বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৭

মানবতা যখন ধর্ষকের শিশ্নের ডগায়!

মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার কিছুদিন আগে তার ডাক্তারী জীবনের একটি ভীষণ অমানবিক অভিজ্ঞতার কথা তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে শেয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর ডাক্তারী জীবনে একটি কেইস পেয়েছিলেন যেখানে একজন ধর্ষক ধর্ষণ করতে গিয়ে তাঁর যৌনাঙ্গটি ক্ষতবিক্ষত করে নিয়ে এসেছিলেন। ভিক্টিম নারীটি ধর্ষকের পুরুষ যৌনাঙ্গটি সম্পূর্ণ কর্তন করতে পারেননি। কিন্তু হাসপাতালে দেরী করে আসার কারণে অধ্যাপক তাঁর অর্ধকর্তিত যৌনাঙ্গটি মেরামত করতে পারেননি। কেটে ফেলতে হয়েছিলো তাঁর পুরুষাঙ্গটির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। যারা ডাক্তার নন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার চাইতে একজন মানুষের মৃত্যু হওয়াও ভালো। কেননা, এটা শুধুমাত্র পুরুষের যৌনতা হারানো নয়, এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কাজ মুত্র ত্যাগের এর সাথে জড়িত। স্বাভাবিক মুত্র ত্যাগের ব্যাঘাত ঘটলে একজন মানুষ মারাও যেতে পারেন। তাঁর চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে এই ধরনের রিপেয়ার বা মেরামতের পরে রোগীকে প্রায় প্রতিমাসেই হাসপাতালে হাজিরা দিতে হয় তাঁর মুত্রনালীকে সচল রাখার জন্য এবং এই কাজটি তাকে প্রায় সারাজীবন করতে হয়।” তিনি আরও বলেছেন,“এর পেছনে টাকা খরচ আছে, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট আছে। এটা অমানবিক। এটা ভীষণ অমানবিক।”

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? ভিক্টিম নারীটি যদি কোনও রকম আত্মরক্ষার চেষ্টা না করে ধর্ষণের শিকার হয়ে যেতো তাহলে তাকে আমরা ‘ধর্ষিতা’ হিসেবে সহানুভূতির চোখে দেখতাম। তিনি যদি ধর্ষণের বিচার চেয়ে বছরের পর বছর আদালতে হাজিরা দিতেন, অর্থ, শারিরীক ও মানসিক কষ্টে দিন যাপন করতেন তাহলে তাঁর দুঃখে চুক চুক করে দুঃখ প্রকাশ করতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু নারীটি ধর্ষককে প্রতিরোধ করতে ধর্ষকের যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছেন সেক্ষেত্রে আমাদের মানবতার নেক নজরে উনি আসবেন না, আসবে ধর্ষক। কারন তাঁর মহামূল্যবান যন্ত্রটি, যার গর্বে তিনি ‘তরে চুদি, তর মায়েরে চুদি, বোইনরে চুদি’ নিত্ত নৈমিত্তিক কথা বলতেন সেই কনফিডেন্সটি তাঁর থাকছে না। তাই এক্ষেত্রে সারওয়ার সাহেব নারীটিকে কাঠ গড়ায় দাঁড় করালেন। নারীটি যে কত বড় অমানবিক তা জানালেন। ধর্ষণ করতে গিয়ে লিঙ্গ হারানো মানুষের বেদনা সম্পর্কে জানালেন। তাঁর ডাক্তারী জীবনে হয়তো কোনও গণধর্ষণের শিকার হওয়া নারীকে তিনি দেখেন নি, দেখন নি পূজার মত শিশু, যাদেরকে ধর্ষণ করতে যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কাটা হয়, দেখেন নি ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রাণ হারানো কারও শরীর, ধর্ষণের পর যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়ার কাহিনীগুলোও হয়তো ওনার কানে আসে নি কখনো।

একজন মানুষ আক্রন্ত হলে সে নিজেকে বাঁচাতে ওই মুহূর্তে কী করতে পারে তা আমি আপনি বলে দিতে পারি না। আমাকে কেউ ধর্ষণ করতে আসলে আমি অবশ্যই সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তাকে প্রতিরোধ করার, এতে তার বিচি গেল না দণ্ড গেল সেটা নিয়ে ভাবতে যাব না। ধর্ষকের লিঙ্গ যেমন গুরুত্বপূর্ণ আমারটাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সারওয়ার সাহেবেরা মনে করেন, আর যাই করো ধর্ষকের লিঙ্গ মেরামোত অযোগ্য করো না, এ বড় অমনাবিক।


এ বিষয়ে ওমর ফারুক লুক্স একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আইনকানুন-শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে যা বলেছেন সেসবের সাথে একমত না হওয়ার কারন নেই। তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে কি ধর্ষণের হার কমানো যায়?’ অবশ্যই না। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে বছর খানেক হল। তাহলে তিনি কেন মনে করলেন, ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে লিঙ্গ কেটে ফেলার মত কোনও বর্বর আইন হতে যাচ্ছে? এরকম আইনের জন্য কোনও মিছিল সমাবেশ ও বাংলাদেশে হয় নি কখনো। ‘ধর্ষণ করা উচিত হয় নি। কিন্তু কোনও ভদ্র ঘরের মেয়ে সন্ধ্যায় ছেলেদের পার্টির দাওয়াতে যায়?’ সন্ধ্যায় ছেলেদের পার্টির দাওয়াতে যাওয়া মানেই ধরে নেয়া হয় তারা ধর্ষণের অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। ‘এসব মেয়েরা আসলে ধর্ষিত হতেই যায়।’ ‘ধর্ষণ করা ঠিক হয় নি, কিন্তু আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ধর্ষকের বিচি ছ্যাচে দেয়াও ঠিক না। এ ভীষণ অমানবিক।’ - এই মানসিকতা যতদিন সমাজে থাকবে ততদিন ধর্ষণ নানা ভাবে বৈধতা পাবে।

তিনি আরও বলেছেন, “ধর্ষণের আগেই ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। আসলেই ধর্ষণ হয়েছে কিনা, পুরুষটির ধর্ষণের উদ্দেশ্য ছিলো কিনা- আদালত সেটা কিভাবে প্রমাণ করবে?”

তাহালে আমরা জানলাম, ধর্ষক যে আসলেই ধর্ষণ করতে এসেছিল এটি মহামান্য আদলতে প্রমাণের স্বার্থে ধর্ষিত হয়ে আদালতে যেতে হবে। আগে ভাবতাম মাথায় মগজের জায়গায় বিচি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর পক্ষেই এধরণের কথা বলা সম্ভব। এখন জানলাম,মাথায় মানবতা থাকলেও এধরণের কথা বলা যায়। কত কিছু যে জানার বাকি!

‘মওলানা দূরের পাখি’ নামের একটি আইডি চোর, ছিনতাইকারী, ছেলেধরা সন্দেহে গনপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা অপরাধগুলোর সাথে ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষায় যৌনাঙ্গে আঘাত করার তুলনা দিলেন। চোর ছিনতাইকারীদের সন্দেহ করে গণপিটুনি দেয়া হয়, ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষক যদি আপনাকে লিঙ্গের জোর প্রদর্শন করতে না আসে কেবল ইশারা ইঙ্গিতে ধর্ষণের সন্দেহ করে লিঙ্গ কেটে ফেলা কি সম্ভব? আর যেই স্ট্যাটাসটি থেকে এই ইস্যুর সুত্রপাত সেখানে সারওয়ার সাহেব স্পষ্টই বলেছেন, ওই ব্যক্তি ধর্ষণ করতে গিয়ে লিঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে এনেছেন।

১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের মধ্যে ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে।

২০১০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৪২৭টি। এর মধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে ২ হাজার ৭৩৪টি। গত ছয় বছরে ধর্ষণের পর ৫০৮ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। তবে হত্যা করার পরও সব পরিবার মামলা বা আইনি আশ্রয় নেয়নি। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ২৮০টি ঘটনায়। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৬৮ নারী এবং মামলা হয়েছে মাত্র ১১৩টি।

http://www.prothom-alo.com/we-are/article/813160/

মানবাধিকার ও আইন সহায়তাকারী বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিভিন্ন গণমাধ্যম পর্যলোচনা করে নারী ও শিশু নির্যাতনের নানা ঘটনা সংরক্ষণ করে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৭২৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সী শিশু ৬২ জন, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ১৭৮ জন এবং ১৩ থেকে আঠারো বছর বয়সীর সংখ্যা ২৫১ জন। অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার হওয়া প্রায় সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত মোট ২৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যাদের ২০ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ রকম বিভিন্ন সংস্থার হিসাবেও একথা স্পষ্ট যে ধর্ষণের মতো নির্মম ঘটনার শিকার হওয়াদের অধিকাংশই শিশু।

https://www.jugantor.com/online/national/2017/03/21/42653/

২০১৭ সালটা শেষ হলেই ১৭ সালের তালিকাটাও পেয়ে যাবেন। আমি জানি লেখাটা পড়ার সময় অনেকেই এই সংখ্যার তথ্যগুলো এড়িয়ে যাবেন। এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। কারন এগুলো পত্রপত্রিকায়-প্রশাসনের খাতায় লিপিবদ্ধ হওয়া ধর্ষণগুলোর একটি পরিসংখ্যান মাত্র। ধর্ষণ যখন দেশে নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে, এরকম অবস্থায় কোনও মেয়ে যদি আত্মরক্ষার্থে ধর্ষককে আঘাত করে, সেটা মাথায় হোক কিংবা ধর্ষকের বিচির মাথায় আমি মেয়েটিকে বাহাবাই দিব। কারন সমাজে মেয়েরা নিজেদের সম্পর্কে ‘দূর্বল, কোমল, শক্তি নেই’ ইত্যাদি শুনতে শুনতে অনেক সময় নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তাই ধর্ষনের হাত থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু না করে নিজের শরীরের উপর সকল অত্যাচার নির্যাতন সয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কোনও মেয়ে যদি আত্মরক্ষার্থে ধর্ষককে আঘাত, ক্ষতবিক্ষত করে নিজেকে মুক্ত করতে পারে তাহলে অন্য মেয়েরাও জানবে পাল্টা আঘাতের ক্ষমতা মেয়েদের আছে। পুরুষাঙ্গের গর্বে যারা মেয়েদেরকে দূর্বল, যৌনবস্তু ভাবে তারাও জানবে ওটি হাত, পা, চোখ, মাথার মত নিরীহ একটি অঙ্গ মাত্র। আর বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১০১ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের সময় আত্মরক্ষার্থে ভিকটিম যদি ধর্ষককে মেরে ফেলে বা শরীরের খুব “গুরুত্বপূর্ণ কোনও অংশ” পারমানেন্টলি ড্যামেজ করে দেয়, আত্মরক্ষার অধিকারবলে (Right to Private Defence) সে আইনের পূর্ণ সুরক্ষা পাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন