তসলিমা নাসরিনের একটি কলামে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন। জান্নাতুন নাঈম প্রীতি তাঁর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে এ কথা বলেছেন, হুমায়ুন আহমেদ আসলে পুরুষতান্ত্রিক নন।
যখন ক্লাস ৬-৭ এ পড়ি, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসগুলো পাগলের মত পড়তাম। হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র ‘হিমু’। টানা হিমু পড়তে পড়তে ঠিক করে ফেললাম আমিও হিমু হবো। নিজেকে তখন হিমু ভাবতে শুরু করলাম। তখন সবেমাত্র ফেসবুক একাউন্ট খুলেছি। সার্চ করে পেয়ে গেলাম হিমুদের কয়েকটি গ্রুপ। একটি গ্রুপে মেম্বার ও হয়ে গেলাম। আমার মত আরও অনেক হিমুরা আছে গ্রুপে। আমরা সবাই হিমু, সে কী উচ্ছ্বাস! গ্রুপে হিমুদের পোস্ট পড়তে পড়তে আমিও একদিন সাহস করে পোস্ট করলাম, মেয়ে হিমু কে কে আছে জানতে চেয়ে। তখন গ্রুপের কয়েকজন আমাকে জানালেন, মেয়েদের আসলে হিমু হওয়া সম্ভব না। মেয়েরা তবে কী হয়? মেয়েরা রূপা হয়। রূপার মত রূপবতী হবে, রূপার মত হিমুদেরকে ভালোবাসবে, নীল শাড়ি পরে নীল পদ্ম হাতে হিমুদের জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু আমি তো রূপা হতে চাই না, আমি হিমু হতে চাই। হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে মাঝরাতে হেঁটে বেড়াতে চাই। শুরু করলাম তর্ক। তখন গ্রুপের কয়েকজন আমাকে হিমু উপন্যাস থেকে লাইন কোট করে দেখালেন, মেয়েদের সম্পর্কে হিমুর কী ধারণা। আর হিমুর পিতা অর্থাৎ হিমুর লেখক মেয়েদের চরিত্র নিয়ে যেসব বাণী দিয়েছেন, যেগুলো অনলাইনে সার্চ করলেই পাওয়া যায়, আমাকে সেসব দেখালেন অনেকে। যেমন- মেয়েদের দুটি জিনিস খুব খারাপ, একটি হচ্ছে সাহস অন্যটি গুয়ার্তুমি/ মেয়েদের বেশি বুদ্ধি ভাল না।বেশি বুদ্ধির মেয়ে কখনো সুখী হয় না। সংসারে যে মেয়ের বুদ্ধি যত কম সে তত সুখী ইত্যাদি ইত্যাদি। সব হিমুরা মিলে প্রমাণ করে দিলেন আমার হিমু হওয়া আসলে সম্ভব নয়। আমি রাগে দুঃখে অপমানে গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর একসময় হিমুর নেশা কেটে গেল, ভুলেও গেলাম সব।
হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ গল্পের মূল চরিত্রের মেয়েটি থাকে অত্যন্ত রূপবতী। তাদের রূপই তাদের গুণ। তাঁর গল্পগুলোর মত তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁর পুরুষতান্ত্রিকতার পরিচয় মিলেছে। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এইচএসসিতে হলিক্রসে পড়তাম। পরীক্ষার ৩ মাস আগে আমার বাচ্চাদের বাবা (হুমায়ূন আহমেদ) আমাকে জোর করে ইউএসএ নিয়ে গেল। পরীক্ষা দেওয়া হল না। আমি যেতে চাইনি। শেষে আমার দাদাকে চিঠি লিখে আমাকে যেতে বাধ্য করল। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। মেডিকেলে পড়তে পারলাম না।'
এইচএসসির মত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষায় হুমায়ূন আহমেদ চাইছিলেন না তাঁর স্ত্রী অংশগ্রহণ করুক।
যাইহোক তিনি পরবর্তীতে এইচএসসি পাশ করলেন। গুলতেকিন লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে হুমায়ূন আহমেদ জানালেন, ‘তোমাকে ইডেনে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছি। মেডিকেলতো পারছোই না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও না।’
গুলতেকিন আহমেদ পরে জানতে পারলেন লং গ্যাপ হলেও তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ আছে। হুমায়ুন আহমেদের কাছে এ ব্যাপারে বললে, তিনি সোজা জানিয়ে দিলেন, তিনি এ বিষয়ে কোনও হেল্প করতে পারবেন না। গুলতেকিন হুমায়ূন আহমেদকে অবাক করে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেন এবং বেশ ভালো নম্বর পেয়েই চান্স পেয়েছেন। গুলতেকিন আহমেদকে হুমায়ুন আহমেদ পরামর্শ দিলেন সোশ্যালজি নিয়ে পড়তে। এ বিষয়ে গুলতেকিন আহম্মেদ তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভাইভার দিন স্যার আমাকে বললেন, তুমি ইংলিশে পড়। আমি বললাম- না। আমি সোশ্যালজি লিখে দিয়ে আসলাম। বিকেলে আমার এক্স হাজবেন্ড আসলেন। বললাম, তোমার কথায় সাবজেক্ট সোশ্যালজি দিয়েছি।সে বলল, খুব ভাল। তুমি ইংলিশ পারবে না। তোমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। ..আমার খুব ইগোতে লাগল। কেন বলল, আমি ইংলিশ পারবো না! আমি ডায়েরি থেকে ফোন নম্বর নিয়ে যে স্যার ভাইভা নিয়েছিলেন তাকে ফোন করলাম। বললাম, স্যার আমি কি সোশ্যালজির পরিবর্তে ইংলিশ নিতে পারি? তিনি বললেন- হ্যাঁ। আর একটা কথা খুব ইগোতে লেগেছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হুমায়ূন বলেছিল, আমাকে সে পোষ্য কোটায় ভর্তি করাতে চেয়েছিল। আমি কেন পোষ্য কোটায় ভর্তি হব!’
