বুধবার, ২২ জুলাই, ২০১৫

যাদের তোমরা মানুষ ভাবো না, তারাই আজ শিখিয়ে দিলো মানুষের সংজ্ঞা !

মুক্তমনা ব্লগার ও অনলাইন একটিভিস্ট ওয়াশিকুর বাবুর হত্যাকারীদের ধরিয়ে দেন দুইজন ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ। তাদের মধ্যে একজনের নাম লাবন্য। রাজধানী ঢাকার একটি গিঞ্জি এলাকায় বাস করেন লাবণ্য। তিনি বলেন- আমরা হিজড়া সম্প্রদায়আমরা এই সমাজে কোন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হোক তা চাই না। তিনি জানান- ঘটনার দিন ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পালিয়ে যাওয়া খুনিদের দেখে তিনি ঝাপটে ধরে ফেলেন। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে একজন পালিয়ে গেলেও বাকি দুইজনের টি-শার্ট আঁকড়ে ধরে রাখতে সক্ষম হন। ওই অবস্থায় পুলিশ ও স্থানীয় জনতা দৌড়ে এসে তাদের ঘিরে ফেলে। এসময় সাথে তাঁর গুরু স্বপ্না ও ছিলেন।


যাদের মানুষ ভাবতে আমাদের বড্ড অস্বস্তি লাগে, তারাই আজ আমাদের শিখিয়ে দিলেন মনবতা কাকে বলে.. লাবন্য বলেন, লাবণ্যর বয়স যখন ৯ বছর, তখন আবিষ্কৃত হয় তিনি অন্য ৮/১০ জনের মত না, তিনি এমন একটি লিঙ্গের মানুষ যার জন্য তাঁর সব আত্মিয় স্বজন তো বটেই তাঁর নিজের বাবা-মাও অস্বস্তিবোধকরে দূরে সরে যায়। পুরুষ কিংবা নারী এই দুই লিঙ্গের বাইরে হবার কারণে তিনি পড়ে যান এক নির্মম অমানবিক অবস্থায়। কচি বয়সে সামাজের লৈঙ্গিক বৈষম্যের শিকার হয়ে পরিবারের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হন। কতটা বর্বর আমরা, কতটা অসভ্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থা।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষকে করেছে প্রথম লিঙ্গ। নারী ছাড়া তাদের চলে না বলে নারীকে দয়া করে দ্বিতীয় লিঙ্গ করেছে। আর যাদের দরকার পরে না, যাদের ছাড়াই তারা চলতে পারে বলে মনে করে তাদেরকে সমাজ থেকেই আলাদা করে দিয়েছে। তাদেরকে মানুষ বলেই মনে করে না আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। আমার ধারনা যদি নারীকে তাদের বংশ বৃদ্ধির কাজে, তাদের দাসীগিরি করার কাজে, তাদের মনোরঞ্জনের কাজে প্রয়োজন না হতো, তবে নারীকেও তারা সম্ভবত সমাজ থেকে আলাদা করে দিতো, মানুষ বলে গণ্য করতো না। এখনো কি নারীকে তারা মানুষ বলে মনে করে??

কেবল মাত্র নারী পুরুষের বাইরে ভিন্ন কোন লিঙ্গ নিয়ে জন্মের অপরাধেই (!) আমরা তাদের আমাদের পরিবার সমাজ থেকে বের করে দিলাম। রাষ্ট্রের মানবধিকার, মৌলিক অধিকার নামক শব্দগুলো তাদের জন্য নয়। কারন তারা আমাদের দৃষ্টিতে মানুষ (?) নয় বলে?? মানুষের সংজ্ঞা আমরা নিজেদের সুবিধামত করে নিজেরাই বানিয়ে নিলাম। আমাদের নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারনে আমরা, মানুষ শব্দটির সীমা সৃষ্টি করে দিলাম। আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই আজ কিছু মানুষকে যন্ত্রনাময় জীবনযাপন করতে হচ্ছে। 


আমি হিজড়া বলি না, তৃতীয় লিঙ্গ বলে তাদের অপমান করতে চাই না, ভিন্ন লিঙ্গ বলি। আমি সমাজের লিঙ্গবাদ প্রথা বিরোধী। আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলোতে কি লিঙ্গের প্রয়োজন আছে? নেই অবশ্যই। লিঙ্গ বৈষম্য সৃষ্টির জন্যই মুলত সৃষ্টি হয়েছে লিঙ্গবাদ। আর এই লিঙ্গবাদের নির্মম স্বীকার শিখণ্ডী সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। নারী তো প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত, নির্যাতিত, অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেই, সেসব কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কে ধর্ম মানল, কে মানল না এসব নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যাথা। ধার্মিকদের মতে তো ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তিনি মহান, দয়ালু, দয়ার সাগর। ধর্ম বিশ্বাসী নয় বলে, দয়ালু ঈশ্বরের দয়ালু বান্দারা রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবুকে দয়ালু ভাবে হত্যা করেছে। কেউ কি আমাকে বলবেন এই ভিন্ন লিঙ্গের মানুষগুলোকে কোন ধর্মে মানুষের সম্মান দিয়েছে? কোন ধর্মের ঈশ্বর তাদের সৃষ্টি করেছে? কোন ধর্ম পালন করবে তারা?



কেবল মাত্র আমাদের মত নয় বলেই তাদেরকে আমরা পরিবার সমাজ থেকে আলাদা করে দিলাম, কেড়ে নিলাম তাদের সকল অধিকার। দিন শেষে আমরাই নাকি ধার্মিক, ধর্মের সমালোচনাতে আমাদের অনুভূতি ওলট পালোট হয়ে যায়, আমরাই রাত দিন মানবিকতার গীত গাই, নিজেদের এক একজন বিশাল মানবতাবাদীর সার্টিফিকেট দিয়ে দিই।

লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে, নিজের উপর ঘেন্না হয় আমার নিজেকে এই সমাজের একজন ভাবতে। 

1 টি মন্তব্য: