মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০১৭

বাহির বলে দূরে থাকো



অনেক ছেলেদের দেখি মেয়েদের সিরিয়াল দেখা নিয়ে ব্যঙ্গ করে। ছেলেরাও যে সিরিয়াল দেখে না, তা নয়। তবে সিরিয়ালের অধিকাংশ দর্শক নারী। মেয়েদের সিরিয়াল দেখা নিয়ে ব্যঙ্গ করা ছেলেরা কি কখনো এর কারণ ভেবে দেখেছেন?

ছেলেরা বিকেল হলে পাড়ার মাঠে খেলতে যায়, সারা মাঠ দৌড়ায়, ফুটবল-ক্রিকেট খেলে, সাইকেল নিয়ে রেইস করে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়, একা কোনও মেয়েকে পেলে সুযোগ বুঝে দলেবলে হয় তো কেউ কেউ ইভটিজিং করে পুরুষত্বও দেখিয়ে দেয়। বাইরের জগতে ছেলেদের বিনোদনের কোন অভাব নেই।

আর বাইরের জগতে মেয়েদের জন্য ‘বিনোদন` নামক কোন শব্দ এখনো প্রচলিত হয় নি। বাইরের জগৎ বলতে মেয়েদের কাছে অনিরাপদ কিছু। মেয়ে যতক্ষণ বাড়ি না ফিরছে ততক্ষণ বাবা মায়ের চিন্তার শেষ নেই। ‘সন্ধ্যা হয়ে গেল, দেরি করছে কেন? কোন বিপদ হয়নি তো?’

শিশু অবস্থায় ছেলে মেয়ে একসাথে মাঠে খেলতে দেখা যায়, একটু বড় হলেই ছেলেটি পাড়ার মাঠের বাইরে আরও একটু বড় মাঠে খেলতে যায়। স্বাভাবিক। ছেলে বড় হচ্ছে। মাঠ বড় হবে, জগৎ বড় হবে। আর মেয়েটির? মেয়েটির শরীর বড় হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ছোট হতে থাকে তার জগৎ। মেয়েটিকে ঘিরে চারদিক থেকে ছুটে আসতে থাকে কথার তীর। মেয়ে বড় হচ্ছে, তার কি খেলা মানায়? দৌড়লে যদি ওড়না ঠিক ওই জায়গা থেকে নড়ে যায়, যদি ওড়নার ফাঁকে কিছু দেখা যায়, যদি মেয়ের দৌড়নোতে নিতম্বের নড়াচড়া কারও কাছে আকর্ষণীয় ঠেকে, যদি কারও ধর্ষণের ইচ্ছে জাগে, আরও কত কী সমস্যা।

মনে পড়ে, আমি যখন ফাইভ-সিক্সে পড়তাম, তখন আমাদের বাসার সামনের সামান্য একটু খোলা জায়গায় আমার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে খেলতাম। পাড়ার অন্য মেয়েরা আসতো না। তাই ছেলেরাই ছিল আমার বন্ধু। কিন্তু যখন ক্লাস সেভেন-এইটে উঠি, আমার সবচেয়ে ক্লোজ ছেলে বন্ধুটির লম্বায় বাড়তে থাকে আমার চেয়ে বেশি, নাকের নিচে একটু একটু গোঁফের আভাস দেখা দেয়, আমারও শারীরিক পরিবর্তন হতে থাকে। তখন আমার খেলার ক্ষেত্রে বাধা আসে। আর ওই বন্ধুটি তখন ছোট জায়গা থেকে বড় মাঠে খেলতে যায়। ছেলেমেয়ের বন্ধুত্বকে সমাজে স্বাভাবিক ভাবে নেয় না বলে ওর সাথে আমার বন্ধুত্বও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন তো কথাবার্তাও বন্ধ। ও আমাকে দেখলে কেমন যেন লজ্জা পেতো। আমার এক বান্ধবীকে একটা ছেলে বিরক্ত করতো। একদিন দেখলাম আমার ছোটবেলার বন্ধু সেই ইভটিজারসহ তার আরও কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একসাথে রাস্তায় হাঁটছে।

মেয়েরা যত বড় হতে থাকে মেয়েদের জগৎ তত ছোট হতে থাকে। আর ছেলেদের বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের জগৎও বড় হতে থাকে। আমাদের পাড়ায় একটি মেয়ে সাইকেল চালাতো। মেয়েটির নাম জানতাম না। সবাই বলতো ‘ফাহিমের বোন’। পাড়ার একটা কোচিংএ পড়তাম তখন। একদিন শুনি, কোচিং এর স্যারেরা কিছু সিনিয়র ছেলেদের নিয়ে ‘ফাহিমের বোন’এর সাইকেল চালানো নিয়ে সমালোচনা করছেন। এতবড় মেয়ের সাইকেল চালানোর কী দরকার সেটা তারা বুঝে উঠতে পারছেন না। মেয়েটির বাবা-মাও এসব ব্যাপারে সচেতন না বলে তাদেরকে নিয়ে সমালোচনা চলে আরও কিছুক্ষণ।

এসব সমালোচক, নিন্দুক, ধর্ষক, ইভটিজারদের ভয়ে প্রয়োজন ছাড়া মেয়েরা সাধারণত বাইরে যায় না। কারণ বাইরে গেলে সুস্থ ভাবে ফিরে আসতে পারবে এর নিশ্চয়তা কে দিবে? বাইরের জগতে মেয়েদের কোন বিনোদন নেই, বিনোদন তবে কোথায়? কেউ কেউ বিনোদন খুঁজে নেয় টিভি সিরিয়ালে। সিরিয়ালে বৌ-শাশুড়ির ঝগড়া দেখে সবাই নিশ্চিত হয়, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু আর জগতের সব সমস্যার স্রষ্টা মেয়েরাই। যদিও বৌ-শাশুড়ির ঝগড়ার স্ক্রিপ্ট লেখক, পরিচালক যে অধিকাংশ সময় পুরুষেরাই হয় সেটা কারও খেয়াল থাকে না।

আপনারা মেয়েদের বাইরে খেলাধুলা মেনে নিতে পারেন না, ইভ টিজিং করে মজা লুটেন, গলির মুখে মেয়েরা আড্ডা দিলে মেয়ের চরিত্র নিয়ে পাড়ায় গবেষণা করাকে সামাজিক দায়িত্ব মনে করেন। আপনারাই মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী, এই আপনারাই নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে মেয়েকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। আবার ঘরে বসে সিরিয়াল দেখলেও আপনাদের আপত্তি। আপনারা আসলে চানটা কী?

৩টি মন্তব্য:

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. হায়রে নারী সিরিয়াল দেখা নিয়ে পুরুষের কটাক্ষ করাকে নিজ পরাধীনতা হিসাবে দেখলেও । যে স্বাধীন বাহিরের জগত এর কথা বলে গেলে সেখানে অস্তিত্বের কারণে চুলার সামনে পরুষ কে দাড়াতে দেখেও নিজেদের বীজয় হিসাবে দেখলে না । একথা বুঝতে পারলে না যে খেলা ছোটবেলায় কেবলই খুশির বড় বেলায় তাই জিতবার দায় সেখানে নারী পুরুষ সবাই একলা ।

    উত্তরমুছুন
  3. খুব বাস্তব কথা লিখেছেন.... exactly এটাই আমার মাথায় ঘুরত সবসময়, মনের কথা লিখেছেন

    উত্তরমুছুন