আজকাল অনেকেই স্মার্ট সাজতে কথা বলার সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি। এরই প্রতিবাদে বায়ান্ন নিয়ে একটি গান শুনছিলাম। শিল্পীর নাম নাজির মাহামুদ। না, শিল্পীর নামে বাংলার চিহ্ন নেই। এতে অবশ্য শিল্পীর কোনো দোষ নেই। বাঙালি মুসলমানের নাম মানেই যেন অদ্ভুত অর্থের আরবি শব্দ। বেশিরভাগ আবার আরবি শব্দগুলোর অর্থ না বুঝেই আরবির প্রতি গভীর প্রেম থেকে নামগুলো রাখে। আরবি শব্দ এত্তেলা থেকে ইত্তিলা শব্দটি এসেছে যার অর্থ সংবাদ। স্কুল কলেজে অনেকেই আমার নামের অর্থ জানতে চেয়েছে। কারণ এ শব্দ তারা আগে শোনে নি। বাংলা ডিকশনারিতে আছে নাকি? -প্রশ্ন অনেকের। নামটা অপরিচিত বলেই বাংলা ডিকশেনারিতে আছে কিনা জানার ইচ্ছে। যদিও বিভিন্ন অদ্ভুত অর্থের আরবি নাম অহরহ শুনে এতটাই পরিচিত হয়ে গেছে, সেগুলোর সাথে যে বাংলা ডিকশনারির কোনো সম্পর্ক নেই সেদিকে নজর নেই। নজর নেই বলাটা বোধহয় ভুল হবে। আরবি নাম মানে ইসলামিক নাম, এ ধারণা থেকেই তো সবাই আরবিতে নাম রাখে। এখন আরবিতে সেই শব্দের অর্থ ছাগল হোক বা ভেড়া, তাতে কী যায় আসে? আরবি তো আরবিই। আর তাছাড়া বাংলা নামগুলো অনেকটা ‘হিন্দু হিন্দু’ শোনায়। মুসলমানের নামে ‘হিন্দু হিন্দু’ গন্ধ, একজন মুসলমানের জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু হয় না।
নাজির মাহামুদ গানের একটি লাইন অনেকটা এরকম, ওরা মাকে ডাকে মাম্মি আর বাবাকে ডাকে ড্যাড/….. আমি হাসবো না কাঁদবো ওরে ও ও বায়ান্ন, তোর জন্য; যদিও মাম্মি আর ড্যাড ডাকার সংখ্যা খুব বেশি নয়। বরং অধিকাংশই মাকে আম্মু/আম্মা/আম্মি, বাবাকে আব্বু/আব্বা ডাকে। অথচ আগে কিন্তু সবাই মাকে মা, বাবাকে বাবা-ই ডাকতো। কে কার বাবা-মা’কে কী ডাকবে সেটা যার যার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু সবাই মিলে একসাথে বাবা-মা নামক দু’টি অতিপ্রিয় শব্দকে অন্য ভাষায় আপন করে নেয়া মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। আরো দুঃখের বিষয়, শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা মাম্মি আর আম্মি ডাকের সংখ্যা সম্পর্কে জেনেও শুধুমাত্র মাম্মি ডাকেরই প্রতিবাদ করেন।
কথায় কথায় ইনশাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, মাশাল্লাহ, সোবাহানাল্লাহ, খোদাহাফেজের ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে। না, এ নিয়ে আমরা কথা বলবো না। এ যে সুন্নত! রাজনৈতিক নেতারা কথায় কথায় ‘ইনশাল্লাহ’ শব্দটি ব্যবহার করে। আমরা ক্ষমতায় গেলে- ‘ইনশাল্লাহ, ব্রিজ হবে’,‘ইনশাল্লাহ, হাসপাতাল হবে, ‘ইনশাল্লাহ, উন্নয়নের জোয়ার বইবে’। ইনশাল্লাহ মানে হল, আল্লাহ চাইলে। ব্যাস আল্লাহও চায় না, উন্নয়নের গল্পও ধীরে ধীরে রূপকথার পাতায় চলে যায়। আল্লাহ চায় না বলাতে রাগ করতে পারেন অনেকেই। তবে অর্থটা তো এমনই দাঁড়ায়।
‘মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ, চেহারা হ্যায় মাশাল্লাহ...’ এরকম একটা হিন্দি গান ক্লাসে বসে কলেজের এক বান্ধবী গাইছিল। স্যার তার সামনে হাঁটছে সে খেয়াল নেই। স্যার প্রথম দু’টা শব্দ শুনেই বললেন, ‘দেখছো দেখছো, মেয়েটা কতো ভালো গজল গাচ্ছে’। হাসতে হাসতে স্যারকে বললাম, স্যার পুরো গজলটা শুনে যান। দেখলাম স্যার একরকম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করলেন। যার অর্থ, নিজে তো এসব ভালো কাজের মধ্যে নেই, অন্য কেউ ভালো কিছু করলে তাকে নিয়ে ফাজলামো, বেয়াদব মেয়ে!
‘এখানে প্রস্রাব করবেন না’ এ দেয়াল লিখনের তোয়াক্কা ছেলেরা করে না। অনলাইনে একটি ছবি দেখলাম, প্রস্রাব না করার অনুরোধটি আরবিতে লেখা হয়েছে। ব্যাস, আর কেউ ভুলেও ওদিকে মূত্রত্যাগ করতে যায় না। এতেই বোঝা যায়, মানুষের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। আসল প্রেম অন্য ভাষায়।
কথায় অপ্রয়োজনীয় আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে বলছি, ইংরেজির বিরুদ্ধে কিছুই বলিনি। কারণ আজকের দিনটিই তো সুশীল সমাজের ইংরেজির বিরুদ্ধে বলার দিন। এ নিয়ে বলার লোকের অভাব হবে না। তবুও বলি, নিজেদের স্মার্টনেস জাহির করতে আমার বয়সী অনেকেই কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি, বাংলা শব্দকে ইংরেজির মতো উচ্চারণ করি, যা খুব বাজে শোনায়। আমরা হয়তো বুঝতে পারি না সেটা। কারণ ইংরেজি জানা মানেই বিশাল জ্ঞানী কিছু, এ ধারণা তো আমরা বড়দের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমি ইংরেজি বর্জন করতে বলছি না। বাংলা ভাষায় অনেক ইংরেজি শব্দ আছে সেসবও ত্যাগ করতে বলছি না। আমি বলতে চাইছি, বাংলা বলতে গিয়ে ন্যাকামো করে অপ্রয়োজনীয় ভাবে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে নিজেকে জাহির করার ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। একইভাবে বাংলার সাথে অপ্রয়োজনীয় ভাবে আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহার করে নিজেকে ধার্মিক বা অতিভদ্র জাতীয় কিছু দেখানোটার অভ্যাসটাও বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালীর জন্য শুভ কিছু বয়ে আনবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন