরাইশদের ৩৬০ টি মূর্তি ভাঙার মধ্য দিয়ে। হযরত মোহাম্মদ নিজ হাতে এসব মূর্তি ভেঙেছেন। তার মানে কি তারা তাদের নবীকেও দুর্বৃত্ত মনে করেন? তারা নিজেরা মূর্তি না ভেঙে, মূর্তি পূজার পক্ষে কথা বলে ধর্মবিরোধী কাজ তো করছেনই, সাথে আবার ‘ইসলামে মূর্তি ভাঙার কথা নেই’ এই জাতীয় কথা বলে মানুষকে ইসলাম ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যা ও ভূল ধারণা দিচ্ছেন। 

তবে সরকার এই বিষয়ে খুব সচেতন। আইন অনুযায়ী, কেউ মূর্তি ভেঙে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে তাদেরকে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করার কথা। কিন্তু মূর্তি ভাঙার জন্য গ্রেফতার করা মানে তো মোহাম্মদের যুগে ৫৭ ধারা থাকলে তিনিও একই অপরাধে গ্রেফতার হতেন। কাজেই নবীকে অনুসরণ করে যারা মূর্তি ভাঙছে, তাদেরকে কোনরকম গ্রেফতার না করে বরং অবিশ্বাসীদের কেউ যদি মডারেটদের দেওয়া ভুল তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে, তবে তাদের জন্য ৫৭ ধারা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে এভাবেই ৫৭ ধারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। 

একদিকে মডারেট মুসলমানরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল-মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছেন, অন্যদিকে বাংলার হুজুর সমাজ নিরলস ভাবে মূর্তি পূজা সম্পর্কে ইসলামের বাণীগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। পিস টিভি বাংলার একজন জনপ্রিয় হুজুর হলেন, আব্দুর রাজ্জাক। হুজুর আব্দুর রাজ্জাক তার বিভিন্ন ওয়াজ গুলোতে মূর্তি পূজা সম্পর্কে ইসলামে কি বলা আছে এবং মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। তিনি তার এক ওয়াজে বলেছেন, “আমি মুসলিম চির  রণবীর, মরণকে করিনা ভয়। আমি ছবিকে কবর দিতে এসেছি। আমি মূর্তিকে লাত্থি দিয়ে ভাঙতে এসেছি! তুমি জানো না আমি মুসলিম? তুমি যখন বিজাতিতে চলে গেছ, সেটা তোমার ব্যাপার। তুমি তো পহেলা বৈশাখ মানো, আমি কি হিন্দুর বাচ্চা? আমি কি হিন্দুর ঘরে জন্ম নিয়েছি নাকি আমি পহেলা বৈশাখ মানবো? তুমি বলো কী! তুমি জানো না আমি মুসলিম? আমার রক্তের সাথে মিশে আছে মূর্তি-ভাঙা নীতি, আমার গোস্তের সাথে মিশে আছে মূর্তি-ভাঙা নীতি, আমি পহেলা বৈশাখকে কবর দিতে এসেছি…আমি হিন্দুর ঘরে জন্ম নেই নি, আমি মুসলিম চির রণবীর, মরণকে করিনা ভয়। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী—আমার উভয়ই সমান”। 


হিন্দুদের মূর্তি ভাঙার পর, মুসলমানরা সাধারণত দাবী করেন, যেহেতু দেবদেবীরা নিজেদের মূর্তি নিজেরা রক্ষা করতে পারে নি, কাজেই সনাতন ধর্ম একটি মিথ্যা ধর্ম আর এতেই প্রমাণিত হয়, ইসলাম একমাত্র সত্য ধর্ম।

মক্কায় ক্রেন দুর্ঘটনায় শ'খানেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, মিনায় পদদলিত হয়ে মারা গেছেন প্রায় হাজার খানেক মানুষ। যদিও সৌদি আরব তাদের ব্যবসায়িক কারণে মিনায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যাটি গোপন রেখেছে। মুসলমানরা আল্লাহ্‌র ঘরকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বলে মনে করেন। আর হাজীরা হলেন ‘আল্লাহ্‌র মেহমান’। অথচ আল্লাহ তার অতিথিদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে যথারীতি ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করা হয়।


তবে আর যাই হোক, আল্লাহর ঘর কাবা কখনও বন্যা-ভুমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হয় না – এই জাতীয় কথা মুসলমানদের কাছ থেকে শুনে আসলেও গুগল করে ১৯৪১ সালের বন্যায় কাবাঘর ডুবে যাওয়ার বেশ কিছু ছবি ভিডিও পেয়ে গেলাম।



মূর্তি-মন্দির ভাঙার মাধ্যমে হিন্দুদের দেবদেবীদের অক্ষমতা প্রমাণিত হয়, একই ভাবে আল্লাহ্‌র ঘর- মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়েও কি আল্লাহর অক্ষমতা প্রমাণিত হয়?

ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে ভারতসহ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময়ে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের অত্যাচারের চিত্র গুলো ফুটে উঠেছিল তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইটিতে। দেশের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এই অযুহাত দেখিয়ে ‘লজ্জা’ বইটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। 

মসজিদ ভাঙার তথ্য বের করতে গিয়ে বেশ কিছু মসজিদ ও মাজার পেলাম যেগুলা ভাঙা হয়েছে মুসলমান জঙ্গিদের দ্বারা।



হিন্দুরা একটা পরিত্যক্ত বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল বলে কত কিছু হয়ে গেলো, অথচ দুনিয়ায় আরো কত বিখ্যাত মসজিদ-মাজার ভাঙা হলো, কিন্তু সেসবে মুসলমানদের কোন প্রতিবাদ দেখলাম না।
কিছুদিন আগে আইএস কাবা ঘর ভেঙে ফেলার হুমকি দেয়। তারা বলেছে, ‘জনগণ কাবাঘরের পাথরগুলো ছোঁয়ার জন্যই মক্কায় যায়, আল্লাহর জন্য সেখানে যায় না, এরা আসলে পাথরের দাস, আল্লাহর দাস বা বান্দা নয়; আর তাই জর্দানের পর আমরা যখন সৌদি আরবে হামলা চালাব তখন কাবা ঘর ধ্বংস করে দেব’। আইএস এর কাবা ঘর ধ্বংসের হুমকি, সিরিয়ায় হামলা চালানো এসব কিছুতেই মুসলমানেরা চুপ ছিলেন। কিন্তু যেই রাশিয়া সিরিয়ায় আইএসকে প্রতিহত করতে সৈন্য পাঠায়, সাথে সাথে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন ‘মুসলিম বিশ্ব’। সিরিয়া থেকে প্রতিদিন পালিয়া আসা হাজার হাজার শরনার্থীদের ব্যাপারে এই ‘মুসলিম বিশ্ব’ ছিলেন নীরব দর্শক। তারাই আবার গাজায় ইজরাইল হামলার প্রতিবাদে #SaveGaja হ্যাস ট্যাগ দিয়ে ফেইসবুক টুইটার কাঁপিয়েছিলেন। এই হল তাদের ধর্ম আর ধর্মানুভূতি। 


এছাড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সহ বিভিন্ন কারণে ভেঙে যাওয়া কিছু মসজিদ ও মাজারের ছবি দেখুন এই লিংকে


The Great Mosque of Aleppo, Syria -- A world heritage site originally built in 715 by the Umayyad dynasty, ranking it among the oldest mosques in the world. The epic structure evolved through successive eras, gaining its famous minaret in the late 11th century. This was reduced to rubble in the Syrian civil war in 2013, along with serious damage to the walls and courtyard, which historians have described as the worst ever damage to Syrian heritage.



Great Mosque of Samarra -- Once the largest mosques in the world, built in the 9th century on the Tigris River north of Baghdad. The mosque is famous for the Malwiya Tower, a 52-meter minaret with spiraling ramps for worshipers to climb.



Al- Omari Mosque, Gaza - Ancient monument in the heart of Jabalya's old town dates back to the Mamluk Era. The walls, dome and roof were destroyed by Israeli airstrikes during the recent fighting in Gaza, along with dozens more historic sites.


Khaled Ibn Walid Mosque, Syria -- Among Syria's most famous Ottoman-style mosques, which also shows influence through its light and dark contrasts. The vast site became a hub of the battle for Homs, itself a front-line of the conflict. The sacred mausoleum has been completely destroyed, and much of the interiors burned.

Jonah's Tomb, Iraq - The purported resting place of biblical prophet Jonah, along with a tooth believed to be from the whale that consumed him. The site dated to the 8th century BC, and was of great importance to Christian and Muslim faiths.

৯টি মন্তব্য:

  1. আইএস তাহলে ছহী পথেই আছে... ভালো লিখেছেন

    উত্তরমুছুন
  2. ভালই লিখছেনন, অনেক বিষয়ে জ্ঞাত হলাম।

    উত্তরমুছুন
  3. প্রায় 3-4 বছর আগে ঢাকা থেকে মামার বাড়ি চাঁদপুরে আসছিলাম লঞ্চে করে, লঞ্চঘাট থেকে বের হয়ে রিকসা করে যখন যাচ্ছিলাম আশে পাশের কোথাও ওয়াজ হচ্ছিল। অনেক মাইক থাকার সুবাদে ওয়াজে বলা সব কথাই স্পষ্ট শুনা যাচ্ছিল। ওয়াজের একজন বক্তা বলল, ”কয়েকদিন আগে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কালী/দূর্গা মূর্তির শরীর থেকে প্রায় 200 ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে চোরে নিয়া গেছে, এখন আপনারা বলেন কোখায় গেল তাদের ভগবান?? নিজের শরীর থেকে স্বর্ণ নিয়া যায় উনি কিছু করতে পারল না। আর আমাদের ইসলামে এমন করলে আল্লাহর গজব নাজিল হইয়া যাইত........সবাই বলেন সুবাহানআল্লা ”.....সবাই সুবাহানআল্লা বলল। বক্তব্যটি হুবহু এমন না হলেও মূল বক্তব্য এটাই ছিল। এমন প্রকাশ্য দিবালোকে অন্য ধর্মানুভুতিকে আঘাত করে কয়েক হাজার মানুষের সামনে এবং সেখানে আশে পাশে অনেক হিন্দু বসবাস করলেও কেউ কোন টু শব্দও করল না। এই টাইপের ওয়াজ প্রায়ই শুনি কিন্তু কিছু বলতে পারি না 57 ধারার চাইতেও বড় কিছু যে রেডী।

    উত্তরমুছুন
  4. খুনাখুনি ধর্মে সমর্থন করে না, তবু ধর্মের নামে হত্যা হলে তা ধার্মিক মুখবুজে মেনে নেয়,
    এই হল তাদের ধর্ম আর ধর্মানুভূতি।

    উত্তরমুছুন
  5. আপনার হিন্দুবাদী চেতনাদন্ড বড় ই সহি

    উত্তরমুছুন