বুধবার, ৮ জুলাই, ২০১৫

হৈমন্তীদের কথা

ক্লাসে স্যার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করছে, কে করেছে এই কাজ? কার এতো সাহস, বলো?
সারা ক্লাস চুপ। লাস্ট বেঞ্চে বসা মেয়ে চারটি ফিসফিস করে কি যেন বলার চেষ্টা করছে।
লরেন বলল, দেখ ভাই, আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম, আমি তোদের সাথে নেই, তোরা জোর করেছিস বলে বাধ্য হয়ে ছিলাম

মুনঃ বাহ, এখন তো অনেক কিছুই বলবে, তোমার মত স্বার্থপরদের আগেই চেনা উচিত ছিল
আফি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, আমার মা বাবার কাছে কমপ্লেইন দিলে কি করব?
মুনঃ কি আর করবে? ওই লরেনের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে দুজনে মিলে আমাদের দোষ দিয়ে নিজেরা বেঁচে যাবে, এই আরকি!

হৈমন্তী এতক্ষন চুপ ছিল। হটাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আমি করেছি

সবাই তার দিকে তাকিয়ে। মুন তাকে টেনে বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সে আবারো জোর গলায় বলল, স্যার সব কিছু আমার প্ল্যান ছিল স্যার এক মুহুর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন, তারপর মেয়েটিকে সামনে এনে উত্তম মধ্যম দিয়ে ক্লাস থেকে বের করে দিলেন।

কোচিং ছুটির পর, মুন-হৈমন্তী রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিল। মুন বলল, তুই একা তো কিছুই করিস নি, সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিলি কেন?

হৈমন্তীঃ এছাড়া আর কি করতাম? সবাই নিজে কিভাবে বাঁচবে সেই চিন্তা করছিল। দেখে মেজাজটাই গরম হয়ে গিয়েছিল শালা ঠিক যেমন, খালেদা দেয় হাসিনার দোষ, হাসিনা বলে খালেদা দোষী, এই করতে করতে দেশ গেলো জাহান্নামে।

মুনঃ খালেদা হাসিনার গুষ্টি কিলাই, তুই শুধু শুধু কিছু মার খেলি।

মার খেলে কেউ মরে যায় না, আমি প্রফেশনাল মার খাদক আচ্ছা যাই, কাল তাড়াতাড়ি স্কুলে যাবি, অফিস রুমে কাজ আছে বলল, হৈমন্তী। মুন জানে হৈমন্তীর অফিস রুমে কি কাজ! মুন হৈমন্তী একই স্কুলে পড়ে, মিশনারি স্কুল। হৈমন্তী স্কুলের বেতন ঠিক সময়ে দিতে পারে না বলে প্রায় প্রতি মাসে একবার করে তার ডাক পড়ে অফিস রুমে বসে থাকা সিস্টার জেসিকা হৈমন্তীকে বকাঝকা করেন মাঝে মাঝে চড় থাপ্পড় দিতেও ভুলেন না হৈমন্তীর অপরাধ, তার বাবা মা ঠিক সময়ে স্কুলের বেতন দিতে পারে না

ব্যাপারটা ছোট্ট হৈমন্তীকে খুব কষ্ট দিলেও বন্ধুদের সামনে সেটা সে প্রকাশ করে না কারন বন্ধুরা যদি আবার তার প্রতি সহমর্মিতা দেখায় সেটাও তার ভালো লাগবে না

বাংলাদেশ হচ্ছে সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি এদেশে যদি কেউ দুবেলা পেট পুরে খায় তবে বুঝতে হবে, সে অন্য কারো ভাগের খাবার খেয়ে নিচ্ছে, তার জন্য কাউকে একবেলা না খেয়ে থাকতে হবে তাই এইদেশে দারিদ্রতা লজ্জার কিছু হতে পারে না হৈমন্তী বুঝে সেসব কিন্তু তার চারপাশের মানুষগুলোর আচার আচরণ দেখে মনে হয়, দারিদ্রতা বুঝি ভয়াবহ কোন অপরাধ!

পরদিন স্কুলে হৈমন্তী তার আর তার ছোটবোনের স্কুলের বেতন নিয়ে এলো টিফিন ছুটিতে অফিস রুমে বেতন দিবে টিফিন ছুটিতে ব্যাগ ঘেঁটে দেখে তার টাকাগুলো নেই এবার কি হবে? মুনকে ডেকে আনে সে দুই বন্ধু মিলে অনেক খুঁজেও টাকাগুলো পেল না মা বারবার করে বলেছিল, টাকাগুলো যেন কোন ভাবে না হারায় সামনে পরীক্ষা, পরীক্ষার ফি না দিলে যে পরীক্ষায় বসতে দিবে না মাকে সে কিভাবে বলবে টাকা হারানোর কথা তার এখন কি করা উচিত! কিছুই বুঝতে পারে না সে

বাসায় ফিরে টাকা হারানোর কথা মাকে বললে, মা খুব মারল তাকে কিন্তু তার কি দোষ, সে কি ইচ্ছা করে হারিয়েছে নাকি!

কয়েকদিন পর পরীক্ষা, সবাই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, হৈমন্তী সারা বছর পড়ার বইয়ের চেয়ে গল্পবই পড়েছে বেশি, তাই পরীক্ষার এই কদিন তার খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে

প্রথম পরীক্ষা অংক ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে হলে ঢুকেছে হৈমন্তী হলে স্যার সবার এডমিড কার্ড চেক করছে যারা বেতন দিয়েছে তাদের সবাইকে এডমিড কার্ড দেয়া হয়েছে। হৈমন্তী এডমিড কার্ড পায় নি, যেহেতু সে বেতন দেয় নি যাদের কাছে এডমিড কার্ড নেই তাদেরকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। অফিস রুম থেকে এডমিড কার্ড নিয়ে তবেই পরীক্ষায় বসতে পারবে। অফিস রুমে গিয়ে হৈমন্তী ছাড়া বাকি সবাই এডমিড কার্ড পেয়ে গেল, কারন তারা বেতন দিয়েছে, তবে কোন কারনে হয়তো তাদেরকে এডমিড কার্ড দেয়া হয় নি

পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। হৈমন্তী এখন কি করবে? এরমধ্যেই সিস্টার জেসিকা পেয়ে বসল হৈমন্তীকে। সে সিস্টারকে খুব করে বুঝানোর চেষ্টা করল যে, তার মা বাবা টাকা হাতে পেলেই স্কুলের বেতন পরিশোধ করবে, এই মাসে আবার স্কুল বিল্ডিং এর জন্য অতিরিক্ত ২ হাজার টাকা, যা দেয়া হৈমন্তীর পরিবারে জন্য খুব কঠিন ছিল।

পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে তার পরীক্ষার হলে যাওয়া খুব জরুরি। বারবার করে অনুরোধ করল সে।

 হৈমন্তীর দুইটি মাত্র ভালো জামা আছে, কোচিং ক্লাসে সে সারা বছর ওই দুইটি জামা পড়ে যেত, তার বন্ধুরা প্রতিদিন সুন্দর সুন্দর সব জামা পড়তো। বাবা বলেছিল, এইবার পরীক্ষায় প্রথম হলে বাবা তাকে একটা নতুন জামা কিনে দিবে। নতুন জামা পাওয়ার জন্য এই কয়দিন সে খুব খেটে পড়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেতন দিতে না পারার অপরাধে(!) কিনা তার আর পরীক্ষাই দেয়া হবে না! নতুন জামার যেই স্বপ্ন সে দেখছিল তা কি শেষ পর্যন্ত শুধুই স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে??......... ভাবতে থাকে হৈমন্তী

হৈমন্তী জানতো, সিস্টার মানে সেবিকা। সেবাই তাদের মূল কথা। মানবতাই তাদের ধর্ম। তবে কি সে ভুল জানতো?  হৈমন্তী যদি অন্য ধর্মের না হয়ে, সিস্টারের ধর্মে বিশ্বাসী হতো, তবে কি সিস্টারের দুর্লভ মানবতা হৈমন্তীর জন্য ও কিছুটা বরাদ্দ থাকতো?? তবে কি ধর্ম মানবতা দ্বারা পরিচালিত নয়, বরং মানবতা নির্দিষ্ট কোন ধর্ম দ্বারা পরিচালিত??
 ক্লাস সিক্সে পড়া হৈমন্তীকে বিশাল ডিগ্রীধারী মানবতাবাদী সিস্টার প্রতি মাসে চড় থাপ্পড় দিয়ে বারবার মনে করিয়ে দেন যে, হৈমন্তীরা গরীব, এই স্কুল হৈমন্তীদের জন্য নয়, সিস্টারদের সেবা হৈমন্তীদের জন্য নয়

এর মধ্যেই হৈমন্তীর বাবাকে ফোন করা হয়। মেয়েকে পরীক্ষায় বসতে দিচ্ছে না শুনে বাবা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে টাকা ধার করে, টাকা নিয়ে ছুটে আসে স্কুলে। টাকা হাতে পেয়ে হৈমন্তীকে ছেড়ে দেয় সিস্টার জেসিকা।

হৈমন্তী দৌড়ে যায় পরীক্ষার হলের দিকে। পরীক্ষার প্রায় ৩০ মিনিট সময় শেষ হয়ে গেছে। চোখ মুছতে মুছতে খাতা কলম নিয়ে বসে যায় অংক কষতে। প্রশ্নের অংকের সমাধান করতে করতে জীবনের একটি অংকের হিসাবও তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। টাকা যার, শিক্ষা তার টাকা যার, শিক্ষা-মানবতা-সেবা-ধর্ম সবই তার জন্য। স্বয়ং ঈশ্বর ও থাকেন কিনা ওই ভদ্রপল্লীতে!!


অংক পরীক্ষায় সে ৯২ পায়, এই বছরে সে ক্লাসে দ্বিতীয় হয়। মেধায় প্রথম হওয়ার যোগ্যতা রাখে হৈমন্তী। কিন্তু ওরা যোগ্যতা বলতে তো শুধু মেধা বুঝে না, তাদের কাছে অর্থ ছাড়া মেধার কোন মুল্য নেই।  হৈমন্তীদের এভাবেই জীবনযুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়, কিন্তু এই যুদ্ধ কিসের বিরুদ্ধে? জানা নেই হৈমন্তীর! 


১১টি মন্তব্য:

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. লেখাটা খুব ভালো হয়েছে ! খুবই ভালো। তবে লেখায় কোনও কোট থাকলে সেই কোট এর লেখকের নাম লেখার শেষে লিখে দিলে ভালো হয়, বা লেখার মধ্যে এমন ভাবে দিতে হয় যেন তা লেখার বিষয়েরই অঙ্গ বলে মনে হয়। এখানেও সেভাবে দেওয়ার স্কোপ আছে। 'কোট'টা সত্যি অসামান্য তোলা হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  4. এই কোট করা অংশটুকু আমি কোথায় যেন পড়েছি, কোথায় পড়েছি মনে করতে পারছি না বলেই লেখক বা সুত্র উল্লেখ করতে পারি নি

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. তাহলে ঠিক আছে ! তবে কোটটা খুব খুব সুন্দর, আমি ভেবে ছিলাম হয়তো তোমারই লেখা, পরে কোটটা খেয়াল করি, তখন ভাবলাম হয়তো তসলিমা দি'র লেখা। তবে সে যাই হোক না কেন লেখাটাও ভালো, কোটটাও অসামান্য, সহজ ভাবে এতো সুন্দর কথা অসামান্য ভাবনা না থাকলে লেখা যায় না।

      মুছুন
  5. খানিকটা আরোপিত মনে হলেও ভালো লেখা। চলুক। 😊

    উত্তরমুছুন
  6. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কোটেশন।
    লেখায় আবেগের অাধিক্য এবং বাস্তবতা ধূসর ভাবে দৃশ্যমান।
    তবে ভাল হইছে।

    উত্তরমুছুন
  7. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কোটেশন।
    লেখায় আবেগের অাধিক্য এবং বাস্তবতা ধূসর ভাবে দৃশ্যমান।
    তবে ভাল হইছে।

    উত্তরমুছুন
  8. আমাদের কলেজের সিসটার ছাত্রীদের বিপাকে ফেলতে অনেক মিথ্যা কথা বলে , কত অপমান করে!

    উত্তরমুছুন