হুমায়ূন আহমেদ চান নি তাঁর স্ত্রী লেখাপড়া করুক, স্বাবলম্বী হোক। চেয়েছিলেন, স্ত্রী যেন অল্প শিক্ষিত হয়, যেন স্বামীর উপর নির্ভরশীল থাকে, আর নির্ভরশীল থাকা মানেই স্বামীর সকল অন্যায় মুখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হওয়া। সেটি শেষপর্যন্ত হল না। গুলতেকিন শিক্ষিত হলেন, স্বাবলম্বী হলেন। কাজেই অন্যায় আর মুখে বুজে মেনে নেয়ার কারণ নেই।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মেয়ের বয়সী একজনের প্রেমে পড়লেন। গুলতেকিনের সাথে তাঁর ডিভোর্স হল। তাদের সন্তানদের নামে হুমায়ূন আহমেদের নামের চিহ্ন থাকলেও সন্তানদের দায়িত্ব গেল গুলতেকিনের কাছে, যার নামের কোনও চিহ্ন নেই সন্তানদের নামের পাশে।
এত কিছুর পরও লেখিকা প্রীতি মনে করেন হুমায়ূন আহমেদ পুরুষতান্ত্রিক নন। তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে হুমায়ূন আহমেদকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তিনি একটি ছবি দেখেছেন যেখানে তসলিমা নাসরিন হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন, কাজেই এটি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ না হয়ে যায় না। অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তি। আর ওই ছবিটির প্রেক্ষাপট তসলিমা নাসরিন আগেও বলেছেন। ওইদিন প্রীতির স্ট্যাটাসে তসলিমা নাসরিনের ছোট বোন রোকসানা ইয়াসমিন আবার সেইদিনের কথা প্রীতিকে জানালেন। কারণ ওই সময় ইয়াসমিনও তসলিমা নাসরিনের সাথে ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের আমন্ত্রণে তসলিমা ও ইয়াসমিন বইমেলা থেকে একটি চায়ের স্টলে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কিছু ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন এবং তসলিমা নাসরিন ও তাঁর বোন অপেক্ষা করছিলেন। এই তথ্যটি জেনেও প্রীতি স্ট্যাটাসটি এডিট করবেন না, কারণ তিনি মনে করেন না তিনি কোনও ভুল তথ্য লিখেছেন, তিনি বরং মনে করেন তসলিমা নাসরিন এবং তাঁর বোন মিথ্যে বলছেন। আমি সেখানে কমেন্ট করলে প্রীতি বললেন, আমি নাকি নাক গলাচ্ছি। পাবলিক কমেন্টে যার যা ইচ্ছে কমেন্ট করে, সেখানে আমি ওই স্ট্যাটাসের সাথেই প্রাসঙ্গিক একটি কমেন্ট করলে প্রীতি বড়ই বিরক্ত হলেন। যুক্তি তর্ক আলোচনা এসবে তিনি বড়ই বিরক্ত হোন তা অবশ্য কয়েকদিন আগে বুঝেছি। আমি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছি, যাতে তিনি মনে করলেন আমি তাঁর বাণী নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, সাথে সাথে তিনি আমাকে আনফ্রেন্ড করলেন এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্লক করতে ভোলেন নি।
আবার ফিরে যেতে হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে। কারণ লেখিকা প্রীতি এটি নিয়ে এরমধ্যে আরও একটি স্ট্যাটাস লিখেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মেয়ের বয়সীর সাথে বিয়ে করে সংসার করতে লাগলেন। এতে তাঁর জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়ে নি। পুরুষ বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। কোনও নারীর পক্ষে কি সম্ভব ছিল ছেলের বয়সী কাউকে নিয়ে সংসার পাতানো, কোনও রকম সামাজিক সম্মানহানি ছাড়া? এ কথাটিই তসলিমা নাসরিন তাঁর লেখায় বলেছেন। কিন্তু লেখিকা প্রীতি মনে করেন, অবশ্যই সম্ভব। উদাহরণ দেখালেন সুবর্ণা মোস্তফার। সুবর্ণা মোস্তফা তাঁর চেয়ে কম বয়সী পুরুষকে বিয়ে করেছেন। ৪৮ বছর বয়সী পুরুষ ২০-২৫ বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করছে এতো সমাজে অহরহ ঘটছে। সেখানে সুবর্ণার বয়স যখন ৪৮ তখন তিনি বিয়ে করলেন ৩২ বছর বয়সী পুরুষকে। তারপরও সুবর্ণার কি কম সমস্যা পোহাতে হয়েছে বা হচ্ছে? এখনও সুবর্ণাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রশ্ন আসে সুবর্ণার চরিত্র নিয়ে, কারণ তিনি তাঁর চেয়ে কম বয়সী একজন পুরুষের সাথে প্রেম করেছেন। যেন তসলিমা নাসরিন এটি জানতেন না। সুবর্ণা সেলেব্রেটি হয়েও এত বিতর্কিত হলেন সেখানে একজন সাধারণ নারীর পক্ষে আমাদের সমাজে এটি সম্ভব? তসলিমাকে তিনি ভুল প্রমাণ করে বললেন, প্রেম ভালোবাসা গোপন রাখতে নেই, অন্যায় নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথা আমরা তসলিমা নাসরিনের বই পড়ে আগেই জেনেছি। তসলিমাকে ভুল প্রমাণ করে যেসব জ্ঞানের কথা তিনি বললেন সেসব আসলে তসলিমার কাছ থেকে ধার করা। অবশ্য এগুলো যে তসলিমা বলেছেন তা তিনি উল্লেখ করেন নি। বিশ্বাস করুন, যদি ফেসবুকের বাইরে দু একটা বই আমার পড়া না থাকতো তাহলে আমিও প্রীতির ভক্ত হয়ে যেতাম। যেহেতু কিছু বই পড়েছি তাই শাহরুখ খান, আমির খান, অমিতাভ বচ্চন, হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর ভাই পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী(তাঁর ভাষ্যমতে) মাসুম আব্দুল্লাহকে নিয়ে প্রীতির লেখা অনুপ্রেরণামূলক গল্পগুলো ছাড়া বাকি অধিকাংশ লেখা পড়লেই স্মৃতি নড়েচড়ে উঠে। মনে হয় কোথায় যেন পড়েছি। হয়তো একটু এদিক সেদিক হতে পারে, তবে ঘটনাটা এটাই।
আমরা ফেসবুকে যা লিখি এসব আসলে নতুন কিছু নয়। কেউ নিজেদের নামের জন্যে, পুরষ্কারের জন্য লিখি না। তাই একই কথা যদি লিখেও থাকে নিজের মত করে সেটাও অনেক সময় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু যখন আপনি যার কাছ থেকে শিখেছেন, যার লেখা কপি করছেন নিজের ভাষায়, তাঁকেই ভুল প্রমাণ করতে মাঠে নামেন?
আপনি যা লেখেন তা যে আপনি কপি করছেন না, এটা প্রমাণের জন্য যার কাছ থেকে কপি করছেন তাঁর বিরুদ্ধে মাঝেমাঝে বলা খুব জরুরী হতে পারে। তবে এটা খুব অন্যায়। পাঠকের সাথে এবং আদর্শের সাথে ভণ্ডামী।
শুরুতে তসলিমার নাম নিয়ে আলোচনায় আসা, যথেষ্ট আলোচনা হল, এখন তসলিমার নিন্দা করে সম্মান পেতে হবে। অন্যদের মত সুর ধরলেন ‘তসলিমা নাসরিনের সব বিষয়ের সাথে একমত নই’ তসলিমা নারীবাদ, মানবতাবাদ, সমতায় বিশ্বাসী। প্রীতি এরমধ্যে কোনটির সাথে একমত নন সেটা প্রীতিই ভালো বলতে পারবেন। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন- এই কথা যখন বলেছেন একসময় হয়তো বলবেন পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে তসলিমা যা বলেছেন তা আসলে পুরুষবিদ্বেষ থেকে বলেছেন। এসব বলে হয়তো সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যাবে কিন্তু আদর্শের লড়াই থেকে অনেক দূরে সরে যাবেন।