বাংলাদেশের রাস্তায় বের হলে খেয়াল করে দেখবেন রাস্তায় চলাফেরা করছে মানুষদের মধ্যে ৯০ ভাগ পুরুষ, আর ১০ ভাগ নারী। যেন বাইরের জগতটা কেবল পুরুষের। পুরুষের জগতে নারী অনিরাপত্তায় ভুগে।
খুব সকালে যখন কলেজ বাসের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করতাম, তখন যেন একটি অন্য জগৎ দেখতাম। রাস্তার অধিকাংশ মানুষ নারী, বাসের অধিকাংশ যাত্রী নারী। নারী শ্রমিক তারা। বিভিন্ন গার্মেন্টসে কাজ করেন। বাসের হেল্পার তাদেরকে বলতে পারে না, ‘মহিলা তুলি না, মহিলা সিট নাই’।
উচ্চবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ নারীরাই চাকরী করেন না, যেহেতু পরিবারে অতিরিক্ত অর্থের দরকার হয় না। মধ্যবিত্ত পরিবারেরও খুব কম সংখ্যক নারীই চাকরীর সাথে যুক্ত। তবে নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ নারীরাই স্বচ্ছল জীবনের আশায় চাকরী করেন। তাদের শ্রম ও মেধা দেশের কাজে লাগান। সকালে গার্মেন্টসে কাজের জন্য এবং সন্ধ্যায় কাজের ছুটির পর দলে দলে মেয়েরা যখন রাস্তায় হাঁটে, সেই দৃশ্যটি আমাকে মুগ্ধ করে। শুরুর দিকে পথে পথে হাজারো নারীবিদ্বেষী লোকের হেনস্থা ও টিজিং সহ্য করে গার্মেন্টস এর মেয়েরা আজকে এই পর্যায় এসেছে।
মনে আছে, আমরা প্রথম যখন আল্লামা শফি’কে চিনতে শুরু করি, তখন তার একটি ওয়াজের বক্তব্য অনলাইনে ছড়িয়ে গিয়েছিল? শফি তাঁর সেই বক্তব্যে গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকদের সম্পর্কে কী বলেছিলেন মনে আছে? বলেছিলেন, “আপনার মেয়েকে কেন দিচ্ছেন গার্মেন্টসে কাজ করার জন্য? চাকরি তো অনেক করতেসেন। আপনি নিজে করতেসেন, আপনার বউ করতেসে, মেয়েরা করতেসে। কিন্তু কুলাইতে তো পারতেসেন না। খালি অভাব আর অভাব। আগের যুগে রোজগার করত একজন, স্বামী। সবাই মিইলা খাইত। এখন বরকত নাই। সবাই মিইলা এতো টাকা কামাইয়াও তো কুলাইতে পারতেসেন না। গার্মেন্টসে কেন দিচ্ছেন আপনার মেয়েকে? সকাল ৭/৮ টায় যায়, রাত ১০/১২ টায়ও আসেনা। কোন পুরুষের সাথে ঘোরাফেরা করে তুমি তো জান না। কতজনের সাথে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে তা তো জানেন না। জেনা কইরা টাকা কামাই করতেসে, বরকত থাকবে কেমনে?”
মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে গেলে তো আবার শফি হুজুরদের সমস্যা, দরিদ্র অল্প বয়সী মেয়েরা গার্মেন্টসে চাকরী করলে শফি হুজুরেরা বিয়া করার জন্য কচি মেয়ে পাবেন কীভাবে!
যাদের পরিশ্রমের ঘামে ঘুরছে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা, যাদের তৈরী কাপড় পরে হুজুর ওয়াজে যান, যাদের শ্রমের বিনিময়ে রাষ্ট্র বিদেশী মুদ্রা পায়, বিদেশী নানান পণ্য কিনে, সেসব দিয়ে তৈরী হেলিকপ্টারে চড়ে হুজুর সমাবেশে গিয়ে বলে আসেন, মেয়েদেরকে যেন ঘরে বন্দী করে। গার্মেন্টসে তারা ‘জেনা কইরা টাকা কামাই করতেসে’। একটি দেশের অর্থনীতি যাদের জন্য টিকে আছে তাদের’কে অপমান করে এধরণের ঘৃণ্য কথা বলেও সে কীভাবে পার পেয়ে যায়? শুধু যে পার পেয়েছে তা না। পেয়েছে- রেলের জমি, দখল করা পুকুরের মালিকানা, কওমি মাদ্রাসায় তিনি যেসব মূর্খ ও ধর্মান্ধ তৈরী করেন তাদেরকে পাইয়ে দিয়েছেন মাস্টার্সের সমমান সনদ।
প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রী, সরকারি আমলা, বড় বড় ব্যবসায়ী, পুঁজিপতি, এনজিও কর্তা সবার ঠাটবাট এইসব নারী শ্রমিকদের ১২ ঘন্টা শ্রমের ঘামে গড়া। দেশ চালানোর অর্থ আসে শ্রমিকদের কাছ থেকে, আর দেশ চালানোর পদ্ধতি আসে শফি হুজুরের কাছ থেকে। আর শফি হুজুরের আদর্শ বাস্তবায়নে হুজুরের ব্যক্তিগত পুতুল হিসেবে চেয়ারে বসেছেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!
হাসিনা ভোট পাবার আশায় নয়, বিএনপির ভোট কাটার আশায় শফি হুজুরের সাথে আপোষ করছেন। শুনেছি, আগামী নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের কিছু নেতা ৩০টি আসনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবেন। তবে হেফাজত’কে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন প্রমাণ করতে তারা দলের নাম ব্যবহার করবেন না। হাসিনা যদি ধারণা করে থাকেন যে ওই ৩০টি আসনে বিএনপির ভোটগুলো ভাগ হয়ে কিছু হেফাজতের কাছে কিছু বিএনপির কাছে যাবে এবং বিএনপি এতে হেরে গেলেই হাসিনার জয় নিশ্চিত হয়ে যাবে, তবে হাসিনা খুব ভুল ভাবছেন। ৩০টি আসনে যেসব হেফাজতের নেতারা দাঁড়াবেন, তারা কেউ নিজেরা নিজেদেরকে ভোট দিবে কিনা আমার সন্দেহ হয়। হাসিনার মত একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ কি এটা বুঝেন না? ভোট নিয়ে হাসিনার এত চিন্তা! যার জন্য তিনি শফি হুজুরের মত একজন নোংরা লোকের সাথেও আপোষ করতে প্রস্তুত। কিন্তু ভোট নিয়ে তিনি এত ভাবছেন কেন? যারা হৈ-চৈ, দাঙ্গা- হাঙ্গামা করে নিজেদের সংখ্যা জানান দেয় তাদের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। সংখ্যায় কম বলেই সবসময় কোনও না কোনও ঝামেলা সৃষ্টি করে রাস্তায় জড়ো হয়ে নিজেদের সংখ্যা ও ক্ষমতা দেখাতে চায় তারা। সংখ্যায় এই নগণ্য গোষ্ঠীর সন্ত্রাস আর লুটপাট করা ছাড়া তেমন কোনও ক্ষমতা নেই। যদিও তাদের সন্ত্রাসী ও লুটপাটের ক্ষমতার গুণেই আড়ালে চলে যায় আসল ক্ষমতাবান মানুষেরা, যারা বাঁচিয়ে রাখছেন দেশটাকে।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত করেছেন বলে গর্ব করে জানান। কাদের ক্ষমতায় বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ? বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান দুইটি খাতের প্রথম হল গার্মেন্টস শিল্প এবং দ্বিতীয় প্রবাসী শ্রমিক। যাদের ক্ষমতায় হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশ বানানোর স্বপ্ন দেখেন তাদের ক্ষমতা হাসিনার নজরে আসবে কবে? কবে থেকে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের ভোটের মায়া ভুলে আসল ক্ষমতাবানদের ভোটের জন্য হাসিনা রাজনীতি করবেন?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন