রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৪

আমার আমি এবং তসলিমা নাসরিন‘কে নিয়ে আমার অদ্ভুত কিছু অনুভূতি..


আমার জন্মের আগে আমাকে নিয়ে পরিবারে জল্পনা কল্পনা চলছিল, বংশের প্রথম সন্তান। ছেলে হবে নাকি মেয়ে। বাবা কাকাদের ইচ্ছা, মেয়ে হোক। মায়ের ইচ্ছা ছেলে। যাই হোক, হলাম মেয়ে। তাই বাবা আমাকে যেভাবে দেখতে পছন্দ করতেন সেইরকম পোশাক পড়িয়ে আনন্দ পেতেন। আর মা মায়ের পছন্দ মত জিন্স টিশার্ট পড়িয়ে আনন্দ পেতেন। যেহেতু প্রথম সন্তান, তাই আদর যত্নের শেষ নেই। যখন যা চাইতাম, তাই পেয়ে যেতাম। প্রচণ্ড জেদী ছিলাম। আমার কথায় সবাই জি হুজুর, জি হুজুর করতো।

আমার জীবনের আটটি বছর আমার মায়ের চাকরির কারনে মামার বাড়ি কাটিয়েছি। গ্রামের গাছে গাছে বানরের মত লাফালাফি করার জন্য বিখ্যাত ছিলাম। ক্রিকেট খেলতাম, খালি গায়ে কাঁদা মাখামাখি করে হৈ হুল্লোড় করতাম সবার সাথে।

ধীরে ধীরে বড় হচ্ছি আমি। আমার নিজের ইচ্ছা, নিজের স্বাধীনতা জন্ম নিচ্ছে মনের মধ্যে। পোশাকের ক্ষেত্রে বাবা মায়ের পছন্দ আমার কাছে প্রধান্য পাচ্ছে না। প্রাধান্য পাচ্ছে আমার ইচ্ছা,আমার সুবিধা। যেহেতু টি শার্ট জিন্স পড়তে অভ্যস্ত ছিলাম, তাই আমি বুঝতাম এই পোশাকের সুবিধা। আমি এই পোশাকেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। সাথে সাথে বাঁধা পাচ্ছি সমাজের মানুষ গুলোর কাছ থেকে।
বাবা বলে, তোমার ওই আঙ্কেল কি বলেছে দেখেছ? তুমি এখন বড় হচ্ছ, এই পোশাক আর পড়বে না। তোমার জন্য সুন্দর সুন্দর জামা কিনে দিবো, টিশার্ট জিন্স এইসব না। আগেই বলেছি জেদী ছিলাম। আমি মানতাম না। আস্তে আস্তে আমার খেলাধুলায় বাঁধা সৃষ্টি হল।

মা'র চাকরি বদলি করিয়ে চিটাগাং শহরে এলাম। আমরা যেই বিল্ডিং এ থাকতাম তার নিচে একটু খানি খোলা জায়গা ছিল, সেখানে পাশের বাসার ছেলেদের সাথে খেলতাম। লোকে বলতে লাগলো ওই বাসার মেয়েটা ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলে, ছেলেদের মত ড্রেস পড়ে এইসব।
স্কুলের ফ্রেন্ডরা দেখি আমার মত না, খালি ভয় পায়, এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না। আমি বলি একবার করেই দেখ না। স্কুলের টিচাররা বলতো, মেয়েরা এমন দুষ্ট হতে আগে দেখি নি (এখন কলেজের স্যাররা বলে, তাদের কলেজে এমন অনেক কাজ কখনও কোন মেয়ে করেনি এমন সব কাজ আমি ইতিমধ্যে করে ফেলেছি)। আমার মধ্যে একটা ভাব ছিল, '' আমার কিছু যায় আসে না'' টাইপ।

আস্তে আস্তে সবাই একসাথে বলা শুরু করল, এইবার অন্তত তোমার পোশাক বদলাও। আমি বলি, বদলানোর প্রয়োজন দেখি না। আমার যেমন খুশি তেমন থাকবো, তোমাদের প্রবলেমটা কোথায়?? ধর্মের কুসংস্কার আমাকে দমিয়ে রাখতো বলে, ধর্মমুক্ত হয়েছিলাম তখন থেকেই।

কে যেন একবার বাবাকে বলল, আপনার মেয়ে তো দেখি তসলিমা নাসরিন হয়ে যাচ্ছে। তখন আমি ক্লাস ৫ এ পড়ি। ভাবলাম, তসলিমা নাসরিনটা কে? বাবার বুক সেল্ফ ঘাটতে ঘাটতে কিছু বই দেখলাম, বই গুলোর লেখকতসলিমা নাসরিন লজ্জা বইটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। লজ্জা পড়ে মূলভাব বুঝলেও কিছু শব্দ তখন বুঝে উঠতে পারি নি। যেমন পেনিস শব্দটি দেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা পেনিস মানে কি?? বাবা বললেন, এই বই পড়ার বয়স নাকি আমার হয়নি, বড় হলে জানতে পারব।। তারপর কিছুদিন কেটে গেল, আমি নিজের মত করে আমার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম। আর চারপাশের মানুষ গুলোর আচরণ দেখে অবাক হচ্ছিলাম।

তারপর আবার আরেকদিন আরেকটা বই নিয়ে বসলাম তসলিমা নাসরিনের। বই এর নাম ''নিমন্ত্রন'' নিমন্ত্রন পড়ে তো আমি হতবাক!!! মেয়েরা সুদর্শন ছেলে দেখে প্রেমে পড়ে এবং সেই ছেলের দ্বারা প্রতারিত হয়ে তার বন্ধু-বান্ধবদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। আমি সচেতন হয়ে গেলাম তখনই। এরপর একের পর এক তসলিমা নাসরিন এর আরও কিছু বই যেমন: শোধ, অপরপক্ষ, নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য, যাবো না কেন? যাবো, নির্বাচিত নারী, নির্বাচিত কলাম নামক বইগুলো পড়ে শেষ করলাম। বাবার বুক সেল্ফে যা বই থাকতো, সমরেশ মজুমদার, হুমায়ূন আজাদ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, প্রবির ঘোষ, আরজ আলী মাতুব্বর, জাফর ইকবাল........... সব লেখকের বই পড়ে ফেলতাম। বাবাকে বলি তসলিমা নাসরিনের বই কিনে দিতে। বাবা বলেন, তসলিমা নাসরিনের বই এখানে তেমন পাওয়া যায় না। এতদিন তসলিমা নাসরিনের তেমন কোন ছবি দেখি নি। একটা বইয়ের পিছনে দেখেছিলাম,ছোট ছবি। কিন্তু 'আমি ভালো নেই তুমি ভালো থেকো প্রিয় দেশ' বইটাতে প্রথম তসলিমা নাসরিনের বড়-স্পষ্ট একটি ছবি দেখলাম। ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। ছবি দেখে আমার বেশ পছন্দ হল, ভাবলাম আমি যদি উনার মত হতে পারতাম!!!

তারপর আস্তে আস্তে ক্লাস-এইট এ উঠলাম। এর মধ্যে আমি আমার বাবার বুক সেল্ফের বইগুলো ৪ থেকে ৫ বার রিভিশানও দিয়ে দিয়েছি, তসলিমা নাসরিনের বই গুলোও। যতই পড়ি, আরও ভালভাবে বুঝি। বন্ধুদের পাল্লায় পরে হুমায়ুন আহমেদ এর বইয়ের নেশায় পেলো। স্কুলের বন্ধুরা জানে আমি গল্প বইয়ের পাগল। কারো গল্প বই লাগলে আমার কাছে আসতো। আমি তাদেরকে তসলিমা নাসরিনের বই দিতাম। তারা বলে গল্পের বই দে, গল্প। মজার মজার গল্প। কি আর করার, তখন আবার হুমায়ুন আহম্মদ, গোয়েন্দা বই দিতাম তাদের।
এর মধ্যে আমার এক বন্ধু আর আমি দুইজনে মিলে একটা ফেইসবুক আইডি চালাতাম। কিন্তু আস্তে আস্তে ওর পছন্দ আমার ভাল লাগছিলো না। আমার একটা নিজের ফেইসবুক আইডি খুলি। নিয়মিত বসি না ফেবুতে। দুই তিন মাস পরে হটাত মনে পরতো যে আমারও একটা ফেবু আইডি আছে।

ক্লাস-৯ এ আস্তে আস্তে ফেবু কি বুঝে উঠতে শুরু করলাম। ইন্টারনেট নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। আমার প্রিয় মানুষ, তসলিমা নাসরিনকে খুঁজতে শুরু করলাম। এর মধ্যে রেজাল্টে বাবার আশা পূর্ণ না হওয়ায় বাবা নেট কেটে দিলো, ক্লাস টেনের মাঝামাঝি সময়ে আবার নেট কানেকশান লাগালে, আমি আস্তে আস্তে অনলাইন জগত নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। তসলিমা নাসরিনের যা কথাবার্তা ভিডিও পেতাম সব লোড করে নিতাম। এরই মাঝে mean sazu নামে একটা আইডি পেলাম যার আইডিতে, তার মুল কভার পিকচারে, তার স্ট্যাটাসে এবং তার ছবির এ্যালবামে তসলিমা নাসরিন এর অনেক ছবি। বুঝলাম সেও তসলিমা ভক্ত। সাজুর কাছে জানতে পারি, তসলিমা নাসরিন টুইটারে twitter একটিভ, আমিও একটি টুইটার আইডি খুলি। সাজুকে তসলিমা নাসরিন চিনতেন, তার কথায় তনা আমাকে টুইটারে ফলো দিলেন। আমার আনন্দ আর দেখে কে! তখনও আমি নিজে কোনও লেখালেখি করিনি।

আমার বন্ধুরা সারাদিন অনলাইনে আড্ডা, ফাইজলামি করতো। কিন্তু ওদের ওইরকম মজা গুলো আমার ভালো লাগতো না। নারীবাদী একটা পেইজে আমাকে এডমিন বানিয়ে দিলো একজন। আমি সেখানে লিখতাম। আমার বন্ধুরা কেউ জানতো না সেসব। আমার নারীবাদ আর ওই ব্যাক্তির নারীবাদে অনেক পার্থক্য ছিল। তাই ওই পেইজ থেকে আমি সরে আসি।

এরপর আমি নিজের আইডি থেকেই লেখালেখি শুরু করি। এরপর তসলিমা পক্ষ পেইজ খুলি। (আমদের পেইজ মেম্বার এখন দশ হাজারেরও উপরে ছাড়িয়ে যায় অল্পদিনেই)। টুইটারে তসলিমা নাসরিনের সাথে একটা দুইটা কথা বলতে পারি। আমার সীমাহীন আনন্দ, তসলিমা নাসরিনের সাথে কথা বলছি!! আমার স্বপ্নের মানুষটি, যাকে আমি এত এত ভালোবাসি। অন্যরকম এক অনুভূতি।

আমার লেখালিখির এক পর্যায়ে  Etu's Voice নামে একটি পেইজ খুলি। তসলিমা পক্ষের পাশাপাশি ইতুস ভয়েজ পেইজে চলছে আমার ব্যাক্তিগত চিন্তাভাবনার জগতের লেখালিখি। আমার যা কিছু ভালো লাগা, আমি মেয়ে বলে যা সব বাঁধা পাই সমাজ ও পরিবার থেকে সেসব নিয়ে লিখতে থাকি, অনেক বাঁধা আমি ছোটবেলা থেকে জেনে না জেনে যুদ্ধ করে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, আমার বাবা মাকে আমার সমর্থনে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আমার আশেপাশে মেয়েরা তা পারে নি, তাদের জন্য লিখি।

আর তসলিমা পক্ষে কাজ করতে করতে বুঝে উঠতে থাকি তসলিমাকে। আসতে আসতে আবিস্কার করতে থাকি একটি মানুষ সারাটি জীবন কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছেন সমাজ সংস্কারের জন্য, দেখি আমাদের সমাজের মানুষ গুলো কত নোংরা। মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে, একটা মানুষ যে কারো কোন ক্ষতি করতে যায় না, কারো সাতে ও নেই পাঁচে ও নেই এমন একটা মানুষকে নিয়ে কতরকমের অপপ্রচার হতে পারে, মানুষের প্রশংসার পাশাপাশি চারপাশ থেকে ভেসে আসে বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ শব্দ। বাংলা অভিধানে কতপ্রকার গালি আছে, প্রগতিশীল মানুষ কত প্রকার ও কি কি........ এইসব দেখছি, শিখছি........

Etu's Voice কে যারা ভয় পাচ্ছে, তারা আমাকে নিয়ে কুৎসা রটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু আমার কিছু যায় আসে না, আমি তসলিমা নাসরিনের 'চরিত্র' 'ও মেয়ে শুনো' কবিতাগুলো বারবার নিজেকে নিজে বলি। মাঝে মাঝে আমার লেখা গুলোতে তসলিমা নাসরিনের লাইক পাই। মাঝে মাঝে টুইটারে, ফেবুতে একটি দুইটি পোস্ট শেয়ার করেন। বুঝি যে উনি পড়েছেন। ভালো লাগে খুব। কালকে দুঃখে একটি স্ট্যাটাস লিখলাম, তসলিমা নাসরিন কে নিয়ে অপ্প্রচারের বিরুদ্ধে। লেখাটির শিরোনাম ছিল- 'তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি বিবেকবান বোধবুদ্ধি সম্পন্ন সচেতন মানুষদের প্রতি'মেয়েরা নাকি তসলিমা বিরোধী, সেটা নিয়ে লিখি, অনেকে প্রশ্ন করে তসলিমা পক্ষের কাজ কি, সেটা নিয়ে লিখি। সবাই ঈদ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারনে আমার লেখাটি অনেকেরই নজরে পরে নি।

গতকাল রাত ২ টা বা তার বেশি। আমার মাথা ব্যাথা করছিলো প্রচণ্ড, ঘুমাতে পারছিলাম না। কি মনে করে যেন বালিশের পাশে থাকা মোবাইলটা নিলাম, ফেবুতে লগইন করলাম। দেখলাম তসলিমা নাসরিন, আমার লেখাটি শেয়ার করলেন। ভালো লাগলো। তখন খেয়াল করি নি, উনি কি লিখেছেন আমার সম্পর্কে।

তারপর হটাত খেয়াল করলাম উনি লিখছেন, '' ইতু, তুমি এত ছোট্ট একটা মেয়ে! মাত্র সতেরো বছরে পা দিয়েছো কী দাওনি। কিন্তু এত ভালো লেখ, এত ভালো বোঝো। মাঝে মাঝে সত্যি অবাক হই। অনেক বড় হবে, দেখে নিও।''



বারবার পড়লাম লেখাটি। মাথা ব্যাথাটা হাওয়া হয়ে গেলও। এত খুশি লাগলো যে, সকাল হতেই মাকে বললাম। দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছি বলে মা বকাবকি করছিলো তসলিমা নাসরিন কি বলেছেন সেটা মা কে বলাতে, মা একটু খানি হাসি দিয়ে চলে গেলেন রান্না ঘরে। আর আমি আনন্দে কি করব বুঝতে না পেরে, দাঁত ব্রাশ করতে গেলাম। আর ভাবতে লাগলাম, খুশি , আনন্দ ,মানে যদি ঈদ- পূজা- বড়দিন- পূর্ণিমা হয়, তবে আজকে আমার ঈদ- আজকে আমার পূজা- আজকে আমার বড়দিন- আজকে আমার পূর্ণিমা।

২টি মন্তব্য:

  1. আমারো সেই একই কথা যা তসলিমা নাসরিন বলেছেন, ইতু, তুমি এত ছোট্ট একটা মেয়ে! মাত্র সতেরো বছরে পা দিয়েছো কী দাওনি। কিন্তু এত ভালো লেখ, এত ভালো বোঝো। মাঝে মাঝে সত্যি অবাক হই। অনেক বড় হবে, দেখে নিও।

    উত্তরমুছুন
  2. এগিয়ে যান, পরিবর্তন একদিন হবেই।

    উত্তরমুছুন