শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৪

সমাজের সব উদারতা কি কেবল পুরুষদের জন্য?


আমার লেখাটির শুরুতেই তসলিমা নাসরিনের নির্বাচিত কলামের একটি কলাম উল্লেখ করছি-

প্রোসটেট নামে পুরুষের শরীরে একপ্রকার গ্ল্যান্ড থাকে পঞ্চাশের অধিক বয়স বিশেষত ষাট সত্তর বছর বয়সে পুরুষের প্রোসটেট গ্ল্যান্ড আকারে বড় হয় প্রোসটেট গ্ল্যান্ড, দুটো হরমোনের গতিবিধি পরিচালনা করে একটি এন্ড্রোজেন, অপরটি এস্ট্রোজেন বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে এন্ড্রোজেন হরমোন ক্রমশ কমে আসে কিন্তু এস্ট্রোজেন একই অনুপাতে কমে না এস্ট্রোজেন হরমোনের আধিক্যে প্রোসটেট গ্ল্যান্ড বড় হয়ে যায়, মোদ্দা কথা এন্ড্রোজেন এবং এস্ট্রোজেন হরমোন দুটোর পরিমাণগত অসামঞ্জস্যই প্রোসটেট বড় হওয়ার মূল কারণ

এই রোগের প্রধান উপসর্গ ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ, প্রথমে রাতে, এরপর রাত এবং দিন উভয় সময়ে পুনঃ পুনঃ এবং দুতিন ফোঁটা প্রস্রাবের অস্বস্তি, তার উপর প্রস্রাব করার সময় বিষম জ্বালাপোড়াও অনুভূত হয় নিজ ইচ্ছায় প্রস্রাবের আরম্ভ, গতি ও সমাপ্তি ঘটানো সম্ভব হয় না ধীরে ধীরে কিডনি আক্রান্ত হলে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় প্রস্রাব শুরু ও শেষ হওয়ার সময় কিছু রক্ত যাওয়াও এসময় বিচিত্র কিছু নয় প্রোসটেট বড় হওয়ার প্রথম দিকে পুরুষের যৌন উত্তেজনা হঠাৎ বৃদ্ধি পায় যদিও শেষদিকে পুরুষত্বহীনতাই স্থায়ী হয়

মজার ব্যপার হচ্ছে, বুড়ো কুকুরের মধ্যেও প্রোসটেট বড় হওয়ার লক্ষন খুব দেখা দেয় প্রোসটেট উপরের দিকে ঠেলে বড় হওয়ার কারণে কুকুরের মলনালী সঙ্কুচিত হয় এর ফলে মলনালী সারাক্ষণ ভরা ভরা ঠেকে এবং মলত্যাগের যে চেষ্টা বুড়ো কুকুরেরা করে যায় তা অর্থহীন এবং যন্ত্রণাদায়ক প্রোসটেটের পরিবর্ধন এবং প্রতিকার আমার বিষয় নয় আমার বিষয় প্রোসটেট হঠাৎ রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণে ষাট-সত্তর বয়সের সেইসব বুড়ো পুরুষ, যারা কামোদ্দীপনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠে অনেকে এই বিয়েকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য নানারকম যুক্তি তৈরি করেন যেমন বুড়ো বয়সে যত্ন করবার কেও নেই অথবা আমাদের রসুলুল্লাহ নবী, দৃষ্টান্ত দিয়ে গেছেন-ইত্যাদি শারীরিক অসুস্থতার কারণে সাময়িক যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, তাই তারা কোনও বয়স্ক মহিলা নয়, কিশোরী থেকে যুবতী পর্যন্ত মেয়েদের বিয়ে করবার আগ্রহ প্রকাশ করে

পৃথিবীর যত বুড়ো রোগী এই অবস্থায় বিয়ে করে, সাময়িক কামোত্তেজনা নির্বাপিত হলেই তারা পুরুষত্বহীনতায় ভোগে তখন সেইসব বালিকা, কিশোরী এবং যুবতীর জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে আসে তা এমন কেউ নেই যে না জানে এমন কে আছে যে জানে না একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে সচ্ছলতার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়, শেষ অবধি সেই মেয়ে জীবনের দায়ভার অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে কেবল দুটো ভাত-কাপড়ের জন্য কি নির্মম ভাবে বেঁচে থাকে!

(নির্বাচিত কলাম--তসলিমা নাসরিন, পৃষ্ঠাঃ ২৬-২৭)
-------------------------------------------

রেলমন্ত্রীর বিয়ে করার মূল কারনটা সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে আশা করি
অনেকে বলছেন, 'রেল মন্ত্রীর ইচ্ছা হয়েছে বিয়ে করার, করছে, উনি তো কাউরে কামড়াইতে যায় নায়, আপনাদের সমস্যা কোথায়?' আমি ও মানি যে মন্ত্রীর ইচ্ছা হয়েছে উনি বিয়ে করতেই পারেন, তার স্বাধীনতা আছে বিয়ে করার বর্তমানে রেলমন্ত্রীর বিয়ের ঘটনায় মন্ত্রী কিছুটা সমালোচিত হয়েছেন বটে, কিন্তু তাকে বিয়েতে কেউ বাঁধা দিতে যাচ্ছে না কোন মূর্খের দল 'নষ্ট পুরুষ' বা 'সমাজে বিশৃঙ্খলাকারী পুরুষ' উপাধি দিয়ে শ্লোগান দিয়ে তার বিরুদ্ধে মিছিল করতে যাচ্ছে না, তাই ভোট হারানোর ভয় না থাকায় সরকার ও তাকে শুভেচ্ছা জানাতে যাচ্ছে

কিন্তু ভাবুন তো ৬৭ বছরের রেলমন্ত্রী যদি একজন নারী হত, ২৮ বছরের একজন যুবককে বিয়ে করত, এখন রেলমন্ত্রীর জন্য যে উদার সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, নারী মন্ত্রীর ক্ষেত্রে এই অতি উদার-ব্যাক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সমাজ (?) সেটা মেনে নিত?

কখনই না আমার সমস্যা হল ঠিক এইখানে কোন নারী, সে কুমারী হোক আর যাই হোক ৬৭ বছর বয়সে বিয়ের কথা ভবাতেই পারতো না, কারন সে বিয়ের কথা তুললেই সমাজে তার আর মুখ দেখানোর অবস্থা থাকবে না, তাকে নষ্ট- বেশ্যা- খাঙ্কি- মাগী বুড়ি এইসব উপাধি দেয়া হত শুধু সমাজই নয়, এখন যে মন্ত্রীসভার লোকেরা গিয়ে রেলমন্ত্রী কে শুভেচ্ছা, অভিবাদন জানিয়ে এলো, সেই মন্ত্রী সভাই হইত, নারী মন্ত্রীর ক্ষেত্রে তাকে মন্ত্রীসভা থেকে বাতিল করতো, সমাজের মূর্খদের দাবী রক্ষার্থে

আমাদের সমাজের সব উদারতা, ব্যাক্তি স্বাধীনতা কেবল পুরুষদের জন্য, অথচ এই সমাজের কারিগর হল নারী নারীর তৈরি সমাজে নারীকে পুরুষেরা নিজেদের হাতে বন্দী করে রেখে, নিজেরা ভোগ করছে সব ধরনের স্বাধীনতা!!! সমাজে যারা নারীবিরধী কাজগুলো করে তারা ভুলে যায় যে, তারাও একজন নারীর গর্ভ থেকে সৃষ্ট নারী বিরোধী পুরুষ গুলোকে তাই নিমক হারামের জাত বলতে আমার একটু ও আপত্তি হয় না

রেলমন্ত্রী'কে সমালোচনা করে আমি কিছুই বলছি না... কিন্তু একজন নারী যদি এইরকম করে.. তাহলে সমাজ সেটাকে কিভাবে নেয় সেটা বোঝানোর জন্যই আমি লিখেছি মানে সোজা কথায় সমাজে নারী'র অবস্থা বোঝানোনোর জন্য আমি লিখেছি, রেলমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনা করা কোন ভাবেই আমার  লেখার উদ্দেশ্য নয় রেলমন্ত্রী তো তাও তুলনামূলক ভাবে অনেক ভালো মানুষ চিরকুমার থেকে রাজনীতি করে গেছেন, তার বিরুদ্ধে তেমন দুর্নীতির অভিযোগ ও শুনি নি কিন্তু সাবেক প্রেসিডেন্টে এরশাদের কথা যদি বলি? এরশাদের এত কাণ্ডের পরও সে বাংলাদেশের একজন জনপ্রতিনিধি, সে কেবল একজন পুরুষ বলেই সম্ভব

নির্বাচিত কলামের ওই লেখাটুকু তসলিমা নাসরিন ১৯৮৬ সালের দিকে লিখেছিলেন, কিন্তু কি দারুন মিলে যায় আমাদের সমাজে এরশাদের মত লোকেদের জীবনের সাথে তসলিমার কথা গুলো বাস্তব সত্য বলেই তাকে সইতে পারে না পুরুষগুলো কারন তাদের ভালো মানুষের মুখোশ টেনে ছিড়ে ফেলার জন্য তসলিমা একাই যথেষ্ট তাই তো ওরা ভয় পায় তসলিমার কলম'কে। তাকে দেশে ফিরতে দেয় না নিজেদের ভণ্ডামি ধরা পরার ভয়ে








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন