সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৮

মাসুদা কি ক্ষমা চাইবেন তসলিমার কাছে?



মাসুদা ভাট্টির লেখাটির শুরতেই তিনি তসলিমা নাসরিনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তাঁর সম্পর্কে কথাগুলো বলার জন্য এরকম একটি “মোক্ষম” সময়কে বেছে নিয়েছেন বলে। তসলিমার কথাগুলো যে সত্য তা তিনি মিউ মিউ সুরে অনেকটাই স্বীকার করেছেন, না করে উপায়ও ছিল না অবশ্য।  জবাবে তসলিমা বলেছেন, সত্য বলার জন্য সবসময়ই উপযুক্ত।  যদি ভুল মনে না করে থাকি তাহলে, মাসুদা মোক্ষম সময় বলতে ইঙ্গিত করেছেন যখন তিনি আক্রমণের শিকার, নাজুক অবস্থায় আছেন, সকলের সমর্থন দরকার...এরকম কিছু। মাসুদা আসলে কী অবস্থায় আছেন? বর্তমান সময়ের মইনুল বিতর্কে তাঁর ভূমিকা আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

বিএনপি-জামায়েত পন্থী বুদ্ধিজীবী ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন অনেক দিন ধরেই সরকার বিরোধী নানান কূটচালে জড়িত ছিলেন। অনেকের ভাষায় লোকটার খুব বাড় বেড়েছিল। সবাই যখন তাকে শায়েস্তা করার উপায় খুঁজছিলেন তখন সেই সুযোগটি জনাব মইনুলই করে দিলেন একাত্তর টিভিতে মাসুদা ভাট্টির উদ্দেশ্যে “চরিত্রহীন মনে করতে চাই” মন্তব্য করে। মাসুদার করা প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে এমন মন্তব্য করে ব্যারিস্টার মইনুল অবশ্যই অন্যায় করেছেন। পরবর্তিতে তিনি মাসুদা ভাট্টিকে ফোন করে, চিঠি লিখে নানান ভাবে ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা পাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ ততক্ষণে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, মইনুল সাহেবকে নাকানিচুবানি খাওয়ানো হবে। সে উদ্দেশ্যে সাংবাদিকদের মিটিং হয়েছে, মামলা হয়েছে, টকশো এমনকি টিভিতে তাঁর খবর প্রচার না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারমানে বলা যায় এখানে মইনুলকে শায়েস্তা করতে মাসুদা একজন “উছিলা” মাত্র। তাই মাসুদার ভাষায়, “একটি চরম সংকটকালে যখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কবলে থেকে একদল মানুষ ন্যায়ের জন্য লড়ছে..” এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই মিটিং, বয়কট, মামলার সাথে নারী আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই, পুরোটাই রাজনৈতিক। ব্যারিস্টার মইনুলকে নাকানি চুবানি খাওয়ানো হচ্ছে, আরও খাওয়ানোর নির্দেশ এসেছে কেননা আজকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “মইনুলের বিরুদ্ধে আরও মামলা করুন” এবং শেষ পর্যন্ত মইনুলকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। সংকটকাল মইনুলের, মাসুদার নয়। 

এই একাত্তর টিভিতেই নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হোসেন আইভীকে শামীম ওসমান নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। শুধু কি ভাষায় আক্রমণ? শারিরীক ভাবেও আক্রমণ করতে উদ্ধত হয়েছিলেন। না, এর প্রতিবাদে মিছিল মিটিং, প্রেস কনফারেন্স, প্রতিবাদলিপি, বিবৃতি কিছুই হয়নি। উল্টো ওই অংশটুকু কেটে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়েছিল। কারণ শামীম ওসমান সরকারি দলের লোক। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কোনও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা সম্ভব নয়। তাই একাত্তর টিভি সেসময় অনেকটাই নীরব ভূমিকা নিয়েছিলেন। 

মাসুদা ভাট্টি সহ আরও অনেকের মতে তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত ক্ষোভ ঝেড়েছেন। তসলিমার সাথে মাসুদার ব্যক্তিগত সম্পর্কটা কতটুকু?  একসময় তসলিমার কল্যাণে মাসুদার ব্রিটেনে নাগরিকত্ব মিলেছিল। পরবর্তিতে তসলিমার ‘ক’ বইটি প্রকাশিত হলে সেখানে বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের উল্লেখ এসেছে। তাঁদের কারও কারও সম্পর্কে সত্য সামনে আসায় তাঁরা অস্বস্তিতে পড়েছিলেন।  তাই বই ব্যান করতে, কুৎসা রটাতে মাঠে নামেন তাঁদের অনেকেই। তখন মাসুদা ভাট্টিও তাঁদের সাথে তাঁর কুৎসার ঝুলি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। ২০০৩ সালে নভেম্বরের ২০,২১,২২ তিনদিন ধরে মাসুদা ভাট্টির সেই কুৎসা ছাপানো হয় দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায়, যার শিরোনাম ছিল, “তসলিমা নাসরিনের লেখা ‘ক’ ফুরিয়ে যাওয়ার বেদনাঘন আত্মযৌবনিক কামশাস্ত্র”। মাসুদা তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেছেন সেসময় তাঁর নারীবাদ, নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে একাডেমিক জ্ঞান না থাকায় তিনি সেসব গালিগালাজ লিখেছিলেন। তিনি অবশ্য এসব গালাগালকে ব্যক্তিগত আক্রমণ মানতে নারাজ। কী লিখেছিলেন তিনি সেসময় তার কিছু অংশ তুলে ধরা হল-

“তসলিমা নাসরিনের কঃ ফুরিয়ে যাওয়ার বেদনাঘন আত্মযৌবনিক কামশাস্ত্র:..... দূর্বল চিত্রের যে কেউ বইটি পাঠে ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে উদ্বেল হবেন, বিশেষ করে কলেজ ছাত্রদের কাছে বইটি হতে পারে রাতের ঘুম হরণকারী। আত্মজৈবনিক কোন গ্রন্থে এইরকম রগরগে ভাষায় ব্যক্তিগত যৌনতার বর্ণনা খুব কম লেখাতেই খুঁজে পাবেন কেউ। সেদিক থেকে তসলিমা নাসরিনের বইটি অবশ্যই অনেকের কাছে অবশ্য পাঠ্য হবে। এর আগেও এমনটি হয়েছে, তার আমার মেয়েবেলা, উতল হাওয়া পাঠে কামশাস্ত্রের চৌষট্টি কলা তিনি শিখিয়েছেন বাঙালি পাঠককে।…. ক বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের প্রথম বর্ণ বটে। কিন্তু সেটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য। কিন্তু তসলিমা নাসরিন তার ক হয়তো কামশাস্ত্রকেই বুঝিয়েছেন এবং সেটাও এই সাধারণের জন্যই। আশ্চর্য, কোথায় একজন লেখক ক বর্ণানুক্রম দিয়ে কলমের শক্তির কথা বলবেন তা না, তিনি নেমেছেন ক দিয়ে কামশাস্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে।”


তসলিমা তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ‘ক’ বইয়ের নামকরণের কারণ বলেছিলেন, বকুলি নামে একটি কিশোরী মেয়ে গণধর্ষণের স্বীকার হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মা বারবার তাকে বলছিলো, “কথা ক, কথা ক বকুলি”। তবুও সে কথা বলেনি। সেই “বকুলি কথা ক” থেকেই  তসলিমা নিজের বইয়ের নামকরণ করেছিলেন ‘ক’। আর মাসুদা ভাট্টি ‘ক’ নামকরণের পেছনে পেয়েছেন কামশাস্ত্রের গন্ধ। যার যেমন চিন্তা। যারা ‘ক’ পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই জানবেন বইটির মূল আলোচ্য ছিল মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। আরও ছিল, লেখকের নারীবাদী ভাবনা, কর্মকাণ্ড, দেশের নানা ঘটনা, তাঁর লেখক জীবন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, কবি লেখক বুদ্ধিজীবিদের সহচর্যের প্রসঙ্গে নানান আলোচনা। 

তিনি আরও বলেছেন, “এখন প্রতিবছর তাঁর দুটি একটি বই বেরুচ্ছে, হৈ চৈ ফেলে দিচ্ছে শুধুমাত্র যৌনতার কারণেই, কিন্তু যখন তাঁর শরীরে ও কলমে ডেফিসিট হবে, তখন? নিজেকে পরিত্যক্ত ল্যাম্পপোস্ট তসলিমা কেন বানাতে গেলেন বুঝিনা। তাঁর ‘ক’ তাঁকে এরকমই একটি ল্যাম্পপোস্ট বানিয়েছে যেখানে আর কোন দিন হয়ত বাতি জ্বলবে না। কিন্তু পরিত্যক্ত ল্যাম্পপোস্ট পেলে সারমেয়রা যা করে সেটা ভেবে কষ্ট লাগছে।” 

মাসুদার কথা মতে, নারীবাদ সম্পর্কে একাডেমিক জ্ঞান ছিল না বলেই নাকি তিনি  তসলিমাকে পরিত্যক্ত ল্যাম্পপোষ্ট বলেছেন। পরিত্যক্ত ল্যাম্পপোষ্টে সারমেয়রা অর্থাৎ কুকুররা যা করে সেটি ভেবে তিনি দু:খ করেছেন। তাঁর মতে, ‘ক’ বইটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে শরীরে ঘিনঘিনে ঘা ওলা রাস্তায় পড়ে থাকা এক বুড়ি বেশ্যার আত্মরতি। তসলিমার ১ম ও ২য় আত্মজীবনী আমার মেয়েবেলা ও উতল হাওয়ার মত সাহসী বই সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল, এসব বইয়ে নাকি  তিনি বাঙালিকে কামশাস্ত্রের চোষট্টিকলা শিখিয়েছেন। বলে রাখা ভাল, আমার মেয়েবেলা বইটির জন্য তসলিমা নাসরিন দ্বিতীয় বারের মত  আনন্দ পুরষ্কার পেয়েছিলেন। 

 ব্যারিস্টার মইনুল মাসুদা ভাট্টিকে চরিত্রহীন বললে সেটি যদি হয় নারী আন্দোলনের বিষয় তাহলে মাসুদা ভাট্টি সমগ্র লেখাজুড়ে তসলিমাকে চরিত্রহীন থেকে শুরু করে যতসব নোংরা আশোভন ভাষায় গালাগালের ব্যাপারটা কীভাবে তসলিমা-মাসুদার ব্যক্তিগত বিষয় হয়? যারা তসলিমার লেখাকে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে লেখা বলেছিলেন, তারা আশা করি  সুবিচার করবেন। 

২০ বছর আগে তসলিমাকে দেয়া গালাগাল তসলিমা এখনও মনে রেখেছেন বলে মাসুদা অনেকটা গোস্বা করেছেন। প্রশ্ন হল, তসলিমার কাছে কি তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন? না,চান নি। ক্ষমা না চেয়েই তিনি ‘যা হয়েছে ভুলে যান’ জাতীয় মামাবাড়ির আবদারটা কীভাবে করলেন? আর এদিকে যেই মইনুলকে নিয়ে এত শোরগোল সেই মইনুল ফোনে ক্ষমা চেয়ে এমনকি চিঠি পাঠিয়েও ক্ষমা পাননি। 

তাই মাসুদা তসলিমাকে উদ্দেশ্য করে তাঁর স্ট্যাটাসে, মাথা পেতে নিলাম, কোনও বিদ্বেষ নেই, ব্যক্তিগত আক্রমণ করিনি- জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে পাঠকের কাছে সুবোধ বালিকা সেজে যে সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টা সেটি তাঁর চরিত্রের আরেকটি দিককে উন্মোচিত করে, যাকে সোজা বাংলায় বলে ‘ধূর্ত’।

রবিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৮

শফি হুজুরদের স্বাধীনতা দিবসের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা!


মেয়েদের পোশাক নিয়ে মোশারফ করিমের ‘ইসলাম বিরোধী’ মন্তব্যে অনলাইন অফলাইন তোলপাড়। তিনি ধর্ষণের কারণ হিসেবে পোশাক নয় বরং বিকৃত মস্তিষ্ককে দায়ী করেছিলেন। এটা কিনা হয়ে গেল ইসলাম বিরোধী মন্তব্য? তাহলে কি ইসলাম ‘অশালীন’ পোশাক পরা মেয়েদের ধর্ষণের অনুমতি দেয়? এটা জিজ্ঞেস করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ৭দিনের ব্যান খেলাম সাথে বেশ্যা-মাগী জাতীয় উপাধি সহ ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি। 

কোরআন ধর্ষণের অনুমতি দেয়- এটা মেনে নিতে তাদের আপত্তি। আবার ধর্ষণের জন্য দায়ী শুধুই ধর্ষক এটাও তারা মেনে নিতে পারছেন না। কারণ তাদের অনেকেই সুযোগের অভাবে এখনও ধর্ষক হয়ে উঠতে পারেননি। তাদের চিন্তাধারা কতটা নোংরা তা তারা জানেন। তাদের এই নোংরামি ইসলাম সম্মত কিনা প্রশ্ন তুলতেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত! আমাকে ধর্ষণ করে তারা দেখিয়ে দিতে চায়, আমি মিথ্যা বলছি, কোরআনে আসলে অনেক “ভালো ভালো” কথা লেখা আছে। কোরআনে যদি এত ভাল কথা লেখা থাকে তাহলে কোরআন মেনে চলা ব্যক্তিরা এত জঘন্য রকম নোংরা কেন?

কী বলেছিলেন মোশারফ করিম? খুবই সাদামাটা দুটো কথা। “একটা মেয়ে তার পছন্দ মত পোশাক পরবে না? পোশাকেই যদি সমস্যা তাহলে ৭ বছরের মেয়েটির ক্ষেত্রে কী যুক্তি দিব আমরা? যিনি বোরখা পরেছিলেন তার ক্ষেত্রে কী যুক্তি দিব আমরা? যুক্তি আছে? না।” বলেছিলেন, আমরা যেন নিজেরা শ্লীল হয়ে উঠি, ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতে শিখি। “ব্যক্তি স্বাধীনতা”? এটি নিশ্চয়ই ইসলাম বিরোধী শব্দ। মুসলমানেরা সাধারণত ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে তাদের নিজেদের নিয়ম জারি রাখতে এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। তাদের নিজেদের দেশে এধরণের শব্দ কেউ ব্যবহার করলে তার জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যায়, যার উদাহরণ মোশারফ করিম। অত্যন্ত যৌক্তিক কথা বলেও তাকে ক্ষমা চাইতে হল। ক্ষমা চাওয়ার পোস্টটিতে তিনি লিখেছেন, “পোশাকের শালীনতায় আমি বিশ্বাস করি এবং তা জরুরী” এবার প্রশ্ন শালীনতার মাপকাঠি কী? কোনটি শালীন এবং কোনটি অশালীন এটা নির্ধারণ করবে কে? কারও কাছে মেয়েদের মাথার চুল দেখা গেলে সেটি অশালীন, কারও কাছে বোরখা ছাড়া বাকিসব অশালীন, কারও কাছে বোরখার পাশাপাশি নেকাব দিয়ে মুখ না ঢাকলে সেটি খুবই অশালীন। আবার কারও কারও কাছে মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়াই অশালীন। এটা অনেকটা সহি মুসলমান বিতর্কের মত। কেউ মনে করেন যারা নাস্তিক-বিধর্মীদের হত্যা করে তারাই সহি মুসলমান, আবার কেউ মনে করেন যারা মানুষ হত্যা করে তারা সহি মুসলমান নয়। এই সহি মুসলমানের যেমন কোনও সংজ্ঞা বা মাপকাঠি নেই, শালীন/ অশালীনেরও নেই। এটা সম্পূর্ণই নির্ভর করে ব্যক্তির উপর। 

তাহলে মেয়েরা কী করবে? ঘরে বসে রান্নাবান্না আর বাচ্চা জন্ম দেয়ার যুগে ফিরে যাবে? নাকি পুরুষেরা নিজেদের চিন্তাধারাকে শালীন করবেন? এই প্রশ্ন তুলে মোশারফ করিমকে ক্ষমা চাইতে হলেও মেয়েদেরকে তেঁতুল মনে করা, মেয়েদেরকে স্বামী সেবা আর বাচ্চা জন্ম দেয়ার নির্দেশদাতা’কে কিন্তু তার ভয়ংকর আইনবিরোধী কথাগুলোর জন্য কোনও রকম ক্ষমা চাইতে হয় নি। বরং আমাদের নারী প্রধানমন্ত্রী তার সেবা যত্নে অর্থবিত্ত, স্বাদ আহ্লাদ, দাবিদাওয়া- সবকিছু একের পর এক পূর্ণ করে যাচ্ছেন। সংবিধান বিরোধী কথা বলেও শফি হুজুরকে ক্ষমা চাইতে হয় না। অথচ সাদামাটা দুটো যৌক্তিক কথা বলে মোশারফ করিমকে আতংকিত হয়ে ক্ষমা চাইতে হয়। স্বাধীন দেশে শফি হুজুরেরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাই স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শফি হুজুর সহ সকল নারীবিরোধীদেরকে স্বাধীনতার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানানোই যায়।

কাদের সিদ্দিকী, যাকে আমরা বঙ্গবীর বলে চিনি, ক’দিন আগে তিনি রঙ্গবীর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। বললেন, “এদেশে শুধু নারী আর নারী, আল্লাহ্‌র রহমত আসবে না।” নারী ক্ষমতায় থাকলে আল্লাহ্‌র রহমত আসবে না, দেশের উন্নতি হবে না- এসব কথা শফি হুজুরদের কাছ থেকে শুনলেও কাদের সিদ্দিকীর মত ব্যক্তির মুখ থেকে একই কথা শুনতে হবে কখনও ভাবিনি।

মোশারফ করিম সেদিন অনুষ্ঠানে আরও একটি জরুরী কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, “এটা আমাদের অসুস্থতা, সমাজের অসুস্থতা এবং সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে এরা যদি পার পেয়ে যেতে থাকে সেটাই বড় ব্যাধি। পার পেয়ে যেতে থাকলে ব্যাধি ছড়ায়, কমে না।” পার পেয়ে গেলে ব্যাধি ছড়ায়, কমে না- এটি জেনেও তিনি ক্ষমা চেয়ে তাদেরকে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ দিলেন, যা অত্যন্ত হতাশার। তিনি না হয় আতংকিত হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন, আমাদের সমাজের ‘ভালো পুরুষেরা’ কোথায়? ফেসবুকে নারীবাদ বিষয়ক কিছু লিখলেই যারা ‘সব পুরুষ এক না’ স্লোগান ধরেন, তারা কেন এ ঘটনায় মোশারফ করিমের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না? আপনারা তো দাবী করেন, দু’একটা খারাপ পুরুষের জন্য সব পুরুষের বদনাম হয়। কয়েকটা খারাপের ভয়ে একজনকে ক্ষমা চাইতে হল, এরপরেও কেন আপনারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন না? কেন বলছেন না মোশারফ কোনও ভুল করেন নি? প্রতিবাদটা যতটা জোরালো হওয়া উচিত ততটা জোরালো কেন হচ্ছে না? কবে হবে? ব্যাধিকে প্রশ্রয় দিতে দিতে আর কত ছড়ানো হবে?

বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৭

কপি পেস্ট লেখিকা

তসলিমা নাসরিনের একটি কলামে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন। জান্নাতুন নাঈম প্রীতি তাঁর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে এ কথা বলেছেন, হুমায়ুন আহমেদ আসলে পুরুষতান্ত্রিক নন।

যখন ক্লাস ৬-৭ এ পড়ি, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসগুলো পাগলের মত পড়তাম। হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র ‘হিমু’। টানা হিমু পড়তে পড়তে ঠিক করে ফেললাম আমিও হিমু হবো। নিজেকে তখন হিমু ভাবতে শুরু করলাম। তখন সবেমাত্র ফেসবুক একাউন্ট খুলেছি। সার্চ করে পেয়ে গেলাম হিমুদের কয়েকটি গ্রুপ। একটি গ্রুপে মেম্বার ও হয়ে গেলাম। আমার মত আরও অনেক হিমুরা আছে গ্রুপে। আমরা সবাই হিমু, সে কী উচ্ছ্বাস! গ্রুপে হিমুদের পোস্ট পড়তে পড়তে আমিও একদিন সাহস করে পোস্ট করলাম, মেয়ে হিমু কে কে আছে জানতে চেয়ে। তখন গ্রুপের কয়েকজন আমাকে জানালেন, মেয়েদের আসলে হিমু হওয়া সম্ভব না। মেয়েরা তবে কী হয়? মেয়েরা রূপা হয়। রূপার মত রূপবতী হবে, রূপার মত হিমুদেরকে ভালোবাসবে, নীল শাড়ি পরে নীল পদ্ম হাতে হিমুদের জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু আমি তো রূপা হতে চাই না, আমি হিমু হতে চাই। হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে মাঝরাতে হেঁটে বেড়াতে চাই। শুরু করলাম তর্ক। তখন গ্রুপের কয়েকজন আমাকে হিমু উপন্যাস থেকে লাইন কোট করে দেখালেন, মেয়েদের সম্পর্কে হিমুর কী ধারণা। আর হিমুর পিতা অর্থাৎ হিমুর লেখক মেয়েদের চরিত্র নিয়ে যেসব বাণী দিয়েছেন, যেগুলো অনলাইনে সার্চ করলেই পাওয়া যায়, আমাকে সেসব দেখালেন অনেকে। যেমন- মেয়েদের দুটি জিনিস খুব খারাপ, একটি হচ্ছে সাহস অন্যটি গুয়ার্তুমি/ মেয়েদের বেশি বুদ্ধি ভাল না।বেশি বুদ্ধির মেয়ে কখনো সুখী হয় না। সংসারে যে মেয়ের বুদ্ধি যত কম সে তত সুখী ইত্যাদি ইত্যাদি। সব হিমুরা মিলে প্রমাণ করে দিলেন আমার হিমু হওয়া আসলে সম্ভব নয়। আমি রাগে দুঃখে অপমানে গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর একসময় হিমুর নেশা কেটে গেল, ভুলেও গেলাম সব।

হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ গল্পের মূল চরিত্রের মেয়েটি থাকে অত্যন্ত রূপবতী। তাদের রূপই তাদের গুণ। তাঁর গল্পগুলোর মত তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁর পুরুষতান্ত্রিকতার পরিচয় মিলেছে। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এইচএসসিতে হলিক্রসে পড়তাম। পরীক্ষার ৩ মাস আগে আমার বাচ্চাদের বাবা (হুমায়ূন আহমেদ) আমাকে জোর করে ইউএসএ নিয়ে গেল। পরীক্ষা দেওয়া হল না। আমি যেতে চাইনি। শেষে আমার দাদাকে চিঠি লিখে আমাকে যেতে বাধ্য করল। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। মেডিকেলে পড়তে পারলাম না।'
এইচএসসির মত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষায় হুমায়ূন আহমেদ চাইছিলেন না তাঁর স্ত্রী অংশগ্রহণ করুক।

যাইহোক তিনি পরবর্তীতে এইচএসসি পাশ করলেন। গুলতেকিন লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে হুমায়ূন আহমেদ জানালেন, ‘তোমাকে ইডেনে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছি। মেডিকেলতো পারছোই না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও না।’

গুলতেকিন আহমেদ পরে জানতে পারলেন লং গ্যাপ হলেও তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ আছে। হুমায়ুন আহমেদের কাছে এ ব্যাপারে বললে, তিনি সোজা জানিয়ে দিলেন, তিনি এ বিষয়ে কোনও হেল্প করতে পারবেন না। গুলতেকিন হুমায়ূন আহমেদকে অবাক করে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেন এবং বেশ ভালো নম্বর পেয়েই চান্স পেয়েছেন। গুলতেকিন আহমেদকে হুমায়ুন আহমেদ পরামর্শ দিলেন সোশ্যালজি নিয়ে পড়তে। এ বিষয়ে গুলতেকিন আহম্মেদ তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভাইভার দিন স্যার আমাকে বললেন, তুমি ইংলিশে পড়। আমি বললাম- না। আমি সোশ্যালজি লিখে দিয়ে আসলাম। বিকেলে আমার এক্স হাজবেন্ড আসলেন। বললাম, তোমার কথায় সাবজেক্ট সোশ্যালজি দিয়েছি।সে বলল, খুব ভাল। তুমি ইংলিশ পারবে না। তোমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। ..আমার খুব ইগোতে লাগল। কেন বলল, আমি ইংলিশ পারবো না! আমি ডায়েরি থেকে ফোন নম্বর নিয়ে যে স্যার ভাইভা নিয়েছিলেন তাকে ফোন করলাম। বললাম, স্যার আমি কি সোশ্যালজির পরিবর্তে ইংলিশ নিতে পারি? তিনি বললেন- হ্যাঁ। আর একটা কথা খুব ইগোতে লেগেছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হুমায়ূন বলেছিল, আমাকে সে পোষ্য কোটায় ভর্তি করাতে চেয়েছিল। আমি কেন পোষ্য কোটায় ভর্তি হব!’

হুমায়ূন আহমেদ চান নি তাঁর স্ত্রী লেখাপড়া করুক, স্বাবলম্বী হোক। চেয়েছিলেন, স্ত্রী যেন অল্প শিক্ষিত হয়, যেন স্বামীর উপর নির্ভরশীল থাকে, আর নির্ভরশীল থাকা মানেই স্বামীর সকল অন্যায় মুখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হওয়া। সেটি শেষপর্যন্ত হল না। গুলতেকিন শিক্ষিত হলেন, স্বাবলম্বী হলেন। কাজেই অন্যায় আর মুখে বুজে মেনে নেয়ার কারণ নেই।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মেয়ের বয়সী একজনের প্রেমে পড়লেন। গুলতেকিনের সাথে তাঁর ডিভোর্স হল। তাদের সন্তানদের নামে হুমায়ূন আহমেদের নামের চিহ্ন থাকলেও সন্তানদের দায়িত্ব গেল গুলতেকিনের কাছে, যার নামের কোনও চিহ্ন নেই সন্তানদের নামের পাশে।

এত কিছুর পরও লেখিকা প্রীতি মনে করেন হুমায়ূন আহমেদ পুরুষতান্ত্রিক নন। তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে হুমায়ূন আহমেদকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তিনি একটি ছবি দেখেছেন যেখানে তসলিমা নাসরিন হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন, কাজেই এটি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ না হয়ে যায় না। অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তি। আর ওই ছবিটির প্রেক্ষাপট তসলিমা নাসরিন আগেও বলেছেন। ওইদিন প্রীতির স্ট্যাটাসে তসলিমা নাসরিনের ছোট বোন রোকসানা ইয়াসমিন আবার সেইদিনের কথা প্রীতিকে জানালেন। কারণ ওই সময় ইয়াসমিনও তসলিমা নাসরিনের সাথে ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের আমন্ত্রণে তসলিমা ও ইয়াসমিন বইমেলা থেকে একটি চায়ের স্টলে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কিছু ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন এবং তসলিমা নাসরিন ও তাঁর বোন অপেক্ষা করছিলেন। এই তথ্যটি জেনেও প্রীতি স্ট্যাটাসটি এডিট করবেন না, কারণ তিনি মনে করেন না তিনি কোনও ভুল তথ্য লিখেছেন, তিনি বরং মনে করেন তসলিমা নাসরিন এবং তাঁর বোন মিথ্যে বলছেন। আমি সেখানে কমেন্ট করলে প্রীতি বললেন, আমি নাকি নাক গলাচ্ছি। পাবলিক কমেন্টে যার যা ইচ্ছে কমেন্ট করে, সেখানে আমি ওই স্ট্যাটাসের সাথেই প্রাসঙ্গিক একটি কমেন্ট করলে প্রীতি বড়ই বিরক্ত হলেন। যুক্তি তর্ক আলোচনা এসবে তিনি বড়ই বিরক্ত হোন তা অবশ্য কয়েকদিন আগে বুঝেছি। আমি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছি, যাতে তিনি মনে করলেন আমি তাঁর বাণী নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, সাথে সাথে তিনি আমাকে আনফ্রেন্ড করলেন এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্লক করতে ভোলেন নি।

আবার ফিরে যেতে হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে। কারণ লেখিকা প্রীতি এটি নিয়ে এরমধ্যে আরও একটি স্ট্যাটাস লিখেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মেয়ের বয়সীর সাথে বিয়ে করে সংসার করতে লাগলেন। এতে তাঁর জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়ে নি। পুরুষ বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। কোনও নারীর পক্ষে কি সম্ভব ছিল ছেলের বয়সী কাউকে নিয়ে সংসার পাতানো, কোনও রকম সামাজিক সম্মানহানি ছাড়া? এ কথাটিই তসলিমা নাসরিন তাঁর লেখায় বলেছেন। কিন্তু লেখিকা প্রীতি মনে করেন, অবশ্যই সম্ভব। উদাহরণ দেখালেন সুবর্ণা মোস্তফার। সুবর্ণা মোস্তফা তাঁর চেয়ে কম বয়সী পুরুষকে বিয়ে করেছেন। ৪৮ বছর বয়সী পুরুষ ২০-২৫ বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করছে এতো সমাজে অহরহ ঘটছে। সেখানে সুবর্ণার বয়স যখন ৪৮ তখন তিনি বিয়ে করলেন ৩২ বছর বয়সী পুরুষকে। তারপরও সুবর্ণার কি কম সমস্যা পোহাতে হয়েছে বা হচ্ছে? এখনও সুবর্ণাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রশ্ন আসে সুবর্ণার চরিত্র নিয়ে, কারণ তিনি তাঁর চেয়ে কম বয়সী একজন পুরুষের সাথে প্রেম করেছেন। যেন তসলিমা নাসরিন এটি জানতেন না। সুবর্ণা সেলেব্রেটি হয়েও এত বিতর্কিত হলেন সেখানে একজন সাধারণ নারীর পক্ষে আমাদের সমাজে এটি সম্ভব? তসলিমাকে তিনি ভুল প্রমাণ করে বললেন, প্রেম ভালোবাসা গোপন রাখতে নেই, অন্যায় নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথা আমরা তসলিমা নাসরিনের বই পড়ে আগেই জেনেছি। তসলিমাকে ভুল প্রমাণ করে যেসব জ্ঞানের কথা তিনি বললেন সেসব আসলে তসলিমার কাছ থেকে ধার করা। অবশ্য এগুলো যে তসলিমা বলেছেন তা তিনি উল্লেখ করেন নি। বিশ্বাস করুন, যদি ফেসবুকের বাইরে দু একটা বই আমার পড়া না থাকতো তাহলে আমিও প্রীতির ভক্ত হয়ে যেতাম। যেহেতু কিছু বই পড়েছি তাই শাহরুখ খান, আমির খান, অমিতাভ বচ্চন, হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর ভাই পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী(তাঁর ভাষ্যমতে) মাসুম আব্দুল্লাহকে নিয়ে প্রীতির লেখা অনুপ্রেরণামূলক গল্পগুলো ছাড়া বাকি অধিকাংশ লেখা পড়লেই স্মৃতি নড়েচড়ে উঠে। মনে হয় কোথায় যেন পড়েছি। হয়তো একটু এদিক সেদিক হতে পারে, তবে ঘটনাটা এটাই।
আমরা ফেসবুকে যা লিখি এসব আসলে নতুন কিছু নয়। কেউ নিজেদের নামের জন্যে, পুরষ্কারের জন্য লিখি না। তাই একই কথা যদি লিখেও থাকে নিজের মত করে সেটাও অনেক সময় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু যখন আপনি যার কাছ থেকে শিখেছেন, যার লেখা কপি করছেন নিজের ভাষায়, তাঁকেই ভুল প্রমাণ করতে মাঠে নামেন? 

আপনি যা লেখেন তা যে আপনি কপি করছেন না, এটা প্রমাণের জন্য যার কাছ থেকে কপি করছেন তাঁর বিরুদ্ধে মাঝেমাঝে বলা খুব জরুরী হতে পারে। তবে এটা খুব অন্যায়। পাঠকের সাথে এবং আদর্শের সাথে ভণ্ডামী।

শুরুতে তসলিমার নাম নিয়ে আলোচনায় আসা, যথেষ্ট আলোচনা হল, এখন তসলিমার নিন্দা করে সম্মান পেতে হবে। অন্যদের মত সুর ধরলেন ‘তসলিমা নাসরিনের সব বিষয়ের সাথে একমত নই’ তসলিমা নারীবাদ, মানবতাবাদ, সমতায় বিশ্বাসী। প্রীতি এরমধ্যে কোনটির সাথে একমত নন সেটা প্রীতিই ভালো বলতে পারবেন। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে পুরুষতান্ত্রিক বলেছেন- এই কথা যখন বলেছেন একসময় হয়তো বলবেন পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে তসলিমা যা বলেছেন তা আসলে পুরুষবিদ্বেষ থেকে বলেছেন। এসব বলে হয়তো সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যাবে কিন্তু আদর্শের লড়াই থেকে অনেক দূরে সরে যাবেন।

মানবতা যখন ধর্ষকের শিশ্নের ডগায়!

মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার কিছুদিন আগে তার ডাক্তারী জীবনের একটি ভীষণ অমানবিক অভিজ্ঞতার কথা তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে শেয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর ডাক্তারী জীবনে একটি কেইস পেয়েছিলেন যেখানে একজন ধর্ষক ধর্ষণ করতে গিয়ে তাঁর যৌনাঙ্গটি ক্ষতবিক্ষত করে নিয়ে এসেছিলেন। ভিক্টিম নারীটি ধর্ষকের পুরুষ যৌনাঙ্গটি সম্পূর্ণ কর্তন করতে পারেননি। কিন্তু হাসপাতালে দেরী করে আসার কারণে অধ্যাপক তাঁর অর্ধকর্তিত যৌনাঙ্গটি মেরামত করতে পারেননি। কেটে ফেলতে হয়েছিলো তাঁর পুরুষাঙ্গটির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। যারা ডাক্তার নন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার চাইতে একজন মানুষের মৃত্যু হওয়াও ভালো। কেননা, এটা শুধুমাত্র পুরুষের যৌনতা হারানো নয়, এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কাজ মুত্র ত্যাগের এর সাথে জড়িত। স্বাভাবিক মুত্র ত্যাগের ব্যাঘাত ঘটলে একজন মানুষ মারাও যেতে পারেন। তাঁর চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে এই ধরনের রিপেয়ার বা মেরামতের পরে রোগীকে প্রায় প্রতিমাসেই হাসপাতালে হাজিরা দিতে হয় তাঁর মুত্রনালীকে সচল রাখার জন্য এবং এই কাজটি তাকে প্রায় সারাজীবন করতে হয়।” তিনি আরও বলেছেন,“এর পেছনে টাকা খরচ আছে, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট আছে। এটা অমানবিক। এটা ভীষণ অমানবিক।”

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? ভিক্টিম নারীটি যদি কোনও রকম আত্মরক্ষার চেষ্টা না করে ধর্ষণের শিকার হয়ে যেতো তাহলে তাকে আমরা ‘ধর্ষিতা’ হিসেবে সহানুভূতির চোখে দেখতাম। তিনি যদি ধর্ষণের বিচার চেয়ে বছরের পর বছর আদালতে হাজিরা দিতেন, অর্থ, শারিরীক ও মানসিক কষ্টে দিন যাপন করতেন তাহলে তাঁর দুঃখে চুক চুক করে দুঃখ প্রকাশ করতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু নারীটি ধর্ষককে প্রতিরোধ করতে ধর্ষকের যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছেন সেক্ষেত্রে আমাদের মানবতার নেক নজরে উনি আসবেন না, আসবে ধর্ষক। কারন তাঁর মহামূল্যবান যন্ত্রটি, যার গর্বে তিনি ‘তরে চুদি, তর মায়েরে চুদি, বোইনরে চুদি’ নিত্ত নৈমিত্তিক কথা বলতেন সেই কনফিডেন্সটি তাঁর থাকছে না। তাই এক্ষেত্রে সারওয়ার সাহেব নারীটিকে কাঠ গড়ায় দাঁড় করালেন। নারীটি যে কত বড় অমানবিক তা জানালেন। ধর্ষণ করতে গিয়ে লিঙ্গ হারানো মানুষের বেদনা সম্পর্কে জানালেন। তাঁর ডাক্তারী জীবনে হয়তো কোনও গণধর্ষণের শিকার হওয়া নারীকে তিনি দেখেন নি, দেখন নি পূজার মত শিশু, যাদেরকে ধর্ষণ করতে যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কাটা হয়, দেখেন নি ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রাণ হারানো কারও শরীর, ধর্ষণের পর যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়ার কাহিনীগুলোও হয়তো ওনার কানে আসে নি কখনো।

একজন মানুষ আক্রন্ত হলে সে নিজেকে বাঁচাতে ওই মুহূর্তে কী করতে পারে তা আমি আপনি বলে দিতে পারি না। আমাকে কেউ ধর্ষণ করতে আসলে আমি অবশ্যই সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তাকে প্রতিরোধ করার, এতে তার বিচি গেল না দণ্ড গেল সেটা নিয়ে ভাবতে যাব না। ধর্ষকের লিঙ্গ যেমন গুরুত্বপূর্ণ আমারটাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সারওয়ার সাহেবেরা মনে করেন, আর যাই করো ধর্ষকের লিঙ্গ মেরামোত অযোগ্য করো না, এ বড় অমনাবিক।


এ বিষয়ে ওমর ফারুক লুক্স একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আইনকানুন-শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে যা বলেছেন সেসবের সাথে একমত না হওয়ার কারন নেই। তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে কি ধর্ষণের হার কমানো যায়?’ অবশ্যই না। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে বছর খানেক হল। তাহলে তিনি কেন মনে করলেন, ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে লিঙ্গ কেটে ফেলার মত কোনও বর্বর আইন হতে যাচ্ছে? এরকম আইনের জন্য কোনও মিছিল সমাবেশ ও বাংলাদেশে হয় নি কখনো। ‘ধর্ষণ করা উচিত হয় নি। কিন্তু কোনও ভদ্র ঘরের মেয়ে সন্ধ্যায় ছেলেদের পার্টির দাওয়াতে যায়?’ সন্ধ্যায় ছেলেদের পার্টির দাওয়াতে যাওয়া মানেই ধরে নেয়া হয় তারা ধর্ষণের অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। ‘এসব মেয়েরা আসলে ধর্ষিত হতেই যায়।’ ‘ধর্ষণ করা ঠিক হয় নি, কিন্তু আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ধর্ষকের বিচি ছ্যাচে দেয়াও ঠিক না। এ ভীষণ অমানবিক।’ - এই মানসিকতা যতদিন সমাজে থাকবে ততদিন ধর্ষণ নানা ভাবে বৈধতা পাবে।

তিনি আরও বলেছেন, “ধর্ষণের আগেই ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। আসলেই ধর্ষণ হয়েছে কিনা, পুরুষটির ধর্ষণের উদ্দেশ্য ছিলো কিনা- আদালত সেটা কিভাবে প্রমাণ করবে?”

তাহালে আমরা জানলাম, ধর্ষক যে আসলেই ধর্ষণ করতে এসেছিল এটি মহামান্য আদলতে প্রমাণের স্বার্থে ধর্ষিত হয়ে আদালতে যেতে হবে। আগে ভাবতাম মাথায় মগজের জায়গায় বিচি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর পক্ষেই এধরণের কথা বলা সম্ভব। এখন জানলাম,মাথায় মানবতা থাকলেও এধরণের কথা বলা যায়। কত কিছু যে জানার বাকি!

‘মওলানা দূরের পাখি’ নামের একটি আইডি চোর, ছিনতাইকারী, ছেলেধরা সন্দেহে গনপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা অপরাধগুলোর সাথে ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষায় যৌনাঙ্গে আঘাত করার তুলনা দিলেন। চোর ছিনতাইকারীদের সন্দেহ করে গণপিটুনি দেয়া হয়, ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষক যদি আপনাকে লিঙ্গের জোর প্রদর্শন করতে না আসে কেবল ইশারা ইঙ্গিতে ধর্ষণের সন্দেহ করে লিঙ্গ কেটে ফেলা কি সম্ভব? আর যেই স্ট্যাটাসটি থেকে এই ইস্যুর সুত্রপাত সেখানে সারওয়ার সাহেব স্পষ্টই বলেছেন, ওই ব্যক্তি ধর্ষণ করতে গিয়ে লিঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে এনেছেন।

১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের মধ্যে ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে।

২০১০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৪২৭টি। এর মধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে ২ হাজার ৭৩৪টি। গত ছয় বছরে ধর্ষণের পর ৫০৮ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। তবে হত্যা করার পরও সব পরিবার মামলা বা আইনি আশ্রয় নেয়নি। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ২৮০টি ঘটনায়। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৬৮ নারী এবং মামলা হয়েছে মাত্র ১১৩টি।

http://www.prothom-alo.com/we-are/article/813160/

মানবাধিকার ও আইন সহায়তাকারী বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিভিন্ন গণমাধ্যম পর্যলোচনা করে নারী ও শিশু নির্যাতনের নানা ঘটনা সংরক্ষণ করে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৭২৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সী শিশু ৬২ জন, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ১৭৮ জন এবং ১৩ থেকে আঠারো বছর বয়সীর সংখ্যা ২৫১ জন। অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার হওয়া প্রায় সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত মোট ২৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যাদের ২০ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ রকম বিভিন্ন সংস্থার হিসাবেও একথা স্পষ্ট যে ধর্ষণের মতো নির্মম ঘটনার শিকার হওয়াদের অধিকাংশই শিশু।

https://www.jugantor.com/online/national/2017/03/21/42653/

২০১৭ সালটা শেষ হলেই ১৭ সালের তালিকাটাও পেয়ে যাবেন। আমি জানি লেখাটা পড়ার সময় অনেকেই এই সংখ্যার তথ্যগুলো এড়িয়ে যাবেন। এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। কারন এগুলো পত্রপত্রিকায়-প্রশাসনের খাতায় লিপিবদ্ধ হওয়া ধর্ষণগুলোর একটি পরিসংখ্যান মাত্র। ধর্ষণ যখন দেশে নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে, এরকম অবস্থায় কোনও মেয়ে যদি আত্মরক্ষার্থে ধর্ষককে আঘাত করে, সেটা মাথায় হোক কিংবা ধর্ষকের বিচির মাথায় আমি মেয়েটিকে বাহাবাই দিব। কারন সমাজে মেয়েরা নিজেদের সম্পর্কে ‘দূর্বল, কোমল, শক্তি নেই’ ইত্যাদি শুনতে শুনতে অনেক সময় নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তাই ধর্ষনের হাত থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু না করে নিজের শরীরের উপর সকল অত্যাচার নির্যাতন সয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কোনও মেয়ে যদি আত্মরক্ষার্থে ধর্ষককে আঘাত, ক্ষতবিক্ষত করে নিজেকে মুক্ত করতে পারে তাহলে অন্য মেয়েরাও জানবে পাল্টা আঘাতের ক্ষমতা মেয়েদের আছে। পুরুষাঙ্গের গর্বে যারা মেয়েদেরকে দূর্বল, যৌনবস্তু ভাবে তারাও জানবে ওটি হাত, পা, চোখ, মাথার মত নিরীহ একটি অঙ্গ মাত্র। আর বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১০১ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের সময় আত্মরক্ষার্থে ভিকটিম যদি ধর্ষককে মেরে ফেলে বা শরীরের খুব “গুরুত্বপূর্ণ কোনও অংশ” পারমানেন্টলি ড্যামেজ করে দেয়, আত্মরক্ষার অধিকারবলে (Right to Private Defence) সে আইনের পূর্ণ সুরক্ষা পাবে।

নারীবাদীরা কি পুরুষাতঙ্ক ছড়াচ্ছে?

অভিযোগ উঠেছে, অনলাইনের নারীবাদীরা নাকি নারীবাদের নামে পুরুষাতঙ্ক ছড়িয়ে কিশোরীদের পুরুষবিদ্বেষী করে ফেলছে।


যে পোশাকই পরুক, বুকের ওপর ওড়না নামক অতিরিক্ত কাপড়টি মেয়েরা কাদের আতঙ্কে জড়ায়? মেয়ে সময় মত বাড়ি না ফিরলে অভিভাবকের দুঃশ্চিন্তা বাড়ে কাদের আতঙ্কে? কলেজের ছেলে বন্ধুরা কত জায়গায় ঘুরতে যেত। অথচ শহরের ভিতরেই একটা জায়গায় বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায় না, কীসের আশংকায় অভিভাবকেরা অনুমতি দেন না? কাদের আতঙ্কে? ওড়না, হিজাব, বোরকা এতসব পোশাকের বস্তা পরতে হয় কাদের হাত থেকে বাঁচতে? পুরুষাতঙ্ক ছড়ানোর জন্য পুরুষেরাই কি যথেষ্ট নয়? এখন নিশ্চয়ই জিকির ধরবেন, সব পুরুষ এক না। সেটা আমরা খুব জানি। সব পুরুষ ধর্ষণ করেন না। কেউ কেউ করেন। কেউ কনডম পরে করেন, কেউ না পরে করেন। কেউ হোটেলে নিয়ে করেন, কেউ বন্ধুর বাসায় করেন। কেউ সৎ মেয়েকে করেন, কেউ নিজের মেয়েকে করেন। কোনও পুরুষ চিমটি দেন, কেউ খামচি, কেউ আবার ‘পাছা হাতান’। কেউ বাসে হাতান, কেউ রাস্তায় হাতান। কেউ হিজাবে আকর্ষিত হন, কেউ ওড়নায় আকর্ষণ পান। কোনও কোনও পুরুষ আবার খুব ভাল। এসব কিছুই করেন না। এরা বউ নিয়ে থাকেন। ইচ্ছে হলে বউকে চাকরী করার অনুমতি দেন, ইচ্ছা না হলে দেন না। ইচ্ছে হলে বউকে শাড়ি পরান, ইচ্ছা হলে বউএর শাড়ি খুলেন। কাজেই সব পুরুষ কোনও ভাবেই এক হতে পারেন না। কিন্তু সমস্যাটা হল, সব পুরুষই আমাদের সমাজে বসবাস করেন, বিয়ে করেন, সংসার করেন, বউ আছে, বাচ্চা আছে, চাকরী করেন, ফেসবুক করেন, ভালো ভালো স্ট্যাটাস শেয়ার দেন, কমেন্টে ভালো উপদেশ দেন, লাইক দিয়ে পাশে থাকেন। এখন ভালো পুরুষ- খারাপ পুরুষ আলাদা করার উপায় কী? আর ভাল খারাপের সংজ্ঞাটাই বা কী? যিনি ধর্ষণ করেন তিনি খারাপ পুরুষ, আর যারা ধর্ষণের কারণ হিসেবে ভিক্টিমের দোষ খুঁজে বের করেন তারা কী? যিনি এসবের মধ্যে নেই কিন্তু ঘরে বউ নামক একটা সেবাদাসী রাখেন, নিজেরা ইচ্ছেতে বউকে চলতে বাধ্য করেন তিনি কেমন পুরুষ? ছোটবেলায় সমাজ বইয়ে পরিবারের শ্রেণিবিভাগ পড়েছি। ‘আমাদের সমাজের পরিবারগুলো পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। পরিবারের কর্তা থাকেন একজন পুরুষ। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে পুরুষের হাতে।’ পিতৃতন্ত্র ব্যাপারটা বইয়ে পড়তে পড়তে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পিতৃ্তন্ত্রের জায়গায় পুরুষতন্ত্র পড়ে দেখুন। নারীর কর্তা সাজা, নারীকে দাসী বানানো যে সমাজে সামাজিক নিয়ম সে সমাজে ভালো পুরুষটি কে? আর এরকম ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বষী সমাজে পুরুষাতঙ্ক ছড়ানোর দায় নাকি নারীবাদীদের! যেন নারীদের আতংকিত করার মত যথেষ্ট পরিমাণ ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা, অত্যাচার, নির্যাতন এখনও তারা করে উঠতে পারেন নি। আরও কিছু বাকি আছে।

নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে। এরকম খারাপ পরিস্থিতিতেও আশা রাখছিলাম, ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেক মেয়েই এখন তাদের জীবনের কথা লিখছে। নিজের মত করে নারীবাদের চর্চা করছে। সবার মতের সাথে যে আমি একমত তা না। কেউ হিজাব পরে নারীবাদের কথা বলে, কেউ ওড়না পরে। কেউ ধার্মিক, কেউ নাস্তিক। কেউ তসলিমার মতাদর্শকে সঠিক মনে করেন, কেউ করেন না। যার যাই মত থাকুক, তসলিমা নাসরিন একা সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে ‘নারীর কথা, নারী বলবে’ এটার চর্চা শুরু করেছিলেন। এর ফল আমরা সবাই ভোগ করছি।

মেয়েরা কথা বলছে এটা আমার কাছে যখন স্বস্তির বিষয় অন্যদিকে অনেকের কাছে এটিই এখন ভয়ংকর অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো পুরুষ, খারাপ পুরুষ সব একজোট হয়ে এখন মেয়েদের কথা বলা বন্ধের চেষ্টা চালাচ্ছেন। খারাপ পুরুষেরা জোরে করে আর ভালো পুরুষেরা নানান অভিযোগ তুলে। এখানেও আরেকবার প্রমাণিত হয়ে যায় সব পুরুষ এক না।

ভালো পুরুষ, খারাপ পুরুষ নির্বিশেষে উপসংহার টানেন এই বলে যে, নারীরাই নারীর শত্রু। নারী মুক্তিতে যেহেতু তাদের কোনও স্বার্থ নেই, তাই নারীমুক্তির জন্য নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। তারা কি আসলে বলতে চান, পুরুষতন্ত্র যেহেতু পুরুষের স্বার্থ রক্ষা করে তাই তারা পুরুষতান্ত্রিক হবেনই। ধর্ষণ যেহেতু পুরুষকে মজা দেয় তাই পুরুষ ধর্ষণ করবেই। নারীকেই বরং রেখে ঢেকে চলতে হবে? সংসারে নারী পুরুষের অবাধ্য হলে যেহেতু পুরুষ অসন্তুষ্ট হয়ে নারী নির্যাতন করবে, তাই নারী নির্যাতন রুখতে নারীকেই পুরুষের বাধ্য হতে হবে?

পুরুষ চায় পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে। পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে নারীদের দমিয়ে রাখতে হবে। নারীর শরীরকে অশুচি, যৌনবস্তু, মাংসপিণ্ড বলে প্রচার করতে হবে। একইভাবে পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে নারীর কথা বলা বন্ধ করতে হবে। নারীর কথা বলা বন্ধ রাখতে মাঝেমাঝে নারীর দুঃখে চুকচুক করতে হবে, ধর্ষণের কারণে নারীর ইজ্জত-সম্ভ্রম চলে গেল বলে গভীর দুঃখ প্রকাশ করতে হবে, ধর্ষকের ফাঁসির মাধ্যমেই সমস্ত সমস্যার সমাধান করে ফেলার ভান করতে হবে। আমাদের সমাজের তথাকথিত ভালো পুরুষেরা সেটিই করে থাকেন। এরপরেও নারীরা কথা বলতে চাইলে, প্রতিবাদ করতে চাইলে তাদেরকে পুরুষবিদ্বেষী উপাধি দিতে হবে। ভয়ংকর নারীবিদ্বেষী সমাজে বসবাস করে যখন কেউ নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষবিদ্বেষের অভিযোগ তোলে, তখন হেসে বাঁচি না। ধর্মের বিরুদ্ধে বললে যেমন ধার্মিকেরা ধর্মবিদ্বেষী শব্দটি এড়িয়ে মুসলমান বিদ্বেষী কিংবা হিন্দু বিদ্বেষী, খ্রিষ্টান বিদ্বেষী ইত্যাদি অভিযোগ তোলে, তেমনি পুরুষের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বললে পুরুষেরা পুরুষতন্ত্র বিদ্বেষী শব্দটি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলে পুরুষ বিদ্বেষী। একবার ভেবে দেখে না, নারীরা পুরুষ বিদ্বেষী হলে ভ্রূণ অবস্থা থেকে জন্ম নিয়ে, মাতৃদুগ্ধ খেয়ে পুরুষ হয়ে, নারীর দিকে এই অভিযোগ তোলার সুযোগ হতো না।

শফি হুজুররা আসলে কতটা ক্ষমতাবান?

বাংলাদেশের রাস্তায় বের হলে খেয়াল করে দেখবেন রাস্তায় চলাফেরা করছে মানুষদের মধ্যে ৯০ ভাগ পুরুষ, আর ১০ ভাগ নারী। যেন বাইরের জগতটা কেবল পুরুষের। পুরুষের জগতে নারী অনিরাপত্তায় ভুগে।

খুব সকালে যখন কলেজ বাসের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করতাম, তখন যেন একটি অন্য জগৎ দেখতাম। রাস্তার অধিকাংশ মানুষ নারী, বাসের অধিকাংশ যাত্রী নারী। নারী শ্রমিক তারা। বিভিন্ন গার্মেন্টসে কাজ করেন। বাসের হেল্পার তাদেরকে বলতে পারে না, ‘মহিলা তুলি না, মহিলা সিট নাই’।

উচ্চবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ নারীরাই চাকরী করেন না, যেহেতু পরিবারে অতিরিক্ত অর্থের দরকার হয় না। মধ্যবিত্ত পরিবারেরও খুব কম সংখ্যক নারীই চাকরীর সাথে যুক্ত। তবে নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ নারীরাই স্বচ্ছল জীবনের আশায় চাকরী করেন। তাদের শ্রম ও মেধা দেশের কাজে লাগান। সকালে গার্মেন্টসে কাজের জন্য এবং সন্ধ্যায় কাজের ছুটির পর দলে দলে মেয়েরা যখন রাস্তায় হাঁটে, সেই দৃশ্যটি আমাকে মুগ্ধ করে। শুরুর দিকে পথে পথে হাজারো নারীবিদ্বেষী লোকের হেনস্থা ও টিজিং সহ্য করে গার্মেন্টস এর মেয়েরা আজকে এই পর্যায় এসেছে।


মনে আছে, আমরা প্রথম যখন আল্লামা শফি’কে চিনতে শুরু করি, তখন তার একটি ওয়াজের বক্তব্য অনলাইনে ছড়িয়ে গিয়েছিল? শফি তাঁর সেই বক্তব্যে গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকদের সম্পর্কে কী বলেছিলেন মনে আছে? বলেছিলেন, “আপনার মেয়েকে কেন দিচ্ছেন গার্মেন্টসে কাজ করার জন্য? চাকরি তো অনেক করতেসেন। আপনি নিজে করতেসেন, আপনার বউ করতেসে, মেয়েরা করতেসে। কিন্তু কুলাইতে তো পারতেসেন না। খালি অভাব আর অভাব। আগের যুগে রোজগার করত একজন, স্বামী। সবাই মিইলা খাইত। এখন বরকত নাই। সবাই মিইলা এতো টাকা কামাইয়াও তো কুলাইতে পারতেসেন না। গার্মেন্টসে কেন দিচ্ছেন আপনার মেয়েকে? সকাল ৭/৮ টায় যায়, রাত ১০/১২ টায়ও আসেনা। কোন পুরুষের সাথে ঘোরাফেরা করে তুমি তো জান না। কতজনের সাথে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে তা তো জানেন না। জেনা কইরা টাকা কামাই করতেসে, বরকত থাকবে কেমনে?”

মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে গেলে তো আবার শফি হুজুরদের সমস্যা, দরিদ্র অল্প বয়সী মেয়েরা গার্মেন্টসে চাকরী করলে শফি হুজুরেরা বিয়া করার জন্য কচি মেয়ে পাবেন কীভাবে!

যাদের পরিশ্রমের ঘামে ঘুরছে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা, যাদের তৈরী কাপড় পরে হুজুর ওয়াজে যান, যাদের শ্রমের বিনিময়ে রাষ্ট্র বিদেশী মুদ্রা পায়, বিদেশী নানান পণ্য কিনে, সেসব দিয়ে তৈরী হেলিকপ্টারে চড়ে হুজুর সমাবেশে গিয়ে বলে আসেন, মেয়েদেরকে যেন ঘরে বন্দী করে। গার্মেন্টসে তারা ‘জেনা কইরা টাকা কামাই করতেসে’। একটি দেশের অর্থনীতি যাদের জন্য টিকে আছে তাদের’কে অপমান করে এধরণের ঘৃণ্য কথা বলেও সে কীভাবে পার পেয়ে যায়? শুধু যে পার পেয়েছে তা না। পেয়েছে- রেলের জমি, দখল করা পুকুরের মালিকানা, কওমি মাদ্রাসায় তিনি যেসব মূর্খ ও ধর্মান্ধ তৈরী করেন তাদেরকে পাইয়ে দিয়েছেন মাস্টার্সের সমমান সনদ।

প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রী, সরকারি আমলা, বড় বড় ব্যবসায়ী, পুঁজিপতি, এনজিও কর্তা সবার ঠাটবাট এইসব নারী শ্রমিকদের ১২ ঘন্টা শ্রমের ঘামে গড়া। দেশ চালানোর অর্থ আসে শ্রমিকদের কাছ থেকে, আর দেশ চালানোর পদ্ধতি আসে শফি হুজুরের কাছ থেকে। আর শফি হুজুরের আদর্শ বাস্তবায়নে হুজুরের ব্যক্তিগত পুতুল হিসেবে চেয়ারে বসেছেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!

হাসিনা ভোট পাবার আশায় নয়, বিএনপির ভোট কাটার আশায় শফি হুজুরের সাথে আপোষ করছেন। শুনেছি, আগামী নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের কিছু নেতা ৩০টি আসনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবেন। তবে হেফাজত’কে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন প্রমাণ করতে তারা দলের নাম ব্যবহার করবেন না। হাসিনা যদি ধারণা করে থাকেন যে ওই ৩০টি আসনে বিএনপির ভোটগুলো ভাগ হয়ে কিছু হেফাজতের কাছে কিছু বিএনপির কাছে যাবে এবং বিএনপি এতে হেরে গেলেই হাসিনার জয় নিশ্চিত হয়ে যাবে, তবে হাসিনা খুব ভুল ভাবছেন। ৩০টি আসনে যেসব হেফাজতের নেতারা দাঁড়াবেন, তারা কেউ নিজেরা নিজেদেরকে ভোট দিবে কিনা আমার সন্দেহ হয়। হাসিনার মত একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ কি এটা বুঝেন না? ভোট নিয়ে হাসিনার এত চিন্তা! যার জন্য তিনি শফি হুজুরের মত একজন নোংরা লোকের সাথেও আপোষ করতে প্রস্তুত। কিন্তু ভোট নিয়ে তিনি এত ভাবছেন কেন? যারা হৈ-চৈ, দাঙ্গা- হাঙ্গামা করে নিজেদের সংখ্যা জানান দেয় তাদের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। সংখ্যায় কম বলেই সবসময় কোনও না কোনও ঝামেলা সৃষ্টি করে রাস্তায় জড়ো হয়ে নিজেদের সংখ্যা ও ক্ষমতা দেখাতে চায় তারা। সংখ্যায় এই নগণ্য গোষ্ঠীর সন্ত্রাস আর লুটপাট করা ছাড়া তেমন কোনও ক্ষমতা নেই। যদিও তাদের সন্ত্রাসী ও লুটপাটের ক্ষমতার গুণেই আড়ালে চলে যায় আসল ক্ষমতাবান মানুষেরা, যারা বাঁচিয়ে রাখছেন দেশটাকে।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত করেছেন বলে গর্ব করে জানান। কাদের ক্ষমতায় বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ? বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান দুইটি খাতের প্রথম হল গার্মেন্টস শিল্প এবং দ্বিতীয় প্রবাসী শ্রমিক। যাদের ক্ষমতায় হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশ বানানোর স্বপ্ন দেখেন তাদের ক্ষমতা হাসিনার নজরে আসবে কবে? কবে থেকে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের ভোটের মায়া ভুলে আসল ক্ষমতাবানদের ভোটের জন্য হাসিনা রাজনীতি করবেন?

বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৭

দুর্বল বানিয়ে দুর্বলতা খোঁজা আর কতদিন চলবে?

১. বাচ্চাদেরকে পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা করানো নিয়ে মাঝেমাঝে পত্রিকায় নিউজ দেখি। মানুষ এতটা নির্মম হতে পারে বিশ্বাস হতো না। সেদিন ‘স্ল্যামডগ মিলিয়নিয়ার্স’ মুভিটা দেখছিলাম। মুভিতে সেলিম আর জামাল দুই ভাই সেরকমই একটি চক্রের ফাঁদে পড়ে যায়। তাদেরকে ভালো খাবারের লোভ দেখিয়ে এক জায়গায় আনা হয়। সেখানে তারা দেখে তাদের মত আরও অনেক শিশু। যারা ভাল গান গাইতে পারে তাদেরকে বড় শিল্পী বানানোর স্বপ্ন দেখানো হল। বাছাই পর্ব শুরু হল। খুব ভালো গাইতে পারে এমন একজন বাচ্চাকে একটি গান গেয়ে শোনাতে বলা হল। বাচ্চাটি খুব ভালো গাইল। তারপর তাকে চোখ বেধে অজ্ঞান করে পরে তার চোখ দুটি নষ্ট করে তাকে অন্ধ বানিয়ে দিলো। গান গাইতে পারে এমন অন্ধ ভিক্ষুক তাও আবার বাচ্চা, কামাই খুব ভালো হবে। সেলিম পুরো ব্যাপারটা দেখে ফেলে। এদিকে তার ভাই জামাল বড় শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। অপেক্ষা করছে কবে তার পালা আসবে। জামালের পালা এলে সেলিমকে পাঠানো হয় জামালকে ডেকে আনতে। পথে সেলিম জামালকে ইশারায় বুঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলে, সেলিম ইশারা করলেই যেন দৌঁড়ে পালায়। দু’ভাই পালিয়ে বাঁচে ওই ভয়ংকর চক্রের হাত থেকে। শিশুদের পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা ব্যবসা চালানোর বিরুদ্ধে আমরা সবাই।

পঙ্গু বানিয়ে শুধু কি ভিক্ষা ব্যবসা চলে? না। পঙ্গু বানিয়ে আরও অনেক কিছুই করা হয় যেগুলোকে আমরা অপরাধ মানি না, খারাপ কিছু বলেও মনে হয় না।

পাবলিক বাসে ড্রাইভারের পাশের কিছু সিট নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত। সংরক্ষিত সিট নিয়ে পুরুষের বাঁকা কথার শেষ নেই। কোনও পুরুষ যদি নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন দখল করে তবে তাকে শাস্তি বা জরিমানা গুণতে হবে। কিছুদিন আগে পরিবহণ সংক্রান্ত কিছু বিধি নিষেধে এমন আইন করা হয়। যার কারণে পুরানো তর্ক আবার ঘুরে ফিরে এলো। সমানাধিকারের কথা বলা হয়, অথচ সংরক্ষিত সিট বরাদ্ধ করে নারীরা অতিরিক্ত অধিকার ভোগ করছে! এ নিয়ে প্রায় বাসে পুরুষেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। এ আলোচনা যে কেবল বাসে হয় তা নয়। দৈনন্দিন জীবনে, পথে ঘাটে, ফেসবুকেও হয়। নারীদের জন্য সংরক্ষিত সিটের দরকার হয়। কারণ নারীরা দুর্বল এজন্য তারা দাঁড়িয়ে বাসে চড়তে পারে না, এছাড়াও আছে মহিলা সংক্রান্ত আরও নানান ঝামেলা। মহিলা সংক্রান্ত ঝামেলা গুলো কীরকম? এই যেমন ভিড়ের মধ্যে নারীর শরীর পুরুষের কাম জাগায়। পুরুষ বাধ্য হয়ে নারীদের গায়ে হাত দেয়। অধিকাংশ নারী নীরবে নিজেকে সরিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কোনও কোনও নারী আবার এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের প্রতিবাদ করে যা বাসের সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিনষ্টের কারণ হয়।

কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য নিয়মিত বাসে চলাচল করেন এমন একজন নারীর সাথে কথা হয়েছে। যিনি জানিয়েছেন তাদের দুর্ভোগের কথা। বাসে সিট খালি নেই, তবে দাঁড়ানোর জায়গা আছে, এরকম অবস্থায় নারীরা বাসে উঠতে গেলে গাড়ির হেল্পার জানায়, ‘মহিলা সিট নাই’। বাসের ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, ‘মহিলা তুলিস না’ কারণ মহিলা যাত্রী নিলে আবার যদি তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। ‘সিট লাগবে না, দাঁড়িয়ে যাব’ বলতে বলতে কর্মজীবী নারীরা ভিড় ঠেলে বাসে চড়েন। জানান, ভিড় বাসে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শগুলোর কথা। লজ্জায় প্রতিবাদ করতে পারেন না। যদি বলেন ‘লোকটা অসভ্যতা করছে’ তাহলে জানতে চাওয়া হয় ‘কী ধরণের অসভ্যতা তিনি করছেন?’ অসভ্যটিকে লাথি দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দিতে অসভ্যতার ধরণ জানতে হবে। কারণ পুরো বাসটিই যে ছোটবড় নানান জাতের অসভ্যতে ভরপুর।

কর্মস্থলেও নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অফিস শেষে ভিড় বাসের দুর্ভোগ পোহানোর পর বাড়ি ফিরে রান্না করে স্বামী বাচ্চাদের খাইয়ে, চাকরি ও সংসার সামলে দিন শেষে প্রমাণিত হয় নারী দুর্বল। এটা মেনে নিয়েই তারা ঘুমাতে যায়। আবার ভোর হলেই স্বামী বাচ্চাকে খাইয়ে, অফিস-স্কুলের জন্য প্রস্তুত করে নিজেকে দুর্বল প্রমাণের লড়ায়ে নেমে যায় তারা।

২. মেয়ে মানুষ একা বাইরে যাওয়া ঠিক না।

কেন ঠিক না?

মেয়ে মানুষ বলে।

আমার কাছে সবচেয়ে অপমানজনক মনে হতো যখন, সন্ধ্যার পর বের হতে হলে ছোট ভাই বা কোনও পুরুষকে সাথে নিয়ে বের হতে বলা হতো। যেন আমি একটা যৌনবস্তু, মাংসের দলা ছাড়া আর কিছু না।

হয়তো কোনও ওষুধ আনতে যেতে হবে। বলা হল দারোয়ান চাচাকে সাথে নিয়ে যাবে। সোজা বলে দিতাম, ‘তাহলে দারোয়ান চাচাকেই বলো, আমাকে বলছ কেন?’ জানি আমার নিরাপত্তার জন্যই বাবা-মা এসব বলতেন। মেয়েদের কাছে এটা স্বাভাবিক কারণ ‘তুমি দূর্বল’ ‘তুমি দুর্বল’ শুনতে শুনতে ওরা মেনেই নিয়েছে ওরা দুর্বল, অসহায়। কিন্তু অন্য মেয়েদের মত আমি এটিকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারি নি। তাই কাউকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনলেই প্রচণ্ড রেগে যেতাম।

নারীদের সংরক্ষিত আসনের দরকার হয়, চলাফেরার জন্য পুরুষ সঙ্গীর দরকার হয়, অপরাধের ভুক্তভোগী হওয়ার কারণে লজ্জিত হতে হয়। সুযোগ দেয়া হবে না কিন্তু বলা হবে, পারে না। পুরুষের উপর নির্ভরশীল বানিয়ে রেখে বলা হবে, পুরুষ ছাড়া চলতে পারে না। এটা অনেকটা শিশুদেরকে পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা ব্যবসা চালানোর মত নারীদেরকে পঙ্গু বানিয়ে ‘পুরুষতন্ত্র’ চালানো নয় কি?

যদিও একটি আমাদের কাছে নির্মম অন্যটি স্বাভাবিক। মুভিতে সেলিম ও জামাল পালিয়ে নিজেদেরকে পঙ্গু হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। নারীদের মধ্যে যারা পঙ্গুত্ব বরণ করে নি, সচেতন হয়েছে, তারা অন্যদেরকে সচেতন করার চেষ্টা করে। এজন্য আমার মতো কেউ কেউ অনলাইনে লেখালেখির পথ বেছে নিয়েছে। নারীবাদ নিয়ে লিখি বলে Abidur Rahman Maya নামে একজন বললেন, ‘লিঙ্গ নিয়ে এত নাড়াচাড়া করা কি ঠিক?’ উত্তরে বললাম, ‘আমার লিঙ্গ তো নড়াচড়া করে না, ফিক্সড। আপনাদের লিঙ্গের এত নড়াচড়া দেখে বলি। এত নড়াচড়া করলে কেউ যদি লিঙ্গে বাইড়াইয়া আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর অবস্থা না রাখে, তাইলে তো আপনাদেরই বিপদ। আপনাদের ভালোর জন্যই বলি’। আমার উত্তরটি অনেকের কাছে খুব অশ্লীল মনে হতে পারে। কারণ অন্যায়টা সমাজে স্বাভাবিক হয়ে গেছে প্রতিবাদটা বরং অস্বাভাবিক, যা অনেকের কাছে বাড়াবাড়িও মনে হয়।

সেদিন Taibur Rahaman নামে একজন আমার একটি লেখায় মন্তব্য করল, ‘এ কেমন দুনিয়া এসে গেল। দাদী নানীর পোশাক ছেড়ে সব শর্ট পোশাক পরলে ইভটিজিং ধর্ষণ হবে না কেন? এ যেন বাঘের সামনে মাংস রেখে মানবতার কথা বলা হা হা হা আজব দুনিয়া’। ধর্ষণ করাটাকে উনি সম্ভবত ওনার মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছেন। উত্তর দিলাম, ‘নিজেকে বাঘ আর মেয়েদেরকে মাংসের দলা মনে করা প্রজাতির স্থান জঙ্গলে। যদিও জঙ্গলের পশুরা তাকে মেনে নিলে আরকি! মেনে না নিলে তাদের জন্য রয়েছে চিড়িয়াখানা, রয়েছে খাঁচা।’

‘সেক্স চ্যাট করতে পারেন?’ এর উত্তরে, ‘না ভাই, আমি খালি বিচি ছ্যাঁচতে পারি। লাগবে ছ্যাঁচা?’ গুণীজনেরা বলেন, এ ধরণের মন্তব্যকারীদের সাথে তর্কে যেও না। কুকুর তোমাকে কামড় দিলে তুমিও কি কুকুরকে কামড়াতে যাবে?’ আমার কাছে আসলে এধরণের মন্তব্যগুলোর উত্তর দেয়া জরুরী মনে হয়। আমি প্রতিবাদী হতে প্রেরণা জাগানো বিশাল লেখা লিখে ফেললাম। আমার লেখা অনুযায়ী কেউ চলতে গেলে তাকে ঠিক এ ধরণেরই মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হবে যা আমার লেখার মন্তব্যে আমি পেয়ে থাকি। আরেকজনকে প্রতিবাদী হতে বলে একই ধরণের মন্তব্যের মুখোমুখি করলাম, অথচ আমি নিজে সেসব এড়িয়ে গেলাম। এটা অনেকটা নিজেকে বাঁচিয়ে অন্যকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার মত। আমি এই থিউরিতে বিশ্বাসী নই। আমার মতে, প্রতিবাদ করতে সাহস জোগাতে বড় বড় লেখার চেয়ে একজনকে প্রতিবাদ করতে দেখলেই বরং অনেকটা সাহস সৃষ্টি হয়ে যায় যা ওই লেখায় হয় না। ইদানীং আমার উত্তর পেয়ে কেউ কেউ নিজেদের কমেন্টটাই ডিলিট করে দেয়, কেউ আবার ক্ষমা চায় বাজে মন্তব্যের জন্য। আমি এড়িয়ে গেলে অনেক মেয়েরা নিজেরা সেসবের উত্তর দেয়। পাল্টা আঘাত না এলে ওদের হুশ ফিরবে না, দুর্বল বানিয়ে দুর্বল প্রমাণের এসব প্রথা চলতেই থাকবে। আর পাল্টা আঘাতের শুরুটা বোধ হয় এভাবেই হয়।