বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫

‎নাস্তিক হত্যার বিচারেও অনুভূতিতে আঘাত লাগে‬!


অনেকদিন হয়ে গেলও কিছু লিখতে পারছি না। কি লিখব, কাদের জন্য লিখব, লিখে কি হবে--এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। এতগুলো প্রাণ নেই হয়ে গেলও শুধুমাত্র তারা দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, ভাবতো বলে। নাস্তিক মরলে দেশে কার কি যায় আসে? 
লিখতে গেলে কিছু স্বপ্ন লাগে, আশা লাগে। কিন্তু দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে এখন ভয় হয়। অনলাইনে দেশের পত্রিকা পড়ে হতাশ হই। জানি হতাশ হবো, তবুও দেশের পত্রিকাই পড়ি। অথচ আমি এখন যেই দেশে আছি, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামটাও জানি না।

মাঝে মাঝে মনে হয়, ঘুম থেকে উঠে যদি শুনি বাংলাদেশ বলতে কোন দেশ কখনও ছিল না, তবে খুব খুশি হবো। আমার সমস্ত ভাবনা জুড়েই বাংলাদেশ। দেশটা আমাকে হতাশা ছাড়া আর কিছুই দেয় না। দেশটা যদি নেই হয়ে যেতো, তাহলে হয়তো একটা চিন্তা মাথা থেকে দূর হতো।
আগে রাতে টিভিতে টক শো দেখতাম, আর রাজনীতি নিয়ে বাবার সাথে কঠিন আলাপ করতাম। এখন রাজনীতি নিয়ে নিজেই ভাবি, যদিও ভেবে কোন কূল কিনারা পাই না। জিয়া পরিবার দেশে খাল কেটে কুমির আনলো। কাজেই বিএনপির কাছে কারও কোন কিছু চাওয়ার নেই। তখন সব আশা ভরসা হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামীলীগ। কিন্তু ভোটের রাজনীতিটা এখন আওয়ামীলীগও শিখে ফেলেছে। এদেশের অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে ভোট দেয়। কাজেই যেই দলের ব্যানারে আল্লাহ খোদার নাম পাওয়া যায়, তাদের মার্কায় ভোট দিয়ে ভাবে যে, ‘যাক আল্লাহ্‌র পথেই আছি’। বিএনপি-জামায়েত ভোট পায় শুধুমাত্র এই কারণে। আওয়ামীলীগও বুঝে গেছে ভোট পেতে হলে তাদেরও ধর্মকে ব্যবহার করতে হবে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান এদেরকে আওয়ামীলীগ যতই লাথি-জুতা মারুক না কেনও, ভোট তারা আওয়ামীলীগকেই দিবে। কাজেই এদের নিয়ে আওয়ামীলীগের কোন চিন্তা নেই। চিন্তা এখন বাকি ৯০ পার্সেন্টের ভোট নিয়ে। তাই বিএনপি-জামায়েতের সাথে তাল মিলাতে আওয়ামীলীগ এখন মাঠে নামিয়েছে ওলামীলীগকে। নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যু নিয়ে তারা আর ঘাটাচ্ছে না। সজীব ওয়াজেদ জয় তো বলেই দিলেন যে, এটা নাকি একটা ‘সেন্সিটিভ’ ইস্যু। নাস্তিক হত্যার বিচার করলেও তো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। আর অনুভূতিতে আঘাত লাগা মানেই ভোট কমে যাওয়া। তাতো হতে দেয়া যায় না। কাজেই মরুক কিছু নাস্তিক।
প্রতিবার কোন নাস্তিক হত্যার পর মন্ত্রী-মিনিস্টাররা স্ক্রিপটে লেখা কিছু বক্তব্য গেয়ে চলে যান, প্রতিবারই বিচারের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে, তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে, আবার বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তদন্তের কোন অগ্রগতি নেই। ব্লগার রাজীবের খুনীরা এখন জামিনে মুক্ত হয়ে নতুন কোন ব্লগার হত্যায় মনযোগী হয়েছে। অভিজিৎ হত্যা মামলায় ও একই রকম কিছু নাটক দেখলাম। বাবু হত্যাকারীদের দুইজন পথচারী পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিলেও পরবর্তিতে সেসবের কোন খবর পেলাম না। হয়তো তারাও এখন মুক্ত হয়ে নতুন লিস্ট নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এরপর অনন্ত হত্যা, নীলয় হত্যা- এসব মামলারও কোন খবর জানা নেই। এসব দেখে প্রকাশক দীপনের বাবা ক্ষোভে বলেছেন যে, তিনি পুত্র হত্যার বিচার চান না। হানিফ সাহবে নাকি দীপনের বাবাকে খুনীদের আদর্শের একজন বলে মন্তব্য করেছেন। আর এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, দেশে কোন জঙ্গি নেই, দেশের আইন শৃঙ্খলার অবস্থা খুব ভালো। যা ঘটছে, সবই বিচ্ছিন্ন। এরপর আর বিচার চাওয়ার কোন মানে হয়? এদিকে দেশের মানুষও সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। প্রতিটি ব্লগারের মৃত্যুর পর তারা জানতে যায়, ‘কেন মারল? কি লিখছিল? ইসলাম নিয়ে না লিখলেই তো হয়’। দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে কারও কোন ভাবনা নেই।

শুনেছি, মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে বিচার প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি দিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাকামীদের বিচার চাইলো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এসব ছাতারমাথা সংগঠনগুলো কথা বলছে, নিজেদের দাবী জানাচ্ছে। এত স্পর্ধা তাদের!
স্পর্ধা হবে নাই বা কেনও? আমাদের এখানে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে বিচার চাইতে যায় উন্নতদেশগুলোর কাছে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নালিশ করতে যায় উন্নতদেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের কাছে। আমরাই বুঝিয়ে দিয়েছি যে, আমরা একটা মেরুদন্ডহীন জাতি, দেশের আভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে কথা বলার সাহস তো আমরাই তাদেরকে দিয়েছি।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে এত সময় ব্যয় সহ্য হয় না। ৪২ বছর পর বিচার হচ্ছে, তাও আবার ট্রাইবুনালের রায়, এরপর সুপ্রীম কোর্টে আপিল, তারপর আবার রিভিউ। রিভিউয়ের পর আবার ক্ষমা- আরও কতকিছু। এরমধ্যে আবার রায়ের কপি নাকি লেখা শেষ হয় না। এইসব কাহিনী করতে গিয়ে জেলের ভিতরেই যুদ্ধাপরাধীদের অধিকাংশ মারা যাবে। তাও ভালো যে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মারা যাবে, মন্ত্রী হিসেবে নয়। আওয়ামীলীগের কাছে পাওয়া বলতে এতটুকুই। আর বাকি সবকিছুই এখন দুইদলেরই এক। দেশ নিয়ে এখন আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে হয় না। কাকে ভরসা করে দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখব? দেশের স্বার্থেই আওয়ামীলীগ-বিএনপির বিকল্প কিছু ভাবার সময় এসেছে কি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন