কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী, মুজাহিদ এই পর্যন্ত চারজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। আমার জন্য, যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর মানেই ছিল বইখাতা বন্ধ করে টিভির সামনে বসে থাকা। কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের দিন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে কুখ্যাত ঘাতকের বিচার হচ্ছে!বিভিন্ন চ্যানেলে তার কুকর্মের কথাগুলো বর্নণা করা হচ্ছিল, সেসব দেখছিলাম, আর রাগে ফেটে পড়ছিলাম। কামারুজ্জামানের রায় কার্যকরের দিন বিনা নোটিশে স্যার পড়াতে চলে এলেন। স্যারকে সাথে নিয়েই সেদিন কামারুজ্জামানের কুকর্মের কাহিনী শুনলাম, স্যারের সাথে রাজনৈতিক আলাপ করলাম, সাথে বাবাও এসে যোগ দিলেন। গত ২২শে নভেম্বর, কুখ্যাত দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহাসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হল। আমি দেশের বাইরে। জাগো বিডি ওয়েব সাইট থেকেই সাধারণ আমি বাংলাদেশের চ্যানেল গুলো দেখি, কিন্তু সেদিন জাগো বিডি সাইটটা স্লো হয়ে গেলও। প্রবাসীরা সবাই নিশ্চয়ই এই একটি ওয়েব সাইটের মাধ্যমে দেশের খবর শুনছিল। সাইট স্লো, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর শোনার সময় বারবার আটকে যাচ্ছিল, রেগে গিয়ে হয়তো ল্যাপটপ ভেঙ্গে ফেলতে পারি, এই ভয়ে ল্যাপটপটা হাতের নাগালের বাইরে রেখে, নাওয়া খাওয়া বন্ধ রেখে নিউজ শুনছিলাম। ভেবেছিলাম রাত ১০টার মধ্যেই হয়তো ঝুলিয়ে দেয়া হবে। ১১টায়ও যখন ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে না, তখন মনে মনে খুব চাইছিলাম আরেকটু দেরী হোক, ১২টা ক্রস করুক। ফাঁসির তারিখটা ২১শে নভেম্বর না হয়ে যেন ২২শে নভেম্বর হয়। অবশেষে বাংলাদেশ সময়ে ১২টা ৫৫ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হল। কাজেই দিনটাকে ২২শে নভেম্বর ধরাই যায়। ২২শে নভেম্বর আমার জন্মদিন। জন্মদিনটা ফেইসবুক প্রোফাইলে হাইড করে দিয়েছিলাম যাতে কেউ দেখতে না পায়। কিন্তু কয়েকজন বন্ধু মনে রেখেছিল, তারা ওয়ালে পোস্ট করার পর, অনেকেই শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাতে শুরু করল। জানা যখন হয়েই গেলও, ভাবছিলাম সুকান্ত ভট্টাচার্যের আঠারো বছর বয়স কবিতাটা পোস্ট করব, শেষ পর্যন্ত আর করা হল না। এই বয়স নিয়ে কম ভোগান্তি হয় নি। তবে ছোট থাকার অনেক উপকারিতাও আছে। সব ভুলত্রুটিগুলো ছোট বলে মাফ পাওয়া যায়। কিন্তু বড় হয়ে গেলে এই সুবিধাটুকু আর পাওয়া যায় না। জগতের জটিল সব বিষয়গুলো নিয়ে ছোটদের ভাবতে হয় না। কিন্তু আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলেই মানুষ নিজেকে জটিল সবকিছুতে জড়িয়ে ফেলে। আমি ছোট থাকতে চাই, ভুল করার পর বয়সের অজুহাতে ক্ষমা পাওয়ার সুবিধাটুকু পেতে চাই সবসময়। জটিল কোনকিছুতে নিজেকে জড়াতে চাই না।
শুনেছি কিশোরী ঐশীর নাকি ফাঁসির রায় হয়েছে? ঐশী তার পুলিশ বাবা ও মাকে খুন করেছে। ঐশী মাদকাশক্ত ছিল। খুনের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছরের কম। বয়স বিবেচনায়, ঘাতক গোলাম আজম যাবজ্জীবন সাজা পেলও, অথচ ঐশীর বেলায় বয়স বিবেচনায় আনা হল না!
