বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৭

নারীবাদীরা কি পুরুষাতঙ্ক ছড়াচ্ছে?

অভিযোগ উঠেছে, অনলাইনের নারীবাদীরা নাকি নারীবাদের নামে পুরুষাতঙ্ক ছড়িয়ে কিশোরীদের পুরুষবিদ্বেষী করে ফেলছে।


যে পোশাকই পরুক, বুকের ওপর ওড়না নামক অতিরিক্ত কাপড়টি মেয়েরা কাদের আতঙ্কে জড়ায়? মেয়ে সময় মত বাড়ি না ফিরলে অভিভাবকের দুঃশ্চিন্তা বাড়ে কাদের আতঙ্কে? কলেজের ছেলে বন্ধুরা কত জায়গায় ঘুরতে যেত। অথচ শহরের ভিতরেই একটা জায়গায় বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায় না, কীসের আশংকায় অভিভাবকেরা অনুমতি দেন না? কাদের আতঙ্কে? ওড়না, হিজাব, বোরকা এতসব পোশাকের বস্তা পরতে হয় কাদের হাত থেকে বাঁচতে? পুরুষাতঙ্ক ছড়ানোর জন্য পুরুষেরাই কি যথেষ্ট নয়? এখন নিশ্চয়ই জিকির ধরবেন, সব পুরুষ এক না। সেটা আমরা খুব জানি। সব পুরুষ ধর্ষণ করেন না। কেউ কেউ করেন। কেউ কনডম পরে করেন, কেউ না পরে করেন। কেউ হোটেলে নিয়ে করেন, কেউ বন্ধুর বাসায় করেন। কেউ সৎ মেয়েকে করেন, কেউ নিজের মেয়েকে করেন। কোনও পুরুষ চিমটি দেন, কেউ খামচি, কেউ আবার ‘পাছা হাতান’। কেউ বাসে হাতান, কেউ রাস্তায় হাতান। কেউ হিজাবে আকর্ষিত হন, কেউ ওড়নায় আকর্ষণ পান। কোনও কোনও পুরুষ আবার খুব ভাল। এসব কিছুই করেন না। এরা বউ নিয়ে থাকেন। ইচ্ছে হলে বউকে চাকরী করার অনুমতি দেন, ইচ্ছা না হলে দেন না। ইচ্ছে হলে বউকে শাড়ি পরান, ইচ্ছা হলে বউএর শাড়ি খুলেন। কাজেই সব পুরুষ কোনও ভাবেই এক হতে পারেন না। কিন্তু সমস্যাটা হল, সব পুরুষই আমাদের সমাজে বসবাস করেন, বিয়ে করেন, সংসার করেন, বউ আছে, বাচ্চা আছে, চাকরী করেন, ফেসবুক করেন, ভালো ভালো স্ট্যাটাস শেয়ার দেন, কমেন্টে ভালো উপদেশ দেন, লাইক দিয়ে পাশে থাকেন। এখন ভালো পুরুষ- খারাপ পুরুষ আলাদা করার উপায় কী? আর ভাল খারাপের সংজ্ঞাটাই বা কী? যিনি ধর্ষণ করেন তিনি খারাপ পুরুষ, আর যারা ধর্ষণের কারণ হিসেবে ভিক্টিমের দোষ খুঁজে বের করেন তারা কী? যিনি এসবের মধ্যে নেই কিন্তু ঘরে বউ নামক একটা সেবাদাসী রাখেন, নিজেরা ইচ্ছেতে বউকে চলতে বাধ্য করেন তিনি কেমন পুরুষ? ছোটবেলায় সমাজ বইয়ে পরিবারের শ্রেণিবিভাগ পড়েছি। ‘আমাদের সমাজের পরিবারগুলো পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। পরিবারের কর্তা থাকেন একজন পুরুষ। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে পুরুষের হাতে।’ পিতৃতন্ত্র ব্যাপারটা বইয়ে পড়তে পড়তে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পিতৃ্তন্ত্রের জায়গায় পুরুষতন্ত্র পড়ে দেখুন। নারীর কর্তা সাজা, নারীকে দাসী বানানো যে সমাজে সামাজিক নিয়ম সে সমাজে ভালো পুরুষটি কে? আর এরকম ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বষী সমাজে পুরুষাতঙ্ক ছড়ানোর দায় নাকি নারীবাদীদের! যেন নারীদের আতংকিত করার মত যথেষ্ট পরিমাণ ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা, অত্যাচার, নির্যাতন এখনও তারা করে উঠতে পারেন নি। আরও কিছু বাকি আছে।

নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে। এরকম খারাপ পরিস্থিতিতেও আশা রাখছিলাম, ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেক মেয়েই এখন তাদের জীবনের কথা লিখছে। নিজের মত করে নারীবাদের চর্চা করছে। সবার মতের সাথে যে আমি একমত তা না। কেউ হিজাব পরে নারীবাদের কথা বলে, কেউ ওড়না পরে। কেউ ধার্মিক, কেউ নাস্তিক। কেউ তসলিমার মতাদর্শকে সঠিক মনে করেন, কেউ করেন না। যার যাই মত থাকুক, তসলিমা নাসরিন একা সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে ‘নারীর কথা, নারী বলবে’ এটার চর্চা শুরু করেছিলেন। এর ফল আমরা সবাই ভোগ করছি।

মেয়েরা কথা বলছে এটা আমার কাছে যখন স্বস্তির বিষয় অন্যদিকে অনেকের কাছে এটিই এখন ভয়ংকর অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো পুরুষ, খারাপ পুরুষ সব একজোট হয়ে এখন মেয়েদের কথা বলা বন্ধের চেষ্টা চালাচ্ছেন। খারাপ পুরুষেরা জোরে করে আর ভালো পুরুষেরা নানান অভিযোগ তুলে। এখানেও আরেকবার প্রমাণিত হয়ে যায় সব পুরুষ এক না।

ভালো পুরুষ, খারাপ পুরুষ নির্বিশেষে উপসংহার টানেন এই বলে যে, নারীরাই নারীর শত্রু। নারী মুক্তিতে যেহেতু তাদের কোনও স্বার্থ নেই, তাই নারীমুক্তির জন্য নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। তারা কি আসলে বলতে চান, পুরুষতন্ত্র যেহেতু পুরুষের স্বার্থ রক্ষা করে তাই তারা পুরুষতান্ত্রিক হবেনই। ধর্ষণ যেহেতু পুরুষকে মজা দেয় তাই পুরুষ ধর্ষণ করবেই। নারীকেই বরং রেখে ঢেকে চলতে হবে? সংসারে নারী পুরুষের অবাধ্য হলে যেহেতু পুরুষ অসন্তুষ্ট হয়ে নারী নির্যাতন করবে, তাই নারী নির্যাতন রুখতে নারীকেই পুরুষের বাধ্য হতে হবে?

পুরুষ চায় পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে। পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে নারীদের দমিয়ে রাখতে হবে। নারীর শরীরকে অশুচি, যৌনবস্তু, মাংসপিণ্ড বলে প্রচার করতে হবে। একইভাবে পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে নারীর কথা বলা বন্ধ করতে হবে। নারীর কথা বলা বন্ধ রাখতে মাঝেমাঝে নারীর দুঃখে চুকচুক করতে হবে, ধর্ষণের কারণে নারীর ইজ্জত-সম্ভ্রম চলে গেল বলে গভীর দুঃখ প্রকাশ করতে হবে, ধর্ষকের ফাঁসির মাধ্যমেই সমস্ত সমস্যার সমাধান করে ফেলার ভান করতে হবে। আমাদের সমাজের তথাকথিত ভালো পুরুষেরা সেটিই করে থাকেন। এরপরেও নারীরা কথা বলতে চাইলে, প্রতিবাদ করতে চাইলে তাদেরকে পুরুষবিদ্বেষী উপাধি দিতে হবে। ভয়ংকর নারীবিদ্বেষী সমাজে বসবাস করে যখন কেউ নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষবিদ্বেষের অভিযোগ তোলে, তখন হেসে বাঁচি না। ধর্মের বিরুদ্ধে বললে যেমন ধার্মিকেরা ধর্মবিদ্বেষী শব্দটি এড়িয়ে মুসলমান বিদ্বেষী কিংবা হিন্দু বিদ্বেষী, খ্রিষ্টান বিদ্বেষী ইত্যাদি অভিযোগ তোলে, তেমনি পুরুষের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বললে পুরুষেরা পুরুষতন্ত্র বিদ্বেষী শব্দটি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলে পুরুষ বিদ্বেষী। একবার ভেবে দেখে না, নারীরা পুরুষ বিদ্বেষী হলে ভ্রূণ অবস্থা থেকে জন্ম নিয়ে, মাতৃদুগ্ধ খেয়ে পুরুষ হয়ে, নারীর দিকে এই অভিযোগ তোলার সুযোগ হতো না।

২টি মন্তব্য: