বিজয় দিবসে ফেইসবুকে ঢুকেই দেখলাম অনেকে পোস্ট দিচ্ছে, তারা শাহাবাগে যাচ্ছে, সবাই একসাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে, কনসার্ট করবে, বিজয় দিবস উদযাপন করবে। আর আমি দূর দেশে একা বসে ভাবছিলাম, গত বছরে আমি বিজয় দিবসে কি করেছিলাম। ২০১৪ সালের বিজয় দিবসে বন্ধুদের সাথে একটা র্যালিতে গিয়েছিলাম, তারপর একটা শপিং সেন্টারের পাশে সবাই মিলে আড্ডা। ২০১৩ সালে কি করেছিলাম? ২০১৩ সালে বন্ধুদের সাথে জামালখান চেরাগী পাহাড়, যেখানে চিটাগাং গণজাগরণ মঞ্চ বসে, সেখানে বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলাম সবাই মিলে একসাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে। স্কুলে যদিও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে, কিভাবে স্কুলে নতুন কোন হাঙ্গামা করা যায়, সেসব প্ল্যান করতাম। কলেজে কড়া নিয়ম থাকার কারণে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় বন্ধুরা যারা চুলে বেনি করে আসে নি, তারা ইন্সট্যান্ট বেনি করে নিতো, কারণ জাতীয় সঙ্গীত শেষ হলেই চেকিং চলতো। আমার যেহেতু চুলের ঝামেলা নেই, তাই আমি জুতা মোজা, আইডি কার্ড, নেইম প্লেট সব ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে নিতাম। আর কোন কারণে আইডি কার্ড বা নেইম প্লেট না আনলে কিভাবে কড়া চেকিং এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সেসব নিয়ে প্ল্যান করতাম।
মাঝেমাঝে খুব কলেজে যেতে ইচ্ছে করে। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চগুলো ছিল আমার এবং আমার মত কিছু হাই লেভেলের ব্রিলিয়েন্টদের জন্য বরাদ্ধ। সকাল সাড়ে ছয়টায় কলেজের জন্য বের হতাম, বাসায় ফিরতাম দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে। দিনের প্রায় নয় ঘন্টা সময় আমি বন্ধুবান্ধব নিয়ে কাটাতাম। কলেজে কখনও একটার বেশি বই নিয়ে যাই নি, কারণ আমি কলেজে পড়তে যেতাম না, বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈহুল্লোড় করতাম, স্কুলেও তাই করতাম। স্কুলে ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত প্রতিবছর আমি নিয়মিত উপস্থিতির জন্য পুরষ্কার পেয়েছিলাম। আমি স্কুলে যাব না, এটা ভাবতেই পারি না। সেই আমি এখন বন্ধুবান্ধব ছাড়া, আমার মজার স্কুল-কলেজ ফেলে একা একটি অনিশ্চিত জীবনযাপন করছি, কেবলমাত্র বাংলাদেশের মত একটি স্বাধীন দেশে বসে নিজের মত প্রকাশ করেছিলাম বলে।
পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে বলে থাকেন, ‘পাকিস্তানিরা বর্বর জাতি। কারণ ৭১ এ তারা আমাদের মা-বোনদের অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, ধর্ষণ করেছে’। পাকিস্তানিরা তাদের মা-বোনদের অত্যাচার-নির্যাতন-ধর্ষণ করেছে বলে পাকিস্তানিদের উপর ঘৃণা। আর প্রতিদিন স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে নারী নির্যাতন, ধর্ষণের পরিসংখ্যান গুলো নিয়ে কারও মাথা ব্যথা আছে? বাংলা ভাষার অধিকাংশ গালি মা বোন দিয়ে শুরু হয়। এইসব গালি আবার তাদের খুব পছন্দের।
‘নারী স্বাধীনতা’ শব্দটি এখনও স্বাধীন দেশটির অধিকাংশ পুরুষকে হাসায়। ‘নারী স্বাধীনতা আবার কি? নারীরা আমাদের মা-বোন-বউ হয়ে থাকবে, আমাদের ইচ্ছায় চলবে, এইতো!’ ইদানিং রাস্তাঘাটে হিজাব বোরখার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা বেড়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, পুরুষের স্বাধীনতা। নারীর উপর যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। ইচ্ছে হলেই রাস্তায় চলতে বিরক্ত করা, ইচ্ছে হলেই ধর্ষণ করা, যৌন হয়রানি করা, ইচ্ছে হলে বিয়ে, ইচ্ছে হলেই তালাক। নারী স্বাধীনতার কথাগুলো স্পষ্ট কন্ঠে জানিয়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। সেই তসলিমা নাসরিন আজ প্রায় একুশ বছর ধরে নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত।
স্বাধীন দেশটিতে কেউ যদি ব্লগ, ফেইসবুকে নিজের মতামত প্রকাশ করে তবে তাকে হত্যা করা হয় এবং যার কোন বিচার তো দূরে থাক, রাষ্ট্র এই হত্যাকে কোন অপরাধের আওতায় ফেলে না।
সরকার বদলের সাথে সাথে স্বাধীনতার ঘোষকের নাম পাল্টে যায়, যুদ্ধাপরাধী একটি দল দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়, সেই যুদ্ধাপরাধীদের পাশে দাঁড়ায় দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল, যেটি মুক্তিযোদ্ধার দল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। তাদেরই ডাকা হরতালে ককটেল বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ হারায়, পঙ্গু হয় সাধারণ মানুষ। মুক্তিযোদ্ধারা এদেশে চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারায়, আর কুখ্যাত রাজাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে শান্তিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। বিভিন্ন ইস্যুতে সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা এখানে নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপার। মায়ের পেটেও এদেশে শিশুরা নিরাপদ নয়। স্বাধীন দেশটিতে এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনার খেতাব পায়।
সত্যি বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। এই দেশে স্বাধীনভাবে সব ধরণের অপরাধ করা যায়। অপরাধীদের জন্য এটি একটি স্বাধীন দেশই বটে।
দু'জন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি দেয়ার পর নাশকতার ভয়ে সারাদেশে সব ধরণের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে রাখতে হয়, বিজিবি মোতায়ন করতে হয় বিভিন্ন শহরে- কাদের ভয়ে? এই শত্রুদেরই তো আমরা ৭১এ আমরা পরাজিত করেছিলাম, তবে এত ভয় কেন? ৭১এ নয় মাস যুদ্ধের পর যাদের পরাজিত করেছিলাম বলে ১৬ ডিসেম্বর দিনটিকে আমরা বিজয় দিবস পালন করি, সেই শত্রুদের থেকে কি বাংলাদেশ আজও মুক্ত হতে পেরেছে? আমরা কি ১৬ ডিসেম্বরের মর্যাদা রাখতে পেরেছি? বিজয় দিবস পালনের যোগ্যতা অর্জন করেছি?