ঐশীর এই পরিণতিতে ঐশী একা দায়ী নয়, একজন ঐশীকে ফাঁসি দিলেই সমাজে আরেকজন ঐশী সৃষ্টি হবে না, এমন নিশ্চয়তা কি দেয়া সম্ভব হবে? ঐশীর বয়স অল্প ছিল, সে যে ভুল করেছে সেটাই তাকে বুঝতে দেয়া হল না, তাকে তার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হল না। হ্যাঁ, আমি ঐশীর ফাঁসির বিপক্ষে। কেবল ঐশী না, আমি চাই সব মানুষকেই নিজের ভুল বোঝার, অনুতপ্ত হওয়ার, ভুল সংশোধের সুযোগ দেয়া হোক। তবে যুদ্ধাপরাধীর কথা আলাদা।
মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কাদের মোল্লা নিজের কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত তো দূরের কথা, ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে গেলও। কামারুজ্জামানের মৃত্যুর পর তার পরিবার মিডিয়ায় ‘ভি’ চিহ্ন প্রদর্শন করেছে। সাকা-মুজাহিদ ক্ষমা চাওয়ার নাটকটা করে, চেয়েছিল হয়তো একদিন বেশি বাঁচতে পারবে, কিন্তু যখন দেখল এতে কাজ হচ্ছে না, তখন তার পরিবারের সদস্যরা বাইরে এসে জানিয়ে দিলো তাদের বাবা ক্ষমা চায় নি। এইসব যুদ্ধাপরাধীরা কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময়ই অপরাধ করে নি, যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে দেশে এসে তারা বিএনপি সরকারের আমলে পুনর্বাসিত হয়ে নিজেদের কুকর্ম অব্যাহত রেখেছে। আর এই অপরাধীদের যদি কোন ভাবে ক্ষমা করা হয়, তবে ভবিষ্যতে সরকার বদলের পরই তারা জেল থেকে মুক্ত হয়ে, ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যের সাথে জড়িত প্রত্যেক সদস্যকে হত্যা করবে। বিচার চলাকালীনই কিছু সাক্ষীকে হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে। কাজেই এইসব পশুর প্রতি মানবতা দেখানোর ভুলটা আমি করছি না। তবে কথা হল, এই কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিলেই কি দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে যাবে? তা কিন্তু না। দেশে জঙ্গিবাদের চাষ ঠিকই হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদের চাষের দিকে নজর না দিয়ে আমাদেরকে ঢেড়স চাষের পরামর্শ দিয়েছেন। বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের এই জাতীয় মন্তব্য শুনেই বুঝতে পারি, ৭১ এ ঘাতকরা জাতিকে অনেকটুকুই মেধাশুণ্য করতে পেরেছে।
একের পর এক মুক্তমনা মানুষ হত্যা চলছে, কেবল নাস্তিক মুক্তমনা নয়, বিদেশী নাগরিক হত্যা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া—এসবই নির্বিঘ্নে ঘটে চলেছে। সরকার যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দিচ্ছে, এর জন্য ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এইসব ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনাগুলোর দিকেও কি তারা একটু নজর দিবেন? নাকি এখনও ৪৪ বছর হয়নি বলে বিচার কার্য শুরু করা যাচ্ছে না?
আবার দেশের মানুষের নিরাপত্তার দোহায় দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এই অবস্থাতেও হত্যা উৎসব চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে কি কোন ফল পেয়েছে? দেশের মসজিদ মাদ্রাসায় মগজ ধোলায় চলছে, নাস্তিক হত্যাকে ‘সেন্সিটিভ’ ইস্যু আখ্যা দিয়ে অপরাধীদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে—এইগুলো যদি পারেন বন্ধ করেন, সুফল পাবেনই, নিশ্চিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন